ইচ্ছেকুসুম
অনেকক্ষণ থেকে মাছওয়ালার হেঁকে যাওয়া কানে আসছিল পূরবীর। হাতের কাজ সারতে
সারতে গা করেনি সে। কিন্তু আওয়াজটা তাদের বাড়ির সামনে এসে থামতেই পলাশের দিকে চোখ চলে গেল। অদ্ভূত চোখে পলাশ
তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পূরবী সেই দৃষ্টির সামনে আস্তে আস্তে মাথা নামিয়ে নিল। বিবর্ণ সোফাটা
ঘষে ঘষে সাফ করতে করতে মৃদু স্বরে বলল, ‘একটু চা করি আদা গোলমরিচ দিয়ে?’
আর তো কয়েক ঘণ্টা! পলাশ চেয়েছিল সমস্ত কাজ থেকে পূরবী আজ ছুটি
নিক। ক’টা বছর ঘর বাইরে সামাল দিতে দিতে সোনার অঙ্গে কালি পরে গেছে। আজ অন্তত একটু
বিশ্রাম নিক। পূরবী হেসে উঠেছিল, অভ্যাস কি আর সহজে ছাড়া যায়? অন্তত বাসিঘর সাফসুতরো করে একসঙ্গে
বসে চা-টুকু খাওয়ার
বিলাসিতা তার পরিশ্রম মনেই হয়না!
পাঞ্জাবির পকেট থেকে দুটো একশ টাকার নোট বার করে পূরবীর দিকে
এগিয়ে দিল পলাশ। টাকা ক’টা হাতে নিতে সঙ্কোচ হয় বড্ড। বাইরে মাছওয়ালার হাঁকডাক বাড়ে, ‘জ্যান্ত রুই আছে, ভালো ট্যাংরা আছে
বৌদি!’ পলাশ ইশারা করে, ‘যাও!’ পূরবী দু’পা এগিয়েই থমকে যায়। প্রশ্ন করে, ‘দুপুরে রান্না
করব তাহলে?’ কৌতুকে দু’চোখ চকচক করে পলাশের, ‘গরম গরম মাছ ভাত মন্দ কী!’
দরদাম করে কিছুটা রুই নেবার পর
দেখল অল্প ট্যাংরাও হয়ে যাবে। হঠাত পূরবী আহ্লাদে গলে যেতে যেতে বলল, ‘মাছ কিন্তু
বেছে দিতে হবে, তবেই নেব বলাই!’ মাছওয়ালা বলাই বারান্দায় মাছ কাটতে বসে যায়। পূরবী
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বলাইয়ের পেশিবহুল হাতের নড়াচড়া দেখতে থাকে লোলুপের মত। দেখতে
দেখতেই পলাশের শীর্ণ হাত দুটোর কথা মনে পড়ে যায়। গতরাতে ঐ হাতেই তাকে বুকের মধ্যে
টেনে নিয়েছিল পলাশ। মুখে চোখে হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল, ‘এই সিদ্ধান্তে তুমি খুশি
তো? ভেবে দেখ, এখনো সময় আছে!’
ইউথ্যেনশিয়া কাকে বলে জানেনা পূরবী,
সে শুধু জানে পলাশ আর পারছে না মারণ রোগের সঙ্গে লড়াই করতে। টাকাপয়সা ফুরিয়ে আসছে,
বসতবাড়িটাও বন্ধক দেওয়া হয়েছে। পলাশ মুক্তি চায়। পূরবীও লড়াই করে করে ক্লান্ত। সেও
স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে নিতে চায়। সেইমত গতরাত্রে আলাদা আলাদা সুইসাইড নোটও লিখে
রেখেছে। আর তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা!
দুটো থালায় গরম ভাত বাড়ে পূরবী।
থালার পাশে সর্ষে দিয়ে কষা ট্যাংরা আর রুইমাছ ভাজা। দুটো বাটিতে মাছের ঝোল সাজিয়ে
রান্নাঘরের তাক থেকে বিষের শিশিটা হাতে তুলে
নেয় পূরবী। বাইরে পলাশ অপেক্ষা করছে।
শিশির ঢাকনা খুলতে খুলতে দু’চোখের
পাতায় ভেসে ওঠে বলাইয়ের পেশিবহুল হাত,
চওড়া কাঁধ। পূরবীর হঠাত ভীষণ বাঁচতে ইচ্ছে করে। একটা বাটিতে শিশির অর্ধেক তরল ঢেলে
দেবার পর বাকি অর্ধেকটা নিয়ে থমকে দাঁড়ায়। ঠিক বুঝে উঠতে পারে না পূরবী, ঢালবে কি
ঢালবে না!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন