কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৫

সুবীর সরকার


হেরম্বচরিত




পুনরুত্থানপর্ব

ঘরের মধ্যে ঘর। ঘরবাড়ির বিন্যাসে অগোছালো এক ভাবভঙ্গী বিন্যাসের সামান্য  অদল বদলেই অগোছানোটা অনায়াসেই সুসজ্জিত সাজানো পথঘাটের রূপ ধারণ করতেই পারে। চরাঞ্চল থেকে রাত্রির খুব মাঝামাঝি থেকে জল ছুঁয়ে পাক খাওয়া বাতাসের অসামান্য মৃদু এক মন্থরতা সমস্ত সংজ্ঞার তীব্র বদল ঘটিয়ে দিয়ে যাবতীয়তাটাকেই সংজ্ঞায়িত করে তোলে। চর কিন্তু চিরস্থায়ী নয়, কোনো না কো্নো চরকে সামগ্রিকতা  সহই তলিয়ে যেতে হয়, ডুবেও যেতে হয়। আবার নতুন নামের ধারাবাহিকতাকেই  অব্যাহত রাখে। এখানেই তো রহস্য। রহস্যের স্থবিরতাকে সচল করে তুলতে পারলেই পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের ডুবে যাওয়া চরের ফিনিক্স পাখির মতো পুনরুত্থান। সাদৃশ্য অসাদৃশ্য তখন আর কোনো বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। বিষয়হীনতাই ঘরের মধ্যে ঘরের ভিতর কেবল অন্তহীন সব ঘরবাড়ি ঢুকিয়ে দেয়। নমোপাড়া যূগীপাড়া ঢুলিপাড়া দিনাজপুর কলোনী বামনপাড়া কাঁসারীপাড়া যাবতীয় সব টুকরো টাকরায় যেন ফেলে আসা এক দেশ হয়ে পুনর্নির্মিত হতে চায়। হতে পারাটা সম্পূর্ণ না হলেও হতে চাওয়াটাই অনায়াসসাধ্য এক যৌথতা এনে ফেলে। যৌথতার শর্তসাপেক্ষ সামর্থের বিচিত্রতরতার ব্যাপ্ত সময়পর্বের ভিতর আবহমানের সব চরাঞ্চল ঘরবাড়ি আমোদপ্রমোদ পাশাখেলা স্মৃতিময়তা নিয়ে অনিশ্চিত ললাট লিখনের মতো জীবনের খন্ডে খন্ডে ভঙ্গ বিভঙ্গের মরমিয়া গানের আবহের নৈকট্যের সারাৎসার হয়ে গন্ডীর ভিতর গন্ডী ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া পেশীময় স্মৃতিময় প্রাবল্যের দোলায় দোলায় ভাসে। ভাসতেই থাকে। ভেসে যায়। এত এত জট জটিলতায় সূর্যোদয় সূর্যাস্ত চাঁদ ও অন্ধকার সবই নিজস্ব অধিকারে মর্যাদায় ঘরবাড়ির বিন্যাসটুকু এলোমেলো করে দিতে থাকে জীবনের জরুরিতম কার্যকারণ সূত্রে।





দেহতত্ব

অতিক্রমণের এক পর্বে হেরম্ব পরিচিত অপরিচিত নিসর্গের গমক্ষেত ধান পাট তামাক  তালগাছ নারকেল সুপারীর সারি -- এসবের মহামহিম গাম্ভীর্যময় অস্তিত্বের সামনে  এসে দাঁড়ায়। তার দাঁড়ানোটা দাঁড়াবার ভঙ্গীটা অতি রাজকীয়। নিসর্গের অতি নিবিড় প্রাণবন্তে স্নিগ্ধতায় শুশ্রূষায় হেরম্ব তার অস্তিত্বের সকল সংকটকাল যেন অতিক্রম করতে থাকে। খুঁজে পেতে থাকে আত্মপরিচয়ের শিকড়বাকড়। প্রকৃতির চিরচেনা দৃশ্যপট অচেনা সব অনুপম মানুষেরা দৃশ্যকেন্দ্রের আধো আঁধারের ঘনঘোরজাত নতুন  হতে থাকা মানবশাবকের মহামান্যতাই অর্জন করে ফেলে। অতিক্রমণের পর্ব থেকে পর্বান্তরে যাওয়া আসার শূন্যশাসিত অংশগুলি থেকে সুর করে যেন পাঠ করে যাওয়া  পুরাণপুস্তক আরো আরো পুরাতন হতে থাকা মরজীবন নিসর্গের কিনার ঘেঁষে সদ্য রচিত নিসর্গেরই হাত ধরে নিসর্গকে স্থাপিত করে অনিবার্য নিসর্গগাথার ভিতর। হাট থেকে হাট চরাঞ্চলে ধানবাড়ি গান নাচের হাটের মধ্যে রেখে আসা জলধোয়া বসুনিয়া আব্রাহাম মিনজ খড়ম জোতদারের আধিভৌতিক পৃথিবীর জনপদের সহজিয়া আখ্যানের মরমিয়া আহ্বানের তীব্র অংশগ্রহণ করতে চাওয়া হেরম্বকে কি তবে বনভূমি চা-বাগানের হাট আদিবাসী গ্রাম ময়ূর-ময়ূরী বাইসন বাঘের ডাক হাতিধরা গান  নুড়িপাথর শ্যাওলা নদীর সব বন্ধন সম্পর্ক ছিন্ন করে আপাতত অন্য কোনো  পরিক্রমণের অংশীদার হতে হবে! হেরম্বর তাতে কোনো ক্ষয়বৃদ্ধি নেই, কারণ তার স্মৃতিকাতরতা নেই; থাকলেও স্মৃতিকাতরতাকে অজস্র স্মৃতির ছায়া উপচ্ছায়ায় সে বিনির্মাণ করে তুলবে ভিন্ন রকম কোনো স্মৃতিময়তায় মিশ্রিত করে দেবার সহজাত  সংক্রমণে।





ভূগোল ইতিহাস

এই যে জট পাকানো ভূগোল ইতিহাসের ভিতর হেরম্বকে ঢুকে পড়তে হয় এক ধরনের বাধ্যবাধকতায়, সে ভূগোলবাহিত সময়ের কথক হয়ে উঠতে থাকে একসময়। জীবনের নিজস্ব নিয়মেই এটা ঘটে। এইসব জট পাকানো জটিলতায় হেরম্ব কি দমবন্ধ পরিবেশ পরিস্থিতির অস্বস্তিটুকু এড়িয়ে চলতে চায়; সে কি ইতিহাস ভূগোলের বাইরে খোলা বাতাসের মধ্যে আসবার তাগিদ অনুভব করে! বাধ্যবাধকতার নিঃসঙ্গতায় হেরম্ব ক্লান্ত হয়, কিন্তু ক্লান্তি তাকে গ্রাস করতে পারে না, সে আবার বাধ্যবাধকতায় চলে যায়। ইতিহাসের অংশ হয়ে ভূগোলের খণ্ডাংশ হয়ে হেরম্ব নিজের মতোন এক জীবনযাপন বয়ন করতে থাকে। জীবনযাপনটা জীবনযাপন হয়ে উঠবে কিনা সেই সংশয় গ্রাস  করলেও সংশয় থেকে সে আর সংকটের দিকে কিছুতেই চলে যেতে চায় না। এটা কি তবে তার  আত্মগোপনতা! সে হাট হয়ে ওঠবার গোটাটাই প্রত্যক্ষ করে। হাট থেকে  হাটে রাতের বনভূমি অতিক্রম করতে করতে সে প্রতিদিনের প্রতিদিন হয়ে ওঠার পর্ব-পর্বান্তর অগ্রাহ্য করে নির্জনতার পথে নির্জন সব সাঁকো ও শালবনের দিকে পা বাড়ায়। সে কি পলায়নের কথা ভাবে; না কি পলায়নটাই তার জন্য পূর্বনির্দিষ্ট! হেরম্ব তার জট পাকানো ইতিহাস ভূগোলের এক জীবনকে জীবনযাপনের ধরাবাঁধার সঙ্গে সংযুক্ত বিযুক্ত করতে থাকে। হয়তো এও এক বাধ্যবাধকতা; তবু সাঁকো হাট নদী দিয়ে সে পুরাণ ইতিহাসের সমস্ত মিথগুলোকে উপেক্ষা করতে করতে অন্য এক মিথ ইতিহাসেরই চমকপ্রদ দৃশ্যায়ন ঘটাতে থাকে। এই পর্বে তার সঙ্গে অফুরন্ত ও জটজটিল সব স্মৃতিকাতরতা কিংবা কাতরতা থেকে চুঁইয়ে পড়া স্মৃতিরা নিরপেক্ষভাবেই থাকে; নিরুপায় হয়েই অথবা!








   





2 কমেন্টস্:

  1. হেরম্ব চরিতের একটা দিক মুক্তির পথে ইতিহাস ভূগোলের অতীত বর্তমান জনজট ছড়িয়ে,আরেকটা দিক নিঃসঙ্গতায় তার ক্লান্তি। এই দুই মিলে একটি আসাধারণ গদ্য পড়লাম। ধন্যবাদ

    উত্তরমুছুন
  2. হেরম্ব চরিতের একটা দিক মুক্তির পথে ইতিহাস ভূগোলের অতীত বর্তমান জনজট ছড়িয়ে,আরেকটা দিক নিঃসঙ্গতায় তার ক্লান্তি। এই দুই মিলে একটি আসাধারণ গদ্য পড়লাম। ধন্যবাদ

    উত্তরমুছুন