কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০২০

ফারহানা রহমান




যে তীব্র উইটের লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী



জীবনের সবচেয়ে বিষণ্ণ, বিপন্ন ও অস্থির সময়ে যখন সবকিছু অর্থহীনতার ভিতর ডুবে যেতে চায় তখনই আমি বারবার যার হাত ধরে উঠে আসি স্বাভাবিকতার পাশে, সেই মানুষটা হচ্ছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। জানিনা অন্য  কারোর অনুভূতি কেমন, তবে আমার কাছে মুজতবা আলী মানেই ম্যাজিক।  গভীর অনুভূতি, পাণ্ডিত্য, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা আর একই সাথে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ যে তীব্র উইটের সংমিশ্রণ হয়েছে তাঁর লেখায় সেটা মূলত  বাংলাভাষায় এককথায় বিরল বলা যেতে পারে।

সেই যে হরহামেশা ইউরোপ-আমেরিকা যাওয়া লোকটা (ঝান্ডুদা) ইটালির ভেনিস বন্দরে জাহাজ থেকে নেমেছেন যাবেন লন্ডনে। (ঝান্ডুদার বপুটি যারা দেখেছেন শুধু তারাই জানেন, যে কোন জাহাজের পক্ষে তাঁকে ভাসিয়ে রাখা সম্ভব নয়) বিশাল বপুওয়ালা ঝান্ডুদা সাথে করে বন্ধুর মেয়ের জন্য রসগোল্লা নিয়ে যাচ্ছেন লন্ডনে। কিন্তু বেরসিক কাস্টম অফিসার (চুঙ্গিওয়ালা) কিছুতেই টিনের কৌটায় করে প্যাকেট করা রসগোল্লা নিয়ে যেতে দেবেনা। অগত্যা কি আর করা, সবাই মিলে ভাগাভাগি করে শুরু হল রসগোল্লা খাওয়া। এদিকে  কিছুক্ষণ আগেই ঝান্ডুদারের আমন্ত্রণে সকলে মিলে ইটালির বিখ্যাত কিয়ান্তির   (মদ) কয়েকটি বোতল খাওয়া হয়ে গেছে। এবার খাওয়া হচ্ছে রসগোল্লা। কিন্তু চুঙ্গিওয়ালা কিছুতেই রসগোল্লা মুখে দেবেনা। ঝান্ডুদা খাইয়েই ছাড়বেন। একসময় হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, ঝান্ডুদা তামাম ভুঁড়িখানা নিয়ে ক্যাঁক করে পাকড়ে ধরলেন টুঙ্গিওয়ালাকে আর একটি রসগোল্লা নিয়ে থেবড়ে দিলেন নাকের উপর। “চুঙ্গিওয়ালা ক্ষীণকণ্ঠে পুলিসকে ডাকছে। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে আমার মাতৃভূমি সোনার দেশ ভারতবর্ষের ট্র্যাঙ্কলে যেন কথা শুনছি। কিন্তু কোথায় পুলিস? চুঙ্গিঘরের পাইক বরকন্দাজ, ডাণ্ডা-বরদার, আস-সরদার বেবাক চাকর-নফর বিল্কুল বেমালুম গায়েব! একি ভানুমতী, এ কি ইন্দ্রজাল!” 
শেষ পর্যন্ত পুলিশের বড়কর্তা এসে পৌঁছালো। তিনি একটি রসগোল্লা মুখে তুলেই চোখ বন্ধ করে রইলেন আড়াই মিনিট। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আবার হাত বাড়িয়ে দিলেন। ফের। আবার। 
এবারে ঝান্ডুদা বললেন, ‘এক ফোঁটা কিয়ান্তি?’
 
কাদম্বরীর ন্যায় গম্ভীর নিনাদে উত্তর এল, ‘না। রসগোল্লা।’
টিন তো ভোঁ ভোঁ
চুঙ্গিওয়ালা তার ফরিয়াদ জানালে।
কর্তা বললেন, ‘টিন খুলেছো তো বেশ করেছো, না হলে খাওয়া যেত কী করে? চুঙ্গিওয়াকে তিনি আরও বললেন, ‘তুমি তো একটা আস্ত গাড়ল। টিন খুললে আর ঐ সরেস মাল চেখে দেখলে না?

এ তো গেলো রসগোল্লার রস! এছাড়াও দেশে বিদেশে, চতুরঙ্গ, ভবঘুরে ও অন্যান্য, পঞ্চতন্ত্র, চাচাকাহিনীর বেঁচে থাকো সর্দিকাশির বিখ্যাত সেই প্রবাদ,    ‘ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাতদিনে আর না খেলে এক সপ্তাহে।’ দেশে বিদেশে, হিটলারের প্রেম, বড়বাবু, জলেডাঙ্গায়। এসব পড়তে পড়তে কোথায় যে হারিয়ে যেতাম, কে জানে! কায়রোর টঙ ঘরে গিয়ে এক কোণায় বসে চা খেয়ে খেয়ে,  আড্ডাবাজ মিশরীয়দের জটলার দিকে ভুবুক্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একদিন  আড্ডার প্রাণবিন্ধু হয়ে যাওয়ার সেই গল্পের কথা ভেবে কতবার ভেবেছি মিশরে গিয়ে ওইসব টঙ ঘরে চা খেতে হবে...

আবার তোতা কাহিনীর সেই বুদ্ধিমান ভারতীয় তোতা যে কিনা তার ইরানী সদাগর মালিক ভারতে যাচ্ছে শুনে সেখান থেকে একটি সওগাত আনতে বলেন, সেটা হচ্ছে খাঁচা থেকে তার মুক্তির উপায় কি? সদাগর ভারতের বনে এসে একঝাঁক তোতাপাখি দেখে চেঁচিয়ে বললেন, ‘তোমাদের এক বেরাদর ইরান দেশের খাঁচায় বদ্ধ দিন কাটাচ্ছে। তার মুক্তির উপায় বলে দিতে পারো?’ কথাটি  শুনে তৎক্ষণাৎ একটি পাখি মরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ইরানে এসে তোতাকে খবরটি দেওয়া মাত্র তোতাও একইভাবে লুটিয়ে পড়লো। সদাগর তো কেঁদে কেটে একশেষ। কী আর করার? মরা তোতাকে যেই না আঙ্গিনায় ছুঁড়ে ফেললেন  সেই তোতা উড়ে গিয়ে গাছে বসলো আর ভারতের তোতার মরার অভিনয়ের কথা খুলে বলল।

এসব তো গেলো বুদ্ধি আর রসবোধের গল্প। প্রেম? প্রেমের আকুতি, অনুভূতি, গভীরতা আর প্রেম পেয়ে হারানোর বেদনার যে ধ্রুপদী বর্ণনা আমরা দেখেছি শবনমে তার কি কোন তুলনা আছে? আর টুনিমেম? সাঁওতাল মেয়ে টুনি মেম চা বাগানের ম্যানেজার ইংরেজ সাহেব ও’হারার বাড়ির কাজকর্ম করে দেয়। কিন্তু নিঃসঙ্গ ইংরেজ সাহেব ও’হারা টুনি মেমকে রেখেছিল রাণীর সম্মান দিয়ে আর টুনি মেম ও’হারাকে ভালোবেসেছিল লায়লি যেরকম মজনুকে ভালোবেসেছিল সেইভাবে। কিন্তু গ্রামের অশিক্ষিত, মূর্খ, সাম্প্রদায়িক মানুষগুলো এমন স্বর্গীয় প্রেম মানবে কেন? তারা নানা ফন্দিফিকির করে ও’হারাকে জেলে ঢুকিয়ে টুনি মেমকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলো।

আবার সেই নিদারুণ প্রেম-ঘৃণা-নৃশংসতার গল্প অবিশ্বাস্য! সত্যি একেবারে অবিশ্বাস্য সে কাহিনী। আইরিশম্যান ডেভিড ও-রেলি মহাকুমা শহর মধুগঞ্জে অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিস হিসেবে জয়েন করার পর থেকেই দলে দলে নারী এসে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলো তার উপর। প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগলো নানা বয়সের নানা জাতির নারীরা। এদিকে ও-রেলি প্রথম দর্শনেই ইংরেজ মেমের প্রেমে পাগল হয়ে তাঁকে বিয়ে করে মধুগঞ্জে এনে তুলল। কে জানতো ও-রেলি ইম্পোটেন্ট? ভীষণ উচ্ছল হুল্লোড়প্রিয় তাগড়া জোয়ান ও-রেলি বিয়ের কয়েকদিনের মাথাতেই দেখা গেলো সবসময় চিন্তিত, বিষণ্ণ হয়ে চুপচাপ প্রাণহীন অবস্থায় বসে আছে। এদিকে অনন্ত যৌবনা, অপূর্ব সুন্দরী মেমসাহেব, রাতের পর রাত স্বামীর সাথে অভিসারে ব্যর্থ মেম ভোরে গিয়ে পড়লো মদখোর মাতাল বাটলার জয়সূর্যের পায়ে। এভাবে মেম একদিন বাটলারের সন্তানের মা হলেন। কিন্তু ও-রেলি কেন এতবড় অপমান সহ্য করবে? বহুবছর অপেক্ষা করে, দিনরাত সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করে কোন একদিন তিনি আর অপেক্ষার জ্বালা সহ্য  করতে পারলেন না। একদিন ঠাণ্ডা মাথায় রাতের আঁধারে ও’রেলি জয়সূর্য, তার সন্তান ও মেমকে একসাথে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে রাখল। আর নিজেই নিজের এপিটাফে লিখে রাখল- 
‘Here lies the carcass of a cursed sinner,
Doomed to be roasted for the Devil’s dinner’ – Devid O-rely

এরকম অজস্র, প্রেম কাহিনী, ভ্রমণ কাহিনী, সাহিত্য সমালোচনা থেকে শুরু করে কি বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি লিখেননি? আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক ও রম্যরচয়িতা সৈয়দ মুজতবা আলী জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর খর অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেটের করিমগঞ্জে। পিতা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন। মৌলভীবাজার, সিলেট তাঁর পৈতৃক ভিটা । বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ভ্রমণকাহিনীর জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়।

তিনি সিলেটের গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পিতার বদলির চাকরি হওয়ায় মুজতবা আলীর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কাটে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ১৯২১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথমদিকের ছাত্র। এখানে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয় ভাষাশিক্ষা লাভ করেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে এখান থেকে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। অতঃপর দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য বৃত্তি নিয়ে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণার জন্য তিনি ডি.ফিল লাভ করেন ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৩৪-১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মিশরে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।

আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুজতবা আলী কাবুলের শিক্ষাদপ্তরে অধ্যাপনা করেন। সেখানে তিনি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বরোদার মহারাজার আমন্ত্রণে তিনি বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি আট বছর কাটান। এরপর দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পঞ্চাশের দশকে কিছুদিন আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন পাটনা, কটক, কলকাতা এবং দিল্লিতে। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন করেন। বিশ্বভারতীর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অবসরগ্রহণ করেন।

শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সেখানের বিশ্বভারতী নামের হস্তলিখিত ম্যাগাজিনে মুজতবা আলী লিখতেন। পরবর্তীতে তিনি ‘সত্যপীর’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘টেকচাঁদ’, ‘প্রিয়দর্শী’ প্রভৃতি ছদ্মনামে বিভিন্ন পত্রিকায়, যেমন : দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, সত্যযুগ, মোহাম্মদী প্রভৃতিতে কলাম লিখেন। তাঁর বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ভ্রমণকাহিনী। এছাড়াও লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস,  রম্যরচনা। বিবিধ ভাষা থেকে শ্লোক ও রূপকের যথার্থ ব্যবহার, হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা এবং এর মধ্য দিয়ে গভীর জীবনবোধ ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি হল, "বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।" তাঁর রচিত সব বইগুলোকে একসাথে করে সাতখণ্ডে প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে নরসিং দাস পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে আনন্দ পুরস্কার প্রদান করা হয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ মুজতবা আলী মৃত্যুবরণ করেন।



1 কমেন্টস্:

  1. এমন একটি চমৎকার সুস্বাদু সময়োপযোগী অনুভবী লেখার জন্য অজস্র অভিনন্দন।

    উত্তরমুছুন