কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

০১ অমিতাভ প্রামাণিক

চারানা-আটানা
অমিতাভ প্রামাণিক



১ ব্যাকরণ
ব্যাকরণ বিষয়ে আমি যে কিছু লিখিব, এত জ্ঞান আমার নাই। বস্তুত সুমিত যখন আমাকে কালিমাটি পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় একটি করিয়া সরস লেখা দিবার জন্য ধরিয়া পড়িল, আমার ভিতর তৎক্ষণাৎ এই আশঙ্কার পরশপ্রাপ্তি হইল, যাহার প্রতি সরস্বতী বিরূপ, যাহার ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান নাই, সে কী করিয়া হরষপূর্ণ লেখা লিখিবে? গাঁইগুঁই করিয়া এড়াইয়া যাইবার তালে ছিলাম, কিন্তু সুমিতও নাছোড়বান্দা। সুতরাং স্থির করিলাম, ক্ষতস্থানে আঘাত করিয়াই শুরু করা যাউক, রস গড়াইবে হয়ত। অর্থাৎ, ব্যাকরণ।

কবি বলিয়া গিয়াছেন, ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’। ইহা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা মরিতে বসিয়াছে, কিছুকাল পূর্বে ‘আমরি’ নামক কলিকাতাস্থ চিকিৎসালয়ে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে, বোধকরি তাহাতে বিশেষভাবে দগ্ধ অর্থাৎ বিদগ্ধ হইয়া। আপনারা নিরীক্ষণ করিতেছেন, অদ্যকার স্বভাব-প্রতিবাদী বঙ্গবাসী মনুষ্যসন্তান মাতৃভাষা ভুলিতে বসিয়াছে, অথচ বিদেশী ভাষা যে কিছু উত্তমরূপে আয়ত্ত করিতেছে, তাহা প্রতীয়মান হয় না। রাস্তাঘাট হইতে মসনদ, সর্বত্র প্রতিবাদ করিয়া যাহারা দিন গুজরান করিতেছে, তাহারা প্রতিবাদ শব্দটিকেও শুনিতেছি ‘পতিবাদ’ বানাইয়া লহিয়াছে। মার্ক্স ও গান্ধীর নীতি যদি যথাক্রমে মার্ক্সবাদ ও গান্ধীবাদ হয়, তবে পতিবাদ নিঃসন্দেহে পতি-র নীতি। কিন্তু যাহারা পতি বিষয়ে অনভিজ্ঞা, তাহাদের ভাষ্যেও পতিবাদের ছড়াছড়ি। 

মাতৃভাষারই হাল এইরূপ, তবে অন্য ভাষায় দক্ষতা কিরূপ হইবে তাহা সহজবোধ্য। রাজভাষা শিক্ষা সহজ নহে, উচ্চারণ অতিশয় কঠিন, তাহা বঙ্গসন্তান দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর ইংরাজী বাক্যালাপেই পরিস্ফুট হয়। কী করিয়া হইবে? যে ভাষায় পি ইউ টি পুট, অথচ বি ইউ টি বুট নয়, বাট, তাহার শিক্ষা কি যাহার তাহার কর্ম? জি ডাব্‌ল্‌ ও ডি হইল গুড, অথচ ডি ডাব্‌ল্‌ ও আর ডুর নহে, ডোর, আবার পি ডাব্‌ল্‌ ও আর পুরও নহে, পোরও নহে, পুওর। কী ঝঞ্ঝাট! এই ভাষায় ‘হাউ ডু ইউ ডু’ শব্দের অর্থ ‘আপনি কেমন করিয়া করেন’-এর পরিবর্তে ‘আপনি কেমন আছেন’। অর্থাৎ যাহা বলা হয়, তাহা ‘মীন’ করা হয় না। আমাদের ভাষায়, ভদ্রলোকের এক কথা। সুতরাং এই দুরূহ ভাষা হইতে সপ্তহস্ত দূরে অবস্থান করাই বুদ্ধিমানের কাজ, বঙ্গজরা তাহাই করিয়া থাকে।

সহজ পাঠ দ্বারা বাংলা শিক্ষা শুরু হয়, সুতরাং বাংলা সহজ, বাংলায় এই সকল সমস্যা নাই। এই রকমই ভাবিয়াছিলাম, কিন্তু হায়, সে ভাবনাও ঠিক নহে। দেখিলাম, কবি বলিয়াছেন, ‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর’। এই ধরম হইল ধর্ম, এই করম হইল কর্ম। বাংলা গ্রামারের চটি বহিতেও লিপিবদ্ধ আছে ইহা হইল চরম তুচ্ছ ব্যাকরণ, সর্বজনজ্ঞাত। তথাপি চরম মানে চর্ম নয়। কী অদ্ভুত, গড়বড় কেস!

চর্ম হইতেছে চামড়া। অথচ দামড়া ছেলেটিকে দর্ম বলিয়া সম্বোধন করিবার উপায় নাই। রাজ্যে কর্ম অপ্রতুল, কর্ম লইয়া কামড়াকামড়ি চলিতেছে বেশ কিছুকাল যাবৎ, কিন্তু কর্ম এবং কামড়া সমার্থক নয়, কামরা তো নয়ই। চর্মকে অনেকে চাম বলিয়া থাকেন, ঘাম যেমন ঘর্ম। কিন্তু আমকে অর্ম বলিলে বর্ম পরিয়া রে রে করিয়া তাহারাই উদ্যতখড়্গ হইবেন, সে বর্মও রাজনৈতিক সংগঠন বা ক্ষতস্থানে লাগাইবার ‘বাম’ নহে। আম হইল আম্র। তবে কি মধুময় সেই তামরস তবে তাম্ররস? না। তাম্র হইল গিয়া তামা। সেইজন্য মামাকে মাম্র বা জামাকে জাম্র বলিলে লোকে নিরক্ষর বলিবে, বলিবে ইহার তাল নাই। সংস্কৃতে ‘তমালতালিবনরাজিনীলা’র তালি বাংলায় হইল তাল, লোকে আজকাল জালি করিতেছে, তাহা যেমন জাল, গালি দিলে যেমন গাল দেওয়া হয়। কিন্তু মুখের গাল যদিচ গণ্ড, গৃহিণী চণ্ডমূর্তি ধারণ করিলে তাহাকে চাল বলা যায় না, যাহারা ভণ্ড তাহাদিগকে ভাল বলিলে ঠিক হইবে না। অধিকতর গুবলেট কেস!

বাল্যে আমরা যখন বাংলা পাঠাভ্যাস করিতাম, তখন পরীক্ষায় বিবিধ প্রশ্নাবলির একটি ছিল একই উচ্চারণবিশিষ্ট দুইটি শব্দের অর্থের পার্থক্য প্রদর্শন। একবার পরীক্ষায় আপন ও আপণ শব্দদ্বয়ের পার্থক্য নিরূপণের উপর প্রশ্ন আসিল। পরীক্ষাভবনে আমার এক বন্ধু দূর হইতে আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর বলিবার জন্য সঙ্কেত করিতে লাগিল। আমি ভাবিলাম আপন শব্দের অর্থ সে নিশ্চয় জানিবে, তাই আপণ শব্দের অর্থ যে দোকান, তাহা বুঝাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। জোরে শব্দ উচ্চারণ করিলে শিক্ষক মহাশয়ের কর্ণগোচর হইবে, উনি আমার কর্ণ পাকড়াইয়া হল হইতে নিস্ক্রমণের রাস্তা দেখাইয়া দিবেন, এই ভয়ে হাঁ করিয়া ওষ্ঠাধর প্রকম্পিত করিয়া যথাসাধ্য দোকান বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম। সে কিছুতেই বোঝে না। বাধ্য হইয়া দুইটি অঙ্গুলি ও কান প্রদর্শন করিয়া চুপি চুপি কহিলাম – দো কান। সে এতক্ষণে বুঝিল। খাতায় লিখিয়া আসিল, আপণ শব্দের অর্থ দুইটি কর্ণ!

ভুল বুঝিলে শব্দের অর্থের হানি হয়, ইহা স্বাভাবিক। কিন্তু আজকাল এস এম এসের যুগ, সমস্ত কিছু সংক্ষেপে ব্যক্ত করিবার যুগ। এই সংক্ষেপকরণ সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপণে, বিশেষ করিয়া পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপণে বহুকাল ধরিয়া প্রচলিত। ‘অস চলিবে’র অর্থ যে অসবর্ণ বিবাহে আপত্তি নাই, বা ‘কে স চা’-র অর্থ যে কেন্দ্রীয় সরকারে চাকুরিরত বা -রতা, তাহা বিশদে বলিবার প্রয়োজন নাই আর। তথাপি কিয়ৎকাল পূর্বে একটি বিজ্ঞাপণের বর্ণনায় বিশেষ চমৎকৃত হইয়াছিলাম। পাত্র-পাত্রী কলমেই বিজ্ঞাপণ ছিল – “সুন্দরী, শিক্ষিতা পাত্রীর জন্য উপযুক্ত পাত্র চাই। পাত্রী ৩২ ব্রা পরা কন্যা, নিয়মিত মাসিক ২৫, হাতে হাজা উঃউঃ”। যাহারা এই বিবরণে যুগপৎ বিস্মিত ও উত্তেজিত হইতেছেন, তাহাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, ৩২ কোন সাইজ নহে, বয়ঃক্রম। ব্রা পরা কন্যা হইল জাতিতে ব্রাহ্মণ, পরাশর গোত্র, কন্যারাশি-র সংক্ষিপ্ত রূপ। নিয়মিত মাসিক ২৫ হাজার টাকা আয়, তদুপরি হাতে হাজার টাকার উপরি উপার্জন, এই হইল পরবর্তী অংশের অর্থ। আপনারা বোধকরি অন্য কিছু ভাবিতেছিলেন!

যাহা লেখা হয়, তাহাই ‘মীন’ না করার তালিকায় বাংলা আপ্তবাক্যের সংখ্যা কম নহে। এ বিষয়ে নূতন-পুরাতন বহু গল্প চালু আছে। আমি একটি স্ব-অভিজ্ঞতালব্ধ ঘটনা ও একটি শ্রুত কাহিনী পেশ করি। 

ঘটনাটি সেই সতীর্থকে লইয়া যে দুইটি কর্ণ ব্যবহার করিয়াও আপণ শব্দের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করিতে পারে নাই। পরবর্তী জীবনে সে কাব্যরচনায় প্রয়াস পাইয়াছিল, কিন্তু সে পৃথক কাহিনী। সম্ভবতঃ নবম শ্রেণীর ষাণ্মাষিক পরীক্ষায় প্রশ্ন আসিয়াছিল, ‘খয়ের খাঁ’ শব্দবন্ধ দ্বারা বাক্য রচনার। ষাণ্মাষিক পরীক্ষার উত্তরপত্র ছাত্রদিগকে ফেরত দেওয়া হইত, এই স্থলে দিবার পূর্বে গুরুমহাশয় তাহার উত্তরপত্র খুলিয়া ক্লাশে পাঠ করিয়া শুনাইলেন। সে লিখিয়াছে, ‘পান খেয়ে তোর মুখটা ঠিকমত লাল হয়নি, তুই আর একটু খয়ের খাঁ’!

শ্রুত গল্পটি যে আপ্তবাক্য লইয়া, তাহা হইল, ‘সাবধানের মার নেই’। এইস্থলে উত্তরকর্তা সৃজনীশক্তির চরম নিদর্শন প্রয়োগ করিয়া লিখিয়াছে, ‘সাবধানের বাবার মুখভর্তি গোঁফদাড়ি, কিন্তু সাবধানের মার নেই’!

ছাত্রছাত্রীরাই ভবিষ্যতের নাগরিক। তাহাদিগের ভুল উত্তর লইয়া হাস্য অনুচিত। হাস্য করিতে হইলে তাহা লইয়া করাই যুক্তিযুক্ত যাহারা ভবিষ্যতের নাগরিক বানাইবার জন্য ভারপ্রাপ্ত। কিন্তু তাহাদের কার্যাবলি নিরীক্ষণ করিলে প্রথমেই যে আপ্তবাক্যটি স্মরণে আসিবে, তাহা হইল, ‘পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়’।

দুর্ভাগ্যক্রমে আপামর বঙ্গসন্তান ইহাকেও শাশ্বত সত্য হিসাবেই মানিয়া লহিয়াছে। সত্য, পাগল বাক্যবাগীশ, তাহার পক্ষে শ্রবণযোগ্য ও অশ্রাব্য সকল ভাষাতেই অজস্র বাক্যবর্ষণ সম্ভব। যদিও প্রকৃত পাগলের কণ্ঠে আমি অদ্যাপি মন্দাক্রান্তা, মেঘনাদবধ কাব্য, নাইজেরিয়ার পর্যটন ব্যবস্থা, মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ, ডারুইন তত্ত্ব, গ্লোবাল ওয়ার্মিং থিওরি – প্রভৃতির কিছুই শ্রবণ করি নাই। ভাবিয়া দেখিলে এইরূপ প্রতীয়মান হয় যে, এই সকল বিষয়াদি পাগলের পাগলামির মহৌষধ হিসাবে বিবেচিত হইতে পারে। হয়তো এই কারণেই বাল্যকালে এই সকল গুরুত্বহীন বিষয়ের কিয়দংশ পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে, যাহাতে বালক-বালিকাগণ শিক্ষিত হউক না হউক, অন্ততঃ সম্পূর্ণরূপে পাগল হইবে না।

পাগলের পাগলামি হইতে ছাগলের ছাগলামির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাউক। ছাগল সর্বভুক, ইহাও সর্বৈব মিথ্যা। ছাগল তৃণভোজী, সে চিকেন, মাটন, বীফ, পর্ক, মৎস্য, ডিম্ব প্রভৃতির কিয়দংশও স্পর্শ করে না, ভক্ষণ তো দূরের কথা। বিপাকে পড়িয়া কদাচিৎ সে প্লাস্টিকের প্যাকেট, পূজা সংখ্যার দেশ, হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপ, শাড়ির আঁচল, শিশুর ডায়াপার বা বাজারের ফর্দের ন্যায় সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য গলাধঃকরণ করিয়া থাকে সে কথা সত্য। কিন্তু সাধারণভাবে তৃণ ও পনসপত্রের প্রতিই তাহার মনোযোগ বেশি ন্যস্ত থাকে। এ বিষয়ে সে মনুষ্যের ন্যায় খুঁতখুঁতে নহে। যে সকল মনুষ্য পনস বা কাঁঠাল আগ্রহ লইয়া ভক্ষণ করে, তাহারাও হয় খাজা নতুবা রসালো, এই দ্বয়ের একটিকেই অধিকতর পছন্দ করে। ছাগবৎস কাঁঠালপত্র পাইবামাত্র উদরস্থ করে, তাহা খাজা না রসালো কাঁঠালের পত্র, ইহা পরীক্ষা করিবার প্রয়োজন বোধ করে না। 

শুধু এই কারণেই ছাগকে সর্বভুক বলিয়া গালি দেওয়া অতিশয় অন্যায্য। হিন্দুগণ গো-জাতিকে লইয়া প্রয়োজনের অধিক মস্তকে তুলিয়া নৃত্য করে, অথচ ছাগকে গালি দেয়। সম্যক অবলোকন করে না, ছাগল গরু অপেক্ষা অধিকতর সংস্কৃত প্রাণী। তৃণ, কাঁঠালপত্র, পালং চারা, প্লাস্টিক, আনন্দবাজার রবিবাসরীয়, সে যাহাই ভক্ষণ করুক, পশ্চাদ্দেশ হইতে হজমোলার গুলির ন্যায় সমান মাপের ট্যাবলেট নিস্ক্রমণ করিয়া থাকে। ছাগলের নাদি অনাদিকাল হইতেই প্রযুক্তির এক অসীম বিস্ময়। গরু হাজার জীবনেও এইরূপ গোবর ক্যাপসুল প্রদানে অক্ষম। সে ক্ষমতা যদি তাহার থাকিত তবে বড় বৌ ও মেজ বৌ-তে মিলিয়া ঘরের প্রাচীরে ঘুঁটে দিবার প্রয়োজন অনুভূত হইত না।

ছাগের প্রতি এই বিমাতৃসুলভ আচরণ শুরু হয় প্রাথমিক বাংলা পাঠাভ্যাসের শুরু হইতেই। প্রথম পৃষ্ঠাতেই শিশুদিগকে শিক্ষাদান করা হয়, ‘অ-এ অজগরটি আসছে তেড়ে’ বলিয়া। আপনারাই বলুন, কয়টি শিশু বাল্যে অজগর দেখিবার সুযোগ পায়? যাহাদের অজগর কী, সে সম্বন্ধে কোন ধারণাই নাই, তাহাদিগকে প্রথম হইতে এইরূপ কুশিক্ষা প্রদানের জন্যই ভবিষ্যতে তাহারা রাজনৈতিক নেতা বনিয়া অজগরের ন্যায় সর্পিল হইয়া জনগণের প্রতি ধাবমান হয়। অজগরের অর্ধেক হইল অজ অর্থাৎ ছাগ, যাহা বহু শিশুদিগের নিকট অতিপরিচিত প্রাণী, যাহা ক্ষুদ্রতর শব্দ, যাহার উচ্চারণ অজগর অপেক্ষা সহজতর। অজকে উপেক্ষা করিয়া অজগরকে প্রাধান্য দেওয়া বাংলা শিক্ষার এক চরম ভুল, ইহা অস্বীকার করিলে বলিতে হইবে বঙ্গবাসীর চর্ম পুরু। 

বাংলা ছাড়িয়া ইংরাজীতে দৃষ্টিপাত করা যাউক। রাজভাষায় আলোকপ্রাপ্ত মনুষ্য গরু অপেক্ষা ছাগলের সহিত নিজেকে অধিকতর সন্নিবিষ্ট জ্ঞান করে বলিয়াই আপন এবং অপরের সন্তান-সন্ততিদিগকে ‘কিড্‌’ বলিয়া সম্বোধন করে। অভিধানে স্পষ্ট লিখিত আছে, কিড শব্দের আক্ষরিক অর্থ ছাগবৎস। এক্ষেত্রে মনুষ্য-ছাগ মিলিয়া মিশিয়া একাকার। বালক-বালিকাদিগকে ‘কাফ’ জাতীয় সম্বোধন অদ্যাপি কর্ণগোচর হয় নাই। সুতরাং ইংরেজ মতে গরু আউট, ছাগল ইন। এই অতিরিক্ত জ্ঞানের সুবাদেই তাহারা বঙ্গভূমি দখল করিয়া দুইশত বৎসরকাল শাসন করিয়াছিল বলিলে অত্যুক্তি হইবে না।

বস্তুত গরুর নিকট হইতে অর্থহীন হাম্বা-হাম্বা জাতীয় উৎকট বলিউডি সঙ্গীতের লিরিক ব্যতীত আর বিশেষ কিছুই মনুষ্য লাভ করে না। যদিচ মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সহিত তুলনা করিয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আজকাল ফিগার-সচেতন বঙ্গমাতা আপন সন্তানের জন্য মাতৃদুগ্ধপান অপেক্ষা ফর্মূলা মিল্কের উপরই বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করিতেছেন। মাতৃদুগ্ধের অভাবে শিশুর মাতৃভাষার শিক্ষাও সম্যক লাভ হইতেছে না। যাহারা ফর্মূলা সংগ্রহে অক্ষম, তাহারা গোদুগ্ধ পান করাইয়া থাকেন, ফলে শিশুটি বড় হইয়া গরুতে পরিণত হয়। হয় ষাঁড় হইয়া অন্য গরুর প্রতি ধাবমান হয়, অথবা গরু হইয়া ষাঁড় দ্বারা নির্যাতিতা হয়, সংবাদপত্রে নিয়মিত আপনারা তাহা পাঠ করিতেছেন। গোদুগ্ধ অপেক্ষা ছাগদুগ্ধ অধিক উপকারী জ্ঞান করিয়াছিলেন মহাত্মা গান্ধী, রোজ প্রাতে এক ঘটি ছাগদুগ্ধ পান না করিলে তিনি সত্যাগ্রহে মনোনিবেশ করিতে পারিতেন না। ছাগের প্রতি বিরূপতার কারণেই সত্যের প্রতি আগ্রহ অদ্য স্থিমিত, যৎপরোনাস্তি ভুল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য দ্বারা জনগণকে বিভ্রান্ত করিয়া ভোটপ্রার্থনায় ব্যস্ত আজ নেতৃবৃন্দ, তাহা আপনারা নিঃসন্দেহে স্বীকার করিবেন।

কিন্তু ইহা হইতেও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হইল ছাগধ্বনি। অজগণ ব্যা-অ্যা-অ্যা-অ্যা-অ্যা করিয়া যে শব্দ বায়ুমণ্ডলে ধ্বনিত করে, তাহাতে হিন্দুস্তানী ও কর্ণাটিক বেশ কয়েকটি রাগ-রাগিনীর মিশ্রণ বর্তমান, যাহার কিয়দংশও হাম্বা’তে নাই। শুদ্ধ ব্যা-এর উপরেই ছাগ শব্দমালা, স্বর ও ব্যঞ্জন লইয়া স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। ব্যা-ধ্বনি শুদ্ধ না হইলে ছাগমাতা আপন বৎসকে পুনঃপুনঃ তাহা রিহার্সাল করাইয়া শুদ্ধ করিয়া দেয়। 

ইহাই ব্যা-করণ। যতই ছাগকে অবজ্ঞা করিয়া ‘ছাগলে কী না খায়’ বলিয়া থাকুক, মনুষ্যও ছাগের ন্যায় ব্যাকরণচর্চা প্রক্রিয়াতেই আপন ভাষা শুদ্ধরূপে শিক্ষা করিবার প্রয়াস পায়।  

2 কমেন্টস্:

  1. অনেক দিন মন খুলিয়া হাসি নাই। বস্ততঃ সমগ্র বিশ্বে বর্তমানে যে হরিবোল চলিতেছে তাহাতে রামগরুড়ের ছানা হইয়া যাইবার প্রবনতাই বেশি। উইট,হিউমার ও স্যাটায়ার মিশ্রিত অসাধারণ পরিবেশনটি হাতেপাতে গলাধঃকরণ করিয়া অমিতাভ আপনার নিকট আমার চাহিদা বাড়িয়া গেল। হাসিই সর্ব-রোগহরা ঔষধ, বুঝিলাম। ধন্যবাদ জানাই প্রামাণিক মশাই ও সেইসংগে সম্পাদককে। নীতা বিশ্বাস।

    উত্তরমুছুন
  2. আননদ লাগলো, বাংগালী হোয়ে আবার জনমাব

    উত্তরমুছুন