কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

০৮ লিপিকা ঘোষ

ব্যালটলিপিকা ঘোষ




‘চল্লাম’
‘কোথায় আর যাবি?’
‘নো ম্যান ল্যান্ডে’
একটু চুপ করে থেকে ঋজু আবার জিজ্ঞেস করে ‘যাবি ই ?’
‘হ্যাঁ’
‘শোন্’
‘বল’ গুছোতে গুছোতে বলে তোর্সা ।
‘যাস না , থেকেই যা না হয় আমার সঙ্গে’
খুব অবাক-চুপ হয়ে থাকে তোর্সা কিছুক্ষণ । বোঝার চেষ্টা করে, এটা কি ঋজুর প্রবল অধিকার বোধের দাবি, নাকি মহুয়ার ঘোরে পাওয়া মৌ-নেশার প্রলাপ।
‘তুই ভালো লিখিস’ ঋজু বলে।
হাসে তোর্সা। জাস্ট ঘোর ছাড়া আর কিছু না। ‘ধুর, ওসব লেখা নাকি? ছাইপাঁশ’
‘যাস না’
তোর্সা কি থাকবে আরও কিছুক্ষণ? আরও কিছুদিন?
ছাপাখানার ঘুপচি আঁধারে ভ্যাপসা গরমের মধ্যে রাশি রাশি ব্যালট পেপার চেক করতে করতে ভিড় করে আসছে সে সব অতীত। চারপাশে সাদা, গোলাপী, হলুদ ব্যালট রাশি রাশি। সামনে ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের সর্ব-স্তরীয় প্রস্তুতিতে সহকর্মীদের সঙ্গে তোর্সাও লেগে পড়েছে। এ এক বিচিত্র পর্ব। সব চাপান উতোর শেষ হলে আর সময় থাকবে না ওদের।
আঞ্জুমানারা খাতুন বিবি, ফুল্লরা মন্ডল, সুরুজ্জামান সেখ... পর পর প্রার্থীদের নামের তালিকা চেক করে চলেছে নিশ্বাস ফেলার থেকেও দ্রুত গতিতে।
ব্যালট পেপার নম্বর অনুযায়ী সাজানোটা শেষ থেকে শুরু, না শুরু থেকে শেষ, তা নিয়ে জোর বিতর্ক তুলেছিল তোর্সার এক সহকর্মী ভাই পলাশ। তোর্সার অভিজ্ঞতা বড়ই কম। ও শুধু ভাবছে, শেষ থেকে শুরু আর শুরু থেকে শেষ যা-ই হোক না কেন, ‘শুরু’ আর ‘শেষ’টা তো রইল। ব্যালট আর ব্যালট চারদিকে। প্রশাসনিক ঘেরাটোপের মধ্যে ওরা ক’জনা দম ফেলার আগে কাজ শেষ করছে। তোর্সা গুনে চলেছে রূপনগর ১, রূপনগর ২, রূপনগর ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ বুথের ব্যালট। এরপর বাক্সবন্দি করে সব ব্যালট চলে যাবে পদ্মা-পাড়ে। সেখানে পদ্মার ভাঙ্গন, সেখানে পদ্মার পানি, সেখানে চর জেগে রয়। ভয় হয় তোর্সার, ও পানিতে আগুন লাগবে না তো, ও পানিতে লহু মিশবে না তো! ‘দিদিমনির মন কোনদিকে?’ আদিত্যদা জিজ্ঞেস করে মাঝ থেকে। ঠিক টের পেয়েছে। উত্তর দেওয়ার আগেই চৌধুরীদা ধমকে ওঠে, ‘লাঞ্চ করবে না তোর্সা?’
‘নাহ, আপনারা যান’
‘রাখো তোমার ব্যালট পেপার গোনা’, ধমকে ওঠেন।
এ ধমকে একটা স্নেহ জড়িয়ে আছে।
তোর্সা বারবার মোবাইল খুলে দেখছে কোনো মেসেজ এল কিনা –- “মোবাইল খোল্, কল রিসিভ কর্”। তোর্সার মোবাইলে কল ডাইভার্ট করা থাকে একটা সুইচড অফ নম্বরে। ঋজু বিরক্ত হয়ে এই এক মেসেজ করতে থাকতো। নাহ, কোনো মেসেজ নেই। ধমক খেয়েও তোর্সা ওঠে না। ‘আমি পরে লাঞ্চ করব, আপনারা খেয়ে আসুন’
‘থাকো পড়ে’, গজগজ করতে করতে গাড়িতে গিয়ে বসেন চৌধুরীদা। তোর্সা হাসে।
পঞ্চায়েত ভোটের পরই যদি তোর্সা সত্যিই কোনো নো ম্যান ল্যান্ডে চলে যায় আর ফিরে না আসার জন্য!
‘তুই যেখানেই যা,আমি ঠিক খুঁজে নেব তোকে, গিয়ে দ্যাখ’, ঋজুর জোরালো দাবি।
হাসে তোর্সা। একটু তাহলে থেমেই থাকুক ও, ভেবেছিল। থেমে থাকতে থাকতে কখন কত দিন পেরিয়ে, বছর পেরিয়ে কত সময় বয়ে গেছে। তোর্সা টেরও পায়নি।
যখন টের পেল, তখন তোর্সা সত্যিই এক নো ম্যান ল্যান্ড-এ দাঁড়িয়ে। এই ছাপাখানা, রাশি রাশি ব্যালট, সহকর্মীদের হৈ হৈ রৈ রৈ, ওই ঘূর্ণি লাগা পদ্মার পানি, বি এস এফ ক্যাম্প, সব কিছুর মধ্যেই তোর্সা এক নো ম্যান ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। তার বেদম হাসি পায়। ব্যালট ব্যালট, অন্তহীন ব্যালট গুনে চলেছে সে। গুনতে গুনতে তোর্সাও হঠাৎ একটা ব্যালট হয়ে গেল। মেরুন পাড় সাদা শাড়ির এক আশ্চর্য ব্যালট। এক মানুষ বিহীন দ্বীপে উড়ছে সে। সে-ই ব্যালট, সে-ই প্রার্থী, ভোটার কই?
ছাপাখানার বৃদ্ধ মালিক হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছেন, ‘ সিস্টার নিবেদিতা, তুমি কোথায় উড়ে চলেছো, তুমি তো ব্যালট। বাক্সবন্দি হও। তোমার উড়তে মানা’।
তোর্সা হাসে। এ ব্যালটের উড়তে মানা নেই, ছিঁড়তে মানা নেই, পুড়তে মানা নেই। নো ম্যান ল্যান্ডে উড়ছে ব্যালট।
উড়ুক তবে, মেরুন পাড় সাদা শাড়ির এ ব্যালট অন্তহীন উড়ুক...!





0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন