কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

দন্ত-বিকাশ : একটি মৃত্যুদন্ড 

বিকাশের ওপরের পাটির সামনের দিকের দাঁতদুটো এত বড় ছিল না যে ওকে লোকে দন্তবিকাশ বলবে। তবে দাঁতদুখানা নেহাৎ ছোটও ছিল না। অন্যান্য সব দাঁতের থেকে বেশ বড়। তার মানে এই নয় যে, এই দুই মক্কেলের জন্য তার মুখ বন্ধ হতো  না। দাঁতের জন্য যদি আদৌ হাঁমুখ বন্ধ না করতে পারত, তবে তো অবশ্যই লোকে  তাকে দন্তবিকাশ বলে ডাকতকিন্তু দান্তে বা দেঁতো - কোনোটাই পুরোপুরি হবার  সৌভাগ্য আমাদের বিকাশ মন্ডলের হয়নি। বরঞ্চ ইস্কুলে তার এক ক্লাসমেট ছিল, প্রকাশ, যার সামনের দুখানি দাঁতের কল্যাণে তার মুখ কখনো বন্ধই হতো না। সে  যেখানে দেঁতো বা দন্তবিকাশের শিরোপা সহজেই পেয়ে বসে রইল, মন্ডলবাবাজী খুদে ইঁদুর দাঁতের অভাব আর গজদন্তের আগের স্টেজের মাঝামাঝি আটকে থেকে গেল। লোকে তাকে ঠিক দেঁতোও বলত না আবার কেউ কেউ খরগোস বলতেও ছাড়ত না। সবাই তার ছবি দেখলেই সেখানে দাঁতের উপস্থিতির কথা জানান দিত, “ঐ দেখ, দুটো দাঁত কিন্তু ঠিক বেরিয়ে আছে এমন করেই দাঁতদুখান বড় হবার সাথে  সাথে বিকাশ মন্ডলের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। সবাই তাকে তার দাঁত দিয়ে চিনত অথচ তাকে ঠিক দেঁতোও বলত না। দাঁতের এই মধ্যম পন্থাতেই তার বাল্যবেলা যৌবনের দিকে হেলে গেল 

মা: কি রে বিকাশ, ডেন্টাল ফাইলিং করবি নাকি
বিকাশ: সেটা কী ব্যপার
মা: আরে তোর সামনের এই যে দুটো দাঁত বেরিয়ে থাকে বাইরের দিকেফাইলিং করলে এগুলো অন্যদের সমান হয়ে যাবে। 
বিকাশ: বটে? সমান হবে বুঝি? কিন্তু তাও তো ভেতর থেকে বাইরের দিকেই বেরিয়ে থাকবে, চোখে পড়বে, মুখ খুললে... তাই না?
মা: মানে! কী যা তা বলছিস?
বিকাশ: না মানে বলছিলাম, দাঁত বড়-ছোট যাইহোক, মুখের ভেতর হতে বাইরের দিকেই তো চোখ মেলবেযখন যখন মুখ খুলব আর কী!
মা: দাঁত চোখ মেলবে? এই, তোর কাব্যি রাখ তো বিকাশ! দু-তিন মাস দাঁতের  ওপর স্টিলের একটা পাত পরে থাকতে হবে, তাহলে সমান হয়ে যাবে। মুখ সবসময় বন্ধ রাখতে পারবি। 
বিকাশ: দাঁতের ওপর স্টিলের পাত? কী দরকার মা, ছাড়ো না। আমার দাঁত কি  আর খাম্বা বড় নাকি? ওরা তো মাঝারি বড়। আমি তো এমনিতেও মুখ বন্ধ করতে পারি। 
মা: হ্যাঁ, পারিস, কিন্তু সচেতনভাবে বন্ধ রাখতে হয়। তখন এমনিই বন্ধ থাকবে। 
বিকাশ: মুখ এমনিই বন্ধ রাখতে পারলে কি ক্লাসে কথা বলার বদ অভ্যাস কমে যাবে?
মা: আবার ঠাট্টা করছিস? করবি, না করবি না, সোজা কথা বল তো দেখি?  
বিকাশ: থাক থাক। মুখ বন্ধ করে কাজ নেই। মুখের ভেতর পাত-টাত নাই বা ঢোকালাম। 
মা: বেশ যা ইচ্ছে কর।

বিকাশের বড় হবার সাথে সাথে তার বৃহত্তর দুই দাঁতের শরীরে লম্বা লম্বা খাঁজের মতো দাগ দেখা দিল। প্রতিটা দাঁতের মাঝামাঝি দুটো করে দাগবাথরুমের সাদা  দেওয়ালে ছোপের মতোবিকাশের মা ভয় পেলেন, দাঁত দুটো না মাঝখান থেকে  ভেঙে যায়। হাজার হোক দুধের দাঁত তো আর নয়। তাও এক্কেবারে সামনে।  দাঁত ভেঙে পড়লে বিয়ের সম্ভাবনাও ভেঙে পড়তে পারে। বাবা বললেন, দুই দাঁতের মধ্যেকার গ্যাপটাও চিন্তার বিষয়। ফি বছর বেড়েই চলেছে বলে মনে হচ্ছে। দাঁতদুটো যদি হাত পা ছড়িয়ে আলাদা হয়ে যায়, কী কেলেঙ্কারীটাই না হবে বাবা! বাবা-মার  মতো বিকাশের কিন্তু দাঁতদুখান নিয়ে অত ভয়ভাবনা ছিল না। সে ওদের বেশ  পছন্দই করতসময় সুযোগ করে আয়নায় দেখে নিত, পারলেই খাঁজ বরাবর আঙুল চালিয়ে নিত, এমনকি দুটো দাঁতকে দুদিক থেকে দু'আঙুলে ধরে চাপ দেওয়াটা একটা খেলার মত ছিলতবে দাঁত বার করা হাসির দিকে না গিয়ে বিকাশ মন্ডল আস্তে আস্তে একটা ঠোঁট বাগানো হাসি কাল্টিভেট করল, যেখানে দাঁতের অগ্রভেদী বিস্তারকে সে ঠোঁটের নিম্নগামী অনুশাসন দিয়ে ঢেকে রাখতে শিখলঐ দন্তহীন এক ঠোঁট হাসি তার  ট্রেডমার্ক হয়ে গেল আর বিকাশ ঠোঁট ক্যালানে বাঞ্ছারাম হয়ে উঠল 

বিকাশ: কথা বললে চোখের দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাক যে বড়
প্রেমিকা: তোমার সামনের দুটো দাঁত কথা বললেই কেমন সুড়ুত করে বেরিয়ে আসে। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে বড় ভালো লাগে। 
বিকাশ: ওদের জন্যেই কি তবে প্রেমে পড়ে গেলে?
প্রেমিকা: তা বলতেই পারো। কথা বললেই কেমন যেন আরেকটা তুমি কথা বলে। তুমি যা বলো তা তোমার ঐ দাঁত দুখান ঘসে মেজে আবার আবার করে বলে। ঐ আবারটারই প্রেমে পড়ে গেলাম তো!  
বিকাশ: প্রেম কেবল বাইরে থেকে ভেতরের দিকে দেখে শুনেছিলাম, এখন দেখছি যার দিকে দেখে সে অবিশ্যি ভেতর থেকে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। 
প্রেমিকা: বেশ বলেছ। এভাবেই তো শোধবোধ হয়। 

তারপর মধ্যজীবনে এসে একদিন সকালে উঠে বিকাশ মন্ডল বাথরুমের আয়নার সামনে এসে দেখল, তার সামনের দাঁতদুটো রাতারাতি মানুষ হয়ে গিয়ে মুখ থেকে  বেরিয়ে তার চিবুক ছুঁয়েছে এবং তার ফলে বিকাশের মুখ দিয়ে কথা বেরোনো দুষ্ক হয়ে উঠেছে। দাঁতদুটোর মধ্যিখানের ফাঁক যেমন ছিল তেমনই আছে তবে দুই দাঁতের চারটে দাগ আরো লম্বা হয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়েছে সাদার ওপর কালো সেপাই হয়ে। বিকাশ আয়না দেখে হাল্কা হাসার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু দাঁতের বেখাপ্পা আকারের কারণে সে হাসি মাঠে মারা গেলসে শান্তভাবে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সকাল ৭টা। শীতের শহর জেগে উঠছে আরেকটা নতুন-পুরনো দিনের জন্য। নিচে ঝুঁকলে চোখে পড়বে, পাশের বাড়িতে প্লাস্টার অফ প্যারিসের পোছ  লাগাচ্ছে মিস্তিরিরা। ম্যানহোল পরিষ্কার করছে কর্পোরেশনের লোক আর ইলেকট্রিক  পোস্টে উঠে কয়েকজন হাতুড়ি নিয়ে কীসব ঠোকাঠুকি করছে। বিকাশ মন্ডল  বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে রান্নাঘরে ঢুকলডান হাত দিয়ে ওপর থেকে প্রথম ড্রয়ারটা খুলে বার করে আনলো একটা সাঁড়াশি জাতীয় জিনিস। তারপর আবার বাথরুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল 

এরপর বিকাশের বাথরুমে কী হয়েছিল আমাদের জানা নেই, তবে একথা ঠিক যে  সেদিন সব খবরের কাগজেরই কাভার স্টোরি ছিল বম্বে ব্লাস্ট মামলায় দোষী সাব্যস্ত ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি। জোর বিতর্ক হয়েছিল রাষ্ট্রযন্ত্র, সন্ত্রাস, ধর্মীয় পক্ষপাত ও মৃত্যুদন্ড নিয়ে। সেদিন সকাল সাড়ে ৬টায় নাগপুর সেন্ট্রাল জেলে মেমনকে হত্যা করা হয়। এক সাংবাদিক লিখেছিল, যদিও কখনো শোনা যায়নি ফাঁসির সময়  রক্তপাত হয়, অথচ ফাঁসুড়ে নাকি তাকে পরে এক ইন্টারভিউতে বলে, মেমনের মাথার কাপড়ে রক্ত লেগে ছিলফাঁসুড়ে তার মাথার কালো কাপড় খুললে দেখা যায়, কে বা কারা সামনের দুটো দাঁত উপড়ে নিয়েছে সকলের অজান্তে। যদিও এতে তার মুখ বন্ধ  হয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি। সাংবাদিকের মতে, এই বিদঘুটে ঘটনা চেপে  দেওয়া হয় পাছে প্রশাসন নিয়ে হাসাহাসি হয়। একমাত্র সে'ই দাঁত ভাঙার এই ব্রেকিং নিউজ ভাঙতে পেরেছিল বলে দাবি করে। যদিও অন্যান্য কাগজে পরের দিন ঐ সাংবাদিকের আজগুবি রিপোর্ট নিয়ে হাসির ফোয়ারা ওঠে। ফাঁসুড়ে কোনো মন্তব্য করতে নারাজ। বিকাশের পাড়ায় কয়েকজন পরের দিন সন্ধ্যেবেলা চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে আর ক্লাবঘরে তাস পিটতে পিটতে বলাবলি শুরু করে: যদি  সত্যি সত্যিই মালটার সামনের দাঁতদুটো কেউ উপড়ে নিয়ে থাকে, তবে বেশ করেছে। বম্বে ব্লাস্টে ক'জন লোক মারা গেছিল মনে আছে? বিকাশ সম্পর্কে কেউ কোনো  কথা বলেনি। ডেন্টাল ফাইলিংয়ের মাধ্যমে অনেকের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়।  


1 কমেন্টস্:

  1. বাহ, দারুণ লাগল - দন্তরুচি কৌমুদি।
    শ্রাবণী দাশগুপ্ত

    উত্তরমুছুন