কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৯

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়




নদী থেকে বিদ্যার ত্রিদেবীর অন্যতমা, পরে একেশ্বরী: সরস্বতী



                                                                            
তিন তিনখানা, তিন কিসিমের সরস্বতী পুজো হয়ে গেলো, জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি জুড়ে। ৯-১০ ফেব্রুয়ারি দেবী সরস্বতী তো আছেনই; ৩০-১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা আমার কাছে বিদ্যাদেবীর প্রতীকই মনে হয়; আর ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষাদিবস তো বাংলাদেশ ছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গে ছাড়াও ভারতে এক সেকিউলার সরস্বতী পুজো ‘কালিমাটি’র এই সংখ্যাটা তার  পরেরটাই। কিন্তু ৯-১০ ফেব্রুয়ারি ক’জনের পুজো হলো? ছোটবেলায় গ্রামে দেখতাম উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ভাবে নিজের পুজোকে নাম দিতেন। সবাই সরস্বতী না ব’লে কেউ কেউ ‘ভারতীর আরতিতে’ ইত্যাদি দিয়ে ব্যানার সাজাতেন। কাউকে কিন্তু দেবী ইলাপূজার কথা বলতে শুনিনি। তিন বিদ্যাদেবী এক হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা দুঃখের। 

গ্রিক পুরাণে বিদ্যার বা জ্ঞানের দেবীর সংখ্যা নয়। এঁদের অধিক্ষেত্র আর প্রতীক নির্দিষ্ট। ক্যালিওপ-এর মহাকাব্য/লিখনফলক; ক্লিওর ইতিহাস/গোটানো পাণ্ডুলিপি; ইউটার্পি-র গান ও শোকগাথা/aulos নামের বাঁশি; মেলপোমিনি-র বিয়োগান্ত কাব্য/মর্মন্তুদ মুখোশ; পলিহিম্নিয়া-র স্তব?ওড়না; টার্প্সিকোরে-র নাচ/বীণা; থালিয়া-র মিলনান্ত কাব্য/মজার মুখোশ; আরইউরানিয়া-র জ্যোতির্বিদ্যা/খ-গোলক, দিক-নির্ণয় যন্ত্র।

 আর্যদের জ্ঞান, বিদ্যারও এক দেবী ছিলেন না। উপরে উল্লিখিত সরস্বতী, ইলা, ভারতী ছাড়াও অন্য নামও বেদে পুরাণে পাই। প্রথমে সরস্বতী ছিলেন সরস্বতী নদীর বৈদিক দেবী, যে নদী হিমালয় থেকে নির্গত হয়ে পশ্চিমবাহিনী হয়ে সমুদ্রে পড়তো। তাঁর তীরে মুনি ঋষিরা অর্চনা, বেদাভ্যাস, যজ্ঞ ইত্যাদি করায় তার জল ও তীর পবিত্র ছিল। তারপর নাকি দেবতা বরুণ তাঁর স্ত্রীকে চুরি করে কোথায় রেখেছে তা না করায় ক্রুদ্ধ মহর্ষি উতথ্যর অভিশাপে সরস্বতীর জল মরুভূমিতে গিয়েই নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। সম্ভবতঃ মরুভূমিপ্রসারে সরস্বতীর জল শুকিয়ে যাওয়ার পর থেকেই সরস্বতী নদীর আর্চনিক পবিত্রতা তাঁকে বাক, বিদ্যা, সাংস্কৃতিক কলাবিদ্যা ও বিজ্ঞানের দেবী করে তোলে। জনগণের কাছে সংস্কৃত ভাষাকে নিয়ে আনার গৌরব তাঁকেই দেওয়া হয়। কিন্তু শ্রীঅরবিন্দ তাঁর Secret of the Veda গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, সরস্বতীর নাম কেবল অন্যান্য নদীর সঙ্গে  নয়, অন্যান্য দেবীর সঙ্গেও, বিশেষ ক’রে ইলা ও ভারতীর সঙ্গে জড়িয়ে যায়, যাঁরা মনস্তাত্বিক প্রতীকই ছিলেন। সরস্বতীর পাশে তাঁদের পূজাও হতো। পরবর্তী পুরাণিক অর্চনাপদ্ধতিতে সরস্বতী একাই হয়ে যান বাক্, বিদ্যা ও কাব্যের দেবী, ভারতী হয়ে দাঁড়ায় তারই এক নাম। কিন্তু বেদে ভারতী কেবল সরস্বতীর থেকে আলাদা দেবীই নন, তার আর এক নাম মাহী। ঋগ্বেদের পঞ্চম খণ্ডের পঞ্চম সূক্তে লেখা হয়েছে—
इळासरस्वतीमहीतिस्रोदेवीरमयोभुवः |
बर्हिःसीदन्त्वअस्रिधः ||



অর্থাৎ ‘ইলা, সরস্বতী, মহী, তিন দেবী যাঁরা সুখের জন্ম দেন, যাঁরা হোঁচট খান না’, অথবা ‘আঘাত করতে আসেন না’, ‘তাঁরা যেন এই যজ্ঞীয় আসনে তাঁদের স্থান নেন’ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১১০ নং শ্লোকে এই ভাবটিই আরো বিশদ করা হয়েছে —
नो यज्ञं भारती तूयमेत्विळा मनुष्वदिहचेतयन्ती |
तिस्रो देवीर्बर्हिरेदं सयोनं सरस्वतीस्वपसः सदन्तु ||

‘ভারতী যেন আমাদের এই যজ্ঞে দ্রুত আসেন, এবং ইলা এখানে আমাদের চেতনা (অথবা জ্ঞান। বোধসমূহ)-কে মনুষ্যবৎ জাগ্রত ক’রে, এবং সরস্বতী, তিন দেবী বসুন এই সুখভরা আসনে, নিজেদের কাজ সুসম্পন্ন করতে করতে। কিম্বা মধুছান্দস-এর অষ্টম সূক্তে ভারতীকে মহী নামে উল্লেখ ক’রে বলা হচ্ছে যে — ইন্দ্রের জন্যে মহী কিরণে ভরভরন্ত, নিজের প্রাচুর্যে উপচে পড়ছেন, সুখী সত্য (সুনৃত) হিসেবে নিজের প্রকৃতিতে তিনি যজ্ঞদাতার জন্য এক পক্ব শাখার মতো উদার। যজ্ঞে সরস্বতীর সঙ্গী মহী জ্ঞানের প্রতীক, কারণ বেদে আলোক ও জ্ঞান সমার্থক।   

एवाहयस्यसून्र्ताविरप्शीगोमतीमही |
पक्वाशाखानदाशुषे ||

শ্রীঅরবিন্দ বলছেন সরস্বতী যেখানে শব্দ, মহী সেখানে সুনৃত, অর্থাৎ সুখপূর্ণ সত্য। ইলাও সত্যের শব্দ, এক পরবর্তী বিভ্রান্তিতে তাঁর নাম বাক্-এর ধারণার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়। সরস্বতী যেমন চেতনাকে যথার্থ চিন্তায়, অথবা মনের যথার্থ অবস্থায় জাগ্রত করেন, ‘চেতয়ন্তী সুমতীণাম্’, ইলাও তেমনই করেন। তিনি ‘সুবীরা’ বা উদ্দীপনায় ভরপুর, জ্ঞানদায়িনী। তিনিও সূর্যের সঙ্গে যুক্ত, যখন অগ্নি, ইচ্ছা সূর্যের, সত্য আলোকের প্রভুর রশ্মিতে প্রজ্বলিত হয়, ইলার সঙ্গে এক মন হয়ে উঠে, ‘जुषस्वाग्नइळयासजोषायतमानोरश्मिभिःसूर्यस्य |’ তিনি সূর্যরশ্মিদের অর্থাৎ সূর্যের গোপালদের মা, তাঁর নামের অর্থ যিনি সন্ধান করেন ও পান, আর ঋতম্ ও ঋষির মতো এটি একই ভাবনা-অনুষঙ্গ ধারণ করে। ইলা তার ফলে দ্রষ্টার সেই দিব্যদৃষ্টি যা সত্যকে লাভ করে।



শ্রীঅরবিন্দ Secret of the Veda গ্রন্থে বলছেন সরস্বতী যদি শ্রাব্য-সত্য শ্রুতির প্রতীক হন, যা আমাদের দেয় অনুপ্রেরিত শব্দ, ইলা প্রতিনিধিত্ব করেন দৃষ্টির, সত্যদৃষ্টিরশ্রুতি এবং দৃষ্টি যদি কবি, ঋষি ও সত্যদ্রষ্টার দুই শক্তি হয় তবে সরস্বতী ও ইলার ঘনিষ্ঠ যোগের কথা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। এর সঙ্গে যদি মহী বা ভারতী সূর্যের ‘বৃহজ্জ্যোতির’ বা ‘ঋতম্ জ্যোতির’ মতোই সত্য-চেতনার বৃহতত্বের প্রতীক, যা মানুষের সীমিত মানসে অবতীর্ণ বা উদিত হয়ে আর দুই ভগিনী জ্ঞান-কর্তৃত্বকে আবাহন করে আনে। তিনের মধ্যে এই সূক্ষ্ম কিন্তু জীবন্ত পার্থক্য পরে বেদজ্ঞানের পতনের কালে অষ্পষ্ট হয়ে যায় আর ভারতী বা মহী, ইলা আর সরস্বতী মিলে মিশে এক হয়ে যান।

আদিবৈদিক যুগ থেকে উত্তরবৈদিক যুগ অবধি নদী থেকে জ্ঞানের ত্রিদেবীর অন্যতমা হয়ে শেষে একেশ্বরী হওয়ার পথে দেবী সরস্বতীর জন্মবৃত্তান্ত এবং পতিবৃত্তান্ত সমানে পাল্টেছে। পতিবৃত্তান্তর কথায় আদিবৈদিক যুগে সরস্বতী অগ্নির সঙ্গে যোজিত ছিলেন, ইলা ও ভারতীর সঙ্গে অগ্নির জিহ্বার তিন শিখা। আদিতম বৈদিক যুগের সূক্তগুলির বহুধা ঐতিহ্যে সরস্বতী এরপর প্রথমে ইন্দ্রের, পরে দেববেদ্য অশ্বিনীকুমার ভ্রাতৃদ্বয়ের স্ত্রী বা সঙ্গিনী। তার কারণ সরস্বতীর পবিত্রকারী জলের কারণে তার তীরে যজ্ঞে ব্রাহ্মণদের পশুবলি বিধেয় ছিল। আন্তঃউপজাতি লড়াইয়ের সময় তাঁর জল ব্রহ্মহত্যার পাতক থেকেও মুক্তি দিতো। ভেড়া আর ভেড়ী ছিল তাঁর প্রিয়তম অর্ঘ্য, নিরামিষ খিচুড়ি নয়। যজুর্বেদের সময় থেকে সরস্বতী বাক বা পবিত্র শব্দের সঙ্গে একার্থক হয়ে ওঠেন। ব্রাহ্মণগুলির সময়ে ব্রহ্মার পূজা যখন তুঙ্গে, সরস্বতী হয়ে গেলেন ব্রহ্মার স্ত্রী। কিন্তু পরে বৌদ্ধ এবং জৈনরা যখন ব্রহ্মাকে তাঁদের বেদ-বিরোধী, দেব-বিরোধী বার্তার প্রধানা উদ্দিষ্টা করলেন, তখনও সরস্বতী এই ‘heterodox and heteroprax’ ঐতিহ্যগুলির মধ্যেও টিকে থাকলেন তো বটেই, নিজের সম্মানের আসনও ধরে রাখলেন।
পুরাণগুলিতে সরস্বতীকে করে দেওয়া হলো ব্রহ্মার কন্যা, তাঁর মুখমণ্ডল থেকে সৃষ্ট। কিন্তু সরস্বতীর জন্মের পরে তাঁর রূপ থেকে চোখ সরাতে না পেরে, কামাতুর ব্রহ্মা তাঁকে অবলোকন করতে, চারদিকে চারমুখ তৈরি ক’রে ফেললেন। কিন্তু এর ফলে তিনি অপদস্থ হওয়ায় সরস্বতীকে বিষ্ণুর স্ত্রী করা হলো। ব্রহ্মার অবশ্য অজাচার অভ্যস্ত। মানসকন্যা সন্ধ্যার সঙ্গেও তিনি অশোভন ব্যবহার করায় শিবের হাতে একটি মস্তক হারান। বিষ্ণুর স্ত্রী হবার এই সময়েই সরস্বতীর গায়ে ওঠে বীণা, পাণ্ডুলিপি, রুদ্রাক্ষ জপমালা, পায়ের নিচে হংস। তবে পরবর্তী কিছু পুরাণ মতো, তিন সপত্নী গঙ্গা, লক্ষ্মী, ও সরস্বতীর বিবাদ অসহ্য হয়ে ওঠায় বিষ্ণু সরস্বতীকে ব্রহ্মার হাতে তুলে দেন, আর গঙ্গাকে শিবের হাতে।

ব্রহ্মার সঙ্গে সরস্বতীর বিবাহও সুখের হয়নিকোনো যজ্ঞে অধিষ্ঠিতা থাকাকালে ব্রহ্মা তাঁকে ডাক পাঠালে সরস্বতী তাঁকে অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু প্রতীক্ষা করতে অরাজী ব্রহ্মা তাঁর জন্য এক দ্বিতীয়া স্ত্রী, গায়ত্রীকে গ্রহণ করায় সরস্বতী তাঁকে শাপ দেন যে বছরে একবার ছাড়া তাঁর পূজা হবে না। কিন্তু গায়ত্রীও একার্থে বিদ্যার দেবী হয়ে ওঠেন। ব্রহ্মার স্ত্রী গায়ত্রী চতুর্বেদের মাতা হওয়া ছাড়াও, একাধারে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও তিন বেদ। গীতকারীদের ত্রাণ করেন।

তবে বেদ যে বেঁচে আছে তা সরস্বতীর জন্যেই। মহাভারত অনুযায়ী শ্রুতিনির্ভর বেদ যখন ক্ষীণবীর্য ব্রাহ্মণদের দুর্বল স্মৃতির কারণে মৃতপ্রায়, তখন সরস্বতীর পুত্র সারস্বতই তাদের জীবন্ত রাখেন। বৌদ্ধযুগে প্রজ্ঞাপারমিতার মিথও শুষে নিয়ে সরস্বতী উচ্চতম জ্ঞানের প্রতীক হয়ে উঠলেন।



পুজোর দিনে অতি পরাক্রান্ত এই মিথের কথা ভাবতে ভাবতে ভাবছিলাম এই মিশ্র, স্ববিরোধী উপাদানের ইন্ডিক ঐতিহ্যের গর্বিত উত্তরাধিকারী আমি। সরলীকরণে কে আমায় মজায়! সম্বিত পেয়ে দেখি পাতের ডিম-পাঁউরুটি তেমনি  পড়ে আছে। থাক, আজ নিরামিষাশ

গ্রন্থসূত্র

1.   Sri Aurobindo, Secret of the Veda, Volume 15: The Complete Works of Sri Aurobindo (Pondicherry: Lotus Press, 2018), pp. 94-97.
2. George M. Williams, Handbook of Hindu Mythology (Oxford;  New York : Oxford University Press, 2008), p. 257;  সুধীরচন্দ্র সরকার, পৌরাণিক অভিধান (কলকাতা: এম. সি. সরকার, ১৩৯৬/১৯৮৯), পৃঃ ৫৩৬, ৫৪১-৪২।
3. Charles Russell Coulter, Patricia Turner (eds.) Encyclopedia of Ancient Deities (Oxon, New York: Routledge, 2012), pp. 413-14.
4. সরকার, পৌরাণিক অভিধান, পৃঃ ১৪৭-৪৮।
5. Williams, Handbook, p. 259; Coulter & Turner, Encyclopedia, 414.






0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন