কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

অশোক তাঁতী



সমকালীন ছোটগল্প



লেবুপাতার গন্ধ



মালা বলল, একথা তো মানতেই হবে যে সবাই একদিন মারা যাবে। জানি, জানলেও আমরা কেউ বিশ্বাস করি না।
এই রবিবার সকালে মালার মন মেজাজ বেশ ভালো আছে। জানুয়ারির চার তারিখ। গত দুদিন ধরে আকাশ মেঘলা। মালার মেয়ে বলছিল, কী বাজে, কালো কালো দিন!

গত দুদিন হালকা বৃষ্টি বা শিশির পড়েছে। মাঝেমাঝে বেশ জোর এক পশলা বৃষ্টিও হয়েছে। আজ সকাল থেকে পরিষ্কার নীল আকাশ। গাছের পাতাগুলো চকচকে সবুজ। জানালা দিয়ে লেবুগাছটার মাথা দেখা যাচ্ছে। অর্ধেক পাতা নেই। এখনও গাছে কয়েকটা লেবু ধরে আছে। এগুলো পুজোর শেষ দিকে কুঁড়ি থেকে পুরুষ্ট হয়েছে। আর দূরে মেলার মাঠে প্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে। মালা তার মেয়েকে বলল, যা তো মা, জুঁই, একটা লেবুপাতা পেড়ে আন তো!

মা’কে দেখে আজ তার খুব ভালো লাগছিল। জুঁই সাথে সাথে ছুটল বাগানে।  অনেক খুঁজে, হাত লেবুর কাঁটা লেগে ছড়ে গেলেও সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে  পরিষ্কার, সবচেয়ে সবুজ লেবুপাতাটা পেড়ে আনল। মালার চোখ চকচক করে ওঠে। জুঁইটার দিকে একবার হেসে চোখ বন্ধ করে হাত পাতল। জুঁই পাতাটা সাবধানে মায়ের হাতে রেখে তার আঙুলদুটো মালার নাকের কাছে নিয়ে যায়। মালা একটা বড় শ্বাস নেয়। তারপর চোখ বন্ধ করে একটু একটু করে শ্বাস ছাড়ে। দ্বিতীয়বার চোখ অল্প খোলা রাখে। ঠোঁটে হাসির ভঙ্গি। জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে আর একটা শ্বাস নেয়। বাঁ হাত দিয়ে মেয়ের হাত ধরে। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, দেখেছেন অশোকদা, সারা আকাশ জুড়ে কেমন লেবুফুলের গন্ধ। এরকম সুন্দর গন্ধের মধ্যে আজকে আমি মারা যেতে পারি।

আমি এখানে অনাহূত। এসেছি মালার ব্লাড প্রেসার মাপতে। ডিজিটাল যন্ত্রে প্রেসার সঠিক উঠেছে কিনা সে ব্যাপারে মালার বর সৌম্য বেশ চিন্তিত। তাই আমার প্রাচীন মার্কারি ম্যানোমিটার নিয়ে হাজির হয়েছি। খুব সাবধানে, নিজেকে প্রায় স্টেরিলাইজ করে মালার ঘরে ঢুকেছি। এখন এঘরে জীবাণুর সংক্রমণ খুব সাংঘাতিক ঘটনার জন্ম দিতে পারে। এটা মোটামুটি প্রত্যেক রবিবারের কাজ।

মালার বিছানাটা নিচু। বিছানার পাশে ছোট্ট অক্সিজেন সিলিন্ডার। প্রায় ফুট দেড়েক লম্বা। এই শীতের সময় কোনো কোনো রাতে তার দমবন্ধ হয়ে আসে। বাতাসে শুধু দূষণের গন্ধ পায়। কোথাও অক্সিজেন থাকে না। পৃথিবীর সমস্ত কোণ জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে তার বুকের ওপর। শুধু ঐ সিলিন্ডারটা ছাড়া। সৌম্য সরু প্লাস্টিক পাইপটা তখন মালার নাকে লাগিয়ে দেয় একটা ক্লিপ দিয়ে। মালা বলল, ঐ ক্লিপটা যদি সারাক্ষণ আপনার নাকে শুঁয়োপোকার মতো সুড়সুড়ি দেয়, আপনার ভালো লাগবে? আমি ওদের বলি জানালাটা খুলে দিতে  যাতে লেবুপাতের গন্ধ ঘরের মধ্যে আসে। ওরা কিছুতে খুলবে না।

এই ঘরের জানালাতে দুটো করে পাল্লা। বাইরের দিকটা কাঠের খড়খড়ি লাগানো, আর ভেতরে কাচ। এখন কাচের জানালা বন্ধ। কাঠেরটা খোলা। বাইরের রোদ আসছে ঘরে। অনেকদিন পর এত উজ্জ্বল রোদে সবাই খুব খুশী। যদিও তাপমাত্রা একটু নেমেছে। মালার গায়ে ভারী কম্বল চাপানো। সে বলল, যদি  আমরা সবাই জানতাম যে সবাই একদিন মারা যাব, সবাই যদি সে কথা বিশ্বাস  করতো, তাহলে কত নতুন নতুন ভাবে আমরা সবকিছু করতে পারতাম!
আমি বললাম, তোমার মতে মৃত্যু নিয়ে আমরা ছেলেমানুষি করি?
-হ্যাঁ নিশ্চয়ই। কত ভালোভাবে ব্যাপারটা আমরা ভাবতে পারি। যখন আমরা বিশ্বাস করব যে আমরা একদিন মারা যাব, সেদিন আমরা মনে মনে নিজেকে  তৈরি রাখতে পারব। বুঝতে পারব পৃথিবীটা কত সুন্দর! জীবনের সাথে আরও ভালোভাবে মিশে যেতে পারব। জীবন নিয়ে আরও বেশী করে বাঁচব।
সৌম্য রেগে ওঠে, মালা হচ্ছেটা কী? সারাক্ষণ মরা নিয়ে কথা না বলে অন্যকিছু নিয়ে বলতে পারো না?
মালা মৃদু হাসল। -আমি মরা নিয়ে তো কথা বলছি না! বাঁচা নিয়ে কথা বলছি। তুমি জানো, আজকে নবি দিবস? হজরত মহম্মদের জন্মদিন? কাল পূর্ণিমা?
-তোমাকে এসব খবর কে দিল?
-জানতে হয় মশাই। পৃথিবীর জানা বোঝার সমস্ত খবরই আমি পাই। তুমি না দিলে কালিন্দি দেবে। কালিন্দি না দিলে জুঁই দেবে। জুঁই না দিলে অশোকদা দেবে। তোমরা কেউই যখন দেবে না তখন আলো থেকে, বাতাস থেকে, মাটি থেকে খবর পাই। বাতাসের সামান্য তারতম্য আমি বুঝতে পারি, সে কথা তুমি জানো।  অবশ্য জানো না বলে হাড়ে হাড়ে টের পাও বলা ভালো।

সৌম্য সকালেই বলছিল যে, গতরাতে প্রচণ্ড শ্বাস কষ্ট হয়েছে। অর্ধেক রাত শ্বাস  নিতে পারে নি। সে কথাটাই আজ সকালে এত রসিকতা করে মালা কী করে বলে, বুঝতে পারি না। সৌম্য রেগে গেলেও নিজেকে সংযত রেখে বলে, সারাক্ষণ  তোমার ঐ সব বিশ্রী রসিকতা আমার একটুও ভালো লাগে না।
-আজ সকালটা তোমার ভালো লাগছে তা বেশ বুঝতে পারছি। তোমার গা  থেকেও আজ সকালের রোদের গন্ধ উঠছে। আসলে কাল রাতে তো আমি মারা গেছিলাম। আজ সকালে যখন জেগে উঠলাম, তখন আমার পুনর্জন্ম হল। সেই  উপলক্ষে আজ আমি তোমাকে একটা নতুন জিনিস রান্না করে খাওয়াব।

সৌম্যর কান্না পেল। মালা নানারকম রান্না করতে, খেতে, খাওয়াতে ভালোবাসতো। এখন খাওয়া বলতে খুব অল্প একটু ভাত, নুন ছাড়া একহাতা  সবজি সেদ্ধ। বিছানা থেকে উঠে বাথরুম যেতেও হাঁফিয়ে যায়। মালা তার দিকে তাকিয়ে বলে, মশাই এত অল্পে ঘাবড়ে গেলে হবে! মারা যাওয়া শিখতে হবে, তবেই তো বাঁচা শিখবে।
কথাটা অন্যদিকে বাঁক নিচ্ছে দেখে সৌম্য বলল, তুমি কী খাওয়াবে বললে না তো! বাজার করতে হবে না!
-কিছুই করতে হবে না। আজ ছুটির দিনে শুধু খেতে হবে, ঘুমোতে হবে আর আড্ডা, গল্প। অশোকদা আপনার বাজার হয়ে গেছে?
এইসব কথার মাঝে কালিন্দী দরজার পাস থেকে উঁকি দিয়ে বলল, বৌদি খেঁসারি শাক পাওয়া গেছে।
মালা সৌম্যর দিকে ফিরে বলল, দেখেছ, বললাম আগে ভাল করে ধুয়ে নে। তারপর শুধু ডগাগুলো কেটে নে। ডাঁটা রাখিস না। অশোকদা কফি খাবেন?

মালার ঘাড়ের কাছে একরাশ তুলো। মাঝেমধ্যে ডায়ালসিস চলছে। চোখমুখ ফুলে আছে। বললাম, তোমার প্রেশারটা আগে মাপি।
মালা কম্বল থেকে হাত বের করার চেষ্টা করে। সবটা পেরে ওঠে না। জুঁই এসে কম্বলটা সরিয়ে দেয়।
-অশোকদা আমার মাকেও একটু শিখিয়ে দেবেন।
আমি হাতে ব্যান্ডটা জড়াতে জড়াতে বললাম, ঐ মাপবে।
মালা হঠাৎ বলল, আমার মনে হয় আমি রবিবারে মারা যাব।
সৌম্য খবরের কাগজটা ভাঁজ করে সোফার ওপর ছুঁড়ে মারল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন, রবিবার কেন?
জুঁই হেসে ফেলল, রবিবার ছুটির দিন বলে।
সৌম্য গজগজ করে, মেয়েটার মাথাও খাচ্ছে।
-ছুটির দিনে ছুটি হয়ে যাবে। আপনি ফটিক পরেন নি? তাছাড়া রবিবার আপনারা  সবাই ঘরে থাকবেন। বেশী ছোটাছুটি করতে হবে না।
আমি গম্ভীর হয়ে হাতে স্থেথো লাগাচ্ছি। মালা বলল, আচ্ছা অশোকদা, আপনার জানা আছে ভীষ্ম কী বারে মারা গেছেন?
মহাভারতের যুগে বার আছে কিনা আমার জানা নেই। তখন তিথি নক্ষত্র মেনে কাজ হতো নিশ্চয়ই। কিন্তু সোম থেকে রবি, সাতদিনে সপ্তাহ হবার যুক্তিটা  কবেকার, বুঝতে পারি না। বরং পনেরো দিনের শুক্লপক্ষ আর কৃষ্ণপক্ষের যুক্তিটা  অনেক বেশী বাস্তব সম্মত।
-আমার অবাক লাগে, মহাভারতে এত মৃত্যু তার কোনটা কোন বারে কিছুতে জানা যাবে না? অভিমন্যু কী বারে মারা গেল? শুধু মনোজ মিত্রর নাটকে আছে, সপ্তদিবস, সে তো সপ্ত সমুদ্র দূরে। সেই সাতদিন পরের কথা ভেবে এখন থেকে কেন মনমরা হয়ে থাকব বলতে পারেন? আপনার বন্ধুকে একটু বোঝান। আজ ট্যাংরামাছ আর খেঁসারি শাক। আমি রাঁধব। আমাকে হাসপাতালের বিছানায় দেখতে পেলে আপনার বন্ধু খুব খুশী হয়। হাসপাতাল গেলে আমার এই প্রিয় জানালাটার কী হবে?

দু’দিন আগে মালার ডায়ালিসিস হয়েছে। এখন চার পাঁচদিন পর পর ডায়ালিসিস করাতে হচ্ছে। সৌম্য উঠে জানালার পর্দাটা আর একটু টেনে দেয়, যাতে আকাশের যেটুকু দেখা যাচ্ছে না, সেটাও দেখা যায়। খোলা আকাশটাই দেখা  গেলে আরও ভাল হত। নীল রঙের ওপর সারি সারি সাদা বক। জানতে চাইলাম, জানালাটা তোমার খুব প্রিয়?
-আপনাদের কত কাজ আছে। আমারও ছিল। এখন কিছুই পারি না। একথা দুঃখ  করে বলছি না। আপনাদের চেয়ে এখন হয়তো আমি বেশী আনন্দে আছি। আমার দুঃখ একটাই, আপনারা শুধু শুধু আমার জন্য দুঃখ পাচ্ছেন। আপনাদের যেমন রাস্তাঘাট অফিস দোকান বাজার আছে, কেউ হঠাৎ একটা কথা ছুঁড়ে দিয়ে যায়, আমার তেমনি জানালা। শুকনো পাতার ওপর ছাতারের শব্দ। প্রত্যেকদিন  গাছের কেমন পরিবর্তন হচ্ছে। পাতাগুলো সবুজ থেকে কেমন হলুদ হয়ে যাচ্ছে। শিশিরবিন্দু কেমন উড়তে উড়তে পড়ছে। হঠাৎ হাওয়াতে একটা প্রজাপতি কেমন লাট খেয়ে পড়ল। আপনি জানেন, আমাদের এখানে এত হলুদ প্রজাপতি কেন?
আমি ঘাড় নাড়লাম।
-আপনার বন্ধু বলেছেন ইন্টারনেট থেকে দেখে বলবেন। এমন কাঁচুমাচু হয়ে  থাকলে কখন বলবে বলুন?
সৌম্য উঠে ল্যাপটপটা নিয়ে আসে।
-একটু ফেসবুকটাও দেখে নিও, নতুন কারা আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল।  এক তারিখে একজন শুকনো পাতার ছবি পাঠিয়েছে। একটা ছোট্ট গাঁদা গাছের চারপাশে হ্যাপি নিউ ইয়ার জানিয়েছে। শুকনো পাতা আমার যে কী ভাল লাগে কী বলব!
সৌম্য বলে, শুকনো পাতা আমার মোটেও ভাল লাগে না। দেখ না, কিছুতে জানালার বাইরের পাতাগুলো পরিষ্কার করতে দেবে না। দিনের বেলা ঠিক আছে,  হাওয়ার শব্দ, ছাতারের শব্দ। কিন্তু রাতে তুই ভাব! সেদিন ঘুম ভেঙে জানালার বাইরে হঠাৎ খসখস আওয়াজ। উঠতে যাব, দেখি ও জেগে আছে। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, চুপ! ওটা কালুর খয়েরি বাচ্চাটা! তুই ভাব, পাঁচটা কুকুরের বাচ্চার  হাঁটা, তার মধ্যে মাঝরাতে বোঝা যাচ্ছে ওটা খয়েরি বাচ্চাটা! আর আমি ভাবছি চোর-টোর কিনা!
-আমি জানি ওটা খয়েরিটাই ছিল। তুমি পরে পরীক্ষা করে নিও।
জুঁই বিছানায় বসে খাতার ওপর কিছু আঁকছিল আর আমাদের কথা শুনছিল। বললাম, জুঁই পড়তে বসবে না? সামনে পরীক্ষা।
-ও এখন পড়বে কেন? সৌম্য বলল, রবিবার সকালে ওর পড়া বন্ধ। ওর মা বেঁচে থাকার গল্প করবে আর ও শুধু পড়েই যাবে, এটা মানা যায় না।
-যাবে নাই তো! সারাজীবন ও লেখাপড়া করবে, অনেক বড় হবে। কিন্তু রবিবার সকালে মায়ের কাছে সরষে বীজের গল্প না শুনলে ও কোনদিন বড়মানুষ হতে পারবে না। আধখানা বেঁচে থাকবে।
-সরষে বীজের গল্পটা কী?
-তুমি জান না আঙ্কেল, বুদ্ধদেব চেয়েছিলেন, যে বাড়িতে কারো মৃত্যু হয় নি সেখান থেকে সরষে আনতে হবে। তবেই মায়ের মরা ছেলেকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবে। কোনোরকম মলিনতা ছাড়া একথা বলে জুঁই আবার আঁকতে শুরু করে।
মালা বলল, এটাই আসল কথা। আমাদের জাগতে হবে। বাঁচতে হবে। আমরা হাঁটি চলি যেন ঘুমের মধ্যে আছি। নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো। অর্ধেক ঘুমে। পৃথিবীর অভিজ্ঞতা পুরোপুরি নিতে পারি না। আমরা যা করে যাচ্ছি সবই যেন স্বয়ংক্রিয়। অটোমেটিক্যালি করে যাচ্ছি। যন্ত্র। বোধহীন। অর্ধেক জীবন। জীবনের বাকি অর্ধেক যে মৃত্যু, একথা ভুলে যাই। ফলে পদে পদে আমাদের ভুল হয়। হতাশা নেমে আসে। আমার মেয়ে হতাশ হবে কেন? ও বাঁচবে।
-জানো মা, বৃষ্টিতে গোলাপের সব পাপড়ি ঝরে গেছে।
-তাই? তাহলে তো সবুজ ঘাসের ওপর গোলাপের পাপড়িগুলো ভীষণ সুন্দর  দেখাচ্ছে। একটা ফটো তুলে নিয়ে আয় তো!
অদ্ভুত লাগল।
-তুমি কি বরাবরই এমনি করে ভাবতে মালা?
-না, না। যেদিন থেকে বুঝলাম যে একদিন মারা যাব, সেদিন থেকেই সবকিছু  অন্যরকম দেখতে শুরু করলাম। সেদিন থেকেই বুঝলাম বাঁচাটা কী। তখন থেকেই চাইছি আমার চারপাশের মানুষগুলোও শিখুক।
হঠাৎ দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা হাওয়া আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল – দাদা আমি বাঁচব।
-না দাদা। আপনি ভুল বুঝছেন। নীতার মতো আর্তনাদ নয়। আঁকড়ে থাকার  তীব্র বাসনা নয়। সবকিছু ছেড়ে দিয়ে, সবকিছু মেনে নিয়ে, সবকিছুকে ভালবেসে।

বাইরে একঝাঁক শালিক কিচিরমিচির করে উড়তে শুরু করল হঠাৎই। আমাদের সবার চোখের বাইরে চলে গেল। পাঁচ দশ সেকেন্ড সময়। তারপর আকাশ আবার নীল, শান্ত। আমাদের সবারই বেশ ভাল লাগল। আকাশ থেকে যখন চোখ নামালাম, দেখলা্‌ মালা সৌম্যর চোখের ভেতর তাকিয়ে আছে। নিজেকে এখানে  বেশ বেমানান মনে হল। মালা শান্ত হয়ে চোখ নামিয়ে আমাকে বলল, ঠিক এমনই। এমনই এক শান্ত আকাশ থেকে যখন প্রশ্ন আসবে, তুমি কি প্রস্তুত?  তখন যেন শান্ত হয়ে মেনে নিতে পারি সেই সৌন্দর্য। তখন যেন নিজের কষ্ট না হয়। তখন যেন শূন্যে দু’হাত আঁকড়ে না ধরি।
সৌম্য জানালার বাইরে তাকিয়ে সাবধানে চোখ মুছলো। সাঁতার না জেনে জলে পড়া মানুষের দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের ওপর।
-কিন্তু মালা, যদি কেউ ধরে নেয় যে সে যে কোন মুহূর্তে মারা যেতে পারে,   তাহলে বেঁচে থাকার জন্য যে আকাঙ্ক্ষা, নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবার যে ইচ্ছে, সে সব কিছুই তো থাকবে না!
-কেন থাকবে না! আমার মেয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আপনার মেয়ে এগিয়ে নিয়ে  যাবে। আমি তো সম্পর্কগুলো ভালবাসি। মানুষ, রোদ, লেবুর পাতা সবকিছুকে ভালবাসি। আরও নম্র হয়ে, কাউকে না চটকে।
জুঁই উজ্জ্বল হাসতে হাসতে গোলাপের পাপড়ির ফটো নিয়ে ঘরে ঢোকে। মালা ফটো দেখে উচ্ছল হয়ে উঠল।
-বাঃ! কী সুন্দর! ফেসবুকে দিয়ে দিবি নাকি?
জুঁই বলল, পরে দিচ্ছি। আগে তোমার ইনন্সুলিন ইঞ্জেকশানটা দিয়ে দিই।

বুঝলাম অনেক বেলা হয়েছে। আমাকে এবার বের হতে হবে। শুনেছি ইঞ্জেকশান নিয়ে থাই শক্ত হয়ে গেছে। এখন পেটে নিতে হচ্ছে। তাই উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,  আজকাল জুঁই ইনসুলিন দিচ্ছে না কি?
-হ্যাঁ। ও এখন বুঝে গেছে। ওর মা কষ্ট পেলেও থাকে। কষ্ট আর আনন্দ জীবনের   সমান দুটো অংশ। তাছাড়া কালকে আমার মায়ের নাচের স্কুলের ফাংসান। দেখতে যেতে হবে তো!
-এই শরীর নিয়ে তুমি নাচ দেখতে যাবে?
সৌম্য আঁতকে ওঠে।
হ্যাঁ, আমি আর জুঁই গাড়ি ঠিক করে রেখেছি। তুমি আমাদের নিয়ে যাবে। আমি ঠিক পারব। এবারটা আমাকে দেখতে দাও।
মালা জুঁইকে বলে, যা মা, ইঞ্জেকশানটা নিয়ে আয়!
আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসি। লেবু গাছের নীচ থেকে একটা পাতা কুড়োই। পাতাতে তখনও জীবনের গন্ধ লেগে আছে।

2 কমেন্টস্: