ধারাবাহিক উপন্যাস
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
(৯)
-কত সহজ এই খেলাধূলো! আলো-আঁধারিতে
জীবন-মৃত্যুর খন্ড সীমায় দাঁড়িয়ে যে কাঁধটাকে শক্ত মনে হয়েছিল, মাথা রেখে ঘুমোনো
গেছিল,
সেই কাঁধটাই ধরে নেওয়া যাক আছেই হয়ে যায়।
বিড়বিড় করছিলাম। অনেকটা মদ খেয়ে রাতের সমুদ্রের
ধারে। সঞ্জয় হাতে জপের মালাটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিল।
-এক মেয়ের সঙ্গে যাচ্ছিলাম হেঁটে হেঁটে।
খুব ঘন হয়ে, নিবিড় হয়ে
হাঁটছিলাম আমরা। হঠাৎ রাস্তাতে চেনা আরেক পুরুষ ডাকল। আমি তার সঙ্গে কথা
বলতে শুরু করলাম, সে আমার
কাঁধ হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। আর মেয়েটির সামনে একটি চলমান রিক্সা দাঁড়াল। তাতে তার এক
অফিস কলিগ। মেয়েটি উঠে পড়ল রিক্সাতে। ওরা চলে যেতে
থাকল। আমি বললাম ‘এ
কি, ওর সঙ্গে
কোথায় যাচ্ছ?’বলল, ‘আরে আমার কোনো বন্ধু থাকতে
পারে না নাকি?’বুঝলাম
গোটা খেলাটাই সাজানো। ওই কলিগের সঙ্গে যাবে বলে আমার চেনা লোকটিকে ওই এনেছে। আমি
বললাম, ‘সাজানো
খেলা। তাহলে তুমি আসলে এমনই! আমিই ভুল করেছিলাম’। বলল,
‘সব
সময় তোমাকেই খেলতে নিতে হবে নাকি?’আমার
কানে বেজে উঠলো আরেকদিনের কথা। ওরা বেড়াতে যাচ্ছিল। আমাকে লুকিয়ে। যেতে চেয়েছিলাম।
বলেছিলাম,‘সব
কিছুতে জুড়তে চাই। তোমার সুখে,
দুঃখে থাকতে চাই’।বলেছিল,‘ডাক্তার
দেখাও। সাইকো হয়েছ তো! আমার নিজের স্পেস থাকবে না?’স্পেস! চমৎকার শব্দ। তার মধ্যে
সব ভাণ, ভন্ডামিগুলোকে
ঠেসে দিলে চমৎকার খেলার পুতুল। প্রেম-দাম্পত্য খেলবে। আর তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল। এই
নিয়ে চার মাস হয়ে গেল, আমি ঘুমোতে পারি না একটানা দু’ ঘন্টাও। আমি কি পাগল হয়ে যাব?
সঞ্জয় যেন নেই। ঢেউ-এর শব্দ আছে শুধু।
জপের মালাটা হাতে নিয়ে বসেছিল। থম মেরে আছে। সুনীল কিছুটা দূরে একা একা পায়চারি
করছে। আত্রেয়ীর বাবা হোটেলের বারান্দায় বসে স্কচ খেতে খেতে সমুদ্র দেখছে। আত্রেয়ী
আমার পাশে শুয়ে আছে। আমার কথা শেষ হতেই শার্টের পেছনদিকটা ধরে টানল। আমি আচমকা
টানে পেছনে গড়িয়ে যেতেই চেপে বসলো আমার উপর। চুলগুলো হাওয়ায় দুলছে। অন্ধকার বলে
তার সব ভাঁজ আমি দেখতে পাচ্ছি না। দিনের বেলা হলে নির্ঘাৎ ওর কোঁকড়ানো চুলগুলো
হাওয়ায় এক থোকা ফুলের মতো শিউড়ে শিউড়ে উঠছে দেখতে
পেতাম। অবশ্য এত দ্রুত গতিতে যদি আমার মুখ চুলে ঢেকে যেত তাহলে আমি ঠোঁটের নরম
স্পর্শ ছাড়া কিছুই পেতাম না। সঞ্জয় এখনো সমুদ্রে মগ্ন। অথবা মদে ও ডুবে গেছে।
অথবা...!
-ক্যানভাস জুড়ে একটা x আঁকব। দুটো রেখা
একবারই একে অপরকে বিদ্ধ করে চলে গেছে। আর মিলবে না, কিন্তু
বিদ্ধ করাও থেকে যাবে।
আত্রেয়ীর চুমুর মধ্যে ডুবে যেতে যেতেও আমি
সঞ্জয়ের কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম। সুনীল কখন যেন চলে এসেছে একেবারে আমাদের ঘাড়ের
কাছে। আমাদের ঠিক মাথার উপর
থেকে বলল,
-ওরা কি পরস্পরকে বিদ্ধ করছে?
সঞ্জয় শুধু ঘাড় নাড়লো।
-কাকে বলে বিদ্ধ করা?
-ব্যথা দেওয়াকে বলে।
-আনন্দকে না?
-না। আনন্দ নশ্বর, ব্যথা শ্বাশ্বত। আনন্দ
চলে যায়, ব্যথা থাকে।
আত্রেয়ীর স্তন ছোট, কিন্তু ঠাসবুনোট।
হাতটা টেনে নিয়েছিল। হাতের পাঞ্জার মধ্যে গলে যাচ্ছিল। মাথার উপর ভাসছিল তারাবোনা
মহাজাগতিক আকাশ। পায়ের কাছে সমুদ্র। সঞ্জয় আর সুনীলের সিম্ফোনি আশেপাশে বাতাসে
ঘুরছিল। গুমরোচ্ছিল। বাতাস যেন থম মেরে ছিল। নিম্নচাপ হয়েছে।
-ব্যথাকে আমি উপড়ে ফেলে দিতে গেছিলাম। আমি, কৌরবাকী এবং মিত্রট
তিনটি বিন্দু। কৌরবাকী আমাকে টেনে রাখতে চেয়েছিল। মিত্রটকে ছাড়তে চায়নি। আমি
কৌরবাকী ছাড়া অন্য কিছু চাইনি।
-যুদ্ধ?
-কৌরবাকী এলো
না কেন? কেন আমাকে
ভা্লোবাসতে
গেল? বলেছিলাম
আমি? আমাকে টেনে আনার ফল ফলবে না?
-চাওনি?
-চেয়েছি অনেক কিছু জীবনে। সব পেয়েছি?
-কেড়ে নিয়েছ তো! সিংহাসন?
-নিয়েছি। সিংহাসন কেড়েই নিতে হয়।
-হত্যাও করতে হয়!
-আমি হত্যা না করলে সুষীম করত! সুষীম আমার
চেয়ে কোনো অংশে ভালো
ছিল বলে মনে হয় তোমার? তাই যদি
হবে তাহলে তক্ষশীলায় প্রজাবিদ্রোহ থামাতে আমাকে যেতেহলো
কেন? শাসক
হিসেবে আমি যদি তার চেয়ে উন্নত না হয়ে থাকি তাহলে সে বিদ্রোহ দমন করা এবং সুশাসন
প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল?
-জানি না। আমি রাজা-টাজা কিছু নই।
-তাই জান না। ঠিক-ই। বিপুল সম্পদের সঙ্গে
আসবে বিপুল রক্তস্রোত। দৃষ্ট বা অদৃশ্য। এর কোনো ব্যতিক্রম হয় না।
ওরা কথা বলছিল। সমুদ্র-ও বলছিল ঢেউ-এর
ভাষায়। আমি আর আত্রেয়ী আরো কিছু দূরে অন্ধকারে বালি খুঁড়ে খুঁড়ে জল আনার চেষ্টা
করছিলাম। দুটো শরীর পরস্পরকে বিদ্ধ করে তবু স্পেস-এ ভাসছে। অসহায়! কেউ কাউকে
অবলম্বন করতে পারছে না।
-ক্ষমা শব্দটাকে চেনো অশোক?
-Survival
শব্দটাকে জান সঞ্জয়?
-করে আছি তো!
-হ্যাঁ! কিন্তু কোন মূল্যে?
-কেন?
শ্রমের?
-হা হা! শ্রম? চারটে দাগ টান। রঙ
দাও। তাতে শ্রম?
-ভাবনার শ্রম নেই। ক্যানভাসে ফোটানোর কথা
ছেড়েই দিলাম।
-কী ভাব সঞ্জয়? তোমার গ্যালারির নিত্য
নতুন ধাঁচ দরকার হয়। যাকে বলে Latest in the market! আজ
তোমাকে বানাচ্ছে, তোমার ভাবনাকে - ছবিকে বানাচ্ছে। কাল
শেষ হয়ে গেলে ফেলে দেবে। ইয়াং আর্টিস্ট বলে আজ তোল্লা দিচ্ছে, কাল নতুন কাউকে আনবে।
-গ্যালারির জন্য আমি ছবি আঁকি না।
-এই যে মালা হাতে বসে আছ, এই মালাতেই তো তোমার
বিক্রি লেখা।
-আমি বুদ্ধের ভক্ত!
-এত খ্যাতির লোভ নিয়ে?
-কোথায় দেখলে লোভ?
-তুমি তোমার আর্টিস্ট বন্ধুদের গ্রুপ ছেড়ে
সরে যাওনি, তোমার
গ্যালারি চায় না বলে? গ্যালারির মালকিনের বরের বিরাট
খবরের কাগজ গোষ্ঠী আছে। সে গোষ্ঠীর সঙ্গে আবার তোমার বন্ধুদের লড়াই। তোমারও ছিল,
যখন ছাত্র ছিলে। এখন? সব তো মেনে নিয়েছ?
লোভে না?
-খেতে হয় শিল্প করতে গেলে!
-খেতে হয় বাঁচতে গেলে। আমি যদি কোনো
ঘোড়াওলার ঘরে জন্মাতাম, তাহলে আমি যোদ্ধা হতাম না।
যদি কোনো চামারের ঘরে জন্মাতাম, তাহলে চামড়ার কাজ করতাম। এই
পটুয়া জন্মে আমি শুধু পট আঁকি। তেমনই রাজপরিবারে জন্মে আমি সম্রাট হতে চেয়েছি।
অস্বাভাবিক কি? আমাকে
বিদ্রুপ করলে কেন?
-হত্যাকারী, হিংস্র জন্তু তুমি! কলিঙ্গে লক্ষ
লক্ষ লোক মেরেছ। রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছ বঙ্গোপসাগর। সেই সাগরের তীরে বসার
কোনো যোগ্যতাই নেই তোমার।
এরপর ওরা পুরাণ কথিত গজ-কচ্ছপের লড়াইতে
মেতে উঠবে। ছবিওলা আর পটওলা। বাকী রাত একে অপরকে আক্রমণ করবে, আক্রান্ত হবে, কাঁধ জড়িয়ে বসে কাঁদবে, মদ খাবে এবং বালির উপর
ঘুমিয়ে পরবে। অশোক ফিরে যাবে রাজধানীতে। মহারাজ বিন্দুসার চলে যাচ্ছেন। জৈন ধর্ম
নিয়েছেন। সন্ন্যাসী হবেন। চাণক্য নেই। সুষীম রাজা হবে। এমন একটা প্রেক্ষাপটে চলে
যাচ্ছে অশোক। কৌরবাকীর কাছে আশ্রয় চেয়েছিল। কলিঙ্গ কুমারী নিজের জাতিকে অস্বীকার
করতে পারেনি। এড়াতে পারেনি দীর্ঘকালের অভ্যাস মিত্রটকে। জীবনে এমন মুহূর্ত
আসে। মুহূর্তেই
ঠিক হয়ে যায় ফলাফল। কলিঙ্গ নিবাসে থেকে অশোক চেয়েছিল জীবনকে বদলে নিতে। রাজার
পুত্র, কিন্তু
রাণীর পুত্র না। তাই দক্ষতা সত্ত্বেও সে রাজা হবে না। সুশাসক, যোদ্ধা হিসেবে অনন্য, কিন্তু প্রথম পুত্র না,
তাই রাজা হবে না। উপরন্তু তাকে হত্যা করা সুনিশ্চিত। সুষীম রাজা
হলেই তাকে হত্যার সময় আসবে। প্রতিদ্বন্দ্বীকে বাঁচিয়ে রাখার বিলাসিতা কারো পক্ষেই
সম্ভব না। বন্দী করে রাখলে প্রজা অসন্তোষ, অশোকের গোষ্ঠীর
চক্রান্তের সম্ভাবনা। নির্বাসন দিলে অন্য সামন্তদের সাহায্য নিয়ে ফিরে আসতে পারে
সুষীমকে উৎখাত করতে। তাই নির্মূল করাই একমাত্র ঔষধ।
অশোক ফিরেছিল তার অস্থিরতায়। আক্রান্ত
হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সে আক্রমণে দ্বিধা করে না। সে যোদ্ধা, সে রণনীতিজ্ঞ, রাজনীতিকুশল। তার নীতিবোধ সঞ্জয়ের মতো
কোনোদিনই হবে না, হওয়ার কথা
না।
দ্বার দিয়ে ঢুকছে তার অশ্ব। এতক্ষণ যে
হাওয়ার বেগে এসেছে, নগরীতে
পৌঁছে সে বেগ গিয়েছে কমে। সে চাইছে সকলে তাকে দেখুক। জানুক যে সে ফিরে এসেছে
রাজধানীতে। একটি ঘোড়া এবং তার সওয়ারী ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে নগরীর তোরণ অতিক্রম
করল। আমি দেখতে পাচ্ছি। তারা জ্বলা আকাশের ভেতর, আমি
দেখতে পাচ্ছি এক কালপুরুষের উত্থান। আত্রেয়ী হোটেলে চলে গিয়েছে।
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন