কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ মে, ২০২১

নিবেদিতা আইচ

 

সমকালীন ছোটগল্প


বরযাত্রী

বাতাসে ডিটারজেন্টের ঘ্রাণ। সাদা রঙের অংসখ্য চাদর হাওয়ায় ফুলে ফেঁপে এদিক  ওদিক মাতালের মত দুলছে। প্রতিটার গায়ে লাল অক্ষরে নাম লেখা আছে।

এখন এমন ফুরফুরে হাওয়ার কাল। সব উড়িয়ে নিতে চায়। কিন্তু এই হাওয়া বুক ভরে ভেতরে নেবার উপায় নেই। নাক আর মুখের উপর পাহারা বসিয়ে রাখা জরুরি হয়ে গেছে। এইসব বাধা পেরিয়ে এসে তারপর ভেতরে ঢোকে বাতাস। শুরুর দিকে মাস্ক পরতে এমন দমবন্ধ লাগত আমার! আর এখন এটা নিত্যদিনের পোশাক হয়ে গেছে।

আব্বা বলত, কী দিন আইলো! বাতাসের উপরেও ট্যাক্স বইছে।

আব্বা সহজে মাস্ক পরতে চাইত না। নামাজের সময় এমনি এমনিই বেরিয়ে পড়ত। ঠান্ডা গলায়, কড়া ভাষায় বুঝিয়েছিলাম বহুবার। শোনেনি। ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে।

এই একটু আগে ডাক্তার বলে গেলেন তুলিকার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে। তখন থেকেই বোধহয় আব্বার কথা ভাবছি। ডাক্তার বলেছেন ওর সিভিয়ার হাইপোক্সিয়া। অক্সিজেন স্যাচুরেশন অনেক কম, লেভেল আশির নিচে নেমে গেছে। আব্বার সময়ও শুনেছিলাম এসব।

শুনে শুনে এসব খটোমটো শব্দের মানে শিখে গেছি। আমার অভিজ্ঞতা বলছে যে কোন সময় একটা খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। আর মন বলছে তুলিকার সাথে আমার মুখোমুখি বসে আলাপ হবার সম্ভাবনা শূন্য দশমিকের ঘরে।

আইসিইউ ভবনের ছাদ থেকে দেখতে পেলাম আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে মোড়া লোকজন স্ট্রেচারে করে বডি তুলছে লাশবাহী গাড়িতে। পরিচিত দৃশ্য। আব্বাকে যেদিন ফেরত নিয়ে যাচ্ছিলাম সেদিন ঠিক ওখানেই তুলিকার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। ওর মা আইসিইউ থেকে বেরিয়ে সাধারণ ওয়ার্ডে ফিরে গেছেন এর দুদিন আগে।

আমি বলেছিলাম, আপনি পারলেন মাকে বাঁচাতে। আমি পারলাম না

ওর চোখে কি পানি দেখেছিলাম সেদিন? জানি না! মাস্ক আর ফেসশিল্ডের প্রাচীর ভেদ করে ওকে কেমন দেখায় জানতে পারিনি। আমি ওকে সামনাসামনি কখনো দেখতেই পারিনি। সেও দেখেনি আমাকে।

তবে আমাদের কথা হত ভিডিও কলে। ওর বাঁ চোখের নিচে গালের ওপর ছোট্ট একটা তিল আমাকে প্রতিনিয়ত বলত, ছুঁয়ে দেখো।

ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা আমি ওকে কাতর গলায় বলতাম, চলো দেখা করি!

তুলিকা বলত, আরেকটু ধৈর্য ধরো। বেঁচে থাকলে দেখা হবে নিশ্চয়ই।

আমাদের সম্পর্কটা তুমিতে নেমেছিল তিন মাসের মাথায়। এর কিছুদিন পর আমি ঢাকায় এলাম অফিসের খুব জরুরি একটা কাজে। সারাদিনের ওয়ার্কশপ শেষে সন্ধ্যায় ফিরতে হত। শুরুতে অভিমান করে ওকে কিছু জানাইনি। তাছাড়া দম ফেলবার সময় যে পাব না তা তো জানতামই। খুব টাইট শিডিউল। কিন্তু বিকাল হতে হতে ক্রমশ ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলাম। ওকে লিখলাম, এখন  তোমার বাসা থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে আছি। তুমি চাইলে দেখা হতে পারে।

সেদিন তুলিকার উত্তর পাবার আগেই আমাকে ফিরতে হল। রাতে যখন কথা হল তখন আমি বাসায় ফিরে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছি।

-তুমি আগে বললে না! তুলি আহত স্বরে বলল।

-বললে আসতে?

-তুমি আসবে জানলে আজকে অনলাইনে কাজ সেরে নিতাম। অফিস যেতামই না।

তুলিকার অফিস উত্তরায়। শহরের অন্যপ্রান্ত থেকে সপ্তাহে একদিন ওকে যেতে হয় ওখানে, বাকিদিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম। লকডাউনে এরকমই চলছিল।

সেবার আর দেখা হল না। আজকাল ভাবলে অবাক লাগে, ওর সাথে আমার  কতবার দেখা হয়েছে এর আগে! দুজনেই রোগী নিয়ে ছুটছিলাম। প্রতিবারই এই আইসিইউর বারান্দায় দেখা হত। মাস্ক আর ফেসশিল্ডের আড়ালে থাকত সে। তবু ওর অবয়বটা আমি চিনে নিতাম।

তুলিকার বাবা নেই। ভাই নেই। মায়ের জন্য ছোটাছুটি সব ওর একা করতে হত। শেষদিন ওয়ার্ডে নেবার আগে আমার ফোন নম্বর চেয়ে নেয় তুলিকা।

একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে আমার ফোনটা ছিনতাই হয়ে গেল। প্রায় এক সপ্তাহ আমাকে সে ফোনে পেল না। লকডাউনে সিম তুলে নতুন ফোন হাতে পেতে প্রায় সাত আটদিন লেগে গেল। ফোন সচল হতেই টুংটাং শব্দে ওর বেশ কয়েকটা মেসেজ এসে জমা হল আমার মুঠোয়। ফেসবুকেও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ কথার ঢেউ আছড়ে পড়েছে।

-ভালো আছেন? ফোনে পেলাম না, বেশ কয়েকবার ট্রাই করে। আমার মা খুব  টেনশন করছে আপনাদের নিয়ে।

-আর ইয়্যু ওকে?

-প্লিজ কন্ট্যাক্ট মি এসাপ

তুলিকার অনুরোধে আঙুল ছোঁয়াতেই ওর প্রোফাইলের ছবিটা ভেসে ওঠে। আর  সেই প্রথম ওকে আবরণহীন দেখা।

একদিন কথায় কথায় তুলিকার ছবিটা আম্মাকে দেখালাম। অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে আম্মা বলল, ওর মায়ের সাথে ফোনে ধরায়ে দিস তো আমারে!

তুলিকা সব শুনে আমাকে বলল, আরেকটু অপেক্ষা করো প্লিইজ, যেদিন করোনা শেষ হবে, সেদিনই আমাদের বিয়ে।

আমি তবু প্রতিদিন অন্তত সাতবার করে বলি, তুলি, চলো আমরা বিয়ে করে নিই।

তুলি কৌতুকের ছলে মাথা দুলিয়ে বলে, আচ্ছা! চলো করে নিই। পিপিই হবে আমাদের বিয়ের পোশাক।

বিয়ের পোশাক পরে আমি আজকাল প্রতিদিন অপেক্ষা করি। আজকে সকালে ফোনটা পাবার পর থেকে ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছি। ও সম্মতি না জানালে বিয়েটা হবে কী করে!

ওর দুই হাতে দুটো পানিভর্তি গ্লাভস মুঠো করে রাখা। বোধহয় আজ সকালেই নার্স দিয়েছে। সেদিন ফেসবুকে দেখেছি ব্রাজিল না কোথায় যেন মৃত্যুপথযাত্রী করোনা রোগীকে এই পদ্ধতিতে বিদায় দেয়া হয়। শেষ মুহূর্তে রোগী অনুভব করে প্রিয় কেউ তার হাত ধরে রেখেছে।

গতকাল যখন ডাক্তারকে ব্যাপারটা বললাম, তিনি বললেন এটার ব্যাখ্যা আসলে  এমন নয়। গরম পানি ভর্তি গ্লাভস দেয়া হয় অন্য কারণে। তিনি এমনকি সহজ কথায় কারণটাও বলেছিলেন আমাকে। তখন কি সেসব বোঝার অবস্থা আমার ছিল!

আমি শুধু অবুঝের মত, ঘোরগ্রস্তের মত বলেছি, তবু যদি সম্ভব হয়

আচ্ছা তুলিকা কী ভাবছে? ওর হাতে আমার উষ্ণ হাত? কিংবা ওর মায়ের? মা বলছেন, ভয় পেয়ো না, তুমি একা নও, আমরা সাথে আছি!

জানি না তুলিকা আদৌ কিছু ভাববার সময় পেয়েছে কিনা। এইমাত্র ডাক্তার এসে নার্সকে বলে গেলেন আর সময় নেই, এবার বিছানাটা খালি করতে হবে। অর্থাৎ ওকে নিয়ে ফিরতে হবে এবার।

সেই গাড়িটা বরাবরের মত অপেক্ষা করছে। প্রতিদিন যেমন করে। শুধু গাড়ির যাত্রী বদলে যায় রোজ।

তুলিকে গাড়িতে তোলার সময় ফিসফিসিয়ে বললাম, দেখো, আমাদের বিয়ের দিন  বরযাত্রীরাও প্রত্যেকে সাদা পোশাক পরে এসেছে!

তুলিকাকে নিয়ে ওরা চলে গেলেও আমি চোখ বুজলে দেখতে পাই ওর লজ্জাবনত মুখ। সেই মুখের ওপর কনে দেখা আলো ঝিলমিল করছে।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন