ভাসান
টুনু পিসিকে
শেষমেশ পাওয়া গিয়েছিল। বোসেদের পোড়ো মন্দিরটার ভাঙ্গা সিঁড়ির ধাপে টুনুপিসি কাত
হয়ে মড়ে পড়ে আছে; পাশে গাঢ় খয়েরী রঙের বোতল তখনও আঙুল ছুঁয়ে। আমার দুই কাকু, দাদাভাই, মৃদুলদা - সবাই রাতভর তন্ন তন্ন করে সারা গ্রাম চিরুনী খোঁজা খুঁজেছে। মৃদুলদা তো শহরের
বাসস্টপেও গিয়েছিল। কিন্তু বাড়ির পেছনে চোট্টাপাতার জঙ্গলে, প্রায় নাই
মন্দিরটায় খোঁজার কথা কারুর মনে হয়নি। ওখানে কেউ যায়? তাছাড়া টুনুপিসি তো আর
বাচ্চা মেয়ে না!
আমার দাদুর
বাড়ির রাখাল রহিম বক্সের ছেলে, কানা শমসু সক্কালবেলা বাড়ি মাথায় তুলে খবরটা দিল।
মিন্টুদা বলে, ও নাকি গাঁজাখোর! ওর জিনিস থাকে মন্দিরের ভাঙ্গা দরজার পেছনে। ছোটকাকু আর
মৃদুলদা বাইরে দাওয়ায় বসেই ছিল; শোনামাত্র ছুট। টুনু পিসির মা স্বর্ণ ঠাকুরমা খবরটা শুনেই “ওরে আমার টুনু
রে-” বলে সেই যে জ্ঞান হারালেন, মেয়ের লাশটাও
দেখতে পেলেন না; হাসপাতালেই কাটিয়ে দিলেন ন’দশদিন। লাশঘরে ঢোকার সাথে সাথেই দাদু তড়িঘড়ি ছোটকাকুকে
ঢাকা পাঠিয়ে দিলেন।
আগের দিন রাতে
আমাকে আলাদা করে বড়রা অনেক জেরা করছিল। পুরো পাড়া ফাঁকা ছিল দিনভর। প্রায় সবাই
নদীর ঘাটে, ভাসান দেখতে। আমি আর টুনুপিসিও গিয়েছিলাম। আমার মা, তিন
কাকিমা, দুই পিসি, ঠাকুরমা, একপাল তুতো দিদি, স্বর্ণ ঠাকুরমা সব্বাই ছিল একসাথে, একই ট্রাকে।
টুনুপিসি খুব ভালো শাঁখ বাজায়। মা কাকিমাদের
বাতাস কেটে ‘উলু লুলুলু লু’র সাথে টুনু পিসির গমগমে গম্ভীর শাঁখ। ঐ ট্রাকে প্রতিমা নেই, তাই আমি উঠি
নি। আমি ছিলাম কাকু, দাদাভাই সবার সাথে অন্য ট্রাকে, যেখানে মৃদুলদা মাথা ঝাঁকিয়ে ঢোলের কাঠিতে বোল
তুলছিল, ‘ধাঁই গদা ঘাই ঘিজির ঘিজির’, আর টুটুলদা’
কাঁসায় সংগত করছিল, ‘ট্যাং টিটি ট্যাং টিটি’! দাদাভাই আর কাকুরা একটু পর পর গলা ফাটিয়ে শোর
তুলছিল, “দুর্গা মাঈ কি জয়!”
প্রতিমার ট্রাকে আমিই ছিলাম একমাত্র
মেয়ে। মৃদুলদার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর ঢোলের তালে তালে দুলছিলাম। সরু গলায় চেঁচাচ্ছিলাম পাল্লা দিয়ে, “দুর্গা মাঈকি জয়!” আমাদের
ট্রাকটা ছিল সামনে, মা’দেরটা পেছনে। নদীর বেশ
খানিকটা দূরেই পেছনের ট্রাকটাকে ভলান্টিয়াররা থামিয়ে দিল; কেবল মূর্তিওয়ালা ট্রাক লাইনে থাকবে। আমি দেখতে ছোট খাটো; নয় চলছে, দেখে মনে হয় না।
ভলান্টিয়ারদের একজন বলল - এই বাচ্চা, যাবে না! আমার কাছাকাছি দশ বছরের টুটুলদা উদাস চোখে অন্য দিকে তাকিয়ে
বাজিয়ে যাছে, ‘ট্যাং টি টি ট্যাং টি টি’। ও মাথায় অতটা
উঁচু নয়, কিন্তু গাট্টাগোট্টা। ভলান্টিয়ারদের আমার হয়ে কেউ বোঝাল না। সবচেয়ে বেশি অভিমান হয়েছিল মৃদুলদার ওপর। আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম, বড় হলে মৃদুলদাকে বিয়ে করব। সেই মৃদুলদা আমার নেমে যাওয়া খেয়ালই করল না! মাথা ঝাঁকিয়ে ঢোল বাজাতেই থাকল!
ছোটকাকু আমাকে প্যাঁজাকোলা
করে মা পিসিদের ভিড়ের দিকে যখন এগোচ্ছে, আমি তখন স্পষ্ট শুনছি পেছনে মৃদুলদার ঢোলের বাড়ি, ‘ধাঁই গদা ঘাই ঘিজির ঘিজির,
কুর্চি সোনা
নেমে গেল’।
টুটুলদার
কাঁসাও হঠাৎ বেশ জোরে বাজছিল, ‘ট্যাং টিটি ট্যাংটি টি, হারু মেয়ে হারু মেয়ে’!
সবকিছু হঠাৎ
কেমন অসহ্য লাগছিল আমার। বাড়ি ফেরার জন্য ভয়ানক কান্নাকাটি শুরু করেছিলাম।
“কী ভ্যাতকাঁদরা
মেয়ে রে!” মেজকাকীমার টিপ্পনি শুনে, মা ঠাস্ করে আমায় চড় লাগিয়ে দিল।
চাটগাঁর ভাষায়
‘ভ্যাতকাঁদরা’ মানে ছিঁচকাঁদুনে।
তখুনি টুনুপিসি
বলল, “বউদি আমি রেখে আসি, আমারও ভালো লাগছে না।”
বাড়িতে দাদু আর
বম্মা, মানে দাদুর একমাত্র বিধবা বোন। বম্মার অনেক বয়েস।
চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ। টুটুলদা বলে, ভাঁজের সংখ্যা যত বম্মা’র বয়েসও তত। আমি এক দুপুরে বম্মার বয়েস গুনতে বসেছিলাম। পঁয়ষট্টি পর্যন্ত গুনতে
পেরেছিলাম। বম্মার বাঁ গালের ভাঁজ ধরে গুনছিলাম; ভাঁজের মধ্যে ভাঁজ। একটু টেনে চামড়া আলগা করতে চাইলাম, অমনি বুড়ি খনখনে গলায় মা’র ঘুম চটিয়ে দিল, “ও দিফতি তোর মাইয়া আঁরে চুঁইডার”! (ও দিপ্তি, তোর মেয়ে আমাকে চিমটি
দিচ্ছে)।
ব্যাস আমার গোনা খতম। মা কান ধরে হিড় হিড় করে নিয়ে ঘরে খিল দিয়ে দিয়েছিল।
মা টুনু পিসিকে
রিক্সা ভাড়া দিতে দিতে আমার দিকে চোখ গোল করে শাঁসাল, “তুমি যদি কাউকে জ্বালিয়েছ, একটা মারও কিন্তু মাটিতে পড়বে না”।
এবারের পুজোয়
আমার বাবা আসতে পারেনি। আমার বাবা শহরের নাম করা হার্টের ডাক্তার। ভীষণ ব্যস্ত। বাবা এলে আমার সাথে এমন করার কেউ সাহসই করত না!
টুনুপিসি আমাকে
হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে ভিড় ঠেলে বের করে নিয়ে এসেছিল। বেরোনোর সময় ছোটকাকুকে দেখি বিড়ি ফুঁকছে রিকশাগুলোর কাছে। আমাদের দেখে এগিয়ে এলো। টুনুপিসি কিন্তু দেখেও দেখল না। আমিও না। রিকশায় উঠেই
পিসি দুম করে হুড
তুলে দিল। আমি ফোঁপাতে
ফোঁপাতে শুনছি ছোটকাকু চাপা গলায় বলছে, “পম্পা দাঁড়াও!” টুনুপিসির আসল নাম পম্পা। টুনু পিসিকে আমার তখন ভীষণ মায়াবতী লাগছিল। ছোটকাকুর উপর রাগে আমি ফুটছি তখনও।
স্বর্ণঠাকুরমা
আমার ঠাকুরমা’র দুঃসম্পর্কের বোন। এই বাড়িতেই থাকে। পুজোর সময় আমরা সবাই শহর
থেকে ভিড় করি এখানে; আর সব সামলায় স্বর্ণঠাকুরমা।
আমি বাড়ি ফিরে দাদুর পাশে শুয়ে পড়েছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। সবাই কখন ফিরল
কিচ্ছু জানি না। ছোটকাকুই আমাকে জাগিয়ে বাইরে নিয়ে এসেছিল। দাদারা সব তারাবাজি ফোটাচ্ছে। আমাকেও ধরিয়ে দিল, জিজ্ঞেস করল, “টুনুপিসি কোথায় রে?” আমি কী জানি! জানলেও বলতাম না।
টুনু পিসির লাশ আমরা
ছোটরা দেখি নি। বম্মার ঘরে আটকে রেখেছিল আমাদের।
একসময় শুনলাম, গা হিম করা ‘বল
হরি হরি বোল’। শ্মশানে নিয়ে
যাচ্ছে টুনু পিসিকে। বম্মা
হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল। টুনু পিসির জন্যে এই প্রথম আমাদের বাড়ির কেউ কাঁদল।
আমার হাতের
তালুটা হঠাৎ কেমন গরম মনে হচ্ছিল, যেন টুনু পিসির হাতের ওম ধরে আছি। ‘হরি বোল’ নয়, স্পষ্ট শুনতে
পাচ্ছিলাম, ‘দুর্গা মাঈকি জয়’!
আজকাল ছোট গল্পের কলেবর ছোট থাকেনা I মাত্র একটি ছোট্ট ঈন্গীতের উপর গল্পের রহস্যের জট খোলার চাবি পাঠকদের হাতে ধরিয়ে দেয়া একজন পরিণত লেখকেরই শোভা পায় I ভাসান একটি সার্থক ছোটগল্প I আমার খুব ভাল লেগেছে I
উত্তরমুছুনআজকাল ছোট গল্পের কলেবর ছোট থাকেনা I মাত্র একটি ছোট্ট ঈন্গীতের উপর গল্পের রহস্যের জট খোলার চাবি পাঠকদের হাতে ধরিয়ে দেয়া একজন পরিণত লেখকেরই শোভা পায় I ভাসান একটি সার্থক ছোটগল্প I আমার খুব ভাল লেগেছে I
উত্তরমুছুন