কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

খামোশি


রফিকের স্বরভঙ্গ হচ্ছিলো। তাই লজ্জায় কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। কথা, শব্দ এসব কি আর তার? তার তো শুধু গলাটা আর সেটাই কিনা আমূল বদলে যাচ্ছিলো। বাড়িতে কেউ এলেই লুকিয়ে পড়ছিলো রফিক। আবুচাচা এলো আম্মির সঙ্গে কথা কইতে। সকাল তখন ১০টা। বাইরে রোদ ঝিলিক মারছে। রফিক একলাফে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে উঠে গেল। ছাদে উঠলে মোহল্লাটা স্পষ্টাস্পষ্টি হয়ে যায়। বসন্ত চলে যাচ্ছে শহর থেকে। উত্তাপ বাড়ছে অথচ তাপ বাড়ছে না। রফিক দেখলো পাশের বাড়ির সুহানিআপ্পাকে ওর ছেলেরা ধরে ধরে ছাদে বসিয়ে দিচ্ছে রোদ পোহাবার জন্য। বসন্তের মলিন অভ্যাস রয়ে গেছে। রফিক ভাবলো গলা ছেড়ে  বলবে, 'রোদের তাত বেড়েছে ভাইজান। আপ্পাকে রোদে বসিয়ো না আর,' কিন্তু তার  পর স্বরভঙ্গের কথা মনে আসতেই চুপ করে গেলো। ইংরেজি ক্লাসে যাকে বলে 'ভয়েস চেঞ্জ', এ কি তাই? রফিকের গলার আক্টিভ ভয়েস কি? কি-ই বা তার  প্যাসিভ ভয়েস? সব বাক্যের ভয়েস চেঞ্জ হয় না, বলেছিলেন ইন্দিরামিস। যেমন 'রাম অতি সুবোধ বালক', 'Ram is a good boy' এই বাক্যের কোন প্যাসিভ ভয়েস হয় না। রফিকও তো ভালো ছেলে। তাও তার নামে কেন বাক্য রচনা হয় না ক্লাসে? ঠিক বুঝতে পারতো না রফিক।

সুহানিআপ্পা ছাদে বসে আছে। ঠিক করে কথা বলতে পারে না আপ্পা। রফিককে দেখে হাত নাড়লো। আগে আপ্পা ভারী সুন্দর গান করতো। ছোট্ট রফিক শুনেছে। বছর তিনেক আগে মাথায় কি যেন হলোমগজের আক্রমণ। স্বরনাশ হলো। নিজে  থেকে হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে গেলো। রফিক আবারো আপ্পাকে কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো। তার গলা দিয়ে এখন চার পাঁচ রকমের আওয়াজ বেরোচ্ছে। গলা ভাঙা থেকে কি আরো অনেক কিছু ভাঙা শুরু হলো? এই তো সেদিন ইস্কুলে একটা  ছেলে রফিককে বললো, 'এ বাবা তোরা গরু খাস? মা বলেছে, গরু খাওয়া পাপ। গরু খেলে মানুষ নরকে যায়। তুইও নরকে যাবি।' রফিকের মনে এই 'নরকে যাবি' কথাটা বারবার ঘুরঘুর করতো তারপর থেকে। দিনে-রাতে, বিশেষত ঘুমোনোর সময়। চোখ বন্ধ করলেই জাহান্নামের কালো আগুন তার চোখের ভেতরের পর্দায় ভেসে উঠতো। রফিক লক্ষ্য করেছিল আব্বু আম্মিও পাড়ায় বিফ রোল খেতে গিয়ে  'বিফ' কথাটা উচ্চারণ করে না। কি রোল আছে জিজ্ঞাসা করলে দোকানদার বলে: চিকেন, এগ আর কাবাব। বুঝতে দেরি হয় না কাবাব মানে বিফ কাবাব, কিন্তু তাও  'বিফ' বলে না। আব্বুও চাপা ভাঙা ভাঙা গলায় বলে 'কাবাব দাও।' সবারই কি স্বরভঙ্গ হলো নাকি? কেউ জোরে স্পষ্টাস্পষ্টি কথা কইতে ভয় পায় কেন?


সেদিন ভোরে রফিক একটা বাজে স্বপ্ন দেখলোবাইরে তখন ভোরের আজান। দেখলো জাহান্নামের নিকষ কালো অন্ধকার থেকে উঠে আসছে একটা অতিকায় গরু। তার কপালে লাল তিলক লাগানো রয়েছে আর সিঙে জড়ানো রয়েছে কমলা একটা কাপড়। গরুটা তেড়ে আসছে ওর দিকে। রফিক কথা কইতে পারছে না। তার স্বরভঙ্গ স্বরনাশের পথে চলে গেছে। গরুটা তার বুকে সজোরে ধাক্কা দিতেই স্বপ্নের মধ্যে চিৎকার করে উঠলো রফিক। যে গলাটা বেরোলো সেটা অচেনা হলেও স্বরভঙ্গের কয়েকমাসে এই প্রথম যেন সে চিৎকার করে কিছুটা স্বস্তি পেলো। আম্মি আব্বু এসে তাকে আদরও করলো খুব। আটটা বাজতে না বাজতেই ছাদে উঠলো রফিক। রোদটা আজ একটু মিহি। সুহানিআপ্পা বসে রয়েছে। রফিক আপ্পাকে সেলাম করলো। তার নতুন গলাটা এখন আর অতটা অচেনা অজানা ঠেকছে না তার কাছে। ইচ্ছে করলো আপ্পাকে একটা গান শোনাবে। কিন্তু এই নতুন হেঁড়ে গলায় কি  আর গান হয়? তাও গাইতে ইচ্ছে করলো। সুহানিআপ্পা নিজেই কয়েক বছর আগে অব্দি এই গানটা খুব গাইতো। 'এক অকেলা ইস শহর মে, রাত ঔর দোপেহের মে'... তারপর কি যেন... কি যেন...    

1 কমেন্টস্:

  1. আমি অর্জুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের এই গল্পটিতে যেমন একটিও বাতিলযোগ্য শব্দের উপস্থিতি নেই, অর্জুণের comment এও ঠিক তেমন একটাও অভ্রান্ত কথা নেই।

    উত্তরমুছুন