কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

রঞ্জনা ব্যানার্জী



কালিমাটির ঝুরোগল্প



ধর্ম-অধর্ম  


তর্জনী উঁচিয়ে একভাবে বকে যাচ্ছিল লোকটা সকালের নরম রোদ ওর কালো চুল পিছলে নামছিললোকটার চোখের ঘূর্ণিতে পাগলপনা কিন্তু পরিপাটি কাঁধ-ছাপানো চুল এবং মুখভর্তি দাড়ির আদলটি খুব চেনা! চারপাশে জ্যামে আটকে পড়া যানবাহনের আওয়াজ উজিয়ে ওর কথা শোনা যাচ্ছিল না কিছুইগরম লাগছিল খুব; এ.সি চলছে তাও ক্যাসকটা ঘামে লেপ্টে গিয়েছিল শরীরে।  

পেছনের সিটে সঙ্গীরা সবাই গল্পে মশগুল। ফাদার জানালার কাচ নামিয়ে দিলেন লোকটা যেন অপেক্ষাতেই ছিল। ফাদারের দিকে তর্জনী তাক করে বলল, ‘খুনী’! তড়িঘড়ি কাচ তুলে কুলকুল ঘামতে থাকেন ফাদার। আড়চোখে দেখেন সঞ্জয়কে। ও কি শুনেছে? স্টিয়ারিঙয়ে হাত চেপে সঞ্জয় গোমেজ বসে আছে; যেন মহামতি বুদ্ধ! 
পাঁচ বছর নয়, মনে হয় যেন এই সেদিন : ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত পরিবারগুলোতে পথ্য বিলি করতে সদলে বান্দরবানে গিয়েছিলেন ফাদার। পিটার এনেছিল বীথি মার্মাকে পিটার একাধারে দোভাষী এবং ত্রাসমন্বয়ক। বীথির রান্নার হাত ভালো। স্বামী নেই। প্রবল অর্থকষ্ট। কিশোর ছেলেটি স্কুল ছেড়ে গ্যারাজে কাজ করছে অতএব সাতদিনের রাঁধুনীর চাকরিটা বীথিই পেয়েছিল।

শেষদিনেই অঘটনটা ঘটে। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি বীথির নয় বছরের মেয়ে। রাত বাড়লে ফাদার বীথিকে নিয়ে পুলিশ-স্টেশনে গিয়েছিলেন। ডিউটি অফিসার রিপোর্ট লিখতে লিখতে উপদেশ দিয়েছিল, ফাদারের এসবে নাক না-গলানোই উত্তম।

পরদিন কাকভোরে ঝর্নার ধারে পাওয়া গিয়েছিল মেয়েটাকেশ্বাস পড়ছে। ওর মা এবং স্বজনেরা  কলঙ্কের ভয়ে হাসপাতালে নিলো না। পিটার জেনেছিল পুলিশে রিপোর্ট করায় সন্ত্রাসীরা মা-মেয়ের হাড়মাস আলাদা করার পরিকল্পনা করছে। অতঃপর নিরাপত্তার খাতিরে ফাদার ওদের নিয়ে এলেন দেয়াঙে। কদিন পরেই পুরো পরিবার খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা নিয়েছিল। মেয়েটাকে নতুন নাম দিয়েছিলেন তিনি; ‘তেরেসা গোমেজ’

মাস যেতেই তেরেসার গর্ভচিহ্ন স্পষ্ট হয়েছিলএত ছোটো মেয়ে ঋতুমতী ছিলো? বীথি ভ্রূণ-নাশের অনুমতি চেয়ে কাঁদছিল, শরীরে আগাম নারীত্ব এলেও সে শিশুই; গর্ভের ভার বইতে পারবে না। ফাদার রুষ্ট হয়েছিলেন। ভ্রূণহত্যা চার্চ অনুমোদন করে না। তেরেসা আশ্রমে যত্নেই ছিলোঅনাগত সেই শিশুর জন্য ফরাসি দত্তকও মিলেছিলকিন্তু মা কিংবা শিশু কাউকেই বাঁচানো গেল না। শেষ বিদায়ের দিন ফাদারের মনে হচ্ছিল বীথির মাতম চার্চের সিলিং ছুঁয়ে প্রশ্ন-চিহ্নের মতো দেখছে তাঁকে। সেই ন্যায়-অন্যায়ের দোটানা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠেছিল ফাদারের কাছে। দেয়াং ছেড়েছিলেন তিনিমাদকাসক্তদের জন্য রিহ্যাব গড়েছেন রাজধানীতেসঞ্জয় এখন এই প্রতিষ্ঠানেরই গাড়ি-চালক। বীথি এখনও দেয়াঙেই।

কিন্তু কে এই লোক? ও কি জেনে রায় দিলো, নাকি প্রলাপ বকলো? ফাদার  জোসেফের ভ্রূ টপকে ঘাম গড়ায়। টিস্যু-বাক্সের দিকে হাত বাড়াতেই জ্যাম ছাড়ে। সঞ্জয় গাড়ি টানতেই লোকটা তীরবেগে উইন্ডশিল্ডের উপর আছড়ে পড়ে। বিস্ফারিত চোখে ফাদার দেখেন পাগল নয়, প্রভু যিশুর মুখ...

পেছনে বসা সঙ্গীদের উদ্বিগ্ন আওয়াজ দূর থেকে ক্রমশ নিবিড় হয়। চোখ মেলেন ফাদারসঞ্জয় আশ্বস্ত করে, ‘কিছু হয়নি পাগলটার। ভাগ্যিস ব্রেক কষেছিলাম!’ ফাদার বামে তাকান, প্রভু যিশু নয় ফুটপাতের উৎসুক পথচারীরা দেখছে তাঁকে ফের চোখ বোজেন তিনি...





0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন