কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

চিরশ্রী দেবনাথ



সমকালীন ছোটগল্প


আলিঙ্গন 

অশেষ। এটাই নাম তার। জেল থেকে আজই ছাড়া পেয়েছে। গুণ্ডা হিসেবে ধরা পড়েছিল। নানারকম অপরাধে সাতবছরের জেল হয়েছিল। এখন জেল তো নয়, সংশোধনাগার। এক দিদিমণি আর স্যার ছিলেন। দিদিমণি তাঁতের শাড়ি পরে আসতেন। ফুলহাতা ব্লাউজ, চুলে ফুল। মনে হতো জেলে নয়, মন্দিরে এসেছেন। খুব সুন্দর গলার স্বর। এতো ভালো লাগত। স্যার খুব গম্ভীর। কোনদিন একটুও রাগ দেখাননি। শান্ত হয়ে কত কি বোঝাতেন, পড়াতেন।

প্রচুর ভালো ভালো কথা, ধ্যান, গান ইত্যাদি প্ররোচনায় গুণ্ডামির ট্যালেন্টটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ধূপের মতো। সবাই বলেছে ভালো হতে হবে। ভালো কাজ করতে হবে। ধরা পড়ার সময় পকেটে দশহাজার ছিল। এখন সেই দশহাজার, ফিরিয়ে দিয়েছে জেল। আজকেই ছাড়া পাবে সে। প্রচুর স্নান করলো, ঠাণ্ডা জলে। ক্লিন সেভড, পাঁচফুট দশ ইঞ্চির দীর্ঘ দেহ। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট।  সংশোধনাগারের নিয়ন্ত্রিত জীবনের অস্ফুট দ্যুতি চোখেমুখে।

জেলের বাইরে বেরিয়ে দেখলো আকাশটা একইরকম। ধোঁয়াটে। রাস্তাঘাটগুলো ধুলোমাখা। চায়ের দোকানে জল ফুটছে। খয়েরি বিস্কুট বয়ামে। স্বাস্থ্য খারাপ দুই একটি কুকুর। তিন চারটে মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। একজনের  সাইকেল আছে। হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, বন্ধুদের সঙ্গে কলকল করতে করতে। মেয়েগুলোর স্কার্টের রং হলুদ, সাদা শার্ট, লাল ফিতে, কালো জুতো। ওরা তো কল্যাণী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী নয়! নতুন কোন বালিকা বিদ্যালয় হয়েছে নাকি?
এই শহর তার চেনা। অশেষের কেউ নেই, পথশিশু ছিল। গুণ্ডা হয়েছিল জীবনে। শরীরে জোর ছিল। তিন চারটে মারপিটে সক্রিয় অংশগ্রহণের পর, লাল্টুগুণ্ডার নজরে পরে। ওর বয়স হয়েছিল। গুণ্ডাগিরির উত্তরাধিকারী হয় অশেষ। জেল থেকে বেরিয়ে আপাতত তার কোন আশ্রয় নেই। এখন একটি হোটেল খুঁজে তাকে থাকতে হবে কয়েকদিন।

রিভু লজ। নতুন হয়েছে বোঝা গেল। অশেষ কাউকে চিনল না, তারাও না। ভালই হলো। এখানেই উঠল। পরিচয় দিল... ব্যবসায়ী। দুপুরের  খাওয়া শেষ। তোফা মেনু। ভাত, ডাল, আলুভাজা, মাংস। অনেকদিন পর নিজের মতো করে খাওয়া। এবার কাজ শুরু। আগে মানুষকে কষ্ট দিয়েছে শুধু। এই নামখানি যে তার ছিল কখনো, সে ভুলেই গিয়েছিল, লোকে তাকে আদু গুণ্ডা ডাকত।

অশেষ হাঁটছে। বহু বাড়ি ঘর নতুন নতুন। সে লোকের বাড়ি গিয়ে গিয়ে সাহায্য করবে। কারো কোনকিছু লাগবে কিনা। বুড়োলোক হলে সেবাযত্ন, অসুস্থ হলে ঔষধপত্র।

সামনে একটি রঙওঠা বাড়ি। টিনের চাল। পাঁচইঞ্চি দেয়ালের ঘর। কোনকালে সাদা রঙ পড়েছিল বোধহয়। সব উঠে গেছে। জরাজীর্ণ পাঁচিলের সঙ্গে নড়বড়ে গেট। হলুদ টগর ফুলে ছাওয়া একটি গাছ বাড়ির ভেতরে আছে। বাইরে তার ডাল এসে পড়েছে। ফুলে ফুলে ছয়লাপ গেটের বাইরেটা। এখানেই ঢুকতে হবে প্রথমে। কোন কিছু না ভেবে দরজায় টোকা দিল অশেষ।
কে বাবা তুমি?
প্রৌঢ়া মহিলা, বোধহয় পুজো দিচ্ছিলেন হাতে চন্দন কাঠের টুকরো।
না বলছিলাম আপনাদের কিছু লাগবে? কোন সাহায্য টাহায্য?
ভদ্রমহিলার মুখের তিনরকম ম্যাপ হলো। প্রথমে অবাক হয়ে ভালো করে অশেষকে দেখলেন, তখন দৃষ্টিতে একটু স্নেহ ছিল। তারপর ভুরু কুঁচকে গেলো, দৃষ্টি কুটিল হলো। সবশেষে ভীষণ বিরক্তি আর অবিশ্বাসের ছায়া খেলে গেলো চোখেমুখে। ঠকাস করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
অশেষ হাসল। এ তার জানাই ছিল। লোকজন সহজে কাউকে বিশ্বাস করে না। কোই বাৎ নেহি। পরের বাড়ি।

রোগামত চশমা চোখে কালো একজন লোক। আগের আদুগুণ্ডা হলে সে তাকে শুঁটকি মাছ বলে খিস্তি দিত। এখন ভাবনায় রুচি এসেছে, তাই সুন্দর করে ভাবল নিজের অজান্তেই। অশেষ তার বক্তব্য রাখল।
ভদ্রলোক চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন তা কোন পার্টি? সাদা, সবুজ, লাল, গেরুয়া কাউকেই বিশ্বাস করি না। বলি, ঘরে দুটি মেয়ে আর একটি বেকার ছেলে আছে, মেয়েগুলো আমার মতোই কালো। একজন পঁয়ত্রিশ আর একজন চল্লিশ, পাত্র জোগাড় করে দিতে পারবে? সুপাত্র? আর ছেলের চাকরি?
অশেষ কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই দড়াম  করে দরজা বন্ধ হলো।
আহা পঁয়ত্রিশ বছরের কালো মেয়েটিকে এক ঝলক দেখার  ইচ্ছে ছিল। অশেষের বয়স ঊনচল্লিশ কিনা!
মেয়েটা কি বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকে কোন এক বিবাহকামী পুরুষের আশায়!
আগে হলে দূর মাগী বলত, কিন্তু এতোসব ভাবনা চিন্তা সংশোধনাগারের দিদিমণির জন্য। তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনাতেন জোর করে, গানও। প্রথম প্রথম ভালোই লাগত। পরে অশেষ বুঝতে পারে, এটাও একধরনের আফিম।  খারাপের যেমন নেশা থাকে, ভালোরও তেমন নেশা হয়।

তিনটে বাড়ি পেরিয়ে সে আর একটি বাড়ির সামনে। জোরদার গ্রিল লাগিয়েছে। কলিং বেল আছে। বেল বাজালো অশেষ। একটু ক্যাঁচ শব্দ নিয়ে বাহারী দরজা খুলল। যিনি দরজা খুললেন তিনি সুভদ্রা। আদুগুণ্ডার দল তাকে টাব্বু ডাকত।
হেবি লম্বা মেয়ে। রেশমের মতো চুল কোমড় পর্যন্ত। হলুদ ফর্সা। অতীতের টাবু এখন গৃহবধূ। আদুগুণ্ডাকে চিনতে পারেনি।
বড় বড় দুটো চোখ মেলে বলল, কী চাই?
অশেষের গলা কাঁপছে। আগে হলে বুক, পেট ইত্যাদির মাপজোক করত। এখন শালা চোখের দিকে চোখ যাচ্ছে শুধু। তবুও স্মার্টলি সে সব কথা বলল। টাবু মনোযোগ দিয়ে সব শুনে অশেষকে ঘরে আসতে বলল।
এই রে, ভরদুপুরে ঘরে আসতে বলছে, ভয় পাচ্ছে না, বাড়িতে কেউ নেই নাকি?
টাবু আস্তে আস্তে বলল, সমস্যা আছে আমার। বলতে হলে বসতে হবে। সাহায্য চাইছি।
অশেষ বসল। টাবু তার জন্য এককাপ চা এনে দিল। সঙ্গে দুটো বিস্কুট। টাবু খুব বাজে চা বানায়। ট্যালট্যালে। দুধ কম, লিকার কম, চিনি বেশি। ধুর! সুন্দরী মেয়েরা কি একটু ফ্যাকাশেই সবসময়?

টাবুর সমস্যাটা দারুণ। আসলে ভয়াবহ। টাবুর হাজব্যান্ড একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। প্রমোশন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ম্যানেজার অব্দি আসতে টাবুকে নানাভাবে তার কোম্পানির উচ্চপদস্থদের মনোরঞ্জন করতে হয়েছে। সামনে আবার করতে হবে। সেটা একদম শোয়াশুয়ি। আর আজ রাতেই।
নাহলে টাবুর কপালে দুঃখ আছে। তাই টাবু পালাতে চায়, এই শহর থেকে। টাবুর মা বাবা মারা যাওয়ায় দাদাই ওকে বিয়ে দিয়েছিল। বর্তমানে দাদার কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, টাবুর হাজব্যান্ডকে বলেকয়ে এখানে ঢুকেছে, কাজেই কোন সাহায্য সে পাবে না ঐ তরফে।

অশেষ কোন চিন্তা না  করে বলল, আমার সঙ্গে চলুন। পালাবো। রাজি?
রাজি। টাবু ঘাড় কাত করলো।
দশহাজার টাকা ছিল, এখন নয় হাজার পাঁচশ আছে আমার কাছে। অশেষ  বলল।
টাবু ওরফে সুভদ্রা ফিসফিস করলো, ওর কাছে কুড়ি হাজার আছে।
টাবুর ছেলেমেয়ে হয়নি। সুতরাং পিছুটান নেই। একটি ছোট ব্যাগে সামান্য জামাকাপড় নিয়ে দরজা খোলা রেখেই টাবু অশেষের সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
ট্রেনে করে দু’তিনটি শহর গ্রাম পেরিয়ে নতুন আর একটি জায়গায় এসে অশেষ  টাবুকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে একটি হোটেলে উঠল। সেদিন ছিল ভাঙা অমাবস্যা। হোটেলের ঘর। জানলা দিয়ে চরাচর ডুবে যাওয়া রাত।
টাবু বিছানায় বসে আছে, হাঁটুতে মুখ ডুবিয়ে। অশেষ সামনে চুপচাপ বসে আছে।
হঠাৎ টাবু মুখ উঠিয়ে বলল, আমি তোমাকে চিনি, তুমি অশেষ নও। তুমি আদুগুণ্ডা। বলে খুব হাসতে লাগল।
অশেষও হাসতে লাগল। বলল তাহলে কাল আমরা এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাব।
তারপর? টাবু জিজ্ঞেস করলো।
বিয়ে করলে কেমন হয়? অশেষ বলল।

টাবুর এখন কান্নার সময়। কিছুক্ষণ গেল। একটু জড়িয়ে ধরা। অনেক সময় কাটল। হয়তো সারা পৃথিবীতে এমন আলিঙ্গন মাঝে মাঝে হয়।

পরদিন সকালে হোটেলটিতে পুলিশ এলো। সঙ্গে টাবুর স্বামী। অন্যের বউকে নিয়ে পালানোর অপরাধে অশেষ আবার জেলে মানে সংশোধনাগারে গেলো।
টাবুকে ওর স্বামী নিয়ে গেছে টানতে টানতে, কারো বিছানায় শোয়াবে বলে।

আদুগুণ্ডা এখন বড়ো বড়ো দাড়ি রেখেছে। সে আর জেলের  বাইরে যেতে চায় না। এই জীবনে একটি আলিঙ্গন ব্যতীত তার কিছু চাওয়ার ছিল না।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন