কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ মে, ২০২১

পায়েল চ্যাটার্জী

 

সমকালীন ছোটগল্প


অন্তর

রকেটটা হুশ করে উড়ে গেল। যাক্ শান্তি। এই গ্রহে যা ঝামেলা লেগেছে! অর্থনীতি  গভীর খাদে। মূল্যবৃদ্ধি চোখ রাঙাচ্ছে। বাইরে বেরোলে নভেল করোনা আর বাড়িতে থাকলে এটা কোরো না সেটা কোরো না। বাড়ি মানে আমার কাছে মেসবাড়ি। মেস মালিক সংক্রান্তিবাবু এমনিতেই পরিষ্কার পরিছন্নতা নিয়ে বাতিকগ্রস্ত। হাইজিন  একেবারে ওনার জিনে জিনে। আর এখন তো পারলে স্নানটাও করেন স্যানিটাইজারে। এই শুচিবায়ুগ্রস্ত সংক্রান্তিবাবু এখন আমার শিরে সংক্রান্তির কারণ হয়ে উঠেছে। আমি কে? আমি বিপদভঞ্জন কর্মকার। তবে আমার নামই সার! অন্য  কারোর তো দূর অস্ত, আমি নিজের বিপদই এখনো ভঞ্জন করে উঠতে পারিনি। বাবা-মা বোধহয় তাদের বিপদ মুক্তির আশায় আমার এই নাম রেখেছিল। কিন্তু অকালে পৃথিবী থেকে চলে গিয়ে তারা নিজেরাই আমায় বিপদে ফেলে গেছে। তার উপর প্রেমে লেঙ্গি খাওয়া, বেকারত্বের বিপদ তো আছেই। আপাতত কলকাতার এই মেস বাড়িতে থেকে টিউশন পড়িয়ে নিজের দিন গুজরান করি, খাতায়-কলমে চাকরির চেষ্টা করছি। কিন্তু এই অনন্ত লকডাউনে সেসব বন্ধ। কোনমতে জমানো  টাকায় চলছে। এইরকম বিদঘুটে পরিস্থিতিতেও সংক্রান্তির বাতিকগ্রস্ততায় একটুও চিড় ধরেনি। এই তো সেদিন সবে আমি বাজার থেকে মাছ এনে রান্নাঘরের বাইরে রেখেছি দেখি উনি স্যানিটাইজারের বোতল নিয়ে মাছের গায়ে ঢালতে যাচ্ছেন। রে রে করে দৌড়ে গেলাম।

-আরে কী করছেন মশাই?

-জীবাণুমুক্ত করার চেষ্টা করছি। নিউ ইয়র্কে বাঘের শরীরে ভাইরাস পাওয়া গেছে। কলকাতার মাছ যে ছাড় পেতে পারে এমন বিশ্বাস তোমার হলো কী করে!

-আরে মাছ তো আমি জলে ধুয়ে ভালো করে রান্না করে খাব! জীবাণু তাতে মরবে। কিন্তু ওই স্যানিটাইজার! ওতে ডোবালে যে বিষ-মাছ হয়ে যাবে!

-মাছের মিউকাসে যদি ভাইরাস থাকে! সেখান থেকে তো সংক্রমণ হতেই পারে!

-মা...ছে...র আবার মিউকাস।

মনে মনে বললাম সংক্রান্তিবাবুকে সংক্রমণের বিজ্ঞান বোঝানো আমার কম্মো নয়।  কিন্তু মাছগুলো? সংক্রান্তিবাবু ওদের স্যানিটাইজার না ধুয়ে তার মেসের রান্নাঘরে কিছুতেই আমায় রান্না করতে দেবেন না! অগত্যা আমার মেসের পাশেই গোপেনকে গোপনে মাছগুলো দিয়ে তাদের অ্যালকোহলের প্রকোপ থেকে রক্ষা করলাম। তারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই গোপেনের পেটে ঢুকে পড়েছে। আর আমার পিঠে তখন উচ্ছেসেদ্ধ, পটলভাজারা আমার মৎস্য খিদের উপহাস করছে! "নাহ্, লকডাউন উঠলে এই মেস আমাকে বদল করতেই হবে!" একে করোনায় রক্ষে নেই তার মধ্যে সংক্রান্তিবাবুর বাতিক দোসর! কোনভাবে যদি এই পৃথিবী নামক অস্থির গ্রহটা থেকেই মুক্তি পাওয়া যেত, তাহলে একেবারে বিপদমুক্ত হতাম! এইসব ভাবতে ভাবতে আর রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করতে বড় রাস্তায় গিয়ে দেখি একটা ইয়াব্বড় রকেট দাঁড়িয়ে। দেখে তো চক্ষু ছানাবড়া। কৌতূহল সামলাতে না পেরে রকেটের জানালায় উঁকি মেরে দেখি আপাদমস্তক সাদা পোশাক পরা কিছু লোকজন বসে আছে ভিতরে। হঠাৎ দেখি রকেটের দরজা খুলে আস্ত একখানা যন্ত্রমানব বেরিয়ে এসেছে।

-লাইক টু গো টু অ্যা ডিফারেন্ট প্ল্যানেট?

আরিব্বাস! যন্ত্রমানব কথা বলছে! তাও আমার মনের কথা! কল্পবিজ্ঞানের বইগুলো পড়ে বিজ্ঞানের উন্নতির কথা খানিক আন্দাজ তো করতেই পারি! তা বলে এক্কেবারে মানুষের মত কথা বলা যন্ত্রমানব! প্রযুক্তির মহিমায় সবই সম্ভব! ভাবনার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে উত্তর দিলাম।

-হুইচ প্লানেট? নো করোনা দেয়ার?

-নো ইনফেকশন দেয়ার।

কিন্তু আমার কাছে তো  নিজের জিনিসপত্র কিছুই নেই। সেসব তো নিতে হবে। যন্ত্রমানব আবার পড়ে ফেললো আমার মনের কথা।

-উই প্রোভাইড অল অ্যামিনিটিস ইন আওয়ার "কোয়ারেন্টনিক" প্ল্যানেট।

কোয়ারেন্টনিক প্ল্যানেট! এরকম কোন গ্রহ আছে বলে তো শুনিনি! নতুন আবিষ্কার বোধহয়! এসব ভাবতে ভাবতেই কখন দেখি রকেটের মধ্যে উঠে পড়েছি! সেটা সাঁ  করে উড়তে আরম্ভ করে দিয়েছে! নতুন গ্রহে গিয়ে নিশ্চয়ই খুব ভালো থাকবো। মুক্তি পাওয়া গেছে তাহলে। মেসবাড়ির ওই স্যাঁতস্যাঁতে ঘর, গোপেনের দোকান, সংক্রান্তিবাবুর বাতিক সব নিচে মিলিয়ে যাচ্ছে একটা বিন্দুর মতো। গ্রহ বদল হয়েই গেল। ইতিমধ্যেই আরেকটা যন্ত্রমানব এসে আমায় একটা আপাদমস্তক ঢাকা সাদা পোশাক পরিয়ে দিল আর আমার বসার জায়গাটাও দেখিয়ে দিল। ওখানে বসে পড়তেই দেখলাম কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। নিশ্চিন্ততার ঘুম বোধহয়।

ঘুম যখন ভাঙলো দেখি একটা অদ্ভুত রকমের চকচকে ঘরে নরম তুলতুলে বিছানায় শুয়ে আছি। পাশে পিক পিক আওয়াজ। ওই আপাদমস্তক ঢাকা সাদা পোশাক টাতে দমবন্ধ লাগতে শুরু করেছে। হাঁসফাঁস করছি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি এক যন্ত্রমানবী এসে একটা আওয়াজ করল। অনেকটা এ সি অন করার শব্দের মত। আমি উঠে বসার চেষ্টা করেও পারলাম না। যন্ত্রমানবীটি আমার মনের কথা বুঝতে পেরে একটা সুইচ টিপে আমার ওঠার ব্যবস্থা করে দিল। এ আবার কেমন বিছানা রে বাবা! হাসপাতালের বিছানার মত। তবে ঘরের আলোগুলো দেখে মনে হচ্ছিল কেমন একটা রাজকীয় ব্যাপার। আমার তখন রাজা রাজা ভাব। কোথায় ঐ স্যাঁতস্যাঁতে মেস আর কোথায় এই গ্রহের নতুন ঠিকানা। ওদিকে যন্ত্রমানবীর থেকে ঘড় ঘড় আওয়াজ আসতে শুরু করেছে। কিছু বলার চেষ্টা করছে বোধহয়। শোনার চেষ্টা করার জন্য কানের কভার সরাতেই দেখি কথাগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। আরে এ যে আমার আপন বাংলাভাষা।  কোয়ারেন্টনিক গ্রহেও বাংলাভাষা চলে নাকি? তখন রকেটের যন্ত্রমানব ইংরেজি বলছিল! সব গুলিয়ে যাচ্ছে! ধুর এতো ভাবছি কেন। অন্ন-চিন্তা, অর্থ-চিন্তা, বাসস্থান-চিন্তা নেই, সংক্রান্তিবাবুর বাতিক নেই। আর কি চাই জীবনে?  আচ্ছা, সংক্রান্তিবাবুর বাতিক কি একটু হলেও মিস করছি এখানে?

যন্ত্রমানবীটির কথার সারমর্ম এই যে, এই গ্রহে যান্ত্রিকতার বাস। যন্ত্র মানব- মানবীরাই এখানকার চালিকাশক্তি। করোনা, লকডাউনের মত জটিল পরিস্থিতিতে  পড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের এরা এখানে নিয়ে এসে আশ্রয় দিচ্ছে। করোনা আক্রান্তদের জায়গা নেই এখানে। যারা রোগাক্রান্ত নয়, কিন্তু অন্যান্য কোল্যাটারাল ড্যামেজে  বিধ্বস্ত তারাই এখানে ঠাঁই পাচ্ছে। আজীবন। নিয়মানুবর্তিতাই এই গ্রহের মন্ত্র। এদের নিজস্ব ভাষা আছে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করার সময় তাদের ভাষাতেই কথা বলে এরা। তাই বাংলা, ইংরেজি যে কোনো ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ এরা। কিন্তু আমি এরকম অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি কেন? স্বার্থপর লাগছে নিজেকে। এখানে তো সবাই প্রিভিলেজড। মার্কড সেফ।

আপাদমস্তক মোড়া এই সাদা পোশাকটায় কেমন যেন হাঁসফাঁস করছি। কিন্তু এগুলো এখানে খোলা যাবে না। জীবাণুমুক্ত থাকার উপায়। আচ্ছা, পৃথিবীর ডাক্তারগুলোর তাহলে কতটা কষ্ট হচ্ছে এখন। আমার অসহ্য লাগছে! যন্ত্রমানবের কথায় বুঝেছিলাম এখানে সবই নির্দিষ্ট সময় বিধি মেনে হয়। সারা দিনে রাতে চারবার ফুডিপাল ইনজেকশনের মাধ্যমে খাবার দিয়ে পেট ভরিয়ে দেয় এরা। সেটাও তবে একেবারে নির্দিষ্ট সময়ে।

বেশ কিছুক্ষণ হলো আমার ঘরটা অন্ধকার। ইনজেকশনের মাধ্যমে খাবার পেয়ে আমি শুয়ে আছি। এখানে নিশ্চয়ই কয়েকদিন কেটে গেছে। যন্ত্রমানবীটি বলছিল কোন একদিন নাকি পৃথিবীর মানুষকে ভার্চুয়ালি অন্যান্য গ্রহ ভ্রমণও করানো হবে। কিছুক্ষণ বাদে আমার পোশাকটাও পাল্টানো হবে। আবার গায়ে উঠবে নতুন দমবন্ধকর পোশাক। এখানে যান্ত্রিকভাবে এসব নাকি তৈরি হয়। নিশ্চিন্ত ছন্দোবদ্ধ জীবনযাপন। এরকমটাই তো আমি চেয়েছিলাম। তাহলে একটা কাঁটা কেন বিঁধছে? মন খারাপ কেন আমার? অন্ধকারে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! ঘুম ভাঙিয়ে দিল খিদে! একটু আগেও তো ইঞ্জেকশন পেয়েছি। তাহলে খিদে কেন? মেসে মাঝে মাঝে এরকম হত! বিস্কুট, মুড়ি খেতাম ইচ্ছামত! কিন্তু এখানে? অপেক্ষাই একমাত্র উপায়! আচ্ছা আমাকে কি সারাজীবন এখানে এই ভাবেই থাকতে হবে? না, না ভাবতে পারছি না। কি যেন নেই এখানে? আশা! কিছু চাওয়ার নেই। খোঁজার নেই। সবকিছু প্রাণহীন! অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা, আতঙ্ক, চাহিদা এই অনুভূতিগুলো এতটা দামি! পৃথিবী থেকে এতটা দূরে এসে বুঝতে পারছি হাজারো অসুবিধা সত্তেও  পৃথিবীটা কত সুন্দর। কারণ সেখানে অনুভূতি আছে। সংক্রান্তিবাবুর বাতিকে আমার বিরক্তি, গোপেনের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা, চাকরির চিন্তা, আমার নিয়ম করে দেশের বাড়ি যাওয়া, এসবের মধ্যে প্রাণ আছে। এমনকি ভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যেও প্রাণ আছে। বেঁচে থাকার স্বাদ। আমি থাকতে চাই না এখানে! মুক্তি চাই আমি! একটা নব ঘুরিয়ে যন্ত্রমানবী যখন আমার পোশাক বদলে দিতে যাচ্ছিল, চিৎকার করে বলার চেষ্টা করলাম ফিরিয়ে দিয়ে এসো আমাকে আমার গ্রহে। আমি চাই না এরকমভাবে বিপদমুক্তি। কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজই বেরোচ্ছে না। যন্ত্রমানবীর মুখটা আস্তে আস্তে ডিজল্ভ হয়ে দেখি একটা মানুষের মুখ! আরে এ যে খুব চেনা! গোপেন।

-দাদা, ওঠো, নিচে চলো, সংক্রান্তিবাবু ডাকছে, কি সব ঝড় আসবে নাকি, এখানকার কিছু লোককে তোমাদের মেসে আশ্রয় দেবে, সেই নিয়ে কিছু কথা বলবেন তোমার সঙ্গে।

অস্বস্তিটা কেটে গেছে। এই তো আমার বেঁচে থাকা। আমার এক টুকরো পৃথিবী। একে ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না আমি। মুখ ফিরিয়ে, পালিয়ে যেতে চাই না আমি।

 


4 কমেন্টস্: