দে পরিবার : কম বেশি আমার-তোমার
আরে তুই তো দেবযানীর মতো পাগল! এখন শহর আধা শহরগুলিতে ঘরে ঘরে উচ্চারিত হচ্ছে এমন বাক্য। একদিন স্নান না করলেই মা
বলে উঠছে, কী করে তুই পার্থর মতো গায়ে গন্ধ নিয়ে বাইরে যাবি? আসলে এই দে পরিবার আমদের
চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল লেখাপড়া, ষ্ট্যাটাস, প্রতিষ্ঠার বাইরে আরো একটা কিছু আছে। সেটা আমার নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার। তার পরিণতি হয়তো বা মর্মান্তিকও হতে পারে, কিন্তু আমি আমার মতো করেই বাঁচতে চেয়েছিলাম, আর এটাই ছিল তাদের শেষ কথা। সব নিজের মতো করা বাঁচার নাম কি অবশেষে সিজোফ্রেনিক
নাম নিয়ে মুখ লুকায় অতীতের অন্ধকার কোনো বিচ্ছিন্ন কোণে? সকলের মুখে এক হাঁ করা বিস্ময় কি একই কথা বলে, পাগল! পাগল!
একাকীত্ব মানুষের জীবনের এক মৌলিক সম্পদ, যা আমাদের কখনো সৃষ্টিশীল করে, কখনো একঘরে করে। কার চলে যাওয়ায় কে কখন
একাকী হয়ে পড়ে তা নির্ধারণ করাও বেশ জটিল কাজ। এক না ভূমিষ্ট হওয়া সন্তানের শোকে
এক নারী মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে যদিও
সে জানে আগামীতে সে নিশ্চিত মা ডাক শুনতে পাবে। আবার যে সম্পর্ক থেকে রেহাই
পেতে মানুষ আইন-আদালত তোলপাড় করে, তারপর সে আর মুক্তির আনন্দ নিতে পারে না। আবার বাবা-মায়ের মৃত্যু
অনিবার্য জেনেও একটা সময় পরে তাদের চলে যাওয়াটা মন মানতে পারে না। শুনেছি অভিনেত্রী নার্গিসের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র অভিনেতা সঞ্জয়
ড্রাগসের নেশায় পড়ে। শূন্যতা অনেক সময় মেটে না। মানুষ নিজে অস্ত্র নামিয়ে
ফেলে। যুঝতে পারে না নিজের সঙ্গে।
দেবযানী ও পার্থ শুধু নয়, আমারা অনেকেই মানসিক
দিশাহীনতায় ভুগি। বন্ধু বিচ্ছেদে, প্রেমের ভাঙনে, পারিপার্শ্বিক চাপে আমরা ক্ষয়ে যেতে থাকি। প্রাণোচ্ছলতাও উধাও হয়, হাসি গায়েব হয়। মনের জোর কমতে থাকে আমাদের
একটু একটু করে। রোগের নাম যেমনই গালভরা থাক না কেন আসল সত্য কিন্তু এইটা যে, আমরা একটু একটু করে হারতে থাকি। তবে সীমানা অতিক্রম করে
গেলে তা ধরা পড়ে বা স্পষ্ট হয়ে যায়। এই আত্মপরাজয় থেকে নিজেকে উদ্ধার করার যে প্রয়াস সেটা খুব
শ্রমসাধ্য। চিকিৎসাবিদ্যা আমাদের সহায়ক, কিন্তু আত্মপরাজয় বোধের বা হারানোর যন্ত্রণার কোনো বিকল্প প্রতিষেধক নেই। আমার টিকে থাকার রাস্তা আমাকেই খুঁড়ে নিতে হয়।
দেবযানী ও পার্থও খুঁড়েছিল এমন এক
নির্জন রাস্তা, যে রাস্তা দিয়ে একমাত্র তারাই হেঁটে যেতে চেয়েছিল। কী অসম্ভব ভালোবাসা আর বিশ্বাস! ঔদার্য্য থাকলে একটি মানুষকে তিল তিল করে মরতে দেওয়া যায় ও তাতে নীরবে সামিল হয়ে
দর্শকের মতো দেখা যায়, তা এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার জীবন্ত দলিল। আমারা কথায় কথায় বলি, পাগলও তার ভালোটা আজকাল বোঝে। পার্থ সেই বোকাপাগল যে মা’কে, কুকুরকে, দিদিকে হারিয়েও একা বাঁচার
ভয়ে ভীত ছিল না। সে দিদিকে তার অন্তিম লক্ষ্যের সন্ধানে এক অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে পাহাড়া দিয়ে
গেছে। একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনীয়ার তিল তিল করে মরতে দেখছে এক পদার্থবিদ্যার কঠিনতম
শাখায় দক্ষতার সঙ্গে উত্তীর্ণ সফল শিক্ষার্থীকে। আধুনিক সভ্যতায় এমন বিস্ময়কর বিরল
দৃষ্টান্ত খুঁজলেও বুঝি মিলবে না দ্বিতীয়টি। মানসিক জটিলতা আর ভালোবাসার ভাষার কাছে বিজ্ঞান
হয়তো বা এমনি করেই পরাস্ত হয়!
পার্থর কুকুর সহ দিদির মৃতদেহ নিয়ে থাকা একটি
সামাজিক অপরাধ, মানি। এই এককেন্দ্রিকতার ঠাঁই নেই সমাজে। আমার একার কোনো অস্ত্বিত্ব নেই সমাজে। সকলের জন্য আমার এই টিকে থাকা। এটা কি তারা জানত না? নিশিচত ভাবেই জানত। কিন্তু হয় না। যেভাবে আমি নিশ্চিত জানি, আমার প্রেমিক আর ফিরবে না
আমার কাছে কোনোদিন, আর ফিরলেও সে আর তেমন থাকবে না যেমন বাঁধভাঙ্গা আবেগে আমি তাকে একদিন চেয়েছিলাম। তবু তার জন্য কি
মাঝরাতে ভাঙে না আমার ঘুম? এক অনাগত অতিথির মতো আসা ও হারিয়ে যাওয়া সেই
প্রেম কি চোখ থেকে শিশির হয়ে ঝরে যায় না সকলের অলক্ষ্যে? জানি তো, আমার এই আবেগ, রাতভোর জেগে থাকা, হতাশায় ভোগার কোনো স্থায়ী ভবিষ্যৎ নেই; তবু আমি তা করে যাই। আমি কি শিক্ষিত না? সচেতন না? আমি কি নিজেই নিজের কাউন্সেলিং-এর চেষ্টা করি নি? তবে? আমি সেই ঘুরে ফিরে পার্থর
ছায়া। আমিও অনেক মৃতদেহ আর কঙ্কাল নিয়ে ঘুরছি। প্রতি মুহূর্তে আত্মহত্যা করছি এক
সুদৃশ্য ছাদের তলায়, মার্বেলের ঘরে। আমি জানি আমি মরছি, মরছে আমার আকাঙ্ক্ষা, আমার স্বপ্ন, আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন, আমার মন। সেলফ কেয়ার আমিও ছেড়ে দেব একদিন, যেদিন আমার আকাঙ্ক্ষার শেষ
হবে, যেমনটা দেবযানীর মৃত্যুতে পার্থর শেষ হয়ে গিয়েছিল।
পার্থর সেই পোড় খাওয়া, বিদ্রোহী, বিবর্ণ, জেদী চেহারার প্রতি
শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে বারবার। ‘পাগল’ বললে তাকে অসম্মান করা হবে, মনে হয়। দেবযানীর দুরন্ত আকাঙ্ক্ষা
আমাকে খুব টানে। ভালো লাগার স্বাধীনতাকে এমন শৃঙ্খলমুক্ত দেখার বড্ড সাধ ছিল। গান মানুষের জীবনের সুর বেঁধে দেয়। সেও অনেকেকে বাঁধতে চেয়েছিল এক সুরে। তাকে ‘পাগল’ বলি কী করে? পার্থিব অনাকাঙ্ক্ষা অনেককে স্পিরিচুয়ালিটির দিকে ঠেলে দেয়, সে কাল আমাদের যে কারো
জীবনে মৌলিক হয়ে দেখা দিতে পারে। আমার প্রিয়জন আমাকে এমনি
করে মরতে দেখছে, এমনটা ভাবলেও এক আসাধারণ গরিমায় বুক ভরে যায়। আমাকে আমার মতো করে বাঁচতে দেওয়াটাকেও
আমরা যেখানে স্বেচ্ছাচারিতা বলতে দ্বিধা করি না, সেখানে আমাকে আমার মতো মরতে দাও, এ গান তো নৈরাজ্যের সামিল
হবে!
আমি সত্যি জানি না, এই ভাই-বোন সিজফ্রেনিক ছিল
কিনা বা তাদের জিন বা বংশের দলিল এমনটা বলে কিনা। কিন্তু সিজফ্রেনিক নারী নিয়ে
অনেক পুরুষ ঘর করে। অনেক মহিলাও ঘর করে এমন পুরুষ নিয়ে। এ উদাহরণ আমদের সমাজে জ্বলন্ত। নিয়মিত চিকিৎসার বাইরে
তাদের পরিবার রাতে নীরবে শুতে যাবার আগে বাড়ির রান্নাঘরের আঁশকাটা বঁটি
ও শিল পাটা লুকিয়ে রাখে, কেননা তারা ঘুমন্ত অবস্থায় কোনো মুহূর্তে
আক্রান্ত হতেও পারে। পরিবারের কাউকে শেকলে বেঁধে কেই বা ফেলে আসতে চায় হাজার পাগলের ভিড়ে! তাই এমনি করে তারা জীবন
চালায়। হয়তো এটাই অস্তিত্ব রক্ষার আসল কথা। থেমে না যাওয়া। ঠিক হোক ভুল হোক চলতে
থাকাকেই জীবন বলে। পার্থর জায়গা মানসিক হাসপাতালে নয়, বরং হোক একজন ভালোবাসার মানুষের মনে। এমন একজন এগিয়ে আসুক যে তার
মৃত্যুর ছায়ার হাত ধরে বাঁচার সাহস দেখাতে পারে, যেমন করে পার্থ একদা
দেবযানীর মৃত্যুকে আঁকড়ে ধরে দিদিকে তার
সিদ্ধান্তের সমাপ্তির দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। হতে পারে, এবারের লক্ষ্য দে পরিবারের
কবর খুঁড়ে অন্য ইতিহাসের জন্ম দেবে! পুনরুত্থান ঘটবে এই প্রজন্মের ভিন্ন প্রস্তর ফলকে, মুছে যাবে ভুলের
ইতিহাসটুকু। প্রতীক্ষা করব আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা হাজার পার্থ দেবযানীর উত্তরণের, এক ঐতিহাসিক মোড়ের, যা কালকের অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্তের অস্থির পরিণামের বদল আনবে আগামীতে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন