কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫

শিবাশিস্ আচার্য

অপরাধ

ছিঃ! ছিঃ! প্রথম বিশ্বের দেশও যদি এই অনাচারকে প্রশ্রয় দেয়, তো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তো এইপথেই উচ্ছন্নে যাবে! গজগজ করতে করতে খবরের কাগজটা আছড়ে টেবিলে ফেললেন অনলদা
--
হলোটা কী! উৎসুক হয়ে খবরের কাগজটা নিয়ে দেখি গতকাল মার্কিন প্রশাসনের সমকামীদের বিবাহকে মান্যতা দিয়ে সেনেটে পাশ করানো বিলের বিরুদ্ধে দাদার এই বিষোদগার!
বললাম- ওরাও তো আমাদের মতোই মানুষ, দাদা! সমাজের কোনো ক্ষতি তো ওরা করছে না! অযথা ওদের নিয়ে মাথাব্যথার কারণ কেন? ওরাও তো গণতন্ত্রেরই অঙ্গ!
-
- আপনারা বুদ্ধিমান হয়েও যদি এই কথা বলেন, তবে তো কোনোদিন বলবেন, উভলিঙ্গতেও দেশ চালাবে! ক্ষোভ ঝরে অনলদা' গলায়
-
- দেখুন দাদা, আপাতদৃষ্টিতে এদেরকে আমরা সমাজ-বহির্ভূত জীব বলে ভাবি,  কিন্তু এরা তো যেচে সমাজের কারোকে প্রভাবিত করে না, তাদের ভাব-ভালোবাসা তো দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ যা কিনা বিশ্ব-বহিরঙ্গে প্রভাব তেমন ফেলে না  আমার নিজের জীবনে প্রত্যক্ষ করা একটি ঘটনা শুনুন তাহলে--
--
বলুন, কিন্তু ব্যাপারে তেমন ইন্টারেস্ট আমার নেই...

ঘটনাটি ঘটেছিল ছোটনাগপুরে বেকারত্বের জ্বালামুক্ত হবার তাগিদে জীবনের প্রথম ভাগে সেখানকার অভ্রখনির অফিসারদের শিশুরা বেশি ভাগই পড়ত, এমন একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পাই জয়েন করার কিছুদিনের মধ্যেই পরিচয়  হয় শারীরশিক্ষার শিক্ষক মি. সিংঘম নৃত্যকলার শিক্ষক মি. মায়াপ্পানের সাথে প্রথম থেকেই দেখতাম ওরা দুজন একটু আলাদা... ঠিক অন্যান্যদের মতো নয়... ইন্ট্রোভার্ট... কিন্তু উভয়েই স্ব-স্ব বিষয়ে তুখোড় শিশুদের মনোরঞ্জনকারী হওয়া সত্ত্বেও একে অপরকে দেখলে অনুরাগের ছোঁয়ায় যেন লজ্জারুণ হয়ে উঠতেন; তাই দেখে বাকি শিক্ষকরা ওদেরকে দেখলেই কেমন বিসদৃশ আচরণ করতেনযেন দুজন মনুষ্যগোত্রীয়ই নয়
যেচেই আলাপ করলাম একদিনসতর্ক করে দিলেন কিছু শুভানুধ্যায়ী শিক্ষকবললেন- ওদের সাথে মিশবেন না মশাই! নোংরা মানসিকতা... নইলে কে কবে শুনেছে ছেলেতে-ছেলেতে... বলে চোখ মটকান ওরা সোমত্থ পুরুষমানুষ বিয়ে-শাদী কর্! তা নয়! দুটো পুরুষে মিলে...! জানেন একে অন্যকে খাইয়ে দেয়, মুখ মুছিয়ে দেয়, একে না খেলে অন্যে খায় না, আনন্দের খবরে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আদরের কী ঘনঘটা! একই বাড়িতে থাকে তো, তাই রাতে দুজনে একাকার হয়ে... কী কেলেংকারি কান্ড... যত্তসব!

তারপর গ্রীষ্মের ছুটির পরে স্কুলে ফিরে গিয়ে শুনি, শুধুমাত্র সমকামিতার অপরাধে  তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং স্কুলের শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রী নির্বিশেষে তাদের সাথে মেলামেশা করতে বারণ করা হয়েছেবিদ্যালয়-কর্ত্তৃপক্ষ সবার মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আশঙ্কিত হয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন
অনলদা বললেন, আর তাদের খোঁজ পান নি?
শুনেছিলাম, স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়ে তারা আশ্রয় নেন খনি অঞ্চলে কাজের আশায় কিন্তু কি আশ্চর্য! এত দুঃখেও কেউ কারোকে ছেড়ে কিন্তু চলে যান নি একের দুঃখে অন্যের ব্যথা আনজনে কী বুঝবে? তাদের ভালোবাসা কিন্তু শুধু শারীরিকই নয়, মানসিকও ছিল সবদিক থেকে একে ছিল অন্যের পরিপূরক খনিতে শ্রমিকদের বাজার করা রান্না করার কাজ নিয়ে উভয়ে শ্রমিক-বস্তিতেই একে-অন্যকে ভালোবেসে বাঁধলেন তাদের অবৈধ প্রেমের সুখের নীড় অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেও স্বীয় প্রত্যঙ্গের খামতিটা নরম প্রকৃতির মায়াপ্পন নিজেকে নারী রূপে কল্পনা করে অপেক্ষাকৃত সমর্থ প্রকৃতির সিংঘমের দেহ-বন্ধনে নিষ্পেষিত হতে হতে ধর্ষকামের তুরীয় আনন্দে মগ্ন হতেন নিত্যই

শ্রমিক সর্দারনী মেঘা বাজারের দায়িত্ব হাতছাড়া হওয়ায় রাগে তাদের এই ভালোবাসা সুচোখে না দেখে বরং রটিয়ে দিল, একজন শয়তান অন্যজন তার উপাসক তাই উভয়েই পুরুষ হয়েও নিবিড়-ভালোবাসায় এইভাবে জড়িত

মেঘা মনে মনে সিংঘমকে ভালোবাসতো, সেটাই এক বর্ষার রাতে তাকে বলতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বাড়ি ফেরার সময় স্থানীয় দেবতা মাঠানবুরুর থানের  কাছে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় জোর আঘাত পেয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মারা যাবার আগে স্ফূটে সিংঘমের নাম উচ্চারণ করে যায়, যার ফলে ক্ষুব্ধ জনতা  তাদের দুজনকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়েই ঘর থেকে হিঁচড়ে বের করে এনে চৌমাথায় বেঁধে জ্বালিয়ে দেয় খবরটি যখন আমার কানে আসে, পুলিশ তখন দুজনকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেছে সিংঘম পথেই মারা যানআর মায়াপ্পান মারা যাবার আগে আমার দিকে তাকিয়ে স্ফূটে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,
--
আমাদের অপরাধটা কী ছিল?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনলদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, অসম ভালোবাসা!

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন