উত্তরকথা
(১০)
উত্তরের কোন কোন হাটে
হাটঘুরুয়া,পাগল কিসিমের মানুষের দেখা মেলে। তাদের চোখের সারল্যে বিশ্বভুবনের মায়া।
কি যেন খোঁজেন লোকমান পাগেলা! মাইল মাইল ব্যাসার্ধ জুড়ে বিশ তিরিশ হাটের সবাই তো
লোকমাঙ্কে চেনে। সব দোকানি তাকে চা গজা শিঙ্গারা পুরি খেতে দেয়। লোকমান তার সত্তর
পেরোন শরীরে বলিষ্ঠতা জাগিয়ে জাগিয়ে নদীর বালিতে ডুবে মরতে বসা অতিকায় হাতির গল্প
বলে যায়। সাহেববাড়ির ভূতেদের সাথে জুড়ে দিতে থাকে বড় বন্যায় ভেসে যাওয়া নাওগুলির কথা। ঝাম্পুরা কুষাণির গানের দলের কথা। লোকমানকে ঘুরে ধরে ভিড়। লোকমান নাচে দু এক পাক,আর গেয়ে ওঠে-
‘মাইওর মাও/আমার কালা
জামাই/ভালা নাগে না’
এইভাবে লোকমান নিজেকে নিজের
জীবনের ঢালেই গড়িয়ে দিতে দিতে কত কত মিথ ও কিসসার জন্ম দিতে থাকে। সে কিন্তু
জন্মান্তরের দিকেই হেটে যায়। কেননা এক একটা হাট তো তাকে এক এক জন্মের স্বাদ এনে
দেয়। উত্তরের বাতাসে হেমন্তের হিম জমলে সে শোনাতে থাকে গেরস্থবাড়ির ভোন্দা বিলাইএর
গল্প-
‘আজি কার বা বাড়ির ভোন্দা বিলাই
দুয়রত করিলেক হায় ম্যাও
আজি কার বা বাড়ির চিতিয়া বিলাই
আন্ধনঘরত সোন্ধাইল হায়’
রাতের আন্ধারে লোকমান তার বেঁচে থাকার সমগ্রটুকু নিয়েই
উড়াল্পঙ্খীর মতন নুতন কোন জীবনের দিকে, নুতনতর কোন হাটের দিকেই চলে যেতে থাকে।
(১১)
সোমেশ্বরীর উঠোন থেকে, এগিনা
থেকে বেরিয়ে এসে হলেশ্বর এখন ধনীবাড়ির হাতে
কেনা নয়া জাল। বিল থেকে অনেক বড় রুই আর কাতেলা ধরে আনতে হবে আজ। কেননা বাড়িতে
শাগাইসোদর আসিবে। বাড়ি আজি মেলাবাড়ির ঢক। আইতোত বাহির খোলানত ‘দোতোরা ডাঙ্গার’
পালাগানের আসর হবে। কেদারহাটের ক্ষীরোদ গীদালের দল আসবে। বেশ জমবে। কত কত মানুষের
কালো কালো মাথা। দোতোরা বাঁশিকরকার মাদকতায় রাত রহস্যময় হয়ে উঠতে থাকলেও, রহস্যকে
গীদালের গানে গানে নিয়ে যাওয়া হবে আরো আরো রহস্যের দিকেই। রাতপাখির ডাকের নিচে তখন
শুধু গান আর গান-
‘বাওকুমটা বাতাস যেমন ঘুরিয়া ঘুরিয়া মরে
সেই মতন মোর গাড়ির চাকা চলে পন্থে পন্থে
ও কি গাড়িয়াল মুই চলং রাজপন্থে’
আসন্ন রাত্রির গানের নাচের
কুহকঘোরে হলেশ্বর জালুয়া তার চলার ভঙ্গীতে একধরনের নাচই বুঝি এনে ফেলে। আর
ঝাঁপিয়েই পড়ে ধনীবাড়ির বড়বিলের শিথানে তার গান, তার বাদ্যসমেত-
‘ওরে আমতলি নদীতে ঝাম্পলি খেলাইতে
খসিয়া বা পড়িল বালির শিসের সেন্দুর রে’
(১২)
সেই মানসাইনদীর চরে চরে
ভাবনাবনে কাশিয়ার থোপে থোপে লুকিয়ে থাকা গুলা বাঘের দল, সেই অজানা ফরেষ্ট দিয়ে
সমস্ত যাতায়াতের পথঘাটগুলিতে, খাটু পাইকারের মহিষের বাথানে বাথানে, পুরনো
দিনকালগুলি যেন রাধাকান্তর ও কইকান্তর
সমস্ত দেখা ও না দেখার মহতি সমাবেশের ভিতর সেঁধিয়েই পড়তে থাকে। তাদের শরীরে তরুণ
দিনকাল ফের ফিরে আসতে চাইলেও তা তো আর সম্ভব নয়। এটা বুঝে যাবার পরে দুই বুড়ো
হাটের ফাঁকা অংশেই চলে যেতে চায়। বিড়ি ধরায়। তারা কি একা হতে চায়! জোতদারি আমলের
আলো অন্ধকারে ডুবে মরতে চায়। না কি স্মৃতির ঘোর থেকে ফিরে আসে সাঁঝবেলার ভাঙ্গা
হাটে, তামাকপাতা ও মরিচের চূড়ান্ত ঝাঁঝের কাছে। তাদের চোখের সামনে দুলতে থাকে মরচে
ধরা দোনলা বন্দুক, মানকাচরের ‘রাজার বেটির’ গানের জুলুস, গদাধরের আনারস বোঝাই
পানসি, রূপসীর দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারের ঘোড়া আর শত শত স্মৃতির কোরাস। হাট থেকে হাটে তাদের ব্যাপারী পাইকারের
কাছে ছুটে যেতে হয়। কিন্তু জীবনের পরতে পরতে কি এক স্মৃতির ঘের! যা থেকে বাকি জীবন
আর নিস্তার নেই। তাই জীবনের চিরায়ত সত্যের কাছে ফিরতে ফিরতে রাধাকান্ত ও কইকান্ত
আস্ত এক উত্তর জনপদের জীবন ইতিহাসকেই আষাঢ়
মাসের নয়া জলের সহজতায় খেপলা জালের বিশালতায় কেমন সাজিয়েই দিতে থাকে জনমভর--
‘কলসির পানি মাঝিয়ায় ঢালিয়া
কলসি হইল মোর খালি রে
হায় রে
কলসিতে নাই মোর পানি রে’।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন