সন্নাটা : একটি পাইরেটেড ছদ্ম-ফিলুম
পাইরেটেড ফিলুম দেখার এই এক জ্বালা। কোনটা ফিলুম আর কোনটা হালুম বোঝামুশকিল। ভূতের ছবির হেব্বি সাসপেন্স ভরা মুহূর্তে হঠাৎ সিটকম মার্কা ব্যাকগ্রাউন্ড হাসি।কি না, যে লুকোনো ক্যামকর্ডারে রেকর্ড করছে তার বন্ধুর পশ্চাদদেশ থেকে এক হাল্কা ফুসমন্তর বেরিয়েছে যার সৌরভে গোটা হল দোদুল্যমান। চাপা গলায় শোনাযায়: “উফ ক্যায়া ইয়ার,
ইয়ে ক্রুশিয়াল মোমেন্ট পে পাদ মার রাহা হ্যায়?”
সেদিন ফিল্ম শুরু হওয়ার ঠিক আগে
টাইটল পড়ার সময় অরুণাভ স্পষ্ট শুনতে পেল তার মাতৃভাষা বাংলায় কে যেন ফোনে বলছে –
“এ মা! এসব কবে হলো? সেদিনই তো বাজারে দেখলাম!” অর্দ্ধশ্রুত এই সংবাদ যদিও ‘সু’
ঠেকলো না অরুণাভর, তাও দূরদেশে শনিবারের উইকেন্ডে পাইরেটেড টাইম পাস করতে করতে বাংলা শুনে মন্দ লাগলো না। যাকে বলে দেশী বাংলা, যেখানে এন আর আইয়ের টান থাকে না।
এইসব অবৈধ ভিউয়িং-এ কমিক রিলিফ হলো, সিনেমায় না ঘটে
হলে ঘটা এইসব দৃশ্য। ধ্বনি যা দেখাকে নতুন নতুন সংবেদে ভরে
দেয়। সব থেকে মজা হয় যখন স্ক্রিনের সামনে দিয়ে ছায়ারা এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে,
বাচ্চা কাঁদলে মা তাকে বাইরে নিয়ে যায় ইত্যাদি প্রভৃতি।
সেদিন শনিবারের নিশুতি রাত, অরুণাভ সেই শুক্রবারেই রিলিজ করা একটা হরর ফিল্মদেখছিল। প্রথম ২-৩ মিনিট পর হঠাৎ কোনো এক হতচ্ছাড়া স্ট্রেট ক্যাম-কর্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ১০ সেকেন্ড, ২০ সেকেন্ড, ৩০ সেকেন্ড। আস্তে আস্তেঅধৈর্য হয়ে উঠল অরুণাভ। আজব গান্ডু তো! দাঁড়িয়ে আছে তো দাঁড়িয়েই আছে। না নড়ন নাচড়ন!পাক্কা ২ মিনিট হয়ে যাবার পর অরুণাভ যখন উইন্ডোটা জাস্ট কেটে দেবে ভাবছে, তখন স্ক্রিনঢাকা মিশকালো ছায়া থেকে একটা মেয়ের গলা বেরিয়ে এলো: ‘ওমা, ওটা কি? ধন ধরারমতো করে কি ধরে আছো গো ওখানে? হাল্কা আলো জ্বলছে না? রেকর্ড হচ্ছে নাকি?দেব বলে লাইটম্যানকে? দেবে যখন হল থেকে লাথ মেরে বার করে, বুঝবে ঠ্যালা’।
একথাশুনে অরুণাভ যতটা হকচকিয়ে ছিল, তার পাইরেট ভাইটিও নিশ্চয়ই তাই, বেশিতোকম নয়!কয়েক সেকেন্ডের নীরবতার পর একটা বিরক্ত পুরুষকন্ঠ শোনা গেল: ‘দিদি আপনার চাপটাকোথায় হচ্ছে বলুন তো? বই দেখতে এসেছেন বই দেখুন না! ওভাবে সামনে দাঁড়িয়েথাকলে না আপনি দেখতে পাবেন, না আমি, আর না আমার এই
ডবল ধনের থ্রু দিয়ে অন্যরা। বুঝে যখন গেছেন, ফালতু বাওয়াল না দিয়ে সরে যান তো দেখি!’ জাঁদরেল গলায় উত্তর: ‘সরবো না, কী করবে কর, না আমি দেখব, না তোমায়দেখতে দেব, এই বসলুমএইখানে, তোমার ইস্কিরিন আড়াল করে’। অরুণাভ লক্ষ্য
করল, ছায়ার অন্ধকারে কিছুরদবদল হয়ে গেল, তবু স্ক্রিনটা ঢেকেই রইল। ইতিমধ্যে সিনেমার অডিও কানে পশিয়াচলিতেছে। আর সেই রাষ্ট্রভাষায় হস্তক্ষেপ করছেআ মরি বঙ্গভাষা। যেন হিন্দি পোষাচ্ছে না।পুরুষকন্ঠ এবার বলে উঠলো: ‘এতদিন ধরে হলে ক্যাম মারছি, এরম মালের পাল্লায় তো কোনোদিন পড়িনি! না সরলে কিন্তু সরিয়ে দিতে হবে
আমায়!’ উত্তর এলো ততক্ষণাৎ:‘মেয়েছেলের গায়ে হাত দিয়ে দেখ না, এমন ঠ্যাঙান খাবে না,ধন ধরতে ভুলে যাবে। চোরেরমায়ের আবার বড় গলা!’
এই অব্দি হিন্দি ব্যাকসাউন্ডে বাংলা ফ্রন্টলাইনের পর অডিওটা কেউ
অফ করে দিল,কিন্তু ভিডিওটা একরাশ অন্ধকার নিয়ে চলতেই লাগলো। অরুণাভ ভাবলো, যাচ্চলে, সবে তো খেলা জমেছিল! ধুর! মিনিট
দুয়েক আরও দেখে টেনে টেনে এগিয়ে চলল ভিডিও ধরে। ১০ মিনিট থেকে ১৫, ২০, ২২ হয়ে শেষে
৯০ মিনিট টেনে টেনে বাফার করে দেখল, নাহ, না কোনো শব্দ হচ্ছে, আর না স্ক্রিনের
সামনে থেকে ছায়াটা সরছে।
অরুণাভ ইউন্ডো ক্লোজ করে ভাবতে লাগল, তাজ্জব ব্যপার তো! এহেন একটা ভিডিওআপলোড কী করে হলো? কে করল? কেনই বা করল? তার থেকেও অবাক লাগলএইটা ভেবে যে, ঐ ডায়ালগের পর কী হয়ে থাকবে যাতে দেড়
ঘন্টা ধরে অরব আঁধার কাটলো না! এতো আর হিচকক নয় যে জানালা দিয়ে হিরো খুন হতে দেখে ফেলবে! রিয়ালিটিতে কি আরঅমন হয়?
অথচ হলোটা কী, কিছুই বুঝতে পারল না অরুণাভ। মহিলা কি জাস্ট উঠলেন না? লোকটাও কি
মহিলার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে চাইল? কে জিতল, আর হারলই বা কে? মহিলা কি স্রেফ
সামাজিক বিবেক বা ওবেরয় হওয়ার জন্য নিজের টিকিটের পয়সা নষ্ট করলেন? আর তাহলে কেনই বা এই তুমুল পরাজয়ের রেকর্ডিং আপলোড করল লোকটা?ল্যাপটপের স্লাইড বন্ধ করে দিয়ে পাশ ফিরে চোখ বুজে অরুণাভ দৃশ্যটা কল্পনা করতেলাগলো। অন্ধকার ও নীরবতা কল্পনাপথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও হঠাৎ সেই নৈঃশব্দ্য ছত্রখান করে গলগল আর ফিনকি জাতীয় কিছু তরল শব্দ শুনতে পেল সে। রক্তাভ অনর্গলপ্রপাতধ্বনির ভেতর এক পুরুষকন্ঠের
অন্তিম আর্তনাদ শোনা গেল। তারপর আবার সব চুপ। অরুণাভর বন্ধ চোখের ভেতর অন্ধকারটা কেমন যেন লাল হয়ে উঠল। চোখ খুলতেদেখলপাশ ফেরার সময় বেডসুইচে চাপ পড়ে লাল নাইট
ল্যাম্পটা অন হয়ে গেছে। সেটাকেসুইচঅফ করে অরুণাভ আবার
দৃশ্যটা প্রথম থেকে কল্পনা করতে শুরু করল। ওর মাথার ভেতরতখন একটা গান বাজতে শুরু করেছে:
সুনসান রাতো মে যব তু নহি আতা
তেরে বিনা ঔর লগতা হ্যায় গেহরা ইয়ে সন্নাটা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন