কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫

সোনালী মিত্র

তৈল মর্দন অথবা দেবদাসীবৃত্তি ও সুযোগ সন্ধানী  




দেবালয়ে ঈশ্বরীরে সাজায় অসংখ্য উন্মাদ  
দেবীর মাথাটা খসে গেছে স্তন-নিতম্ব নিয়ে ধার্মিকশৃগাল
ধুপধুনো শঙ্খেপদ্মে অন্ধকারে বৈদিক জাগরণ
ঈশ্বরীর কাম আসে, শোক আসে, আসে না মৃত্যু মেয়ের

কত প্রাণ উৎসর্গ যুগে যুগে ঈশ্বর সমীপে
ত্রিকাল গিয়েছে চলে, বৃথা যৌবন নেবে কি ঈশ্বরে?
খেলা করো, মন্দিরের গোপন কুঠিতে মহাপুরোহিত মর্দন
সৃষ্টি নেই, মৃত্যু নেই, এ দেহ দৈবের ভোগ


গুরুচণ্ডালীঃ-

বেশ কয়েক বছর আগে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিমাকাহিনী অবলম্বনে ঋতুপর্ণ ঘোষ তৈরি করেছিলেন চলচ্চিত্র অন্তরমহলসিনেমা শুরু হচ্ছে উনিশ শতকের শেষভাগ ধরেজমিদার ভুবনেশ্বর চৌধুরী (জ্যাকি শ্রফ) রায়বাহাদুর খেতাব লাভের আশায় তাঁর চির প্রতিদ্বন্দ্বী জমিদারকে টেক্কা দিতে নতুন এক পরিকল্পনা করেন। তিনি  আসন্ন দুর্গা পুজোয় দেবীর প্রতিমা রানী ভিক্টোরিয়ার আদলে তৈরি করার জন্য নিয়ে  আসেন মৃৎশিল্পী দেহাতি ব্রজভূষণকে (অভিষেক বচ্চন)অন্য দিকে নিঃসন্তান তিনি  দ্বিতীয় বিবাহ করেন সন্তান লাভের আশায়। প্রতিরাতে ছোটবউ যশোমতী (সোহা  আলি খান) জমিদারের কাছে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হতে থাকে। বড়বউ যোগমায়া (রূপা গাঙ্গুলী) প্রথমে ছোটবউকে ঈর্ষা করলেও পরবর্তীতে স্বামীর কাছে অত্যাচারিত ছোটবউকে কাছে টেনে নেয়অদ্ভুত মনোদ্বিচারিতা এবং যৌন তীক্ষ্ণতার আদিম রূপ  ছড়িয়ে আছে কাহিনীর পরতে পরতে।

না, আমি এখানে সিনেমার বিশ্লেষণ করতে বসিনি। বলতে চাইছি অন্য কথা। সিনেমাটি যারা দেখেছেন, চোখ বন্ধ করে ঝপ করে একবার সেই দৃশ্যটা ভাবুন তো,  যেখানে সন্তান কামনায় প্রতি রাতে অত্যাচারিত হচ্ছে ছোটবউ এবং ব্রাক্ষ্মণের  নির্দেশে সন্তান লাভের মোক্ষম উপায় হলো সঙ্গমরত অবস্থায় গীতাপাঠের বাণী   কর্ণগোচর হতে হওয়াসেইমত ব্যবস্থাও হলো। স্বামী বিছানায় ফেলে স্ত্রীকে ধর্ষণ  করছেন আর অন্যদিকে একই ঘরে পর্দার আড়ালে গীতাপাঠ করছেন এক ব্রাক্ষ্মণ।  তাতে দেবতা কতখানি তুষ্ট হলেন জানা নেই, কিন্তু গীতা পাঠরত ব্রাহ্মণের যে অবস্থা টাইট, সে কথা বলাই বাহুল্য। প্রথমা স্ত্রীর লাস্যময়ী রূপে খসে পড়া বুকের আঁচলে পুরুষ প্রবীণবধ। সেই যাত্রায় রক্ষা পায়নি যোগমায়া, তার সেই কর্মের জন্য শাস্তি ধার্য করেছিল ব্রাহ্মণসমাজ সাতরাত্রি সাতজন ব্রাহ্মণের সঙ্গে সহবাসযোগমায়া  তাতে অবশ্য খুশি হয়েছিল। আমি ঠিক এই জায়গাটি বোঝাতে চাইছি। যেখানে অর্গাজমের ফোয়ারায় ভেসে যাওয়া পুরুষ, সেখানে দাঁড়িয়েই কামার মতো মেয়েরা ঘোষণা করতে পারে, তারা যৌনসংসর্গে স্বাধীন। বেশ কিছুকাল আগে কামার ব্লগে চোখ পড়তেই চমকে উঠেছিলাম। আরে ব্যাস! সাহসিকতার শেষ সীমা ছুঁয়ে যে মেয়ে উচ্চকণ্ঠে বলতে পারে, আমি দেবদাসী। কামা হচ্ছে একটি বাঙালি হিন্দু মেয়ে, যার  বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম ও কলকাতা উভয় পরিমণ্ডলে। কামা বিলেতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং একজন স্বঘোষিত দেবদাসী। তার মতে, পুরুষের সাথে যৌনসংসর্গ হচ্ছে স্বর্গীয় এবং তা তাকে তার দেবতার কাছে নিয়ে যায়।

******

আর খানিক পথ বাকি, পথ পেরলেই
গণিকার রূপ যে রোজ রোজ খুন করা দু’চারটে ঈশ্বর 
ভয় পেয়ো না ধৈর্য রাখো, তার ভরাট স্তনের দিক মাথা রাখো 
তার ঘামের স্নানে অমরাবতীর শুদ্ধতা, মুখের দিকে
তাকিও না, হুইপ দাও, বল, খোল দ্বার!
জব্বর মূর্খ ক’জনেরা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে  
তুমি তো তেমন নও, ওর কপাল তিলে লেখা আছে  
বিকৃত সভ্যতার ভেঙে যাওয়া মন্দির
ওর গালের টোল দেখে ভুলে যাও
ঘরের সন্তান হেসে উঠলে অবিকল অবিকল অমন টোল
যে ঠোঁটে স্বর্গ বসিয়েছ সেখানে দেখ বসে আছে
শহুরে গঞ্জের সমস্ত ঈশ্বর
তুমি তো এমন বোকামো কর না! তুমি বরং ওর নাভির
গভীরতা মাপো, দেখবে কেমন জন্ম নিচ্ছে কামের ঈশ্বর...

এত সিঁড়ি ভেঙে তুমি কি এমন দেবতার জন্ম দেখতে চেয়েছিলে?

কথার মাপে কথা , তবু কথা  নয় শুধুঃ- 


আপনারা বুঝতে পারছেন হয়তো, কী বিষয়ে আমি কথা বলতে চাইছি। আজ্ঞে হ্যাঁ, দেবদাসীদেবদাসী একটি বহুকালের হিন্দু সামাজিক রীতি বা প্রথা বা কুপ্রথাযেখানে কিশোরীদের দেবতার সাথে বিয়ে দেয়া হয়। (বিয়ে দেওয়া হতো? বিয়েটা কেমন খেলার মতো! কিংবা ঈশ্বরী ঈশ্বরী গন্ধ!) ধর্মগতভাবে দেবদাসীরা ব্রহ্মচারী  হলেও অনেকস্থানেই তাদের পুষ্পিত আচার অনুষ্ঠানের পর একজনের কাছে তুলে দেওয়া হয়, যিনি প্রথম রাতের জন্যে কিছু দক্ষিণাও দিয়ে থাকেনএদের অনেকে পরবর্তীতে  মন্দিরে বা আশ্রমেই থেকে যায় এবং পূজারী বা অন্যান্যদের ভোগের সামগ্রী হয় বলে কথিত আছে। ভারতীয় মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় অর্ধেক সংখ্যক দেবদাসীই পরবর্তীতে দেহব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েএও যেন ঈশ্বরের এক নিদারুণ খেলা। আমরা শুরুতে কামার কথা বলেছিলামকামার গল্প কিছুটা ভিন্ন। ছোটবেলায় দেবদাসী হিসেবে তার অভিষেক হবার পরে সে সাধারণ সমাজেই বসবাস করেছে। পরবর্তীতে সে বিলেতে এসে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে এবং সাথে সাথে দেহব্যবসাও শুরু করেছে। তার ওয়েবসাইটটি দেখলেই বুঝবেন, কতটা গোছানো তার ব্যবসা। ফি থেকে  শুরু করে লোকজনের তার সম্পর্কে অভিমত, ছবি ইত্যাদি বিবিধ অনেক কিছু রয়েছে। এ যেন এক আধুনিক ঈশ্বরী, তাকে তুষ্ট রাখার বিবিধ আয়োজন নিয়ে মেতে আছেন তিনি


ইগো ম্যাগাজিনে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন:-



“ব্রিটিশদের অত্যাচারে ভারতের দেবদাসীরা আরাধনার স্থান (মন্দির) থেকে সাধারণের সমাজে চলে এসেছিল এবং বিয়ে-সাদী করে সাধারণ জীবনযাপন করততাদের বেশ্যা হিসেবে অপবাদ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ভাবে দাবিয়ে রাখার জন্যে।  আমি দেবদাসী জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি অর্থনৈতিক ও যৌন স্বাধীনতা পাবার জন্যে, যাতে আমি দক্ষিণ এশিয়ার পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বলয় থেকে বের হতে পারি”
অর্থাৎ আমি স্বাধীনআমার যৌনজীবন কীভাবে কাটাব সেটা ঠিক করার অধিকার আমার আছে। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে গেল এক জনজাতির কথা। ‘বানছড়া’ জাতির ঘরে কন্যাসন্তান জন্মানোর আনন্দে মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে ছবিটা একবার ভাবুন তো, কন্যাভ্রূণ হত্যার এই সময়ে, বৈপরীত্য লাগছে না? শুধু তাই নয় অন্য প্রতিবেশীরা কন্যার পিতাকে বেশ ঈর্ষার চোখে দেখেন। কি হলো  চমকে উঠছেন নাকি? আরে আমি ভারতবর্ষের এখনকার দিনেরই বাস্তব কথা বলছি, কোনো অলীক স্বপ্নজগতের নয়। যেখানে কণ্যাভ্রুণ হত্যার হিড়িক পড়ে যায়, সেই দেশেরই এক বিপরীত চিত্র, বেশ অবাক লাগেআসলে ব্যাপারটার মধ্যে অন্যকিছু গল্প আছে, সাদা চোখে দেখা যায় না যাগল্পটা এমন --  

তুমি সোনার ডিম দেওয়া হাঁস, তোমার চরণে পূজা করব, না কি হত্যা করব  তোমায়! মেয়ে জন্মানো মানে মেয়ের বিয়ে থেকে পাত্রপক্ষ থেকে মোটা অংকের টাকা ঘরে তুলে তবেই না মেয়েকে কাছছাড়া করা। নেবে নাই বা কেন! মধ্যপ্রদেশের মালওয়া এলাকার এই ‘বানছড়া’ মেয়েদের পারম্পারিক ঐতিহ্য হলো, ১২ বছর বয়স অর্থাৎ ঋতুমতী হবার পর থেকেই বেশ্যাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া মেয়ে এই কর্ম করেই সংসার চালাবে, ভাই বাপকে খাওয়াবে। ব্যাপারটা দারুণ অন্যরকম, তাই না! তাহলে ভাবুন, এমন উপার্জনশীল কন্যা জন্মালে মিষ্টি বিলি হবে না তো কি কান্না হবে?

দূরের জগত কেন, আমাদের চোখের সামনে সোনাগাছি থেকে কামতাপুরী প্রতিটি যৌনপল্লীতে ৯৭% মেয়ের দেখা মিলবে, যাদের কাজের টাকায় দেশের বাড়িতে সংসার চলে; সন্তান পিতা বোনের ভাত যোগার হয় তাদের দেহবিক্রির টাকায়অথচ   ভাগ্যের কী অপূর্ব পরিহাস! পাড়া-পরিবার সমাজ সব জায়গা থেকে আসে চরম ঘৃণা ও অপমান প্রকাশ্যে এই মেয়েদের নাম মুখে আনাও পাপ মনে করে তারা আসলে খিদের জাত বিচার হয় না, টাকায় বীর্য লেগে থাকলেও তার কারেন্সি ভ্যালু কমে না যে! কিন্তু ‘বানছড়া’ জাতি এই কর্মে নিযুক্ত মেয়েকে মাথায় করে রাখে, মেয়ে যে  কোনো অনুষ্ঠানে ভাগ নিতে পারে। বাড়িতেই মেয়েরা থাকে। মহা উৎসাহে মেয়ের বাপ দাদারাই এই ব্যবসার দালালির কাজে নিযুক্ত হয়।

উত্তর কলকাতার এক গার্লস হস্টেলে বসবাসকারী মনোরমা মালভি এই বানছড়া জনজাতির মেয়ে। বি এ পাশ করে সে এখন একটি ক্লিনিকে রিসেপশনের দায়িত্বে আছে। বিশেষ সূত্রে তার সাথে আলাপের মাধ্যমে জানা গেল, তাদের কিছু সামাজিক  অবস্থানের কথাপ্রায় দেড়শ বছর আগে থেকে প্রচলিত এই পেশা ধীরে ধীরে তাদের জীবনধারণের প্রথায় রূপান্তরিত হয়ে পড়েছে বিষয়টা এতই সেন্সেটিভ যে সরকারকেও এখানে হাত দিতে বেশ ভাবনাচিন্তা করতে হয়, বার এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে আসতে হয়েছেপ্রথার শুরুর কাহিনীটা বেশ করুণই বটে। প্রায় দেড়শ বছর আগে ব্রিটিশ সরকার মালওয়া নামল নীমচ এলাকায় তাদের গ্যারিসন তৈরি করে। পুরুষ মাত্রই কামুক, (তর্ক করলে করুন) কাম যে কোনো জাত ধর্ম কর্মের ঊর্ধ্বে... সেনাদের  শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য বুদ্ধিমান ব্রিটিশ সরকার পাশের রাজস্থান থেকে দরিদ্র শ্রেণীর বানছাড়াদের নিয়ে এসে নীমচ, মান্ডসোর, রতলামের মতো বেশ কয়েকটা জায়গায় বসতি গড়ে দেয়। যাযাবরেরা যেমন ঘর পেল, সেনা পেল মেয়ে। ব্যাস, ব্রিটিশ ভোগ্য মেয়েরা মোটা নজরানা পেত। তাদের মধ্যে আলসেমি এবং লোভ বাড়তে লাগলো। বিনা মূলধনে ব্যবসা... সম্বল একতাল মেয়ের নরম মাংস। ঘরে বসে আয়েসে যদি এত টাকা আসে, খাটনি কেন করবে মানুষ! জমে গেল ব্যবসা

ছোটবেলা থেকেই এদের এমন মগজ ধোলাই হয় যে, মেয়েদের মনে গেঁথে যা্‌ এটা ক,নো খারাপ কাজ নয়। যদি মেয়েদের মস্তিষ্কে দেহব্যবসা খারাপ নয় এই ধারণা   বর্তমান থাকে, তবে প্রতিরোধের প্রশ্নই আসে না... এমনি কি একটু বড় হওয়ার পর থেকে পাক্কা খিলানওয়ারীরা’ (এদের এই নামেই ডাকা হয়) শিক্ষা দিতে থাকে কী  ভাবে ধরে রাখতে হবে এই ব্যবসা। মনোরমার মুখেই শোনা, তাদের মতো দুএকজন  মেয়ে যারা এই পেশাকে সরিয়ে রেখে নিজের পায়ের তলার মাটির অন্য রকম কিছু ভেবেছেন, কিন্তু সেই সংখ্যাটা মারাত্মক রকম ভাবে কম। দিনদিন এই প্রথা গিলে  ফেলেছে তাদেরকেজয়শীলা নামক এক মহিলা ৫৫ বছর বয়সে একটি সরকারি সংস্থার উদ্যোগে আশ্রমে রয়েছেন। তাঁর মুখের স্মৃতিচারণ আরো মারাত্মক। ১২ বছরের রজ:স্বলা হবার পর থেকে আরো দশ বারো বছর শরীর নিংড়ে ছিবড়ে করার পর যখন বিয়ের জোগাড় শুরু হয়, তখন দরিদ্র এই জাতির মধ্যে ছেলে মেলা ভার  হয়। কারণ এত বেশি অংকের টাকা পণ দিয়ে ঘরের বউ নিয়ে যেতে অসমর্থ থাকে এরা। অধিকাংশ অবিবাহিতই থেকে যায়। এই অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত হতদরিদ্র মানুষগুলির জীবনবোধ ভিন্নধর্মী। সরকারি প্রচেষ্টায় যখন গণবিবাহের দ্বারা এই প্রথা   বন্ধ করার প্রয়াস হয়, তখন ক্ষণিক ভাবে বন্ধ হলেও আবার যে কে সেই। এই এলাকা জুড়ে প্রায় ১২০০ বানছড়া মেয়ে এখনো এই পেশায় নিযুক্ত।


আরও কিছুক্ষণঃ-


বেশ ক’বছর একটা অখ্যাত মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত এন জি ওর সঙ্গে টুকটাক  যুক্ত আছি আমি, নিজের চোখে বেশ কিছু দৃশ্য দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার

বেঞ্চিতে বসে সুবেশী এক বছর ২৫এর তরুণী তার দামী এন্ড্রয়েড ফোনে ফেসবুকে টুইটারে নানা পোজের ছবি আপলোড করে চলেছেতার পাশেই বিভিন্ন বয়সী গোটা দশেক মেয়ে কেউ মাথায় হাত চালিয়ে উকুন ধরার প্রয়াসে খপ করে ধরে ফেলা রক্তবীজের সত্যান্যাস করতে ব্যস্ত, কেউ বা রসালো গল্প জুড়েছে খাঁকি উর্দিপরা  বন্দুক কাঁধে মানুষগুলোর সাথে। মোবাইল টেপা মেয়েটি বেশ স্মার্ট চটকদারও বটেচোখে চোখ পড়তেই সামনাসামনি চেয়ার নিয়ে বসলাম। যেহেতু আমিও মেয়ে তাই  মোটেই সে উৎসাহী হলো না আমাদের সৌজন্যে সাক্ষাৎকারে। পুরুষ হলে ঘটনাটা উল্টো হতো হলফ করে বলতে পারি। ওদের মাসির মুখেই খবর পেয়ে আসাঅনেক দিনের ইচ্ছে ছিল এদের নিয়ে একটা আসাইমেন্ট তৈরি করব। ওই মেয়েটি দক্ষিণ কলকাতার এক নামী হোটেলে সরকারি নির্দেশে রেড করার ফলস্বরূপ আজ এই শ্বশুরবাড়ি এসেছে। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই এদের আবার ছাড়াবে ওই উপর মহলের  নির্দেশেই, এটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। আসলে এটাও একটা খাদ্যশৃঙ্খলের সূত্রের মতো জানকী নাম মেয়েটার, ওর মুখেই শুনলাম। সোনাগাছির ১২৭নং সুন্দর  গোছানো ঘরটি ওর। আমি বললাম, একবার যাব তোমার ঘরে ঘুরতে, আর তোমার সহযাত্রীদের সাথে কথা বলতে। ও এমন ভাবে মুখ টিপে হাসল যেন কী এমন মজার  কথা বলে ফেলেছি। আরে দিদিমণি এখানে পুরুষমানুষ আসে স্রেফ পয়সা লুটিয়ে হালবা খেতে আর মেয়েমানুষরা আসে বটে ঘরের ফুটো হাড়ির নিচ দিয়ে পৃথিবী দেখা গেলে। খবর্দার এই কথা মুখে আনবে না। পল্লী-পাড়ার ত্রিসীমানাও মাড়িও না।  এতক্ষণে ওর বক্তব্য পরিষ্কার হলো যাক মেয়েটার মুখে বেশ কথা আছে তো! মনে হচ্ছে পেটে শিক্ষাও আছে। কথা চালু রাখতেই ওর চোখে চোখ রেখেই জানতে চাইলাম, এতই যখন জান, অন্য পেশায় যেতে পারত্‌ এই পেশায় কেন এলে? ও ডান দিকে আঙুল তুলে একজনকে দেখিয়ে বলল, এর নাম ফতেমা, ওর মরদ ওকে এখানে বেচে দিয়ে গেছে। ওর পাশে ও ব্রাহী, খুব সখ ছিল ফিল্ম করবে, শালা ফিল্ম! নে কর... এখন প্রতি রাত্রেই ওর নতুন নীলছবি তৈরি হয়। শালা তবুও খেতে পায় না। যা টাকা পায় বিছানায় শোয়া বরের নামে পাঠায়। আর কত গল্প শুনবে দিদি? আগাপাছতলা ঘেঁটে ফেললেও গল্পটা সেই একই। সত্যিই গল্পটা সেই একইদেখলাম অন্য মেয়েরা ওকে বেশ মান্যি করে। জানতে চাইলে কপাল ঠুকে একগাল হেসে বলল,  মা ঠাকমার বংশানুক্রমিক পেশা। মান্যি না করে যাবে কোথায়! আমি কিছুটা না বুঝেই বললাম, ব্যাপারটা খোলসা কর তো জানকী! ও যা বলল তাতে দারুণ বিস্ময়ের ঘোর লেগে গেল এতদিন দূর থেকে শুনেছি কিন্তু আজ যে কেঁচো খুঁড়তে গোখরো ধরে ফেলব ভাবতেই পারি নি। বলতে শুরু করল –

আমাদের বংশে অনেক ঐতিহ্য আছে দিদি। বেশ উৎসাহী হয়ে উঠলাম, বেশ বেশ!  তৎপর হয়ে বললুম, কী রকম? কী রকম বল শুনি? ও বলল, আমার ঠাকুমা পর্যন্ত গুজরাটের মন্দিরে নাচনী ছিল। মায়ের মুখেই শোনা, তখন কত রমরমে দিনকাল। নিচু বর্ণের জন্য এমনিতে আমাদের মন্দিরে ওঠার ছাড়পত্র ছিল না। কিন্তু দেব্দাসীদের ছিল। দেবদাসী অর্থাৎ দেবতার সাথে রজ:স্বলা হবার আগেই মেয়ের বিয়ে দেওয়া মানে তার আর অন্য কোনো পুরুষ স্বামী হবার অধিকার থাকবে নাতাকে মন্দিরেই  দিয়ে দেওয়া হতোমন্দির ধোয়া মোছা দেবতার নানাবিধ কাজের পাশাপাশি চলতে  থাকে শারীরিক শোষণসেই মেয়ের উপর প্রথম ভোগের অধিকার বর্তায় মন্দিরের  প্রধান পুরোহিতেরতারপর রাজা জ্ঞানীগুণী সকল বিত্তশালীর ভোগ্য দেবদাসী। ধর্মের আড়ালে চলে নারী শোষণের এক বিরাট কর্মকাণ্ড। প্রাচীন সতীদাহ প্রথায় স্বামীর সাথে চিতায় চড়তে হতো স্ত্রীকে, তার আর্ত চিৎকার যাতে কার্যে বিঘ্ন না ঘটায়, ঢাকঢোলে  মিলিয়ে যেত সেই আর্তনাদ। তেমনই কচি মেয়েদের উপর অত্যাচারের অংশ হিসেবে মন্দিরে থাকত ঢাকের ঘন্টার শব্দ, ঢাকা পড়ে যেত জীবনের যাবতীয় রঙ ও সুর। অবশ্য এখন সরকারী নির্দেশে অনেকটা বন্ধ হয়েছে এই প্রথা। আর দেবদাসীদের  আস্তানা হয়েছে বিভিন্ন অন্ধকারময় যৌনপল্লীতেপড়াশোনা কিছু শিখেছিলাম। কিন্তু কে দেবে যোগ্য সন্মান! একবার গায়ে রেড লাইট স্ট্যাম্প পড়ে গেলে অন্য পেশার ক্ষেত্রেও ঊর্ধ্বতন বা অধঃস্তন কেবল মাংস চেনে, মাংস।




জানকীর এক নি:শ্বাসে বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে পড়ে যাচ্ছিল কিছু কথা। আমরা পতিতাবৃত্তির নজির বাৎস্যায়নের কামসূত্রে বা কৌটিল্যের লেখাতে পেলেও কোথাও দেবদাসীর উল্লেখ পাইনি। অবশ্য বৌদ্ধধর্মের সময়ে মঠগুলির সন্ন্যাসিনীরা পরে এই পেশায় আসেন তবে হিন্দু ধর্মের রমরমার সাথে সাথে দেবদাসীদের প্রসার ঘটে। অম্রপলি দেবদাসীশ্রেষ্ঠা। জানা যায়, বছরের একটি বিশেষ দিনে শহরের যত  কুমারী মেয়ে আছে, রাস্তায় পাওয়া গেলে তাকে জোর করে তুলে এনে নৃত্য সংগীত  প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য দেবদাসী রূপে গড়ে তোলা হতোভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি প্রাচীন  প্রাচ্য দেশে বেশি মাত্রায় ছিলপ্রাচীন মেসোপটেমিয়ানরা ধর্মীয় যৌনতার প্রতিটি  সুযোগই কাজে লাগাত। ব্যাবিলনদের সবচেয়ে খারাপ রীতি ছিল, জীবনে একবার  হলেও প্রত্যেক মহিলাকে বাধ্য করা আফ্রিদিতি মন্দিরে যেতে, যেখানে তাকে একজন  অপরিচিত ব্যক্তির সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে হতোযেসব মহিলারা ধনী ও আত্মগর্বিত ছিলেন তাঁরা অনেক সময় মিলিত হতে চাইতেন না। তাঁদের তখন দড়ি দিয়ে বেঁধে আনা হতো মন্দিরে। প্রচুর অনুগামী লোক ভিড় করত তখন। এভাবে  বিপুল সংখ্যক মহিলাকে আনা হতোমহিলারা বাড়িতে ফিরে যেতে পারত না   যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত। অপরিচিত কোনো লোককে অবশ্যই টাকা দিতে হতো বন্দিনী মহিলার আঁচলে এবং তাকে আহবান করতে হতো মাইলিত্তা দেবীর  নামে। তাদের মন্দিরের বাইরে মিলিত হতে হতোটাকার পরিমাণ যাই হোক না  কেন তা নিতে অস্বীকার করা পাপ। সুন্দরী মহিলারা সহজেই মুক্তি পেত অল্পদিনে। অসুন্দরীদের থাকতে হতো দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত কো্নো লোকের সাথে মিলনের  আগ পর্যন্ত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ বছর আগে গ্রিসে জেনোফন নামের একজন অলিম্পিক বিজয়ী দেবীর মন্দিরে ১০০ জনের মতো তরুণীকে উপহার হিসেবে দান করে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। করিন্থ নামক ঐ শহরে দেবী আফ্রিদিতির মন্দির ছিল। রোমান যুগে ঐ মন্দিরে প্রায় হাজারের উপর দেবদাসী ছিল।

অর্থাৎ বলা যায় পতিতার দেবী ছিলেন ভেনাস বা আফ্রিদিতি। গ্রিক দার্শনিক সলোন, তিনি একবার আইন প্রণয়ন করেন পতিতারা হলেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ, এদের আয়ের টাকাতেই আফ্রিদিতির মন্দির সংস্করণ এবং সংরক্ষণ করা হবে। সলোনের সময় কিন্তু গ্রিসের নারীরা স্বেচ্ছায় মন্দিরে আসত না, তাদের জোর করে ধরে রাখা হতো  পতিতাবৃত্তির জন্য। এদের অসুখ বিসুখের চিকিৎসার কথা তো দূর অস্ত, দারুণ কষ্টের জীবনধারণ করতে হতো খদ্দের আকৃষ্ট করার জন্য এখনকার মতোই তাদের নগ্ন হয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়াতে হতো কখনো বা রাস্তার ধারেই যৌনসঙ্গম করে খদ্দের আকৃষ্ট করত।

গ্রীক সভ্যতায় যে উপপত্নী রাখার প্রচলন ছিল, শিল্প-সাহিত্য ঘাঁটলেই তা জানতে  পারা যাবে। হেতায়ারা নামে উঁচু দরের পতিতা, যাঁরা গ্রিসের রাজপুরুষ থেকে শুরু করে সেনাপতি, কবি দার্শনিকদের ভোগ্য ছিলেন এঁরা প্রভাবশালী সমাজের ভোগ্য  থাকায় অবশ্যম্ভাবী ভাবেই এঁদের শিক্ষিত ও রুচিসম্পন্না হতে হতো




গ্রিক থেকে যাত্রাপথটা যদি রোমের দিকে টেনে নিয়ে যাই, সেখানেও সেই একই ব্যাপারদেশ ভিন্ন চরিত্র ভিন্ন হলেও কার্য ভিন্ন হবার নয় যেন কোথাও এখানের  পতিতা বলতে বেশির ভাগই ছিল বিজিত অঞ্চলের নারীরা। রোমের চরম উৎকর্ষতার সময় সমগ্র ইতালি জুড়ে হামামখানা তৈরি হয়। হামামখানাগুলি হয়ে ওঠে যৌনাচারের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে নারীপুরুষ উলঙ্গ হয়ে গোসল করার প্রথা ছিল। বড় বড় সম্রাটের স্ত্রীরাও সম্রাটের অজ্ঞাতে পতিতাবৃত্তিতে যুক্ত ছিল। সম্রাট ক্লডিয়াসের স্ত্রী মোনালিসা এই অপরাধে সম্রাটের আদেশে নিহত হন।

মধ্যযুগে অবশ্য পৃথিবীর সব স্থানেই পতিতাবৃত্তির রমরমা চোখে পড়ার মতো ইংল্যান্ডে তখন পতিতাবৃত্তির চল থাকলেও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় লুকিয়ে চুরিয়ে চলত। রাজা অষ্টম হেনরি আইন করে এই প্রথা নিধনের বন্দোবস্ত করেন। তবে জাপানের ক্ষেত্রে সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত অসংবদ্ধ ছিল পতিতা ব্যবসা ১৬১২ সালের পর থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠায় এদের ব্যবসা লাভের মুখ দেখেআসলে পৃথিবীর যে কোকনো প্রান্তই হোক না কেন, দৃশ্যটা একই। শুধু কিছু চরিত্র বদলে যায় মাত্র

হঠাৎ জানকীদের জোর কলকল আোয়াজে চিন্তায় ছেদ পড়ল। ফিরে দেখি, ওদের ছাড়া হয়েছেদিব্যি ফুরফুরে মেজাজে গল্প জুড়েছে কেউ কেউ... কেউ আবার কয়েক ঘন্টা নষ্ট হবার জন্য থানার গুষ্টির ষষ্ঠী নিধন করছে। পুলিসরা কেউ কেউ অবলীলায় ওদের বুকে হাত রেখে মজা লুটছে দিনদাহারে। অন্য মানুষ বসে আছে,  ভ্রুক্ষেপ নেই। আর মেয়েরাও যেন হরিণের মাংস... ১২ ঘন্টা ফুটেও সেদ্ধ হবার নয়!  আর বসে থাকতে ইচ্ছে হলো না। কাগজ গুছিয়ে বাড়ি ফিরে আসব, দেখি জানকী  মিষ্টি করে হেসে বলছে, আবার দেখা হবে দিদিমণি... তোমার কাজে যদি লাগি তবে ডেকো ওর হাসির প্রতি উত্তরে একটা শুকনো হাসি দিয়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। মোপেডে স্টার্ট দিয়ে দক্ষিণ থেকে এবার উত্তর...

সারা রাত সেদিন ঘুম আসছিল না। বারবার জানকীর কথাগুলো মনে পড়ছিল। দেবদাসীরা কেন হলো দেবদাসী? সমাজ পরিস্থিতির চাপে কখন একটা মেয়ে নিজেকে  পণ্য করে তোলে! এরাও তো ভালো জীবন পেতে পারে! তার প্রমাণ হলো শ্বেতাঙ্গ  কট্টী। রাষ্ট্রসংঘের ইয়ুথ কারেজ অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত হলেন মুম্বইয়ের কামাথিপুরার যৌনপল্লির বাসিন্দা এই তরুণী। ১৯ বছরের শ্বেতা কট্টীকে শিক্ষাক্ষেত্রে অননুকরণীয় সাহস দেখানোর কারণে এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। সাহসিকতা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য প্রতি বছর মেয়েদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়। রাষ্ট্রসংঘের তরফে ই-মেল পাঠিয়ে এই সম্মান প্রাপ্তির কথা জানিয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরে মুম্বইয়ের রেড লাইট এরিয়ায় বসবাস করছেন বহু মেয়ে। ক্রান্তিনামে এক এনজিও-র উদ্যোগে তাঁরা শিক্ষার আলো দেখছেন। এই প্রতিষ্ঠানের  সহযোগিতাতেই শ্বেতার পড়াশোনা সম্পূর্ণ হয়েছে। ক্রান্তি-র সদস্য রবিন চৌরাসিয়া জানিয়েছেন, শ্বেতা যৌনপল্লি থেকে বেরিয়ে আসা সেই মেয়ে, যাকে রাষ্ট্রসংঘ সম্মানের জন্য মনোনীত করা হয়েছে।

জানা গিয়েছে, নিউ ইয়র্কের বার্ড কলেজ ইতিমধ্যে শ্বেতাকে ২৮ লক্ষ টাকা বৃত্তি দিয়েছে।  ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্কে বসবাস করে ওই কলেজে মনোবিজ্ঞানে ডিগ্রি কোর্স করবেন শ্বেতা। বার্ড কলেজ আমেরিকার শীর্ষ দশটি কলেজের অন্যতম। এখানে ৪ বছরের স্নাতক ডিগ্রির জন্য খরচ পড়ে ২৮ লক্ষ টাকা। একটি অনুষ্ঠানে বার্ড কলেজেরই এক প্রাক্তন ছাত্রের সঙ্গে দেখা হয় শ্বেতার। তিনিই কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে শ্বেতার নাম প্রস্তাব করেন। শ্বেতার জীবনের কাহিনী শুনে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে বৃত্তি দিতে রাজি হয়।

কর্ণাটকের বাসিন্দা শ্বেতার মা আদতে দেবদাসী ছিলেন। শ্বেতার জন্মের পর তাঁকে নিয়ে তিনি মুম্বই চলে আসেন। কামাথিপুরাতেই শৈশব কেটেছে শ্বেতার। মুম্বইয়ে একজনের সঙ্গে লিভ-ইন সম্পর্ক ছিল তাঁর মায়ের। যৌনকর্মী না হলেও ওই এলাকাতেই বসবাস করতেন তিনি। সে সময় মায়ের পুরুষ সঙ্গীর যৌন লালসার শিকারও হতে হয় শ্বেতাকে। তবে তাতেও দমে যাননি তিনি। একনিষ্ঠ ভাবে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন।

একই সঙ্গে ক্রান্তি-র হাত ধরে তিনি যৌনকর্মীর সন্তানদের পড়াশোনাও শেখাতে শুরু করেন। দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা দেওয়ার পর শ্বেতা এক বছর পড়াশোনা বন্ধ করে  রাজস্থান, নেপাল এবং ঝাড়খণ্ডে মেয়েদের যৌন শিক্ষার প্রচার অভিযানে সামিল হন। নিউ ইয়র্কে পড়াশোনার পাট শেষে ভারতে এসে তিনি যৌন নিগৃহীতাদের সাহায্য করতে চান। তিনি চান, এদেশে যৌন কর্মীদের অধিকার এবং তাঁদের পেশা আইনি অনুমোদন পাক। 

তবে স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে যদি ভারতবর্ষের আদিকালে স্থাপিত করা যায়, তবে সে  ক্ষেত্রে চমকটা কিন্তু কম নয় পতিতাবৃত্তির উৎপত্তি সৃষ্টির আদিকাল থেকেপুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে প্রচুর অপ্সরার উল্লেখ পাওয়া যায় যেমন উর্বশী, মেনকা,  তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, সুকেশী, সরলা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুবাহু এরকম অনেক স্বর্গ-বেশ্যার  নাম আমরা পাই। বাংলা ডিকশনারি মতে অপ্সরা অর্থ - স্বর্গের বারাঙ্গনা বা বেশ্যা; সুরসুন্দরী। [সং. অপ্ + সৃ + অস্ = অপ্সরস্ = অপ্সরা]। সমুদ্র মন্থনে জল অপ থেকে উঠেছিল বলে অপ্সরাস্বর্গ পর্যন্ত যখন হাঁটা হয়েই গেল, তখন কিছু কথা  বলা যাক স্কন্ধ পুরাণ থেকে। স্কন্ধ পুরাণের নাগর খন্ডের ৬০নং শ্লোকে বলা হয়েছে – “নারী জাতির অধরে পিযুষ এবং হূদয়ে হলাহল পূর্ণ” অর্থাৎ কিনা নারীর অধর আস্বাদন কর এবং হৃদয় পীড়ন করমনু সংহিতার ৯ম অধ্যায়ে ১৪নং শ্লোকে বলা হয়েছে - স্ত্রীরা পুরুষের সৌন্দর্য বিচার করে না, যুবা কি বৃদ্ধ তাও দেখে না। সুরূপ বা কুরূপ হোকহয়”এর থেকে নারীকে আর কত ছোট করা যায়! কামসূত্র গ্রন্থের লেখক বাৎস্যায়ন পতিতাদের ৯টি ভাগে ভাগ করেছেন, তা হলো – “বেশ্যা বিশেষ প্রকরণ - কুম্ভদাসী, পরিচারিকা, কুলটা, স্বৈরিণী, নটি, শিল্পকারিকা, প্রকাশ বিনষ্টা, রূপজীবা এবং গণিকা - এই কয়টি বেশ্যা বিশেষ [কামসূত্র : চতুর্থ ভাগষষ্ঠ অধ্যায়-২৪]” পুরুষকে যদি কামের দাস মনে করা হয় তবে নারী হলো সেই কামের উৎস মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক বিখ্যাত মুনি ঋষির নাম  উল্লেখ করা যায়, যাঁরা স্বর্গবেশ্যাদেখে কামার্ত হয়ে তাঁদের সঙ্গে যৌনমিলন  করেছিলেন। বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা এরাই হলেন সেইসব মুনি মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলির মধ্যে  পতিতাবৃত্তি ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে পতিতাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। ঐ কারণেই বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ডঃ অতুল সুর লিখেছেন – “মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল”(দেবলোকের যৌনজীবন, পৃঃ ৬২)। বাংলা ডিকশনারি মতে মৈথুনের অর্থ - রতিক্রিয়া, রমণ, স্ত্রী-পুরুষের যৌন  সংসর্গ। [সং. মিথুন + অ]। ভারতবর্ষের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, প্রথম মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৭) কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষের চিত্র পাওয়া যায়। কৌটিল্যর আরেক নাম ছিল চাণক্য। তিনি প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রবিজ্ঞান গ্রন্থ অর্থশাস্ত্রর রচয়িতা। আর কৌটিল্যের সময় দেহব্যবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল, যে শিল্পের নাম ছিল  বৈশিক কলা। ঐ সময় দেহব্যবসা ছিল সম্মানিত পেশা। জ্ঞানী লোকেরা এই শিল্পের  চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। সপ্তম শতকের রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বানভট্ট। বানভট্ট তাঁর ‘কাদম্বরী’ গ্রন্থে লিখেছেন, সেকালে বেশ্যারাই দেশের রাজাকে স্নান করাত। এমনকি রাজার পরনের সব পোশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিতনবম শতকে কুট্টনীমতগ্রন্থ লিখেছিলেন কাশ্মীরের মন্ত্রী ও কবি দামোদর গুপ্তবিকরবালা  নামের এক বৃদ্ধা বেশ্যার উপদেশনামা নিয়েই মূলত কুট্টনীমতগ্রন্থ লেখা হয়েছিলবাৎসায়নের কামসূত্রের মতো ‘কুট্টনীমত’ও একটি কামশাস্ত্র গ্রন্থ এছাড়া মহাকবি  কালিদাসের মহাকাব্যগুলিতেও বেশ্যা নারীর উল্লেখ আছে। দোনা গাজির ‘সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল’, আবদুল হাকিমের ‘লালমতি সয়ফুল মুল্লুক’, শুকুর মাহমুদের ‘গুপীচন্দ্রের সন্ন্যাস’ - এইসব কাব্য পুঁথিতে বেশ্যা-সংস্কৃতির সরস বিবরণ আছে।



  
কথিত হয়উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির ছিল দেবদাসী প্রথার পথিকৃৎ| সেইসঙ্গে  কোণারকের সূর্য মন্দিরদক্ষিণ ভারতের অন্যান্য মন্দির সহ ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে  শিকড় বিস্তার করে এই প্রথা| যা ধর্মের দোহাই দিয়ে দেহ বা যৌন ব্যবসারই আর এক রূপ| দক্ষিণ ভারতে দেবদাসীহলেও উত্তরভারতে এই রীতির নাম মুখি’| প্রথার জন্মের আদিপর্বে দেবদাসীদের স্থান ছিল অত্যন্ত সম্মানের| অর্থজমি তো ছিলই| তাঁরা ছিলেন মন্দিরের অচ্ছেদ্য অংশ| তাঁদের নাচ-গান ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিল দেবতার আরাধনা| সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষ নিজেরা মেয়েদের উৎসর্গ করতেন দেবদাসী হওয়ার জন্য| বয়ঃসন্ধির আগেই করা হতো উৎসর্গ| তারপর দেবদাসী হয়ে পারফর্ম করার জন্য নিতে হতো নাচ-গানের কঠোর প্রশিক্ষণ| কন্যা উৎসর্গ করার রীতি দক্ষিণ ভারতে মুট্টুকাট্টুভাডুএবং দেভারিগে বিদুভাদুনামে পরিচিত| ‘মুট্টুকাট্টুভাডুমানে দেবতার সঙ্গে বিয়ে| এবং দেভারিগে বিদুভাদু’-এর অর্থ নিজেকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করা| একবার উৎসর্গ হয়ে গেলে সেই মেয়েরা আর ফিরতে পারত না স্বাভাবিক সমাজে| তাঁদের আর বিয়েই হতো না|

কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের জায়গা থেকে চ্যুতি হলো এই প্রথার| অবক্ষয় গ্রাস করল পুরোহিতকে| বোঝা গেলপাথরের বিগ্রহকে উপেক্ষা করে মানুষই ভোগ করতে পারে  দেবদাসীকে| তখন আর উৎসর্গ-টর্গ নয়| লুঠ করে আনা হতো মেয়েদের| এমনকীব্যক্তিগতভাবে মেয়ে কেনাবেচাও হতোএই অবক্ষয়ের হাত ধরেই দেবদাসীদের মধ্যে  চলে এলো রূপভেদশ্রেণীবিভাগযাঁকে উৎসর্গ করা হয় তিনি দত্তালুঠ করে আনা হলে তিনি হ্রুতা’| কেনাবেচা করা হলে সেই কন্যা বিক্রিতা’‚ কেউ নিজেই  নিজেকে দেবতার পায়ে উৎসর্গ করলে তিনি ভক্ত দেবদাসী’‚ অলঙ্কার-সহ কাউকে উৎসর্গ করা হলে তিনি সালঙ্কারা’‚ যদি কেউ দেবদাসী হয়ে নিয়মিত পারিশ্রমিক পানতিনি গোপীকা বা রুদ্রাঙ্গিকা|

একশ বছর আগে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে জানা যাবে, আমরাও এই ধারার ব্যতিক্রমী ছিলাম না। সমাজের নেতৃস্থানীয় খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ এই নৈতিক স্খলন থেকে মুক্ত ছিলেন না। এই প্রসঙ্গে আমি দু’একটি লেখার অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করছি, যার সত্য মিথ্যার দায় আমার নয়। আমি যেটুকু খুঁজে পেয়েছি  সেইটুকুই ‘কোট’ করছি। যাঁরা যাচাই করতে চান, তাঁরা বইগুলি পড়ে দেখতে  পারেন। আমি শুধুই সূত্রধর। এই বক্তব্যও আমার নয়, আমার বিশ্বাসের কথাও নয়।    

বেশ্যাবাজি ছিল বাবু সমাজের সাধারণ ঘটনা। নারী আন্দোলনের ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায়ের রক্ষিতা ছিলএমনকি ঐ রক্ষিতার গর্ভে তাঁর একটি পুত্রও জন্মেছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিতা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন। সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন নিয়মিত বেশ্যা পাড়ায় যেতেন তা তিনি নিজেই তার ডাইরিতে লিখে গেছেনমরমি কবি হাসন রাজা, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত পতিতালয়ে যেতেন”[তথ্যসুত্র: অবিদ্যার অন্তঃপুরে, নিষিদ্ধপল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা, ড. আবুল আহসান চৌধুরী, শোভা প্রকাশ, বাংলাদেশ] এছাড়াও আরও যে বইগুলি এই প্রাসঙ্গিকতায় পড়া যেতে পারে – ১) বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড, নগেন্দ্রনাথ বসু। ২) বেশ্যা পাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ – সম্পাদনা মৌ ভট্টাচার্য। ৩) কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, ১৯৯৯, বিনয় ঘোষ। ৪) বাবু কোলকাতার বিবি বিলাস, পৃথ্বীরাজ সেন। ৫) সংস্কৃত সাহিত্যে বারাঙ্গনা, দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়।

ক্ষতপ্রায় এই প্রথার যে বীজ আদিতে প্রোথিত হয়েছিল, এখন সেই চারাগাছ মহীরূহ  হয়ে ডালপালা ছড়িয়েছে আমাদের সমাজের অন্তরে হ্যাঁ নাম হয়তো ভিন্ন বা এর পেশাগত পরিচয়ও ভিন্ন। যেসব মেয়েরা সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে দেহ বিক্রি করে, সমাজ তাঁদের বলে পতিতাঅপরদিকে, যেসব মেয়েরা হাজার টাকার বিনিময়ে লুকিয়ে দেহ বিক্রি করে, সমাজ তাদের বলে সোসাইটি গার্ল। যারা আর একটু বেশি  দামে দেহ বিক্রি করে, সমাজ তাদের বলে পার্টি গার্ল

বলছি না তুমি আমাকে বিশ্বাস কর
বলছি না তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর ঊর্ধ্বে রেখে
জৈবিক চাহিদাগুলোকে মেরে ফেল হাতের চেটোতে
চুরি করা ছেড়ে চোর প্রেমিকও হয়, তেমনই
আমিও হিন্দু ধর্মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে
ব্রহ্মার আগে বসিয়ে দেব তুমি শব্দ বিষ্ণুর বাঁশি
ছিনিয়ে ভ্যালেন্টাইন গিফট দেব তোমায়
এতে হয়তো বুদ্ধিজীবী সংঘ, কাঞ্চির শংকরাচার্য রোষের স্বীকার হবেন  
হয়তো বা সাইনাথ পন্থী'রা শূলে দেবে আমায়  

তবুও বলছি না তুলতুলে মাটিতে চাষ করে দাও বীজ ধান
শেষ অগ্রহায়ণে ধান কাটা শূন্যতার মতো সুচিত্রা মুর্মুর মতো রাষ্ট্রদ্রোহী
হতে পারি
কুন্তির অবৈধ সন্তানরা রে রে করে তেড়ে আসতে পারে  
রাজনীতিবিদরা মামলা ঠুকতে পারে
গোঁড়াপন্থিরা জিলেটিন প্রস্তুত করতে পারে
সেলিব্রেটিরা রোদ চশমা পরে হাতে মানছি না’ নিয়ে রাস্তায় নামতে পারে   

বলছি না তো ঠোঁটে ঠোট রেখে ভিক্টোরিয়ার নিভৃতে
ঠোঁট আর হাতের চারুশিল্পের গল্প বোনো 
রোদ সরে যেতে থাকে অন্য ছায়ার দিকে
কী করতে পারি বলো?  
হতে কি পেরেছি স্তনের দুধ নিয়ে মায়ের রূপে অবতীর্ণ হতে?
অমৃত হয়ে মায়ার কুম্ভে, কৃষ্ণসখা হয়ে ধর্মযুদ্ধে?

বলছি না তো ভালোবাসতেই হবে 
মান্যতা চাই বলে কলকাতা ভরিয়ে দিইনি জনসমুদ্রে
মহিলা কমিশন ডাকিনি তোমার ঘরে
মোমবাতি শোভাযাত্রায় ধর্ষণের বিচার চাইনি পুরুষের কাছে
লাল- নীল-সবুজ পতাকায় জড়িয়ে নিইনি শরীর
লুকিয়ে রাখনি শরীরে আত্মঘাতী কোনো বোমা  
বলছি না তো, আমাকে লাশ করে দিয়েছ বলে, আকাশ তুমি কাঁদো
বলছি না, ধরণী দ্বিধা হও
চাইছি না পুরুষ অনুকম্পা -

শুধু, চেয়েছি গৌরবের মধ্যে জ্বলতে থাকুক আমার চিতা
সেই আগুনে একদিন যদি, যদি একদিন
পুড়ে যায় তো যাক পুরুষ লিঙ্গের উদ্বেগ


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন