কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৯

তুষ্টি ভট্টাচার্য




পদাবলি -  



(আমি-- আমি সামান্য শখের কলমচি। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি আর কী! আমার লেখার পাঠক খুবই কম যদিও। বড় বড় সাহিত্য সভায় আমাকে পাবেন না। পুরস্কারের বদলে তিরস্কারই পাই বরং। মনের দুঃখে ইচ্ছে জেগেছে পদাকে নিয়ে লিখতে। যদি যুগান্তকারী কিছু লেখা হয়ে যায়, অন্তত পদার নাম করে।

পদাপদাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমারই বয়সী বলে ওকে আমার বন্ধু ভাববেন না। গরীব নয়, কিন্তু গরীব সেজে থাকে। বিচ্ছিরি রকম ড্রেস সেন্স, হয় পাজামার ওপরে টিশার্ট, নয় লুঙ্গির ওপরে ফুল শার্ট! আর পায়ে হয় কাপড়ের জুতো নয় প্লাস্টিকের চটি। সময়ে, অসময়ে হুটহাট আবির্ভূত হয়। আমাদের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। কথাবার্তার টপিক বিবিধ ভারতী থেকে বিলিতি আমড়া পর্যন্ত। গায়ে পড়ে এসে পিত্তি জ্বলানো কথা বলে। আমিও মাঝেমাঝে ওকে কিছু নিরীহ প্রশ্ন করে থাকি।

মাদাম তুভোঁআদপে ফরাসী হলেও এদেশের বাসিন্দা, রঙ জন্মসূত্রে সাদাই ছিল। এখন তাঁর তামাটে মোটা চামড়ায় খসখসে খড়ির দাগ। অত্যন্ত নাক উঁচু টাইপের। এবং জ্ঞানদা। এঁর কথা অর্থাৎ বাণী না শুনলে আমার আর পদার সম্পর্কটা ঠিক খোলসা হবে না। ইনি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় এসে বাণী বিতরণ করে আমাদের আরও বিপাকে ফেলে প্রস্থান করেন।)

কী রে, কোথায় থাকিস? এফবিতে দেখছি না যে!
-
ওই আর কী! ইয়ে মানে...
-
রাখ্‌ তোর ইয়ে! দিনে মিনিমাম দুটো স্ট্যাটাস না দিলে যে তোর ভাত হজম হত না, রাতে ঘুম আসত না, সে কী না বলছে--ইয়ে!
-
না, মানে, বিশ্বাস কর্‌। একটু লিখছি আর কী।
-
তা একটু কেন, কবে আর তুই একটু লিখেছিস? লিখে লিখে গোল্লায় গেছিলি তো সেই কবেই। তবে এফবি ছাড়তে তো দেখিনি।
-
ধুর বাবা! আগে তুই এফবিতে ছিলি না তো! তাই আমি থাকতাম। এখন তুই থাকিস। তাই থাকি না।
আমার এই কথা শুনে পদা আর সামলাতে পারল না। রাগে ফেটে পড়ে বলল,
কী এত বড় খোঁটা দিলি তুই এফবি তুলে!! যা, আমি চললাম!
-
যা, যা ভাগ! ভেগে গিয়ে তো সেই স্ট্যাটাস দিবি, 'হারিয়ে গেছি আমি।'
-
আবার কাব্যি করছিস! তোকে শাপ দিয়ে গেলুম আজ। দশটার বেশি লাইক পড়বে না তোর স্ট্যাটাসে।
-
স্ট্যাটাস দেওয়াই ভুলে গেছি রে!
-
স্ট্যাটাস থাকলে তো দিবি! 
আমি এরপরে আর কথা বাড়াইনি ওর সঙ্গে।



আজকাল সত্যিই আর বেশিক্ষণ এফবিতে থাকতে ভাল লাগে না। তবু আজ বেশ কিছুটা সময় নিউজ ফিড স্ক্রল করছি মনে হচ্ছে যেন অন্য কোন আইডিতে এসেছি কাউকেই চিনতে পারছি না এরা কারা? আমার বন্ধু? আমি কে? কে জানে! এই সমস্ত ভাবনাচিন্তার ফসল আমি কার ঘরে তুলব, পদা ছাড়া? ফলে ওকেই বলে ফেললাম।
হ্যাঁ রে পদা, তুই তো ফেসবুক করিস খুব। কত কী জানিস এই বিষয়ে। আর আমি বেকুবের মত দেখি, কারা কারা যেন ফ্রেন্ড থেকে ফো মানে আলফ্রেড হয়ে গেল। কারা কারা যেন অদৃশ্য মানে ব্লক হয়ে গেল। কারা আবার বিখ্যাত হয়ে গেল, কুখ্যাতও। কাদের কাদের লাইক হুহু, কাদের যেন টিমটিম, কাদের মাথায় হাত পড়ল, কারা যেন কাদের খান হয়ে উঠল। কাদের মাথার 'পরে আর হাত রইলো নাকো। কাদের মাথায় আবার বিশেষ কারুর হাত পড়ে মাথার পিছনে একটা বলয় জেগে উঠল... হ্যাঁরে এইসবের মানে কী? 
পদা কোত্থেকে যেন এক ঠোঙা চিনেবাদাম জোগাড় করেছে। পটাশ পটাশ করে ফাটাচ্ছে সমানে। আমার কথা বোধহয় কানেই যায়নি। তবুও ওই পটাশ পটাশের মধ্যে একবার সে বলে উঠল, 'মনে আছে, রান্না করতে করতে ফেসবুক করতে গিয়ে কতবার পুড়িয়েছিলিস? অতএব মাল্টিটাস্কার হোস না। হয় এস্পার নয় ওস্পার' 'মানে? 'খুব বিরক্ত হয়ে পদা বলল, 'মানেবই লিখছি একটা ফেসবুকের। ডোন্ট ডিস্টাপ!'
এই বলে সে আবার হাওয়া হয়ে গেল বেশ কিছুদিনের জন্য। আমি বুঝলাম, ফেসবুকের মানে বই লিখতে লিখতে ও নিজেই আর জীবনের কোন মানে খুঁজে পাবে না যখন, তখন আবার হাজির হবে। তো, যাই হোক, আমি আমার টুকটাক লেখালেখি আর এফবি নিয়ে মেতে আছি। প্রায়ই দেখি অনেকেই দিই-এর বদলে দেই, আর নিই-এর বদলে নেই লিখে চলেছে সমানে। ওপার বাংলার ক্ষেত্রে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী, এপারের লোকেরাও যদিও কিছু কম যায় না এ ব্যাপারে। তো আবার প্রশ্ন জাগল মনে। আর জিজ্ঞেস করার লোককেও ঠিক সময় মতোই পাওয়া গেল হাতের কাছে। হ্যাঁ রে পদা—দেই আর নেই-এর বদলে দিই আর নিই লেখা যায় না? অন্তত লেখার ক্ষেত্রে? না লিখলেই বা কী! আমার আর কী! শুধু দেই দেখলেই আমার ধেই ধেই করে নেত্য করতে ইচ্ছে হয়। এই আর কী!
পদা শুনেটুনে বলল, দেখ, নেত্য করা ভাল। মেদ কমে, মনে ফুর্তি আসে। নেত্য তুই করতেই পারিস। তবে আমাকে আর ডাকিস না সে সময়ে। আমার মানে বইয়ের কেসটা এখনও পেন্ডিং রয়ে গেছে। তুই নেত্য কর, আমি মানে খুঁজে ফিরি। পদা তো চলে গেল। আর আমি সেদিন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম—পুরো এফবি ধেই ধেই করে নেত্য করছে! কেন করছে, কার জন্যি করছে, সে তোমরা বুঝে নাও বাপু! আমিই কী ছাই অত বুঝি! তবে তোমরা বড়ই বেইমান জাতি, এটুকু বুঝেছি। কত ফোঁটা চোখের জল ফেলেছিলেন উনি তোমাদের জন্য, ভুলে গেলে সবাই? ছিঃ! এই তোমরা মিত্রোওঁ!

দেখতে দেখতে বইমেলার সিজিন চলে এল। কত কত ভবন কত কত মঞ্চ আর কত কত কবিদের ছবি দেখছি কবে কবি হব? হে ভগমান! ভাগবান নিদ্রা গেছেন বুঝলাম। লিটল মেলা চলে এল যথারীতি। গেলবারের মতো এবারেও কী ও কাকুরা...ও দিদি/দাদারা ডাকাডাকি হবে? চুলোচুলি হবে? আগেরবার খুব জমে উঠেছিল এই খেলা। এবারেও শুরু হল ওই কাকুদের ডাক। তা কাকুরা কী আর সব্বাইকে ডাকে? বেছে বেছে নিজেদের মনের মতো লোকদেরই ডাকল। তাই দেখে এবারও অন্য দাদা/দিদিরা রেগেমেগে ওদিকে নয়, ইদিকে আসুন...চলতেই থাকল। আমিও নারদ, নারদ...মন্ত্র জপতে জপতে হেব্বি এঞ্জয় করলাম এসব। আর এসবের মাঝেই হঠাতই একদিন প্রফেসর শঙ্কুর সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, ‘এট্টু জলপাই কোত্থেকে বলুন তো’? কী কেস মাইরি! একে প্রফেসর শঙ্কু, তার ওপর জলপাই...আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি, মুখ বুজতেই পারছি না...কয়েকটা মশা হাঁ মুখে ঢুকে গেল, একটুও কাশলাম না...মাছিরাও আসছে ভনভন করতে করতে দেখে আর পারলাম না। ঢক করে ঢোঁক গিলে নিলাম একটা। তারপর উত্তর দেবার জন্য মুখ খুলব ভাবতে ভাবতেই দেখি কারা যেন জিরো নিয়ে খুবসে আলোচনা করছে। যে সে আলোচনা নয়—একেবারে আঁতেল মার্কা সমালোচনা। কান খাড়া করে শুনে বুঝলাম কোন এক ফিলিমের কথা হচ্ছে, যার নাম জিরো। এদ্দিন সিনেমার ভাষায় শুনতাম জিরো ফিগার করিনা, তোর দিন গিয়াছে, হায়! ফিগার নয়, এখন সিনেমার ভাষা শুধুই জিরো যা বুঝছি, শূন্যতা অতিক্রম করবে খুব শিগগিরই তার আগে পদার সঙ্গে একবার মুলাকাত করে যেতে হবে।



সেদিন একটা আমিনিয়ার ডবল মাটন কাঠি রোল প্রায় শেষ করে এনেছি এমন সময় পদার উদয় বলল, 'ছিঃ! তোর লজ্জা করে না?' আমি বললাম, 'যে যার ভাগ্যে খায় লজ্জার কী আছে! রোজ যখন রুটি চিবোই তখন তো কিছু বলিস না?' সে কইল,'তুই হলি বিগ্রেড কবি রুটিই তোর সম্বল আর ঘটি নয়, এক স্টিলের গেলাসে জল ব্যাস! আর তুই কিনা কাঠি করছিস! ছিছিঃ!! রাগে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে উঠল। কবে থেকে জাত কবি হওয়ার শখ, আর আমায় বলে কিনা বিগ্রেড কবি! চিৎকার করতে যাচ্ছি, সেই সময়ে হাজির হলেন মাদাম।

মাদামের লাঠি আমাদিগের মাঝখানে যেন এক চীনের প্রাচীর তুলিয়া দিল। আমাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত সেই প্রাচীরের গাত্রে গদাম গদাম শব্দে পুনর্বিবেচিত হইবার অপেক্ষায় তখনও ধৈর্য সহ অপেক্ষারত দেখিয়া মাদাম তৎক্ষণাৎ আমাদিগের মাঝে ধপাস করিয়া বসিয়া পড়িলেন দুই ঠ্যাঙ ছড়াইয়া। অধিকন্তু ন দোষায় ভাবিয়া আমরা আর কাল বিলম্ব না করিয়া মাদামের দুই পদপ্রান্তে বসিয়া পড়িয়া আনুনাসিক কন্ঠে আমাদিগের অভিযোগ তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবেশে নিযুক্ত হইলাম। একসময়ে মানসিক স্থিতি ধসিয়া যাইল তাঁহার। ‘খামোশ!’ তাঁহার কন্ঠের এই সুরেলা ধ্বনি শুনিয়া সত্য সত্যই এইবার আমরা থমকাইয়া নিশ্চুপ হইলাম। শুরু হইল মাদামে বাণী। ‘শোন, কতবার তোমাদের বলেছি, অনর্থক এইসব ঝগড়াঝাঁটি করে শুধুশুধু তোমরা শব্দ দূষণ ছাড়া আর কোন উপকারই করতে পারছ না এ পৃথিবীর। এর চেয়ে নিশ্চুপে আরাধনা কর তাঁর।‘ ‘ক্কাকার...?’ পদা তোতলাইয়া উঠিল কেন সে তিনিই জানবেন নিশ্চিত! আমি সভয়ে দেখিলাম মাদামের ক্রুদ্ধ লাল লাল ভাঁটার মতো দুই চক্ষু দিয়া অগ্নি বর্ষণ হইতেছে। বুঝিলাম, এ বৎসর বৃষ্টির আশা না করাই শ্রেয়। মাদাম এই প্রথমবার বাণী ইনকমপ্লিট রাখিয়া বাটি হইতে নির্গত হইতে হইতে বলিয়া যাইলেন, ‘নিরুদ্দেশে চললাম! তোমাদের কাছে আর আসব না!’

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন