কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

অভিজিৎ পাল

মঙ্গলকাব্য সিরিজ


মনসামঙ্গল 

দৈবের সাথে বিরোধ বাঁধাই। একটা আত্মমুখী প্রশ্নচিহ্ন হঠাৎ দীর্ঘায়ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। যে রসের পাত্র আত্ম-পরের বিস্তারিত জটিলতর জটিলতম হিসেব কষতে ভালোবাসে তার সামনে এনে ধরি অজস্র শুভঙ্করী ধাঁধা। সংগ্রামের কোনোদিন শেষ হবে না। আমার সংগ্রামের আনত পদচিহ্নগুলো নেমে আসছে দৈবের কাছে। আত্মযোগ্যতার সঠিক মাপকাঠির ভাষ্য বদলে গেছে আজ। আনত হচ্ছি অপগণ্ডের সামনে। আমি পুনশ্চ পুরাধুনিক বাধ্যকতায় নির্মাল্যের ফুল তুলে দিতে পারব তাঁর কাছে। এবারও ডানহাত ব্যবহার করব না...

চণ্ডীমঙ্গল

মঙ্গলময়ী আমার ক্যানভাসে এসে দাঁড়ান। আমি আমার সামান্য সম্বল দিয়ে উপাচার সাজাই। তিনি পরিপূর্ণ সানন্দে আমার তৃপ্তিবিধান করেন। প্রতিম সন্তানের পূর্ণতার প্রতি আমারও অসীম প্রচেষ্টা। আমার পিতৃপ্রদত্ত মহাজ্ঞানের স্মারক। আমার পিতার কখনই অধিকের ইচ্ছে ছিল না। আমাদেরও নেই। সেই সব স্মৃতিমেদুরতা ভরা দিনে আমরাও দৈনন্দিন আনন্দ ভাতে মেখে নিতাম পাঁচজনে বসে। অভাব ছিল না আমাদের, অভিযোগও না। আমরা যৌথবদ্ধ পরিসরের মধ্যে দিয়ে স্বাদ পেয়েছি পরিপূর্ণ সংসারের। আমরা কলিঙ্গরাজের সম্পদ চাই না...

ধর্মমঙ্গল

সংগ্রামের
পথে পা বাড়াই। এই সব চেনামুখ অবলীলায় আমার আত্মবিষয়ক পাঠবিশ্বে মিশে যেতে পারত। আমি সজ্ঞানে কোনো বিরোধ আঁকতে চাইনি কোনোদিন। অনুভবগম্য প্রেমময়ের কাছে বারবার শুধু পরীক্ষা দিয়ে গেছি শুদ্ধাচারের। আমার বৈরীতাযাপনের শর্তগুলো বড় বেশি ক্ষতিসাধক। এবার আমি মধ্যযুগীয় সংগ্রামের পথে হাঁটতে চাই। আমার আগে ডোম পরে ডোম সাজাচ্ছে অপারক সময়। বাতাসে ছুটে আসা মৈথুনকামী পরাগের রেণুমঞ্জরী কপালে আঁকছে জয়তিলক। আমার অভিযোজনহীন মনন বধ্যভূমির কাছে এসে দাঁড়াচ্ছেন স্বয়ং ধর্মরাজ। আমি আত্মপ্রদর্শিত পথে এবার সময়কে চালনা করতে চাই...

অন্নদামঙ্গল

শহরের
ওই কালো মানুষটাকে তুমি তো ভালোই চেনো। সেই যে, মহানগরের পাশে গুমটি বাঁধা ওর ঘর, ঠাকুর। অন্নপূর্ণার নবমাহাত্ম্য সেজে উঠুক এবার ওর ঘর থেকে। নির্দেশিত দু'টাকার চাল ওর ঘর অবধি পৌঁছায় না ঠাকুর। ওর হাভাতে ভাগ্য হলেও মাঝে মাঝে দু' পয়সা রাস্তার মন্দিরে বা দরগায় দিতে সে কার্পণ্য করেনি। তোমার ফি সপ্তাহের প্রাপ্তিযোগে এখনও অবসর হয়নি ওর হাতে। যে সমস্ত সস্তার ধূপ রোজ সকালে ওর জ্বেলে তোমায় মনে করে, তা জমালে কত কিলো চাল তো,  একবার হিসেব করে দেখো, ঠাকুর। একবার দেখো। ওর সরল বিশ্বাসে আরও সরল করে রেখো ঠাকুর। ওর ভাঁড়ারে দু'মুঠো চালের জোগার করে দিও। নইলে ওরও যে তোমার দেবত্বে সংশয় আসতে পারে...

কালিকামঙ্গল

আমার শরীরের ভেতর প্রবেশ করছে অপারক সূর্যালোকের অস্তিত্ব। আমি একটু একটু করে মহাবিষাদকে অতিক্রম করতে চেষ্টা করছি। অনেকদিন জাগতে চাইনি আমি। মহাতামস ব্রতের পূর্ণতায় অভীষ্টের পথে এগিয়েছি এক পা এক পা করে। আমার জন্য জেগে আছেন মহারুদ্রদেব। আমার জন্য জেগে আছেন শুভশক্তি তাঁর বুকের উপর। অকারণ কারণের হেতুর জটিল পাশ কেটে বেড়িয়ে আসছি আলোর নিশান চিনে। এখনও অন্ধের সহযাত্রী হতে চাই না আমি মানসালোকে। আলোয় আলোয় আলোযাপন শিখছি...

সারদামঙ্গল

ইচ্ছেগুলো
আকাদেমিক ডিগ্রীর উপর ক্রমশ আস্থাশীল হয়ে উঠছে। সমস্যা জটিলতার পাশাপাশি এবার কিছু পতাকাদণ্ড ক্যাম্পাসে অবস্থানকারী। আমরা কিছুই দেখছি না, শুনছি না, বলছি না। গান্ধারকন্যার মতো চোখ বেঁধে কাটিয়েছি বহু বছর। উত্তরণ নেই। সারস্বত ভাবনার গায়ে এসে লাগছে ক্ষতচিহ্ন। শ্বেতপদ্মের উপর চুইয়ে পড়ছে রক্তবিন্দু। রক্তকরবী নাটকের প্রথম পাঠের বিবর্তন হতে চলেছে। আশা রাখি কেতন ভাঙার দিকে। আর্বতনমূলক অধ্যাপনার অংশীদারীদের হাতে জন্মমৃত সদ্যজাত ভাবনার দল পুনর্জীবন পাচ্ছে কুটিলতায়। এই জন্মজার উপর আমাদের আর কোনো অধিকারবোধ খাটানো চলে না...

গঙ্গামঙ্গল

নদীর
সাথে কথা বলি। আমার নৈরাশ্যভরা একাযাপনের নিয়মাবলী নদী জানে। ভেসে যাওয়ার পর কীভাবে ফিরে আসতে হয়, কীভাবে উৎসমূল গায়ে মেখে নিতে হয়, নদী আমায় শিখিয়ে নেয় আত্মিক অনুভবগম্যতায়। আমি আমার যৌবনের উচ্ছ্বাসপূর্ণ উচ্চারণ করি। নদীর উপর আমার একার একটি অধিকরবোধ আঁকি যত্নে। হে প্রভু, আমি আমার শ্যাডোগ্রাফিগুলো এবার ভাসাতে চাই নদীপথে। আমার শৈশবের দিনে পিতামহের হাত ধরে যেমন করে আমাদের লক্ষ্মীপূজার বাণিজ্য নৌকা আমরা সানন্দে ভাসাতাম নতুনতর জলে...

শ্রীমঙ্গল

পৌরাণিক
সমুদ্রমন্থনের ইতিহাস থেকে পাঠ নিতে শিখি কীভাবে শ্রমবাদের সঙ্গে সাম্যবাদ এক রৈখিক হওয়া সম্ভব না। আসুরিক নির্বুদ্ধি দৈবী বুদ্ধিপ্রসূত জটের জাল ছাড়াতে ছাড়াতে নিজেই কখন অজ্ঞাতে জড়িয়ে গেছি জটিলতার আবর্তে। আমার চারিদিকেও এমন সব জটিলতা পাক খেয়ে আসছে। আমিও অঙ্গিকার করতাম একদিন নিগ্রহের মুখ থেকে হাসিমুখে ফিরে আনব পীড়িত মানুষগুলোকে। অজস্র যশস্বী একাকীত্বের সাথে সহবাস করে জেনেছি অস্থিত্বের সংগ্রামে কেউ জয়ী হয়ে গেলে সংগ্রামের ইতিবাচক ইতিহাস অক্ষয় করে রাখতে চায় না। অর্থনৈতিক চালচিত্র বারে বারে শুধু দিক বদলে ফেলে হাওয়া বুঝে...

দুর্গামঙ্গল

নরম রঙের দুঃখ বৃষ্টিতে ভিজেছিল উৎসবদিনে। বন্দিযাপন আর পত্রিকা বিলাসের মধ্যে আমার অস্তিত্বের লড়াই খুঁজছিলাম। পকেট ভরা স্বপ্ন আর কাঁধের উপর একটা বিশ্বাসের হাত ছাড়া আমার আর কিছুই সম্বল ছিল না। আমার চেতনার আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার আগে রাতের পর রাত তোমার কাছে মুখ গুঁজে কান্নার দাগ এখন হয়তো বা কিছু শুকিয়েছে। আমি ভেসে গেছি সময়ের স্রোতে। আমার নিঃসঙ্গ আত্মরতির মানচিত্রের উপর এবার তুমি চাইলেই বধ্যভূমির ছক সাজাতে পারো। নিজের জীবন সংগ্রামের রীতিপদ্ধতি ছাড়া আমার আর কোনো যুদ্ধকৌশল জানা নেই...

শিবমঙ্গল

প্রান্তিক
জীবনের ছন্দে অবগাহন করি। ক্ষুধার অন্নে দাবি জানাই অশেষ সাম্যবাদী দৃষ্টির। সংস্কৃত ছন্দের মতো বিশুদ্ধ এক ভাতের স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম আমি আপামর নিরন্ন মানুষের শুকনো থালায়। মঞ্চবদ্ধ চেয়ারের চাকচিক্যে বসে সেই মহাকাব্যিক অন্নমুখর আভিজাত্যে ক্ষুধার্তের অন্ন স্পর্শের কোনো সংবাদ গণতন্ত্রবিলাসী দেশে খাটে না। মহিমাময় শিব নেমে আসেন খাসজমিতে। কায়িক শ্রমের মর্যাদায় ভক্তের সাথে মেলে ধরেন হাল। অলৌকিকহীন ফসলের ভাগ তুলে দেন নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের পাঠে। পরম কুশলতায় ভক্ত আর ভাক্ত এক শ্রমে সাম্যবাদী গণতন্ত্রের অর্থ আবিষ্কারে মাতেন। আমি দেখে সমৃদ্ধ হতে থাকি...

রায়মঙ্গল

নাগরিকতার
বাইরে গিয়ে জেগে থাকে নিটোল সুন্দরবন। বাঘে মানুষের সহবাসের বৈচিত্র ফুটে ওঠে। দ্বীপ গড়ার আনন্দময় মঙ্গলগান শোনেন দক্ষিণরায়। হাতে তার অপার বিস্ময়চিহ্ন জেগে থাকে ব্যাঘ্রাসনে। এখান থেকেই শুরু হতে পারত প্রান্তবর্গীয় ইতিহাস। নিম্নবর্গচেতনার ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত। অসীম নীলিমায় আকাশরঙা একটা ভোরের গন্ধ এসে লাগছে আমার বিছানায়। একটি সঙ্গমকামী রাতের আবহ বদলে যাচ্ছে দ্রুত। আমি বদলে যাচ্ছি একটু একটু করে। কোনখানে কতটা দ্বিচারীব্রত নেওয়া চলে, তার ছান্দিক বিন্যাস আমার হাতের মুঠোয় বিমুক্ত হয়ে আছে। গড়ান গাছের কোঠর থেকে চেয়ে দেখছে প্রতিবাদী সুন্দরবন...

সূর্যমঙ্গল

জবাকুসুমের
মতো এক উজ্জ্বল আভা আমার আভিজাত্যহীন আভূমি নভোমন্ডল দশদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। মৃত্যুর শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে থেকেও অজানা কোনো এক দৈবের স্পর্শে আমি খুঁজে ফিরছি আমার উষ্ণতম দিন। আলোর রেখা ধরে চলি একা একা। আমার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা যৌন যাপনের মিথ্যে এক পাপবোধ আরও বদ্ধমূল হয়ে বসে। যে সম্পর্কবাহিত রতিবিলাস বিষাদ জাগিয়েছে প্রতিবার তার নাভিকমলে সানন্দে আত্মরতি খুঁজি। তৃপ্ত হই। তপ্ত হই। আকাশের ধূমল রঙের দিকে চেয়ে দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন অন্তরালবাসী মহাপ্রণম্য দিবাকর...

তীর্থমঙ্গল

আনন্দোৎসবের
পর নেমে আসে দলা পাকানো কষ্টের সুর। হৃদিবিলাসী দেবী ধ্রুবময়ী ধ্রুপদী পদে গৃহান্তরে গমন করেন। বেলুড় মঠের গঙ্গার ঘাটে ভাসাই মহাঘট। চর্চিত রাগানুগার স্পর্শ লেগে থাকে আমার যাপনে। আমিও তো সত্যকামী হয়ে বাঁচতে চাই। ভালোবাসতে চাই সেই সব ভালোবাসার কাঙাল মানুষগুলোকে যারা বিন্দু সিঞ্চনেই তৃপ্ত হওয়ার বাসনা রাখে বুক ভরে। ভালোবাসতে জানে। আমার দেবতার আসন পাতি লোকালয়ে। তাঁর মহৎ দিব্যজ্যোতির রেখায় ঔজ্জ্বল্যে ভরে ওঠে ভারতীয় উপমহাদেশের দর্শন চিন্তা। সন্ন্যাসীর গীতি ধ্বনিত হয়। মা কোল পেতে বসে থাকেন অপার স্নেহে। রামকৃষ্ণালোকে ছড়িয়ে যায় বহুজন হিতের বার্তা...


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন