কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

শুভশ্রী পাল




ফিভার





( ১)

ঘুমন্ত শরীরের পাশে মনের আনাগোনা সাবলীল হয়ে ওঠে। শব্দ হাতড়ানো শিথিল হলে আহ্লাদেরা একে একে জলসায় নামে যত্নের হাত ধরে। বোবা ঘুঘু ডেকে ওঠে কার্নিশে। শরীর দুলে উঠলে অশরীরী যত্নবোধ বিলি কেটে এনে দেয় ঘুম ঘুম ঘোর। এসময়ে দোলনার অধিকার শুধু মনের। এদিক সেদিক ছড়িয়ে থাকে শব্দের মানে বই। আহ্লাদেরা গুটিসুটি দিয়ে নাক গলিয়ে দেয় ঘুমন্ত বালিশের বুকে। গলা জড়িয়ে দোল দোল দুলুনির তালে ঢুলতে থাকে মন। ঘুমন্ত শরীরের সাথে কী অস্থির মন পাশ ফিরে যায়? 

হাওয়ায় ভাসতে থাকে ঠোঙাভর্তি আহ্লাদ রঙের কথা।

(২)

আন্তরিক সুখ লিখে রাখা ঘুমেরা জেগে উঠে বেড়াতে বেরোয় অবচেতনের  পাড়ায়। এখানের একান্নবর্তী শরীরের ভাগ করে নেয় এ ওর হেঁসেলের ঘুম। ভৌগোলিক সীমানা টপকে এসে পাশাপাশি রেখে দেয় যত্নতুতো স্মারক। ঘুমের ডায়েরির মধ্য দিয়ে হাতবদল হয়ে যায় ব্যক্তিগত আবদার, খুনসুটি আর বকবকম পায়রার দল। ভোরের চরিত্ররা বদলে যাচ্ছে সময় দেখতে দেখতে। সারারাত জুড়ে চলা স্বপ্নসুলভ স্লাইড শো নির্ঘন্ট বাড়িয়ে চলেছে অবিরাম। জলপট্টির মত জড়িয়ে যাচ্ছে লাজুকলতার লাবডুব লাবডুব লাবডুব...

(৩)

যেবারে সুনামি এলো আমার ঘরে, সব ধুয়ে মুছে সাফ করে রেখে গেছিল একরাশ বালি-পাথর। প্রতিবার বন্যা এসে যে পলি ফেলে যেত তাতে আমার উঠোনের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসত। ক’টাদিন মনকেমনের চাদর মুড়ি দিয়ে  নোনতা ঘুমচোখে অপেক্ষা করতাম জল নেমে যাবার। মেঘলা মন ফিকে হতে হতে উঠোন ভেসে যেত ফলনে। বন্যার প্রতি আলতো স্নেহে তাকিয়ে থাকতাম। আমি চাষাভুষো মানুষ ছিলাম। প্রকৃতির সাথে সহবাস আমার জন্মগত। 

সুনামি এসে ভেঙে দিল আমার একচিলতে ঘর, আমার উঠোনে পুঁতে দিল নোনতা স্বাদের বিষফলের গাছ। ঘূর্ণি আমাকে ওলটপালট করে ছুঁড়ে দিতে থাকে এদিকে সেদিক। কপর্দকশূন্য আমি পালিয়ে এসে উঠলাম অন্য দ্বীপে। এখানের ভাষা-লিপি আমি ঠাউর করতে পারি না। এদ্বীপের বাসিন্দারা আলতো ভাবে আমাকে ছেড়ে দেয় চালা বাঁধার জায়গা। আমি সকাল বিকেল চালে-ডালে রান্না সারি। দোর থেকে বেরিয়ে এলে চোখাচোখি - যত্নসুলভ হাসি। একদিন এক কোথাকার দস্যি দামাল ছানা এক ছুট্টে ঢুকে পড়ে অবাক চোখে দেখতে লাগে আমার ঘর। দু চোখ ভরা কৌতূহল। তার সাবলীল সারল্য আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে স্থির করে দেয়। আমার যাবতীয় আড়াল সরিয়ে সরিয়ে সে বের করে আনে লুকিয়ে রাখা হরবোলাকে। এটা এখানে কেন? ওটা ওখানে কেন? বলতে বলতে গোছাতে থাকে আমার ঘর। আমি তার হাতে তুলে দিই সিন্দুকের চাবি। এতদিন পরে আমার দু চোখ জুড়ে ঘুম নামছে। বাইরে খোলা উঠোন জুলজুল করে তাকিয়ে আছে আমার ঘরের দিকে। এদিকে কোন আগল না থাকায় আমার ভয়সুলভ ঘাম গড়িয়ে নামছে শ্বাসনালি বেয়ে। আমার ঘরে আলো জ্বলে উঠছে একে একে। আমি উঠোনের দরজা লুকিয়ে ফেলার যাদুছড়া খুঁজতে খুঁজতে ঘুমিয়ে পড়ছি স্বপ্নের ভিতর।

(৪)

চোখের পাতায় শীতঘুম রেখে চলা দুজন ম্যাজিশিয়ানের দেখা হয়ে গেলে রাস্তা মোড় নিয়ে ফেলে খাদের কিনার ছুঁয়ে। সৌজন্যের হাসি বিনিময়ের অবসরে তারা ভাগ করে নেয় সার্থক ইন্দ্রজালের কৌশল রহস্য। রক্ত চলাচলের স্রোত নিরবিচ্ছিন্ন হয়ে এলে তারা খুলে রাখে যাবতীয় লোক ভোলানো সাজ-সজ্জা। আলতো যত্নে বের করে আনে একে অপরের ভিতরের হরবোলা। যেভাবে জ্বরের গায়ে লেপ্টে থাকায় সুখ এঁকে দেয় জলপট্টি, সেরকম সুখ এনে দেয় সঙ্গসুলভ ঘোর। বন্ধ জানালা খুলে ঢুকে পড়ে একরাশ সোঁদা গন্ধের ঝোড়ো হাওয়া। বহুদিন পর বৃষ্টি নামে শরীর জুড়ে। হরবোলা ডেকে ওঠে না না সুরে, বুঁদ হতে হতে ঘুমঘোরসুখ দেখে ম্যাজিশিয়ান। প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ক্রোশ-মাইল-কিলোমিটার  সরে এসে তারা একে অপরের যাদু কৌশল আবিষ্কারের খেলায় মেতে ওঠে। কত-শত ভুলে-হারিয়ে-লুকিয়ে থাকা খেলা বেরিয়ে আসে একে একে একে। মুখোমুখি হাত ধরে নতুনের। শীতঘুমের পুরু খোলস ছেড়ে ফেলে তারা ঘুমিয়ে  কাদা হয়ে পড়ে। পাশে ফিরে একে অপরের ঘুম শুনতে শুনতে কথা দেখতে দেখতে তারা পটারির চাকে ফেলে দেয় নিজেদের কাদা হয়ে ওঠা সত্ত্বা। এখানের  বসত ভিটার সংস্কার শুরু হয়েছে। দুজন ম্যাজিশিয়ান গাছ-নদী-হাওয়া হতে হতে ইন্দ্রজাল বিছিয়ে দিচ্ছে নিজেদের আগ্রহে বাঁধা গ্রহ জুড়ে।

(৫)

নিজের কাছে আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে গেলে স্থায়িত্ব ধোঁয়াশা হয়ে ওঠে। যে নিজেই নিজেকে সামলাতে পারে না তাকে অন্য কেউ আগলে রাখবে এ আশার কোর্ট মার্শাল হওয়া উচিত। জলের নীচে নামলে রোজ বোঝা যায় নিজের অন্তর্দ্বন্দ্ব।  খাবি খেয়েও বেঁচে থাকতে চাওয়ার আপ্রাণ লড়াই। প্রতিবার বেঁচে গেলে আবার  নিজেকে ফেলে দিই অনিশ্চয়তার জলে। পেঁয়াজের মত আমি বের করে আনছি কারো চোখের জল, সাথে সাথে নিজেকেও টুকরো টুকরো করছি। দুর্বোধ্য মানুষকে দূর থেকে আগ্রহজনক মনে হলেও তার তালের ছন্দ না কেটে নূপুর পরিয়ে রাখা যায় না। যেভাবে ফিরে গেছে লিপি চিনতে না পারা ভাষাবিদ্  সেভাবেই ফিরে যাবে ভিনগ্রহীর স্পেসশিপ। আমার কোনও মেড-ইজি নেই। লাস্ট মিনিট সাজেশান নেই। নম্বর ক্যারি না হওয়া বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সাময়িক। সাময়িক এবং ক্ষণস্থায়ী।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন