কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৯

সুনীতি দেবনাথ




ত্রিপুরার ভূস্বর্গ জম্পুই হিল




আজকাল মনটা ভোলামাস্টার হয়ে গেছে অনেক কিছুই স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অজান্তে আবার টুকিটাকি ছোটখাটো ঘটনা জ্বলজ্বল করে আগুনের ফুলকির মত নিমেষে জ্বলেও ওঠে বৈকি! সোজাসাপটা কথায় যেসব কথা গুরুত্বপূর্ণ এবং মনে  থাকা দরকার সেগুলো মনে থাকছে না, আবার অতি তুচ্ছ ঘটনা তাদের সামান্য অস্তিত্ব নিয়ে সাড়ম্বরে  নিজেদের জানান দিচ্ছে

এই যেমন বিগত নব্বইয়ের দশকের কথা আমি তখন কাঞ্চনপুর দ্বাদশ শ্রেণী বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি তারিখটা কিন্তু মনে নেই মনে আছে শুধু রাশ রাশ কুয়াশা সাদা ধোঁয়ার মত ভাসমান মেঘের স্তুপ এই উড়ছে এই হারিয়ে যাচ্ছে সেই কবে থেকে ভাসছে, উড়ছে, হারাচ্ছে

উগ্রপন্থী অধ্যুষিত সেসব দিনে পাহাড়ী কাঞ্চনপুরে টানা সাড়ে ছয়টি বছর পরিবার বিচ্যুত হয়ে কাটিয়েছিলাম কাঞ্চনপুর পেরিয়ে ত্রিপুরার ভূস্বর্গ বলে  অভিহিত জম্পুই পাহাড় এই পাহাড়ের সর্বোন্নত জনপদ ভাংমুন আর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বেতলিং শিব এর উচ্চতা সবচেয়ে বেশি ত্রিপুরার সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ এটি প্রায় ২০০ কিলোমিটার জুড়ে  অবস্থিত আগরতলা থেকে দূরে এবং রাজ্যের সর্বোচ্চ পর্বতশ্রেণী মিজোরামের সীমানা শাশ্বত বসন্তের এই চিরস্থায়ী আসন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত প্রতিবছর নভেম্বরে জম্পুই পাহাড়ে অনন্য  অরণ্য ও পর্যটনউৎসব পালিত হয় দেশী এবং বিদেশী উভয় শ্রেণীর পর্যটকদের একটি বড় সংখ্যা অংশগ্রহণ করেন এই উৎসবে এবং এই রঙিন উৎসবের আনন্দ উপভোগ করেন আরো বিশেষ ব্যাপার ছিলো এখানকার কমলালেবু উৎসব জম্পুইয়ের কমলালেবু স্বাদে ছিলো ভারত বিখ্যাত টিলার পর টিলা ঝাপড়া সবুজ কমলাগাছে অজস্র কাচা পাকা কমলালেবুর নৈঃসর্গিক সৌন্দর্যের পীঠস্থান ছিলো কমলালেবুর বাণিজ্যে লাখ লাখ টাকা স্থানীয় অধিবাসীরা উপার্জন করতো দুঃখের  বিষয় এখন জম্পুইয়ের সে কমলাবাগান শুকিয়ে গেছে হাজার হাজার শুকনো কমলালেবুর গাছ নিষ্ঠুর কঠিন হাতে যেন আকাশকে খামচে ধরছে আর এই  কমলালেবুর বাগানকে কেন্দ্র করে যে পর্যটক সমাগম হতো, তাও আর নেই আমি   যখন চাকুরিসূত্রে  কাঞ্চনপুরে, তখনও কমলারবাগান ছিলো যাবার জন্য, দেখার জন্য প্রাণ ছটফট করতো কিন্তু একা থাকতাম বলে সে সুযোগ ছিলো না এখানকার বর্ষা ঋতুও কম রমণীয় নয় এই মরসুমে পর্বতটি ভাসমান মেঘ দিয়ে  আবৃত থাকে  এবং এটি পর্যটকদের জন্য একটি বিরল অভিজ্ঞতার কারণ হয়ে ওঠে পর্বতমালার নীচে মেঘের গঠন এবং তার ধীরে ধীরে নিচে থেকে উপরে ধোঁয়ার মতো ওঠা, ধীরে ধীরে তার রহস্যময়তা ঘাড়ে নিয়ে পুরো পাহাড় চূড়োটি পরিবেষ্টন করা যেন ঘন সবুজ রত্ন পান্নার মতো অমূল্য অভিজ্ঞতা



জম্পুই পাহাড়ের বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন স্থান থেকে সূর্যোদয় পর্যটকদের জন্য একটি চমৎকার আকর্ষণ ভ্রমণ অনুসন্ধিৎসু জম্পুই পাহাড় পরিদর্শনকারী পর্যটকেরা সূর্যাস্তের দৃশ্য এবং সূর্যোদয়ের দৃশ্যকে মিস করতে পারেন না পাহাড় পরিসরে  মিজোরাম উপত্যকায় এবং গ্রামের চমৎকার প্যানোরামিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে সর্বোচ্চ শিখর গৌরবপুর থেকে বেতলিং-শিব (৩২০০ ফুট উচ্চ), পার্বত্য চট্টগ্রাম  পার্বত্য অঞ্চল, কাঞ্চনপুর-দশদা উপত্যকা, ত্রিপুরা ও মিজোরামের অন্য পাহাড়ি পর্বতমালা একটি সুন্দর প্রকৃতির দৃশ্য উন্মোচন করে

ত্রিপুরা সরকারের পর্যটন বিভাগের একটি খুব আধুনিক পর্যটন লজ ইডেন পর্যটন লজজম্পুই পাহাড়ের ভাংমুন গ্রামে নির্মিত হয়েছে, যাতে জনা কুড়ি মানুষ থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এবং সমস্ত আধুনিক সুযোগসুবিধা দিয়ে সজ্জিত এছাড়াও, স্থানীয় আধ্যাত্মিক মিজো মানুষ তাদের বাড়িতেভরাট অতিথিআবাসন সুবিধা প্রসারিত রেখেছে

জম্পুই পাহাড়ে পর্যটকদের পরিদর্শনের জন্য পর্যটন বিভাগ, ত্রিপুরা সরকার রাজধানী আগরতলা থেকে বিভিন্ন প্যাকেজ ট্যুর-এর আয়োজন করেছে জম্পুই পাহাড় একটি বাস্তব পর্যটক স্বর্গ যা একটি সুন্দর বনে এবং সুন্দর ও ইকো বান্ধব পরিবেশে সুন্দর গোলাপ এবং রঙিন নাচ ও সঙ্গীত সহ পর্যটকদের একটি বড় সংখ্যা আকর্ষণ করে জনবিরল এই জায়গাটি অবকাশ-এ পর্যটন-এর জন্য একটি আদর্শ সুযোগ প্রদান করে

সুযোগের  অভাব হলেও কাঞ্চনপুর থাকাকালীন দুবার জম্পুই হিলে যেতে পেরেছিলাম একবার বর্ষার মরসুমে, আরেকবার পুজোর পরপর জম্পুইয়ের ভাংমুনে একটি সরকারি দ্বাদশশ্রেণী বিদ্যালয় আজে শুনেছিলাম ওখানে জম্পুই ভাষা মাধ্যমে পঠনপাঠন হয় পরে অবশ্য অন্য অভিজ্ঞতা হয় ওখানে বাংলা সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজও ছিলো কেউ কেউ ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবেও পড়তো সে অন্য কথা

সন তারিখ মনে নেই আমাদের স্কুল এবং ভাংমুন দ্বাদশ শ্রেণী স্কুলের মধ্যে প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন হয়েছিল প্রথম ম্যাচ হবে ভাংমুনের মাটির সুদৃশ্য গ্যালারিতে দুই স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে খেলা দ্বিতীয় খেলা হবে কাঞ্চনপুরে ব্লকের মাঠে প্রথম খেলার দিন সবাইকে  লাঞ্চ করাবে ভাংমুনের শিক্ষকগণ এবং  দ্বিতীয় দিন কাঞ্চনপুরের শিক্ষকরা সবার অনুরোধে ট্রাক করে আমরা রওনা হলাম ঝাঁকুনিতে অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়ে আসছিলো তবু আনন্দ রাস্তার দুপাশে রংবেরঙের লতানো গাছ লাল, হলুদ, বেগুনী  ফুল ঝাঁকে ঝাঁকে বুনো ঝিঁঝির  একটানা তীক্ষ্ণ সুর অপূর্ব রাস্তায় এক জায়গায় পার্বতী ঝর্ণা আক্রোশে উথালপাথাল রাস্তা ভাসিয়ে নেমেছে মুলি বাঁশ পেতে দেয়া হয়েছে যাতে গাড়ি না স্লিপ করে অবশেষে ভাংমুন গেলাম কী সুন্দর জনপদ চেনা জগৎ নয় ঝকঝকে তকতকে ছিমছাম পরিচ্ছন্ন বাড়িঘর শুধু একটি বিষয়  খারাপ লাগলো ওদের কিচেন বড় নোংরা গরুর কাটামাথা ঝুলিয়ে রাখা শুটকি হচ্ছে কাঠের পাটাতন চকচকে নানা রঙের ফুলবাগান রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং-এর ব্যবস্থা সব বাড়িতে
দুপুরে খেতে দেওয়া হলো সাদাভাত, ডাল, আলুভাজা, সিদল চাটনি, মুরগির ঝোল আর লেবু আমার কিছু কষ্ট হলো পেঁয়াজ রসুন খাইনা বলে ডাল, আলুভাজা  ভরসা ওরা খুব আপশোস করলো  তেমন অসুবিধা হয়নি বলে আমার সংকোচ হচ্ছিল পরিচয় হলো ওখানকার লুসাই বাংলাটিচারের সঙ্গে কতকিছু জেনে নিলেন! আমার শ্রদ্ধা হলো আমরা যদি সবাই এমন হতাম! এরপর খেলার  গ্যালারি পত্রিকা পেতে সবাই বসে পড়লাম জমে উঠলো  খেলা জমজমাটি খেলা আমাদের স্কুলের একজন মাস্টারমশাই বয়স হলেও দারুণ খেলেন তাঁর পায়ে তখন বল! গোল হলো বলে সবাই গো--ও বলে চেঁচিয়ে উঠেছি ল বলার আগেই ধোঁয়াটে সাদা মেঘে মাঠ ছেয়ে গেলো কিচ্ছুটি দেখা গেলো না ল আর বলা হলো না যা হোক শেষ অব্দি আমরা হেরে গেলাম পরে যেদিন কাঞ্চনপুরে খেলা হলো সেদিন আমরা জিতেছিলাম খেলা ড্র হলো ভেতরে যাই হোক সবাই খুশি আমি খুশি প্রথম জম্পুই দেখলাম বলে



দ্বিতীয়বার জম্পুই দর্শন পাড়াপড়শী মিলে পিকনিকে যাওয়া সবার অনুরোধ ঠেলতে না পেরে যেতেই হলো বদলায়নি তেমন কিছু কমলাবাগান তেমনি আছে সীজনও কমলার মনে হচ্ছিল বিশালাকার গাঁদাফুলের গাছে কমলারঙের অজস্র গাঁদাফুল যেন ফুটে আছে সেখানকার একটা নিয়ম ছিলো, প্রাণভরে কমলা খাও কিন্তু আনা যাবে না বাগানগুলো সীজনের আগে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দিতো লুসাইরা পাহারাদারির কোনও ব্যবস্থা ছিলো না বিশ্বাসই ছিলো বড় কথা পাকা কমলার এমন নান্দনিক দৃশ্য যে হতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না আমরা প্রচুর পরিমাণে কমলা খেলাম, আনা তো আর যাবে না তার পরেরবার যখন গেছি জম্পুইয়ে, কী বিচিত্র পরিবর্ত! কমলাবাগান আর নেই তার বদলে এক ঠ্যাংয়ে দাঁড়িয়ে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ সুপুরিবাগান শুনলাম একেকটি লুসাই পরিবার ফি বছর লাখ লাখ টাকার সুপুরি বিক্রি করে মাঝেমাঝে দেখা যায় পেঁপের বাগান কমলাবাগান অধ্যুষিত জম্পুইয়ের সেই সৌন্দর্য আর নেই সারাবছর যে জম্পুইয়ে শীত থাকতো এখন ভূ-উষ্ণায়নের ফলে শীত পালিয়েছে কেবলমাত্র শীতের সীজনেই শীত অনুভূত হয় হিলে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকালে নীলচে মিজোরামের পাহাড় শ্রেণী আজও নয়নাভিরাম রূপে চোখের দৃষ্টিকে স্নিগ্ধ করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি জম্পুই হিল কিন্তু কমলাবাগান না থাকলেও আজও অপরূপ সুষমামণ্ডিত উন্নতি হয়েছে অনেক জলাভাব জম্পুই হিলের অভিশাপ ছিল বলা যায় এখন ত্রিপুরা সরকারের বদান্যতায় নানা স্থানে ঝর্ণার জল আর বোরিং করা জল নিয়ে জলাভাব অনেকটাই মিটেছে জম্পুই হিলে রাস্তাঘাট এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব অনুন্নত ছিল বর্তমানে সেসব অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে হিলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বেতলিং শিব পর্যন্ত এখন গাড়ি করে যাওয়া আসা চলে শোনা যায় বেতলিং শিবে কৃষক আন্দোলনের নেতা রতনমনি রিয়াং নাকি একটা শিবমন্দির স্থাপন করেছিলেন এখন আর তার কোনও চিহ্ন নেই সারা পাহাড়ে হাজার বছরের পুরনো শাল সেগুন গাছ এখনও দেখা যায় তবে ইদানীং কালে চোরাকারবারিরা নীরবে নিভৃতে এসব গাছ কেটে বড় বড় টুকরো দেও নদীর জলে ভাসিয়ে সমতলে নিয়ে আসে এবং প্রচুর দামে বিক্রি করে চাকরিসূত্রে কাঞ্চনপুরে থাকাকালীন সময়ে শীতকালে হাঁটুজলেরও কম জলে দেও নদীতে আমরা স্নান করতাম তখন দেখেছি নদীর পাড় ঘেঁষে তেমনি বিশালাকৃতির একখন্ড কাঠ এটা স্রোতে ভেসে যায়নি আমরা এই কাঠের টুকরোর উপরে কাপড় কাচতাম প্রসঙ্গত বলছি যে ঝর্ণা রাস্তার উপর দিয়ে প্রচন্ড গতিতে চলতো, তার জলকে বর্তমানে রিজার্ভারে সংরক্ষণ করে আশপাশের গ্রামে পাইপলাইনে সাপ্লাই দেয়া হয়

প্রকৃতির লীলানিকেতন ত্রিপুরার ভূস্বর্গ জম্পুই হিল আমাদের অহংকার সারাবছর বর্তমানে এখানে দেশ বিদেশের পর্যটকেরা এসে মেঘে ঢাকা সবুজ প্রকৃতির আনন্দ উপভোগ করে পর্যটন শিল্পের আনুষঙ্গিক আরও কিছু ব্যবস্থাপনা করা হলে নিশ্চিতভাবেই ত্রিপুরা সরকারের আয়ের উৎস হয়ে উঠবে সুন্দরী জম্পুই হিল

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন