মেন্ডিস ও গৌরাঙ্গ
সবাই আমাকে ল্যাংড়া
ডায়াস বলে ডাকে।
আমার বাম পা ডান পায়ের চেয়ে খানিক সরু। ছোটবেলায় টাইফয়েড হলে যা হয়। বাবা তখন নরসিংদী থেকে গামছা লুঙ্গি এনে ফেনীতে ব্যবসা করতেন। আমার টাইফয়েড দেখার তাঁর সময় নেই। কিসের ডাক্তার? কিছুদিন তাবিজ, পানিপড়া চলল মায়ের দৌড়াদৌড়িতে।
লাভের লাভ হলো, বাবার টাকা বাঁচল কিন্তু আমার বাম পা গেল সরু হয়ে। ইশকুলে যেতাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ক্লাসের সহপাঠীরা প্রথম কয়েকদিন মানবিক ছিল। কিছুদিন পরে ব্যাপক বিনোদন আমি। ঊনিশ বিশ হলেই আমাকে ল্যাংড়া বলে গালি দিত।
কোনো খেলায় আমাকে নিতে চাইত না বন্ধুরা, ভালো করে দৌঁড়াতে পারি না বলে। সবচেয়ে কষ্ট হতো, যখন আমার নিচের ক্লাসের ছেলেরা আমার সাথে বনিবনা না হলেই অকপটে ঠুস করে গালি দিত--
: ল্যাংড়া ফিরিঙ্গি
গালি শুনে মাথায়
আগুন খেলে যেতে ৭১বার, কিন্তু মুহূর্তে রাগটা হরতালের
মতো গোলালু হয়ে যেত। জুনিয়র ছেলেগুলো পাশের উকিল বাড়ির সম্ভ্রান্ত ছেলে।
সবচেয়ে হাহাকার কষ্ট হতো, আমাদের ব্যাকরণ
ক্লাসের স্যার, আমি পড়া না পারলেই
কান ধরে টানাতেন
আমার আরেক সহপাঠী
গৌরাঙ্গকে দিয়ে।
বন্ধুরা আড়ালে
আবডালে বলাবলি করতো, খ্রীষ্টান পরিবারে
আমরা সবাই মদ খাই, বাসার সবাই দাঁড়িয়ে
হিসু করি। মেয়েরা নাকি ওড়না পরে না। অথচ আমরা সেভেন্টিনথ এডভান্টেজ। আমার মা খুব
পর্দানশীন। মাথায় ঘোমটা ছাড়া
কোথাও বের হয় না। আমাদের বাসায় মদ নিষিদ্ধ।
আমার আর গৌরাঙ্গের
কান টানাটানির সময় পুরো ক্লাস হাসাহাসি করতো। স্যার খিকখিক করে হেসে বলতেন--
: এরোই তোরা চাই দ্যাখ, সংখ্যালঘু কান
টানাটানি করের।
সাপের তীব্র হিসহিস এর মতো একটা ক্ষোভ ভেতরে তূর্ণা-নিশীথা খেলে যেত। ভাবতাম, দেখিস একদিন আমরাও...
রাতে ঘুমোলে স্বপ্ন দেখতাম যে, ফাদারের সামনে আমি হাঁটু গেড়ে কুর্ণিশ করে আছি। ফাদার আমার বাম পা’টা স্পর্শ করে দিচ্ছেন, পা’টা ভালো হয়ে গেছে। আমি সাঁ সাঁ করে দৌঁড়াচ্ছি। বাংলাদেশের দ্রুততম মানব মাহবুব আলম আমার পিছনে পড়ে যাচ্ছেন। পুরো স্টেডিয়াম হাততালি দিচ্ছে। স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসা মা, বোন টিলডা আনন্দে কেঁদে দিচ্ছে। সোনার মেডেল গলায় ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছি।
দম বন্ধ হয়ে আসে। অদ্ভুত গোঙানিতে ছটফট করতে থাকি। কার স্পর্শে যেন দম ফিরে আসে। চোখ মেলে দেখি, মা বিছানার পাশে। আমার সরু পা’টায় মমতায় মা হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমার ঘাম উবে যায় এক লহমায়। আমাকে বোবায় ধরেছিল, মা বলেন।
রাতে বিছানায় মায়ের স্পর্শে মনে হয়, বাম পা আবার শক্তি ফিরে পেয়েছে। আমি চেতনায় রক্ত মাংসের শপথে অজানা ট্র্যাকে দৌঁড়াচ্ছি। উকিল বাড়ির ছেলেরা আমার পিছনে পড়ে যাচ্ছে। ব্যাকরণ স্যার অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন, টিলডা পেছন থেকে গলা উঁচু করে চিৎকার করে বলছে--
: রান দাদা রান! রা আ আ আ ন দা আ আ আ দা...
এস. এস. সি পরীক্ষার চতুর্থ দিনে আমি বহিষ্কৃত হলাম। নকল করিনি যদিও। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমার পায়ের কাছে বইয়ের একদলা কাটা পাতা পেয়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পা ধরলাম, কাজ হলো না। বের করে দিলেন হল থেকে আমাকে। মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাচ্ছি, মনে হলো ব্যাকরণ স্যার পেছন থেকে খিকখিক করে হাসছেন--
সাপের তীব্র হিসহিস এর মতো একটা ক্ষোভ ভেতরে তূর্ণা-নিশীথা খেলে যেত। ভাবতাম, দেখিস একদিন আমরাও...
রাতে ঘুমোলে স্বপ্ন দেখতাম যে, ফাদারের সামনে আমি হাঁটু গেড়ে কুর্ণিশ করে আছি। ফাদার আমার বাম পা’টা স্পর্শ করে দিচ্ছেন, পা’টা ভালো হয়ে গেছে। আমি সাঁ সাঁ করে দৌঁড়াচ্ছি। বাংলাদেশের দ্রুততম মানব মাহবুব আলম আমার পিছনে পড়ে যাচ্ছেন। পুরো স্টেডিয়াম হাততালি দিচ্ছে। স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসা মা, বোন টিলডা আনন্দে কেঁদে দিচ্ছে। সোনার মেডেল গলায় ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছি।
দম বন্ধ হয়ে আসে। অদ্ভুত গোঙানিতে ছটফট করতে থাকি। কার স্পর্শে যেন দম ফিরে আসে। চোখ মেলে দেখি, মা বিছানার পাশে। আমার সরু পা’টায় মমতায় মা হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমার ঘাম উবে যায় এক লহমায়। আমাকে বোবায় ধরেছিল, মা বলেন।
রাতে বিছানায় মায়ের স্পর্শে মনে হয়, বাম পা আবার শক্তি ফিরে পেয়েছে। আমি চেতনায় রক্ত মাংসের শপথে অজানা ট্র্যাকে দৌঁড়াচ্ছি। উকিল বাড়ির ছেলেরা আমার পিছনে পড়ে যাচ্ছে। ব্যাকরণ স্যার অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন, টিলডা পেছন থেকে গলা উঁচু করে চিৎকার করে বলছে--
: রান দাদা রান! রা আ আ আ ন দা আ আ আ দা...
এস. এস. সি পরীক্ষার চতুর্থ দিনে আমি বহিষ্কৃত হলাম। নকল করিনি যদিও। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমার পায়ের কাছে বইয়ের একদলা কাটা পাতা পেয়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পা ধরলাম, কাজ হলো না। বের করে দিলেন হল থেকে আমাকে। মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাচ্ছি, মনে হলো ব্যাকরণ স্যার পেছন থেকে খিকখিক করে হাসছেন--
: ফিরিঙ্গি নকলবাজ... নকলবাজ...
এরোই তোরা চাই চাই
দ্যাখ...
সেদিনই বাড়ি থেকে পালাই আমি। পালানোর সময় ঘোমটা ঢাকা মায়ের শান্ত মায়াবী মুখটা মনে পড়ছিল, টিলডার অমল ডাক। তবু আমি পালাই।
ফেনী রেল স্টেশনে অনেক রাতে একটা বেঞ্চে বসে আছি। খিদে পেয়েছে প্রচন্ড। একটু আগে এক দুই ঝাঁপি বৃষ্টি হয়েছে। ভিজে গেছি আমি। এখন রাতের আকাশ জুড়ে সংসদ সদস্যের মতো গোলগাল ঠান্ডা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। খানিক বাতাসে আমার গায়ের জামা কাপড় শুকাচ্ছে। ঠান্ডায় কাঁপছি কাটা মোরগের মতো। চারপাশের সাদা প্ল্যাটফর্মকে মনে হচ্ছে ভাতের থালা... ধোঁয়া উড়ছে...। লাল জামা পরা স্টেশনের কুলিটাকে মনে হচ্ছে লাল ঝোলে ডুবে থাকা রুই মাছের টুকরো... একটু পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে গপগপ ভাত খাচ্ছি...
সেদিনই বাড়ি থেকে পালাই আমি। পালানোর সময় ঘোমটা ঢাকা মায়ের শান্ত মায়াবী মুখটা মনে পড়ছিল, টিলডার অমল ডাক। তবু আমি পালাই।
ফেনী রেল স্টেশনে অনেক রাতে একটা বেঞ্চে বসে আছি। খিদে পেয়েছে প্রচন্ড। একটু আগে এক দুই ঝাঁপি বৃষ্টি হয়েছে। ভিজে গেছি আমি। এখন রাতের আকাশ জুড়ে সংসদ সদস্যের মতো গোলগাল ঠান্ডা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। খানিক বাতাসে আমার গায়ের জামা কাপড় শুকাচ্ছে। ঠান্ডায় কাঁপছি কাটা মোরগের মতো। চারপাশের সাদা প্ল্যাটফর্মকে মনে হচ্ছে ভাতের থালা... ধোঁয়া উড়ছে...। লাল জামা পরা স্টেশনের কুলিটাকে মনে হচ্ছে লাল ঝোলে ডুবে থাকা রুই মাছের টুকরো... একটু পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে গপগপ ভাত খাচ্ছি...
উকিল বাড়ির ছেলেরা
হাততালি দিচ্ছে...
আমি খাচ্ছি...
বাবা পান খেতে খেতে
নরসিংদী যাচ্ছেন...
হাসি হাসি মুখ...
বড়দিন আসছে...
আমাদের বাড়িতে
ক্রিসমাস ট্রি লাগানো হচ্ছে...
টের পাচ্ছি আমি জ্ঞান হারাচ্ছি...
বেঞ্চে শুয়ে পড়ছি...
লোক্যাল ট্রেনটা হুশ
শব্দ করে ঝিকঝিক চলে যাচ্ছে...
ঢলে পড়ার আগে অস্পষ্ট দেখলাম কার যেন দুটি হাত...
ঢলে পড়ার আগে অস্পষ্ট দেখলাম কার যেন দুটি হাত...
গৌরাঙ্গ...
আমি বাড়ির পেছনের
কাঠের দরোজায় ঠকঠক করে কাঁদছি... মা মা।...
ভালো লাগল... মন খারাপ হল - কিম্বা দুটো একসাথে।
উত্তরমুছুনশ্রাবণী দাশগুপ্ত।
মন খারাপ করা লেখা
উত্তরমুছুন