বাসস্টপে লাইন দীর্ঘতর হচ্ছে
কৃষ্ণা গ্লাসের
সামনে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছিলাম দূর আকাশ থেকে উলটো হয়ে পড়তে থাকা এক মানুষ - ফেরত
আসা রকেটের মতো ভীষণ জোরে, নামছে তো নামছেই - একসময় রেলের পোস্টে বা মোবাইল
টাওয়ারে তার মাথা ধাক্কা খায় ও ফেটে যায় - ও হো হো হো উল্লাস করে উঠি সবাই - হুই
হুই সিটি সমষ্টির দিকে ধেয়ে আসা একটা রকেট বা আত্মঘাতী বোমা যেন - আকাশে ফেটে
যাওয়া আতসবাজির বারুদটুকরো যেভাবে ছড়িয়ে-ছড়িয়ে নামে, মাথা ফেটে ঘিলু ও করোটির
টুকরো-অবশেষ সেইভাবে আমাদের দিকে পড়ছে - কিছু আমাদের থেকেও দূরে - কোনও বাড়ির ছাদে
- কোনও বস্তির পেছনে - দেখে মনে হয়, নিউট্রাল গীয়ারে নামছে - আমরা পাশাপাশি ও
ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকলেও আমাদের দু’টো দেহের মাঝখানে থাকা দুর্লঙ্ঘ শূন্যতা একটিকে
অপরটি থেকে শুধু বিচ্ছিন্নই রাখে না, আমরা উভয়েই সে শূন্যতা প্রত্যক্ষও করি - ক’রে
যাই - কেননা আমাদের তা ক’রে যেতে হয়; তাই, আমাদের একে-অপরের চামড়ায় ঘষা লাগলেও তা
থেকে আর কোনও তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ ঢেউ তোলে না মগজে - কেননা, আমাদের ঘিলু, ওই যে ওই
উঁচু থেকে ফেটে ছড়িয়ে নিচে নামছে, আমাদেরই দিকে - এসবই আমরা দেখছিলাম, দেখছিলাম
দূরে দাঁড়িয়ে - পেছনে ওই ওদিকে গঙ্গা তার কোমর বেঁকিয়ে ঘুরছে তো ঘুরছেই - ঘুরেই
চলেছে - সেখানেও পড়বে কিছু, ঘিলুর অবেশেষ, করোটির ভাঙা শিং - এখানে গঙ্গার কোনও
বুক নেই - বুক নেই তাই বোঁটা নেই - বোঁটা নেই তাই দুধ নেই - দুধ নেই তাই শিশু নেই
- তারও আগে একটা বাস স্ট্যান্ড - সেখানে বাস ধরবে ব’লে মাঝরাত থেকে লাইনে দাঁড়ানো
মানুষের কিউ - যাকে সার্ত্র আরও পরে সমষ্টি বা গোষ্ঠী বলবেন না, বলা যায় না তাই
বলবেন না, বলবেন কালেক্টিভ - এবং এও বলবেন যে, কিউ-এর সারিবদ্ধ এই মানুষ
নিঃসঙ্গতার বহুত্বেরই নামান্তর - ও হো হো হো - সার্ত্র এ কথা বলার আগেই লাইন
দাঁড়িয়ে গেছে - এবং ক্রমশ তা দীর্ঘতর হচ্ছে - মাঝরাতের ঘুম ঠেলে দূর-দূরান্ত থেকে
লোক আসছে - এত রাত, তাই গাড়ি-ঘোড়া কিছু নেই, হেঁটেই তো আসছে - আর এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে
লাইনে - পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলেও যাদের কোনও ঐক্য বোধ নেই, ছিল না, থাকবে না -
এখানে বিচার হবে সংখ্যা দিয়ে - এই সারিবদ্ধ মানুষের সিরিয়াল এগ্জিসটেন্স নিঃসঙ্গ
এবং শক্তিহীন - আরও বললে, এর কোনও মুখ নেই, ইহা যান্ত্রিক এবং স্থূল - আমাদের এই
নগরে গোটা শহর এভাবেই বেঁচে আছে - আকাশে ফেটে যাওয়া আতসবাজির ঘিলু উল্কাগতিতে
কীভাবে নেমে আসছে বিস্ময়ে তা দেখতে দেখতে
- সরে যাওয়ার কথা ভুলে - হুই হুই সিটি দিতে দিতে এবং বাসের জন্য লাইনে দাঁড়ানো
কিউ-এর মতো।
হাতে তালি দিতে দিতে আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দেখি
আমাদের প্রত্যেকের হাত পিছমোড়া ক’রে বাঁধা। এছাড়া আমাদের কোনও স্মৃতি নেই। ইতিহাস নেই। অতীত নেই।
ঐতিহ্য নেই। সারিবদ্ধ লাইন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া বর্তমান নেই। সকাল হলে দেখা যাবে, সারারাত আমরা যারা বাসের জন্য লাইন দিয়ে
দাঁড়িয়েছিলাম, প্রকৃতপক্ষে এটা বাস স্ট্যান্ডই নয়, এটা, পরিত্যক্ত একটা কবরখানায়
ঢোকার মুখ।
একটা নীল-শাদা ত্রিফলা দাঁড়িয়ে আমাদের পাশে।
অর্ধ-উড়ন্ত একটা দাঁড়কাক মনোস্থির করতে পারে না সে ত্রিফলার কোন্ দণ্ডে বসবে।
লেখাটি ভাল লাগল ।
উত্তরমুছুন