জন্মদিন
সবুজের ভেতর আলো নিয়ে এক একটা ভোর যেমন নিঃশব্দে ছুঁয়ে দেয় মাটি,
তেমন করে এখন একটা একটা পদ্মপাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছি ওর শরীরে। ভোর আসছে।
এখন ঘুমিয়ে ও। এলোমেলো চুলগুলো মুখের ওপর পড়ে দেখাচ্ছে ঠিক যেন
ঘুমন্ত রাজকন্যা। শিথানের সোনার কাঠির সাথে পৈথানের রূপোর কাঠি বদলে
দিলে এখুনি যেন ঘুম ভেঙে উঠে বসবে ও। দেব? না থাক, ঘুমোক ও।
আজ ওর জন্মদিন।
আমি ডাকি ইরাবতী। সাবেকী ঢঙে যদিও ওর নাম
ইফফাত আরা, সে নাম রেখেছে ওর বাবা। কিন্তু ইরা নিজের নামটা
গানের স্কুল থেকে কারাটে শেখার স্কুল, কি বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্রই ইরাবতীই করে দিয়েছে।
গতকাল ওর সর্বশেষ সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষা ছিল। ট্রিপল-ই নিয়ে পড়া আমাদের
ইরাবতী গত ক’রাত একটানা পড়ার টেবিলে
কাটানোর পর গত ভোরে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ডাকল, মা! স্বপ্নে আমি তখন চিলঘরে ঘুড়ি ওড়াচ্ছি অনুর সাথে। আমার হাত ছুঁয়ে অনুর
হাত অদৃশ্য সুতো টানছে। হঠাৎ আমার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল অনু।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম, কিন্তু অনুর শরীরে এত রক্ত কেন? রক্তের ছোপ ছড়িয়ে পড়ছে
ক্রমে ঘরের মেঝে অবধি। অনু... অনু... অঞ্জন!
চোখ খুলে দেখি, ইরা মুখ নামিয়ে আমার গাল ছুঁয়ে ডাকছে, মা...
স্বপ্নে দেখা অনু আর সামনে দাঁড়ানো ইরা, দুজনকে গুলিয়ে ফেলতে ফেলতে ধড়ফড়
করে উঠে বসছি আমি। ইরা বলল, হ্যাপী বার্থ ডে মা! তারপর ফ্লাওয়ার ভাসে গুছিয়ে রাখল একগোছা
স্নিগ্ধ সাদা দোলনচাঁপা। কিন্তু এত সকালে কী করে জোগাড় করল ও এই ফুল! আমার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে
ইরা ফিক করে হেসে বলল, মা, ম্যাজিক। অত বুঝে তোমার কাজ নেই। তবে আজ রাতে তুমি ট্রিট
দিচ্ছ কিন্তু! ক্যান্ডেল লাইট ডিনার, ওকে?
মাথাটা চাপ ধরে আছে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। স্বপ্নে আজ অনু এলো কেন
হঠাৎ! মন থেকে তাড়াতে ইরার জন্মানোর
সময়টা মনে করলাম। ইরা জন্ম নেবার মাসটা বাংলার ভাদ্র মাস। তালপাকা গরম। আমারও তাই। ইরার জন্ম দিতে আমি তখন
বাপের বাড়িতে। ভাদ্রের গরমে স্ফীত উদরে সারাদিন হাঁসফাস। কিন্তু বিকেল হলে উঠে
যেতাম চিলঘরে। ওখানে বসলেই মনে পড়ত অনু আর আমি, এই ঘরটায় লাল পিঁপড়ের ডিম থেকে
ঝিনুকের খোল অবধি কত কী না লুকিয়ে রাখতাম! আমি অনুর সহচর, কিন্তু অনুর মতো বাউণ্ডুলে ছিলাম না। থেকে থেকে উধাও হয়ে যেত
সে ছেলে সেই কৈশোরেই। খুঁজে পেতে বাবা বা কাকারা ধরে এনে পিঠে বসিয়ে দিতেন
দু’ ঘা। ওকে জন্ম দিয়েই কাকী
চলে গেলেন দূর অজানায়। বড় বাড়ি, এর তার হাত ঘুরে অনু বড়ও হলো আর ওর দু’ বছর পর জন্মালাম আমি।
অনু বলত, বড় হয়ে তোকেই বিয়ে করব দেখিস। বিয়ে! এমা! সেটা তো বড়দের
ব্যাপার! অনু তখন বড়দের মতো মুখ করে বলতে শিখেছে, হুহুউম... দেখিস...
চিলঘরের লাল মেঝেতে হঠাৎ রোদ্দুর।
অনুটা ওই রকমই। আর বাউণ্ডুলে বলে পড়ালেখায় মন ছিল না খুব।
ইলেভেন থেকে টুয়েলভে প্রমোশন মিলল না। বাবা ডেকে খুব বকলেন
অনুকে। বললেন, তোর মুখ আমি আর দেখতে চাই না, হতচ্ছাড়া কুলাঙ্গার!
অনুও তেমন, বেরিয়ে গেল তখনই।
ফিরল, ছিন্নভিন্ন। ট্রেনে কাটা পড়া শরীরের কতটুকুই বা ফেরে!
এই যা... সেই অনুকে নিয়েই ভাবছি আমি...
ইরা এখন ঘুমিয়ে।
এক পদ্মপাপড়ি ওর ঠোঁট ছুঁয়ে আছে।
ইরা, আমাদের ইরাবতী, গতকাল ওর সেমিস্টার ফাইনালের
শেষ পরীক্ষা ছিল। বেরোবার আগে মেয়ের সে কী তাড়া! এক স্লাইস ব্রেডে
জ্যাম, দেরী হয়ে যাচ্ছে মা... উফ দাঁতে কাটবার সময় নেই। গ্লাসের দুধটুকু আধখাওয়া। বেরিয়ে গেল। এমনিতেই নাকি লেট। সিএনজি অটোই ভরসা। গাড়ি ও কোনোকালে ব্যবহার
করে না। একবার ভাবলাম বলি, আমিও যাই চল! কিন্তু ভাবার আগেই মেয়ে দরজার বাইরে। সিঁড়ি থেকে গলা চড়িয়ে
বলল, মা রাতে কিন্তু ট্রিট, মনে থাকে যেন...
ইরা বেরোবার পর আজকাল আমার খুব তাড়া থাকে না। সামান্য গুছিয়ে, টিফিন কৌটোয় দুটো স্যান্ডুইচ
ভরে আমিও বেরিয়ে পড়ি। অফিসপাড়া থেকে আমাদের আবাসনের দূরত্ব খুব বেশি নয়। হেঁটে গেলে মিনিট পঁচিশ। এ বয়সে হাঁটার বিকল্প
নেই ভেবে ওই পথটুকু হেঁটেই পাড়ি দিই। রবীন অবশ্য গাড়ি ছাড়া কোথাও যায় না। শাওয়ার নিতে গিয়ে ভোরের
স্বপ্নটা আবার মনে পড়ল। সাথে সেই অনুভূতিটাও। ইশ... এই বয়সেও কী করে... বাথরুম থেকে বেরোতেই চোখ পড়ল
রবীনের ছবিতে। রবীন সিডনি থেকে ফিরতে আরও দু’ সপ্তাহ।
অনুও ফিরেছিল, সাদা কাপড় জড়িয়ে। অথচ ওই মুখ, অবিকল সেদিনের চিলঘরের সকালের
মতো, যেন বন্ধ চোখে আমার ফেরত চুমুটার
অপেক্ষায়...
ইরা ঘুমিয়ে এখন।
ভোর এসেছে আজ নিঃশব্দে।
ইরাবতী, ইরাবতী... আমাদের জন্মদিনটা একদিন আগে পরে কেন হলো গো মামণি? ওর মুখে পুবের জানালা থেকে রোদ
না এসে পড়ে, সেই ভেবে জা্নালার পর্দাগুলো
টানটান করে দিলাম।
ইরাকে কাল ট্রিট দেবার কথা ছিল।
আরও কিছু পদ্মপাপড়ি ইরার গাল ছুঁয়ে।
ইরা, তোমার ফিরে আসার এইসব
মুহূর্তগুলো আর ইরেজ করা যায় না, না? মুছে দেওয়া যায় না সময়ঘড়ির
গতকাল দুপুর থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো? পথরোধ করে দাঁড়ানো ওইসব আততায়ী মুখ, কারা ওরা? খুব ভয় পেয়েছিলে ইরা?
ইরা, ইরা... তুমি জাগবে না?
প্রচণ্ড চাপ বুকে। শ্বাসকষ্ট প্রবল। ঘুম ভাঙলো যখন, সারা
শরীর ঘামে ভিজে সপসপ।
চোখে জল নিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম বিছানায়। পাশের ঘরে চকিতে ওর বিছানার
পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল, রাজকন্যার ঘুম মুখে এলোমেলো পড়ে আছে চুল।
গালে আলতো ঠোঁট রাখতে চোখ মেললো ইরা।
ভালোলাগলো।
উত্তরমুছুন