কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ মে, ২০২১

শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়

 

ম্যানারিজিম - স্বল্প সময়ের নির্ভীক ভাষ্য




 

(৪)

রেনেসাঁ যুগের ছবির প্রসঙ্গ উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিখুঁত, সুন্দর, স্বাভাবিক, নমনীয় প্রতিটি ভারসাম্যপূর্ণ শরীরী সংগতি যার অবয়বগুলো অর্জন করেছে “এলিগেন্ট- গ্রেসফুল- স্পিরিচুয়াল” প্রকাশ। আর এখানেই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর (১৪৭৫-১৫৬৪) কাজকে খুঁজে দেখার। তিনিই একমাত্র রেনেসাঁ হতে বারোক এই পুরো পটভূমি পরিবর্তনের সাক্ষ্য নিজের কাজের মধ্য দিয়ে ধরে রেখেছেন। একজন মহৎ শিল্পীর বৈশিষ্ট্যই হলো যুগোসন্ধির সঠিক চরিত্রকে অনুধাবন করতে পারা। তাঁর কাজে একদিকে যেমন নিখুঁত শৈলীর প্রয়োগ,  তেমনি সিস্টেইন চ্যাপলের কাজে বা লাস্ট জাজমেন্টের ফেস্কোতে ম্যানারিজমের ছাপ সুস্পষ্টউজ্জ্বল আলোর প্রয়োগ, রঙের বর্ণছটা ও পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ভাবনাচিন্তার প্রসার বারোকের দিকে পথচলাকে করেছে এই ফ্লোরেন্সীয় শিল্পীর কাছে উন্মুক্ত ও প্রশস্ত। ছবিতে সম্ভ্রমই যে শেষ কথা হতে পারে না আবার ন্যাচারালিজমই যে একমাত্র অদৃষ্ট নয় ‘ইগনুডো’র ব্যতিক্রমী কাজই এই সকল চিরাচরিত প্রথাকে  ধাক্কা দেয়। শরীরের গঠন নতুন প্রশ্নের সন্মুখীন হয়। রহস্য কৃত্রিমতা, অসংগতি ১৫০৮-১২ সালের মধ্যে আঁকা ম্যানারিজমের বিস্ময়কর ফসল। এ সময়ে সিস্টেন  সিলিং–এর কাজে বিশাল মানব শরীর, সাহসী রঙ, রেখার ঋজুতা, একাধিক চরিত্রের সমাবেশ নতুন আবহ সৃষ্টি করে। ফেস্কোর সাইকোথেলিক টোনালিটি ও স্টাইলিসনেস গতিময়তার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এইসবই ছিলো ম্যানারিজমের ভিত্তি স্বরূপ। ১৫৩৪-৪৬ পর্যন্ত রোমে থাকার সময় যীশুর ছবিতে পূর্ব ধারণাকে নসাৎ করে অভিনবত্ব সঞ্চার করেন যা কল্প জগতে নতুন মাত্রা প্রদান করে। সেখানে যীশু নগ্ন, বলিষ্ট, পুরুষালী ও পেশীবহুল অভিব্যক্তিতে। ডেভিড, পিয়েটা, এ্যাডোনিস-এর যাত্রার যেন পরিপূর্ণতা খুঁজে এনে দেয় এই ম্যানারিস্টের উন্মুক্ত ভাবধারা। মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর কাজের দ্বারা অনেক ম্যানারিস্টই প্রভাবিত ছিলেন গভীরভাবে। বিভিন্ন শিল্পীর ক্যানভাসে অ্যাঞ্জেলোর গতিময়তা ও কাব্যিক রূপকে অনুকরণের প্রাধাণ্য লক্ষ্য করে হাসার উল্লেখ করেছেন – “Painting in the manner of Michelangelo” যা তার অসীম প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ।

অন্যদিকে রেনেসাঁর পড়ন্ত বেলায় খুব দ্রুত পটভূমি পরিবর্তিত হয়ে ক্যানভাস হয়ে  ওঠে অধিক মাত্রায় উজ্জ্বলধরা পড়ে তীব্র ভাষা, অসংগতিই যেখানে নতুন ভাষার নামান্তর। অ্যানাটমির ভাঙ্গাগড়া, ভাবাবেগের আতিশয্য, আলোর ও ন্যুডের নতুন আঙ্গিক জন্ম দেয় বাগ্ময়তা। পুরনো সংগতিপূর্ণ মনোভাব প্রকাশের প্রতি দেখা গেল তীব্র অনাস্থা। মাস্টার পেন্টারদের থেকে সরে এসে ছবি এখন সাধারণের ধরা ছোঁয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে ভাষ্য খুঁজে নিলো। ব্যক্তিগত আবেগ, চিন্তন, মনন প্রাধান্য পেল ধর্মীয় অনুষঙ্গ। বিষয় নির্বাচনেও এলো স্বতন্ত্রতা। ছবিতে স্পেস খুঁজে পেলো বহুমাত্রিকতা। পূর্বের শুষ্ক, ব্যকরণগত নিখুঁত পরিসরের বদলে বুদ্ধিমত্তা, ভ্রম ও নাটকীয়তার গভীরতা প্রদানে সচেষ্ট হলেন ম্যানারিস্টরা। পরিসর ব্যবহারে অসংগতি, ফাঁকা জায়গার আধিক্য আবার কখনো মাত্রাতিরিক্ত অবজেক্টের ব্যবহার ভাবনাকে ধাক্কা দেয়।

ম্যানারিস্টরা আলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা সাহসী পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। আলোর একমুখী মৃদু সঞ্চরণের পরিবর্তে একাধিক উৎস থেকে আলোর বন্যা ছবিতে এক অদ্ভুত স্বপ্নময় জগতের সৃষ্টি করে। ছবিগুলো অনেক বেশি  উজ্জ্বল এবং নাটকীয় অভিব্যক্তি সৃষ্টিতে সক্ষম। ছায়া প্রয়োগে ব্যকরণ বর্হিভূত ব্যবহার আপাতভাবে ভুল বা ভ্রম মনে হলেও সেই সকল পরীক্ষানিরীক্ষাই ছিলো অ্যাবস্ট্রাকশনের দিকে যাত্রার সূচনা। আলোকে স্বর্গীয় মঞ্চ তৈরি করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় এ সময়। পারমানজিয়ানোর ‘ম্যাদোনা’ ও ‘সন্তসহ শিশু’ ছবির আলোর ব্যবহার এখানে বিশেষভাবে উল্লেখিত অথবা জাকোকো দো  পনটরমোরের ১৫২৫-২৮ সালের মধ্যে আঁকা ‘এনটম্বমেন’ বা ‘ডেপোসিসন ফরম দ্য ক্রস’ ছবিটি।

ম্যানারিস্টদের মধ্যে এই সেই পারমিজিয়ানিনো যিনি ১৫২৪ খ্রীঃ মাত্র পাঁচটি ছোট মাপের ছবি নিয়ে ইতালীর পারমা থেকে রোমে আসেন এবং পরবর্তীকাল তাঁকে সনাক্ত করে ‘রাফায়েল রিবর্ন’ – হিসেবে। তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিলো উডকাট ও রূপার প্লেটের কাজে এচিং পদ্ধতির প্রয়োগে। পারমানজিয়ানিনোর (১৫০৩-৪০) ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে সনাক্ত করা যায় ল ম্বাটেশ রীরী বিভঙ্গকে। কৃত্রিম  আলোর সঞ্চার, উজ্জ্বল রঙ প্রথাকে নসাৎ করা টেক্সচার, লাল চকের ট্রিটমেন্টে ঔজ্জ্বল্য ও শক্তি প্রকৃতই – ‘বিউটি বিয়ন্ড নেচার’এর সাক্ষ্য স্বরূপ। তাঁর কাজে  করিজ্জিয়ো, ভিঞ্চি ও ড্যুরের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। তাঁর অপর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো কাঠের ওপর আয়নার উত্তল এফেক্ট সৃষ্টি করা ও একটি হাতের ডিস্ট্রশনের শৈল্পিক ব্যঞ্জনা। আয়নার পিছনের দেওয়ালে সৃষ্ট স্পেস চোখকে আরাম ও  গভীরতা প্রদান করে। এছাড়াও তাঁর ‘ম্যাদোনা অব দ্য লঙ নেক’ ম্যানারিজমের অনবদ্য সংযোজন। লম্বাটে শরীরের তুলনায় ক্ষুদ্র পায়ের পাতা, লম্বা গলার  স্বেচ্ছাকৃত বিভ্রান্তি আবার যীশুর বিভঙ্গেও নাটকীয়তা আবেগের অতিশয্য, যেখানে ক্রমান্বয়ে গড়ে তোলা আলোছায়া গভীরতা ও রহস্যের আবহ যোগ করেছে।

ম্যানারিজমের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ‘কিউপিড ক্রারভিঙ হিস বো’ –  যেখানে মানব শরীর প্রয়োজনের তুলনায় লম্বাটে, চড়া আলো – রিফ্লেক্টিভ অ্যানাটমি যেন হাড়শূন্য অথচ ছবির প্রাণ তাই বলে অন্তঃসারশূন্য কিন্তু নয়। অর্থাৎ  ম্যানারিজম যেন ঠিক ভুলের এক নতুন সীমানা ভাঙ্গাগড়ার খেলায় মেতে ওঠে আপন খেয়ালে, জন্ম নেয় এক্সপ্রেশনিজম খানিকটা বেখায়ালেই। মাত্র সাঁইত্রিশ  বছরের জীবনে তাঁর ছবি এমন উচ্চতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলো ও ম্যানারিজমকে নির্দিষ্ট অভিরূপ দিতে পেরেছিলো বলেই তাঁকে ‘প্রিন্স অব ম্যানারিজম’ বলে অভিহিত করা হয়।

রেনেসাঁ ছবির অন্যতম সম্পদ ছবির ফিগার। মানব-মানবী তথা শিশুর শরীর সঠিক  কাঠামো অনুসারে অঙ্কনে অসামান্যতা অর্জন করেছিলো এসময়। অ্যানাটমি ডিটেলিঙের ক্ষেত্রে যখন অতিরিক্ত কিছুই আর করার অবশিষ্ট ছিলো না। অ্যাঞ্জেলো বা ভিঞ্চির মতো উচ্চতায় পৌঁছনোর কোনো সম্ভাবনা আর যখন নেই, ম্যানারিজমও  এই পরিণতিকে মেনে নিয়েই সচকিতভাবে খনিকটা কৃত্রিমতাকে প্রশ্রয় করে এক শৈল্পিক ডিট্যুরকে অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রকাশ করলো। আসলে ম্যানারিজম পদ্ধতিগতভাবে যতটাই বিকল্প পদ্ধতির অনুসন্ধানে সচেষ্ট থাকুক না কেন, চিন্তা বিষয়বস্তু ও প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে ম্যানারিস্টরা ছিলেন ততোধিক সংবেদনশীল। ফলে তাঁরা ক্যানভাসকেও করে তুলতে পেরেছিলেন সাবলাইম পোয়েট্রির এক একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যা সেই সময়ের তুলনায় এগিয়ে ছিলো আঙ্গিকগতভাবে। শরীরী গঠনের নতুনত্ব এবং বৈপ্লবিক অসংগতির পাশাপাশি পোশাকের নির্মাণের ক্ষেত্রেও  অধিকভাবে ভার আরোপ করা হতো। ফ্লোরেন্সে ব্যবহৃত হতো দীর্ঘায়িত শরীরী অবয়ব আর উত্তর ইতালীতে আধিক্য ছিলো ন্যাচারাল শৈলীকে আঘাত করার আক্রমণাত্মক প্রবণতা।

ছবির আরেক দিক ছিলো আবেগের অত্যধিক প্রকাশ। কখনো শিশুর মুখে অত্যধিক উজ্জ্বলতা আবার কখনো মানবীয় মুখগুলোর বিপন্নতা, বিষণ্ণতা সমস্ত আবেগই ধরা  পড়তো সুষ্পষ্টভাবে। কোনো স্বর্গীয় মহিমায় চরিত্ররা ধরা পড়ে নি পূর্বসূরীদের ক্যানভাসের ন্যায়। একই পটে চরিত্রদের সংখ্যাধিক্য যেমন ছিলো বেশি, তেমনি  প্রতিটি চরিত্রের মুখে অভিব্যক্তিকে বাইবেলীয় কাহিনী অনুসারে পরিপুষ্ট করতে পারদর্শিতা অর্জন করেছিলো ম্যানারিস্টরা। ছবিতে গতি আনার জন্য অধিকাংশ  ফিগারই চলমান। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও অদ্ভুতভাবে দেখা যায় মাথার মুভমেন্ট পায়ের  বিপরীতে যা ছবিকে গতি দিলেও ভারসাম্য বিঘ্নিত করে। ফলে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের নির্মাণচ্যুত হয়ে দেখা যায় ভাবাবেগের সংমিশ্র। চড়া, ভারী, চাপচাপ ঘন রঙ,  তুলির মোটা প্যাচ, আলোর নাটকীয় উপস্থিতি ছায়ার ব্যবহারের ব্যকরণ বিচ্যুতি, বেখেয়ালীপনা, ল্যান্ডস্কেপে একাধিক উড়ন্ত পশু ও ফিগারের সমাবেশ, অপ্রাসঙ্গিক ব্যস্ততা ম্যানারিজমের নিজস্ব এক ঘরাণার সৃষ্টি করেছে। যাকে এক কথায় যথার্থই বর্ণনা করা যায় “স্টাইলিশ”- বলে। তাই ম্যানারিজম সম্পর্কে চিত্র সমালোচকের এই উক্তি প্রাসঙ্গিক যে- “Mannerism is first and foremost a violent reaction to and a dramatic departure from, the ideal order of the art of the Renaissance.

 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন