কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

ময়ূরিকা মুখোপাধ্যায়

ফুঁ


পকেটমারের পকেটেও বোধহয় ভেদ করে যায় সে সুর ইসস্... এমন যদি কোনো  সুর বেরোতো, যেটা গলব্লাডারের পাথর গলিয়ে দিত, এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিত ক্যানসারের কূটবুদ্ধি, তাহলে বাবা বোধহয় দেখতে পেত যে, সত্যিই সত্যিই আমি এখন বাবারভালো ছেলেহয়ে উঠেছি একপাশে আর শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝোলে না, বরং দুকাঁধে সদর্পে চেপে বসেছে অফিস ব্যাগ টা এগারোর মাঝেরহাট লোকাল আর ফিসপ্লেটের সঙ্গে সমান্তরালে চলতে থাকা আমি-তুমি, আর সদ্য কাটা পড়া ক্যানভাস
সুরটার উৎপত্তি ঠিক কোন জায়গায়, বলতে পারব না তবে ওই বাগবাজার কি শোভাবাজার... ঠিক জানি না...
মোটামুটি ঐ জায়গাটাতে... বাঁশির সুরটা কেমন অগোছালো করে দিতে থাকে  সমস্তটা গঙ্গার ঐ ধারগুলো যেন ক্রমশ ঘোলাটে করে দেয় বাস্তব আর উদ্দেশ্যকে তবুও কোনোদিন ভুল করেও প্রিন্সেপ ঘাটের সাদা পিলারগুলোর কাছে ফিরিনি
জাপটে ধরে বসে থেকেছি মুভিংচেয়ার আর পেপারওয়েট, তবে আঁকড়ে ধরতে পারি নি
জীবন এখন আলোর গতি না হোক, শব্দের গতিতে চলে নিশ্চয়ই আর সেই শব্দের গায়ে আলগা হয়ে ঝুলে থাকা সুরগুলো আমার কানে ভিড় করে রোজ যাতায়াতের সময়
এ সুর বাঁশির কিন্তু কে বাজায় মন করে? কেমন নেশার মতো ঝিম ধরিয়ে দেয় সঠিক অনুপাতে মিলেমিশে যায় সারা শরীরে
নেশাটা ঠিক মদের মতো নয়, মহুয়া ফুলের মতো, যা অনেক দূর ধরে বিস্তৃত

দিন দিন নেশাটা অভ্যেসে পরিণত হচ্ছিল কিন্তু এর জন্য যে কে দায়ী, তার খোঁজ কোনোদিন করিনি ভুলে ছিলাম বেশ, কিন্তু ঘোরে থাকতে ভুলিনি জীবনের পরিধির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেত্রফল কীরকম ভাবে যেন কমে যেতে থাকছে তাই বোধহয় এখন সমস্ত কিছু, কলেজবেলার ক্যানভাস থেকে কনফারেন্স-এর নোটপ্যাডে এসে ঠেকেছে আঁকিবুকি কাটা বলতে ব্যাস ঐটুকই
সেই ন-দিন মালশা পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পুড়িয়ে ফেলেছিলাম সব কটা রং, সব কটা তুলি, সব কটা আঁচড় সেদিন জীবনের প্রথম এক্সিবিশান, প্রথম... একেবারে প্রথম...
অ্যাকাডেমিতে...
ছবিটার নাম দিয়েছিলাম স্বপ্ন যেটা আমি দেখেছিলাম, যে দেখাটা  বোধহয় তুমি চাওনি
সেদিন একজন কিনতে চাইল আমার ছবি সমগ্র রবীন্দ্রসদন চত্বর মনে হলো আমার দিকে তাকিয়ে প্রথম চেক বাবা... প্রথম চেক...
তোমার আমার বিরোধে যা মুখ্য বিষয়, তার হদিশই আমার কাছে ছিল কিন্তু তুমিই থাকলে না
ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হলো ম্যাসিভ অ্যাটাক কিন্তু ওটা তো... খুন ছিল! আমি করেছিলাম খুন তোমার ঘাড়ে মাথায় কোপ বসিয়েছিলাম রং-তুলি দিয়ে অস্হির সঙ্গে সঙ্গে ভাসিয়েছিলাম সদ্য পাওয়া চেক প্রমা লোপাট হয়ে গেছিল ক্যা্নভাসটাকে শুধু ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলাম চিলেকোঠার ঘরে ওটাকে পোড়াবার জন্য যথেষ্ট আগুন ছিল না যে আমার কাছে!

তবে কেন! কেন ইদানিং মনে হয় যে, নিজের কাছে নিজের হারের বড় প্রয়োজন? আঙুলের শিরা-উপশিরাগুলো আলগা হতে চায় দলা পাকানো ছেঁড়া কাপড়গুলো আবার নতুন করে রঙিন হতে চায়
কয়েক লক্ষ অচেনা শ্বাস-প্রশ্বাস এদিক-ওদিক করে দিয়েছে অনেককিছু ফুঁ-এর জোর তবে এতটাই...! নাকি, এখানেই একজন শিল্পী বা শিল্পর ক্ষমতা! আপনার বাঁশি জীবনদায়ী কীটনাশকের মতো যা ছড়িয়ে পড়ে কামরা থেকে কামরায় আর তুলে আনে সৃষ্টিকে, যার স্রষ্টা শুধুমাত্র আপনিই

ICCR–এ আজ দ্বিতীয়বারের জন্য প্রদর্শনী কতদিন পর আজ ফতুয়া পড়লাম ইন করা শার্ট-প্যান্টে দম যেন আটকে আসে!
এতদিন শুধু কানাকানি হয়েছিল আপনার সাথে, আজ মুখোমুখি হবই কিন্তু... এখনও যে...
- দাদা... এই এখানে এক ভদ্রলোক বাঁশি বাজাতেন... আমি শুনেছি...
- হ্যাঁ, উঠত বটে... হ্যাঁ তো, তাতে কি?
- না তাকে দেখলাম না তো... এই জায়গাতেই তো উঠত...
- আশ্চর্য তো, আমি কী করে জানব? ...সক্কাল-সক্কাল... সরুন, সরুন নামবো...
- দাদা আপনারা...
- আরে থামুন তো মশাই, কে না কে ভিখিরি বাঁশি বাজায়, তার পেছনে...
নামবেন কোথায়?
- হ্যাঁ?
- আরে নামবেন কোথায়?
- ও হ্যাঁ, প্রিন্সেপঘাট
- তো এগিয়ে চলুন, এগিয়ে চলুন
গঙ্গাটাকে আজ কেমন যেন সমুদ্র মনে হলো! যায়-ফেরে-যায়... আবার কি ফেরে? নাকি, শুধু অমীমাংসিতই থেকে যায় চৌরাসিয়া সুলভ সমীকরণ?



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন