ফার্নান্দো পেসোয়া : ‘দ্য বুক অব ডিসকোয়ায়েট’
সেদিনটা ছিল ১৮ মার্চ ১৯১৪। পর্তুগিজ কবি ফার্নান্দো
পেসোয়া কিছু কাগজ নিয়ে তন্ময় হয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। সম্ভবত সেই বিশেষ দিনটাই আধুনিক
সাহিত্যের জন্য সবচেয়ে আনন্দময় একটি দিন
ছিল। পেসোয়া স্বয়ং বলেছেন, ‘ওই একদিনেই আমি ৩০টা কবিতা
লিখলাম। কবিতাগুলোর ধরন আমি সংজ্ঞায়িত করতে পারব না। ওই দিনটা ছিল আমার জীবনের
সবচেয়ে আনন্দের দিন এবং সেই দিনটাকে ফিরিয়ে পাওয়া বা আবার সেভাবে কবিতা লেখার
অভিজ্ঞতা র্অজন করা অসম্ভব।’
‘দ্য বুক অব ডিসকোয়ায়েট’ বা ‘অশান্তির বই’ একটি কবিতা সংকলন। পর্তুগিজ কবি ও লেখক
ফার্নান্দো পেসোয়ার কবিতা সংকলন। যদিও এ বইটি
প্রকাশিত হয়েছিল পেসোয়ার মৃত্যুর পর।
আর সেজন্যই বইয়ের সব কবিতাই যেমন ছিল, তেমন
অবিকৃত অবস্থায় হুবহু প্রকাশিত হয়েছে। পেসোয়া
এসব কবিতা সম্পাদনা করেননি। এই কবিতাগুলি পেসোয়ার নিজের কথায় বলা যায় , ‘সত্যতা ছাড়া আত্মজীবনী।’ যদিও পেসোয়া
গবেষকরা এখনো বইটির ইতিহাস ও কবিতা নিয়ে ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৮২ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পেসোয়ার মৃত্যুর
৪৭ বছর পর। বিস্ময়ের ব্যাপার,
পেসোয়া মারা গিয়েছিলেন ৪৭ বছর বয়সে ১৯৩৫ সালে। নিঃসন্দেহে বিষয়টি কাকতালীয়। প্রকাশিত হবার পরপরই আলোড়ন সৃষ্টি করে পেসোয়ার
কবিতাগুলি।
১৯৮৪ সালে বইটি স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৮৫-তে
জার্মান, ১৯৮৬-তে ইতালিয়ান, ১৯৮৮-তে ফরাসি এবং
১৯৯১ সালে ইংরেজি ভাষায় রূপান্তর করা হয়, পর্তুগিজ ভাষায় লেখা মূল কবিতাগুলো।
ইংরেজিতে বেশ কয়েকজন পেসোয়ার এই
কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ করেছেন।
ফার্নান্দো পেসোয়ার জন্ম হয়েছিল ১৮৮৮ সালের ১৩ জুন
তারিখে। তাঁর সম্পূর্ণ নাম ফার্নান্দো
অ্যান্তোনিও নগ্যুয়েরা পেসোয়া। পেসোয়া ছিলেন কবি, লেখক,
সাহিত্য সমালোচক, অনুবাদক, প্রকাশক ও দার্শনিক। একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা পর্তুগিজ কবি হিসেবে
পরিগণিত এই কবি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা থেকেও
পর্তুগিজ ভাষায় অনুবাদ করেছেন। ১৯৩৫ সালের ৩০
নভেম্বর মৃত্যু হয় বিশ্বখ্যাত পর্তুগিজ কবি পেসোয়ার।
বাঙালি কবি আবু তাহের তারেক পেসোয়ার বইটির বঙ্গানুবাদ
করেছিলেন মূল পর্তুগিজ ভাষা থেকে। তিনি সে সময়
পর্তুগালের লিসবুয়াতে বসবাস করতেন। নাগরী প্রকাশন থেকে তাঁর অনূদিত বইটি প্রকাশিত
হয়। আবু তাহের তারেক কীভাবে পেসোয়ার বইটির প্রতি ও কবি পেসোয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে
অনুবাদ শুরু করেছিলেন এবং সে সময় পেসোয়ার
কবিতার যত ভেতরে তিনি প্রবেশ করছিলেন ততই
তাঁর ঘোর যেভাবে তাঁকে আবিষ্ট করে ফেলেছিলো, তা তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। তারেকের তখনকার মানসিকতা
এবং পর্তুগিজ কবিতাকে বাংলায় অনুবাদ করে নিজের মত অনুভব করে তা তিনি ব্যাখ্যাও
করেছেন। তারেককে অনুসরণ করে আমরাও পেসোয়ার কবিতা উপলব্ধি করতে পারি।
এক অ্যান্টিক শপের বৃদ্ধার কাছে তারেক প্রথম পেসোয়ার
নাম শুনে আগ্রহান্বিত হয়েছিলেন। পরদিনই তিনি এক বুকশপে গেলেন, তাঁর
নজরে পড়ে গেলো একটি 'অবধারিত' পংক্তি :
শূন্যে অবশিষ্ট থাকে শূন্য।
আমরা কিছুই না।
এই লাইন পড়ে তারেক যেন এক 'ধন্ধে'
পড়ে গেলেন। ভাবলেন বাংলায় অনুবাদ করে পড়লে কেমন হয় দেখা যেতে পারে।
করলেনও তাই। কবিতাটি অনুবাদ করে পড়ার পর
আরো আরো কবিতা অনুবাদ করার নেশা তাঁকে পেয়ে বসলো। কিছু অনুবাদ করার পর মনে হলো
তাহলে তো পুরোপুরি কবিতাগুলি অনুবাদ করলে পুস্তকাকারে প্রকাশই করা যেতে পারে। তিনি তখন উৎসাহ ও ভালো লাগায় তন্ময়। সে
সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ মালেক ভাইয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করলেন এবং তিনি জানালেন বইটি
প্রকাশ করবেন। এভাবেই একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদের কাজ শুরু হলো।
তারেক তিন বছর ধরে পর্তুগালের বাসিন্দা। তাই পর্তুগিজ
ভাষা অনেকটাই রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পেসোয়ার কবিতা কবির স্বভাষায় পড়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন পর্তুগিজ ভাষা থেকেই অনুবাদ
করার জন্য। পেসোয়ার কবিতাগুলি উচ্চ মাত্রায় অর্গানিক, অপ্রয়োজনীয়
শব্দ নেই, স্বচ্ছন্দ গতিতে তরতর করে এগিয়ে চলে। ভাষায় লালিত্য
গাম্ভীর্য কম হলেও এক চলমান মুগ্ধতা কবিতাকে শুরু থেকে শেষ অব্দি টেনে নিয়ে যায়
বলে তারেকের অভিমত।
পর্তুগাল এমনকি ইউরোপেও বিংশ শতাব্দীতে ব্যাপক পঠিত
কবি ফার্নান্দো পেসোয়া। ইউরোপের অন্যান্য
আধুনিক কবির মতো তাঁর কবিতায়ও প্রতীকবাদ, সুররিয়ালিজম প্রভৃতি
প্রচলিত নানাপ্রকার ইজমের প্রয়োগ লক্ষ্য
করা যায়। তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্য। সাহিত্যের
প্রচলিত নন্দনতাত্ত্বিকতা তথা সৌন্দর্য তাত্ত্বিকতাকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেছেন।
পেসোয়াকে বলা হয় পর্তুগালের ইতালো
কালভিনো আর বোর্হেস।
অল্প বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়া, বাবা
ও ভাইয়ের মৃত্যু — এসবের প্রভাব আছে তাঁর ব্যক্তিজীবনে এবং
লেখায়। দেশত্যাগ তাঁকে বোহেমিয়ান করে তুলেছিল অন্তরের অতলান্ত গভীরে। শেকড়চ্যুতি তাঁর জীবনদৃষ্টিকে দিয়েছিল বদলে। তারই ছাপ তাঁর কবিতার পংক্তিতে
পংক্তিতে।
তাঁর একটি কবিতা : ‘সফর’
দেশের পর দেশ হারানো হামেশা অন্য কেউ
শেকড়হীন আত্মা নিয়ে কেবল দেখতে দেখতে বাঁচা।…
জীবনের অন্য অনেক ঘটনার সাথে, এইসব
পাঠ, অভিজ্ঞতা কবির মধ্যে একধরনের
প্লুরালিজম তৈরি করেছে। এগুলোর চর্চাও তিনি করেছেন কবিতায়:
আমাদের মধ্যে বসত করে অগণিত প্রাণ
যখন ভাবি বা অনুভব করি
জানি না কে ভাবে আর অনুভব করে।
পেসোয়া’র মরমিপনাও দেখার মতো:
মৃত্যু হইল রাস্তায় বাঁক
মরা কেবল অদৃশ্য হওয়া
… … …
… … …
কেউ কাউকে হারায় নি কখনো
সকলই সত্য আর রাস্তা।
আবু তাহের তারেক পেসোয়ার মূল পর্তুগিজ ভাষার বইটি
অনুবাদ করেছেন বলে পেসোয়াকে এই অনুবাদে তাঁরই দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে বললে ভুল বলা হবে না। আলোচনায় ব্যবহৃত কবিতার পংক্তিগুলিও তারেকের সৃষ্টি।
তারেকের চোখে পেসোয়াকে দেখা বললে খুব একটা অন্যায়ও হবে না। এসব নিয়ে আলোচনার অবসর
থেকেই যায়। এখানে আবু তাহের তারেক অনূদিত দুটি কবিতা উদ্ধৃত করছি -
দ্যুতিময় বিড়াল
ভেতরের এই রাত্রি কখন দূর হবে, মহাবিশ্ব
আমি, আমার আত্মা, আমার
আসবে দিন
কখন জাগব আমি, এই জেগে থাকা থেকে
জানিনা। ওই উঁচুতে কিরণ দেয় সূর্য
উদাস তারা মিটমিট করে
বেশুমার তারা
হৃদয় স্পন্দিত হয় একান্তে
যায় না শোনা
কবে অবসান হবে থিয়েটারহীন এই নাটকের
নাটকবিহীন থিয়েটার
যেতে পারব ঘরে
কোথায়। কখন। কিভাবে
চেতনার চোখ নিয়ে তাকাইতেছে বিড়াল। গভীরে উঁকি দেয় কে
সে। সে
যিহোশুয়’র মতো সূর্যকে থামতে
বলবে সে। আর জাগব আমি
তারপর হবে দিন
স্মিতহাস, নিদ্রিত আত্মা আমার
মৃদু হাসো। ভোর হবে
তেরছা বৃষ্টি
মিশরের বৃহৎ স্ফিংক্স ঢুলছে এই ভূর্জপত্রে
আমি লিখি, সে দৃশ্যগোচর হয় আমার
স্বচ্ছ হাতে
কাগজের কোণে জাগে পিরামিড…
আমি লিখি। হতবাক, আমার কলমের ডগায়
সম্রাট কেওপ্সের প্রোফাইল…
আমি থমকাই…
অন্ধকার ঘনায়
সময়ের অতল খাদে ডুবি…
মোমবাতির হালকা আলোয় পয়ার লিখতে লিখতে
পিরামিডের কবরে শায়িত আমি
কলমের প্রতিটি আঁচড়ে সমগ্র মিশর আমাকে চাপ দেয়…
রি রি হাসিতে ফেটে পড়ে স্ফিংক্স
কাগজের উপর কলমের খসখস আওয়াজ…
অবাঙ্মানসগোচর দৈত্যাকার হাত ঢুকে
আমার পেছনে, সিলিংয়ের কোণায় ঝাড়ু
দেয়
কাগজ আর কলমের মাঝখানে সম্রাট কেওপ্সের লাশ
খোলাচোখে, দেখছে আমাকে
আমাদের দৃষ্টিবিনিময়ের মাঝ দিয়ে বইছে নীল নদ
নিশানমোড়া উদ্দাম বারকি
অস্পষ্ট। আঁকাবাঁকা। কোণাকুণি
আমি আর আমার চিন্তায়…
পুরনো সোনার চিতায় মহান কেওপ্স আর আমি!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন