কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫

অন্তরা চৌধুরী

শিকড় ও শিকড়হীনতার আখ্যান : ‘সমনামী’ 





ঝুম্পা লাহিড়ীর একটি অন্য স্বাদের অন্য অনুভবের উপন্যাস দ্য নেমসেক’, বাংলা  অনুবাদ সমনামী অনুবাদ করেছেন পৌলোমী সেনগুপ্ত মূলতঃ ভারতীয় সংস্কৃতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এরকম তরঙ্গবিহীন উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে বেশ বিরল পুলিৎজার পুরস্কার প্রাপ্ত এই উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে বেশ সাড়া পড়ে যায় সব উপন্যাসেরই একটি নিটোল কাহিনী থাকে, ক্লাইম্যাক্স থাকে, পরিণতি থাকে;  কিন্তু এই উপন্যাসে কাহিনী থাকলেও তা পরিণতির অপেক্ষা রাখে না নিস্তরঙ্গ ভাবে একটি ভারতীয় পরিবারের প্রবাসে থাকার কাহিনী পাতার পর পাতা জুড়ে নিরবছিন্নভাবে এগিয়ে গেছে

ষাটের দশকের শেষ দিকে অশোক গাঙ্গুলিকে বিয়ে করে অসীমা পাড়ি দেয় দূর প্রবাস আমেরিকায় সেখানে সে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার নিষ্ফল চেষ্টা করে নিজের শিকড়  ছেড়ে গিয়ে বিদেশের মাটিতে নতুন করে শিকড় তৈরি করা অশোক গাঙ্গুলি ও তার  স্ত্রী অসীমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না কিন্তু অনেক অসম্ভবকে সম্ভব একমাত্র মানুষই করতে পারে তাই আস্তে আস্তে জীবনের প্রয়োজনে অসীমা বিদেশী সংস্কৃতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে শিখতে থাকে বিদেশে বসবাসের সমস্ত আদব কায়দা এর মধ্যেই একদিন অসীমা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় আইনত সে একজন আমেরিকার নাগরিক অসীমা ছেলের নামকরণের ব্যাপারে তার দিদার পাঠানো নাম দেবে ঠিক করেছিল কিন্তু ডাকবিভাগের গোলযোগে সেই চিঠি হারিয়ে যাওয়ায়  বিপাকে পড়ে এই দম্পতি তখন কাজ চালানো গোছের একটা নাম রাখে অশোক  সেটা শুধু রুশ সাহিত্যিকদের প্রতি মুগ্ধতা বশতঃ নয় এই নামকরণের প্রেক্ষাপটে একটি ইতিহাস আছে, যা এই উপন্যাসের মূল চালিকা শক্তিও বটে




এক রেল দুর্ঘটনায় যখন প্রাণ হারাতে বসেছিল অশোক তখন গোগোলের গল্প সংগ্রহের একটি উড়ন্ত পৃষ্ঠাই রক্ষা করে তাকে ছেলের নাম তাই ফিরে পাওয়া জীবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় অশোকের কাছে ছেলের নাম হয় গোগোল স্কুলে ভর্তির সময় নিখিল নাম দেওয়া হলেও ছোট্ট গোগোল নিখিল নামের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না কারণ সেই নাম তার কাছে ভীষণ অপরিচিত অথচ এই গোগোল বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এরকম বিচিত্র নামের অধিকারী হওয়ার ফলে সে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে আঠারো বছর বয়স হলে গোগোল আইনি পদ্ধতিতে নিজের নাম পরিবর্তন করে   নিখিলে পরিণত হয়

এরই মধ্যে অসীমা সোনিয়াকে জন্ম দেয় স্বামী-পুত্র-কন্যা নিয়ে অশোক এবং অসীমা ছুটি পেলেই ভারতে ফিরে যেত নিজের শিকড়ের কাছে, নিজের সংস্কৃতির কাছে কিন্তু  তাদের সন্তানদের সেটা কখনোই ভালো লাগত না কার তারা পাশ্চাত্য সভ্যতায়  বেড়ে উঠেছে তাদের কাছে ভারত হাস্যরসের সামগ্রী নিজের পরিবার ও দেশের প্রতি যে শ্রদ্ধা অশোক এবং অসীমার ছিল, তার সিকিভাগও তার ছেলেমেয়েদের ছিল না। তাই আত্মিকভাবে আমেরিকান হয়ে ওঠা গোগোল কোনোদিনই নিজের নামকে  মেনে নিতে পারেনি ভারতীয় শিকড়কেই কি সে মানতে পেরেছিল?

এরপর সমগ্র উপন্যাস জুড়েই গোগোলের জীবন বিস্তৃত হয়ে ওঠার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে সে ভারতীয় বংশোদ্ভুত হলেও শয়নে স্বপনে মননে সে হয়ে ওঠে একজন আমেরিকান এরই মধ্যে গোগোলের আঠারোতম জন্মদিনে তার বাবা তাকে উপহার  দেয় নিকোলাই গোগোলেরদ্য ওভারকোট কিন্তু প্রথম থেকেই গোগোল প্রাণখোলা নয় উপন্যাস পড়তে পড়তে মনে হয়, সে যেন এই জীবনে খুশি নয় তাই বাবার  দেওয়া উপহার সে খুলেও দেখেনি ভীষণরকম ভাবে আত্মবিমুখ একটি চরিত্র তার জীবনের বহুমুখি মানসিক জটিলতা তার অন্তিম পরিণতির জন্য দায়ী

অশোক যে জীবনদর্শন গোগোলের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিতে চেয়েছিল, তা নেবার ক্ষমতা গোগোলের ছিল না সেআপনাতে আপনি বিকশিতহয়ে ওঠে এরই মধ্যে একদিন অশোকের মৃত্যু ঘটে অসীমা সেই বিদেশ বিঁভূইয়ে নিজের মতো করে বেঁচে  থাকার চেষ্টা করে গোগোল পড়াশোনা ও চাকরির জন্য বাইরে চলে যায় এই সময়  সোনিয়া মায়ের সঙ্গে থাকে এই উপন্যাসে এটাও একটা টার্নিং পয়েন্ট বাবা-মায়ের প্রতি ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেক বেশি সংবেদনশীল অসীমা সময় কাটানোর  জন্য পার্টটাইম কাজ খুঁজে নেয় এই সময় মা ও মেয়ের মধ্যে গড়ে ওঠে অপূর্ব সখ্যতা

অন্যদিকে গোগোল একের পর এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে থাকে ম্যাক্সিনের সঙ্গে তার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয় জামাকাপড় চেঞ্জ করার মতোই একের পর এক সম্পর্ক ও অবাধ  যৌনজীবন দেখানো হয়েছে এই উপন্যাসে কিন্তু কোনো সম্পর্কই গোগোলের জীবনে  টেকে না অবশেষে অসীমার তৎপরতায় মৌসুমীর সঙ্গে তার বিয়ে হয় কিন্তু সে সম্পর্কও টেকে না কারণ মৌসুমী তাঁর পূর্বের বন্ধু দিমিত্রিকে ভালোবাসে মাত্র বত্রিশ  বছরের জীবনে গোগোলকে এত বেশি টানাপোড়েনের সম্মুখীন হতে হয় যে, সে ক্লান্ত  হয়ে পড়ে




অসীমা জীবনে অপরাহ্ন লগ্নে পৌঁছে শেষবারের মতো তাদের পুরনো বাড়িতে  খ্রীস্টমাসের পার্টি দেয় আরো একবার তাঁর পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের স্মৃতিচারণ করে সে নিজের সংস্কৃতি, নিজের পরিবার দেশ ছেড়ে চলে আসা অসীমা কি কোনোদিন এই আমেরিকান সংস্কৃতিকে মানতে পেরেছে? হঠাৎ সে অশোকের জন্য  ডুকরে কেঁদে ওঠে তার ছেলেমেয়ে নিজস্ব জীবন খুঁজে নেবে বেঁচে থাকার জন্য কিন্তু সে শুধু একা যদিও সে ভারতের মাটিতে ফিরে যাবে, কিন্তু সেভাবে নিজের দেশকেও কি সে গ্রহ করতে পারবে? সেই দেশ কি তাকেও সেইভাবে গ্রহণ করবে? অমীমাংসিত উপন্যাস মানুষ কী ভয়ংকর একা! উপন্যাসের শেষে ঔপন্যাসিক  বেদনার বড় করুণ সুর লাগিয়েছেন এই প্রথম বাড়িতে এসে গোগোল তার পুরনো বইয়ের তাকে বাবার উপহার দেওয়া সেই বইটা খুঁজে পায় উদ্ঘাটিত হয় তার  নামের রহস্য, যা তার কাছে এতদিন অজানাই ছিল

শিকড় ও শিকড়হীনতার, প্রবাসকে নিজের করে নেওয়ার, পুরনো ও নতুন জীবনের মাঝখানে ত্রিশঙ্কু হয়ে থাকার আত্মিক সংকট উপলব্ধি করার কাহিনী ধরা পড়েছে এই উপন্যাসে          


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন