কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

০১) অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়



মহ্‌সিন ওস্তাদ আলি মখমলবাফ-এর একটি নাটক

অনুবাদ :
অ র্জু ন  ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়

কালিমাটি অনলাইন ব্লগজিনে ‘অণুরঙ্গ’ বিভাগে নাটকটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল কালিমাটি/১৬ (জুন ২০১৪) সংখ্যা থেকে। এই সংখ্যায় রইল তার চতুর্থ তথা শেষ কিস্তি। নাটকটির আগের অংশটুকু পড়ার জন্য নীচের লিঙ্কে যান।

১ম কিস্তি
২য় কিস্তি
৩য় কিস্তি






খাঁচার ভেতর খাঁচা
মহ্‌সিন মখমলবাফ


রচনা মহ্‌সিন ওস্তাদ আলি মখমলবাফ
রচনাকাল ১৯৮১
পরিচালক মহম্মদ রেজা হনারমন্দ
ভাবানুবাদ ও রূপান্তর অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়


দৃশ্য ৪
(একই মঞ্চ। একদিন পর)


ক্যাপিটালিস্ট : তাহলে? চব্বিশ ঘন্টা হয়ে গেল... একটা কেউ এলো না নিয়ে যেতে... !
ফিউডালিস্ট : আমি এখান থেকে বেরিয়েই সবকটা অফিসারের চাকরি খাব আগে... একটাও কোনো কাজের না। অপদার্থের দল। ওরা দেখেছে কালকে আমাকে অ্যারেস্ট হতে। ওদের সামনে দিয়ে আমাকে নিয়ে  এসেছে জেলেঅথচ দেখুন গতকাল থেকে এখন অব্দি কেউ কিচ্ছু করল না ! ভাবুন একবার বিষয়টা !  
অ্যামেরিকান : হাউ লং আর উই সাপোজড্‌ টু স্টে হিয়ার? (কেউ কোনো উত্তর দেয় না।)
গুপ্তচর : একটু পরেই ওরা আসবে। আমাদের সব্বাইকে মেরে ফেলবে ওরা। (বাইরে থেকে কিছু লোকের গলার আওয়াজ শোনা যায়। কয়েকজন লোকের প্রবেশ।)
১ম লোক : (কড়া গলায়) সবাই দাঁড়িয়ে যাও। তোমাদের সময় শেষ। (বৃদ্ধ ও যুবক বাদে বাকি বন্দীদের সেল থেকে বাইরে বের করে আনে)
২য় লোক : (পকেট থেকে কাগজ বের করে পড়তে থাকে) হাসান খান, ইমতিয়াস শাহ্‌, ইকবাল এবং জর্জ বিল--  সি.আই.এ.-র দালাল এবং রাষ্ট্রের গুপ্তচর বাহিনীর চর হিসেবে তোমরা সাধারণ মানুষের ওপর যে অত্যাচার করেছো, যেসব সম্পত্তি ব্যক্তিগত মালিকানায় কুক্ষিগত করেছো, যে সমস্ত লুঠ ও হত্যা করেছো, এইসব কাজের জন্য তোমাদের এইখানে এইমুহূর্তে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। (ভিড়ের মধ্যে থেকে ২/৩জন গুলি চালায়। দাঁড়িয়ে থাকা চারজন বন্দী লুটিয়ে পড়ে যায় মাটিতে। বাকি লোকেরা তাদের টেনে, ছেঁচড়ে মঞ্চের বাইরে নিয়ে যায়।)
১ম লোক : তাহলে তোমরা কি এখনো ভেতরেই থাকবে? নাকি বেরিয়ে আসবে? (দুজন বন্দী সেলের এক কোণে ভয়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চুপ করে।) আমরা যাচ্ছি এখন। যদি তোমরা বেরোতে চাও, দরজা খোলা রইল। (সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে) চলো। (মঞ্চ জুড়ে স্তব্ধতা। সব লোক বেরিয়ে যায়। দুটো সেলের দরজাই খোলা। বেশ কিছুক্ষণ সব চুপচাপ এবং স্থির। কিছুক্ষণ বাদে বৃদ্ধ খুব ধীরে সাবধানে উঠে আসে। নিজের সেলের দরজাটা বন্ধ করে আবার সেলের ভেতরে ঢুকে যায়।)
যুবক : (থমথমে গলায়) ওরা মেরে ফেললো সবাইকে!
বৃদ্ধ : এটা পুরোটাই একটা নাটক। ওরা কেউ সত্যিকারের বুর্জোয়া বা সত্যিকারের জমিদার ছিল না। তবে, পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে আমার মনে হচ্ছে, ওরা কারা ছিল এটা নিশ্চিত করে এখনই বলা যাচ্ছে না। হয়তো ওরা আমাদের মতোই বিপ্লবী ছিল।
যুবক :  কিন্তু যদি ওরা বিপ্লবীই হত, তাহলে আমাদেরকে একবার অন্ততঃ বলতো সে কথা
বৃদ্ধ : এই পুরো ব্যাপারটাই ছিল আমাদের সাথে একটা পরিকল্পিত চাল। এই লোকগুলো চাইছিল যাতে আমরা ওদের কথায় বিশ্বাস করে বাইরে যাই।
যুবক : তাহলে চলুন যাই.. কি সমস্যা আছে তাতে?
বৃদ্ধ : বোকার মতো ভুল কোরো না। তুমি এই দরজার বাইরে পা ফেললেই ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। আর তারপরে প্রচার করবে তুমি পালানোর চেষ্টা করছিলে। এরকম কোরো না। দরজা বন্ধ করো।
যুবক : কিন্তু ওরা গার্ডদেরও মেরে ফেললো... এই চারটে লোককেও... মানে.. আমি বলছি... কি আছে বাইরে গেলে ! যদি সাবধানে যাই !? যদি দেখি এটা একটা চাল, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসব সেলে
বৃদ্ধ : গাধার মতো কাজ কোরো না কমরেড। আঠারো বছর এইখানে থেকে তুমি এখনো ভালো আর খারাপের পার্থক্যটা বুঝলে না !?
যুবক : আমি জানি না বাইরে কী হচ্ছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত কিছু একটা তো হচ্ছেই এই দেওয়ালের ওপারে। কিছু একটা তো ঘটছেই। হয়তো কোনো কৃষক ধান কাটার কাস্তেটা উঁচু করে ধরেছে আঁকাবাঁকা আলপথের ওপরে। হয়তো কোনো শ্রমিকের দল হরতাল ডেকেছে কারখানায়।
বৃদ্ধ : কোন্‌ শ্রমিক? যে দেশে শিল্প-কারখানা-পুঁজিই বেড়ে উঠলো না তার দানব হাত-পা ছড়িয়ে এখনও, সেখানে কিসের বিপ্লব?
যুবক : আপনাদের তো কোনো শ্রমিক শ্রেণীকে দেখতে পাওয়ার কথা নয়। শ্রমিকও আপনাদের খুঁজে পাবে না। কেননা আপনারা তো ওদের খালি মজুরি বৃদ্ধির দাবীতে লড়তে শিখিয়েছেন।
বৃদ্ধ : কমরেড ! তুমি দেখছো না এইলোকগুলো কিরকম স্রোতে ভাসছে ! ওদের কথাগুলো শুনেছ মন দিয়ে? শ্রমিক শ্রেণী কখনো এই ভাষায় কথা বলে না কমরেড। তুমি কি ওদের মুখে লং লিভ দ্য প্রোলেতারিয়েত শুনেছো একবারও?
যুবক : হয়তো আমরা কোথাও ভুল করছি। আন্দোলনের উত্তেজনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা অতি-সরলীকরণ আসতেই পারে।
বৃদ্ধ : কিন্তু তার জন্যে প্রতিষধক থাকা দরকার কমরেড। চিন্তাশীল মনে, চিন্তার অনুশীলনে।
যুবক : আমি তো কলেজে ইতিহাসের ক্লাসে আপনারই ছাত্র ছিলাম কমরেড। ক্লাসে আপনিই এটা পড়িয়েছিলেন আমাদের। পরে পার্টি ক্লাসেও আপনিই শিখিয়েছিলেন এই তিনটে কথা সংশোধন, পুনরাবৃত্তি, আর সম্প্রসারণ। মনে পড়ছে স্যর? আপনি পুনরাবৃত্তির পথে হাঁটছেন। আগের সিদ্ধান্তকে আজকে গ্রহণ করার কথা বলছেন। বিশ্বাস করছেন এই অবস্থায় পরিবর্তনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ক্যাপিটালিস্টরা কিন্তু দাস ক্যাপিটাল থেকে শিখেছে কমরেড, শুধরে নেবার চেষ্টা করেছে নিজেদের ত্রুটিগুলো। আর আমরা, কমিউনিস্টরা ক্যাপিটালিস্টের কোনো কিছু পড়তে গেলে আপনারা বলেছেন ওগুলো না পড়তে, ওগুলো সি.আই.এ.-র দালালদের লেখা। জানেন, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের ঘটনা বিশ্লেষণে কোথাও ভুল হয়েছে।
বৃদ্ধ : কেন !? এরম মনে হয় কেন তোমার?
যুবক : বুঝবেন না (সেলের বাইরে পা বাড়ায়)
বৃদ্ধ : জেলখানার নিয়ম ভেঙো না কমরেড। ডিসিপ্লিন ডিসিপ্লিন ডিসিপ্লিন। একজন কমিউনিস্টের জীবনে ডিসিপ্লিনই সব। যেও না...
যুবক : বিদ্রোহই কমিউনিস্টের ডিসিপ্লিন।
বৃদ্ধ : কমরড যেও না বলছি...
যুবক : কিন্তু দরজা তো খোলা। সব দরজা খোলা। (বেরিয়ে এসেছে সেল থেকে) আসুন দেখে যান এই জায়গাটা... আমি সূর্যটাকে দেখতে পাচ্ছি কমরেড... দেখুন, কি দারুণ হাওয়া আসছে এই দরজাটা দিয়ে...
বৃদ্ধ : পায়ের ঐ শেকল নিয়ে তুমি যেখানে যাবে, ওরা তোমাকে দেখলেই বুঝে যাবে তুমি জেল থেকে পালিয়েছ
যুবক : না ! আমি খুলে ফেলবো শেকল। এই দেখুন, মরচে ধরে গেছে এগুলোতে। (বসে পড়ে পায়ের শেকল খুলতে থাকে এক এক করে। এবং চারপাশে সেগুলো ছড়িয়ে রাখে।) দেখুন,  চেনগুলো কেমন একটার থেকে আরেকটা আলগা হয়ে গেছে...  এতবছর আমি আমি এই চেনগুলোকে আলগা হতে দিইনি।
বৃদ্ধ : ওরকম কোরো না... শেকলগুলো যাতে আলগা না হয়ে যায় সে জন্য আমি আমাদের খাবারের থেকে অল্প অল্প করে তেল আর চর্বি  তুলে ঘষে ঘষে মাখিয়ে রাখতাম শেকলে। যাতে ওগুলোতে মরচে না ধরে। খুলে না যায়। কিন্তু আমার পা দুটো বড্ড সরু হয়ে গেছে। হাঁটলেই শেকলগুলো পা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু আমি কক্ষনো জেলখানার নিয়ম ভাঙবো না। তোমার সেলে ঢুকে পড়ো কমরেড। দরকার হলে তুমি আমার শেকলটা নিতে পারো। নাও, আমার শেকলটা পরে নাও তুমি। আমরা দুজনে দুজনের শেকল অদল বদল করে পরবো। কিন্তু নিয়ম ভেঙো না কমরেড। ডিসিপ্লিন ডিসিপ্লিন...
যুবক : আমি আর ঐ সেলের ভেতরে ফিরব না। আপনি একটা ফসিল হয়ে গেছেন। আপনার সামনে যদি একটা আয়না থাকতো, তাহলে বুঝতেন আমি কী বলছি। বেরিয়ে আসুন, বেরিয়ে আসুন ঐ সেল থেকে। ঐ অদৃশ্য গরাদ ভেঙে থেকে বেরিয়ে আসুন কমরেড। আমি এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি আপনার খাঁচার ভেতর আরেকটা খাঁচা। আরেকটা অদৃশ্য খাঁচা। (বাইরের দিকে এগোয়)
বৃদ্ধ : না.. যেও না.. এরকম ভুল কোরো না কমরেড... এই ফাঁদে পা দিও না.. তুমি মারা পড়বে.. ওরা মেরে ফেলবে তোমাকে..
যুবক : (বুক ভরে শ্বাস নেয়। হাসে) দেখুন কি সুন্দর হাওয়া আসছে। কি দারুণ দেখাচ্ছে সূর্যটা.. আমি একটুও মিথ্যে বলছি না কমরেড.. সব দরজা খোলা.. আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি বাইরে কিছু একটা ঘটছে .. আমাদেরকে দরকার আছে বাইরের ঐ পৃথিবীটার কমরেড.. আমি শাদা বরফের গায়ে লাল রক্তের ছোপ দেখতে পাচ্ছি.. বেরিয়ে আসুন কমরেড...
বৃদ্ধ : আমি তো দেখতে পাচ্ছি না এসব কিচ্ছু..
যুবক : বেরিয়ে আসুন ওখান থেকে.. আমি নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট...
বৃদ্ধ : বিশ্বাস কোরো না তোমার চোখকে। তুমি ভুল করছো। চোখ বন্ধ করো। ফিরে এসো কমরেড। নেতার কথায় কখনো অবিশ্বাস আর প্রশ্ন রাখতে হয় না কমরেড। শুধু তা মান্য করতে হয়। ফিরে এসো বলছি....
যুবক : আমি যাচ্ছি কমরেড... আমি যাচ্ছি... [নেপথ্যে আহ্বান শোনো আহ্বান আসে মাঠ ঘাট বন পেরিয়ে/দুস্তর বাধা প্রস্তর ঠেলে বন্যার মতো বেরিয়ে/ যুগ সঞ্চিত সুপ্তি দিয়েছে সাড়া/ হিমগিরি শুনলো কি সূর্যের ইশারা/ যাত্রা শুরু উচ্ছল, চলে দুর্বার বেগে তটিনী... এই গানের সুরটা খালি বাজবে। বাজতেই থাকবে। ভায়োলিন, পিয়ানো, গীটার এবং ক্লারিনেটে।]   
বৃদ্ধ : না ! না ! (বৃদ্ধ চিৎকার করতে থাকে। একটা হৃদয়-মোচড়ানো চিৎকার। শুনে মনে হয় যেন একটা কুয়োর গভীর থেকে আওয়াজটা আসছে। কিছুক্ষণ বাদে, স্তব্ধতা। বৃদ্ধ তার সেলের ভেতরে হাঁটলেন কিছুক্ষণ। সেলের দরজার বাইরে খাবারের ডিশ আছে কিনা দেখলেন।) গার্ড ! গার্ড ! খাবারের সময় হয়ে গেছে। আমাকে খেতে দিন। আমার খিদে পেয়েছে গার্ড। আমি মারা যাব খিদেয়। আমার খিদে পেয়েছে... গার্ড... আমি জেলখানার নিয়ম ভাঙিনি... এই সেলের বাইরে পা রাখিনি আমি... ডিসিপ্লিন ভাঙিনি... ডিসিপ্লিন ডিসিপ্লিন....  আমাকে খেতে দিন গার্ড... আমাকে খেতে দিন... আমি জেলখানার নিয়ম ভাঙিনি....  (কাশতে থাকেন। প্রচণ্ড কাশি। কাশতে কাশতেই বলতে থাকেন কথাগুলো। কথা আটকে কাশি উঠে আসে। তবু বলতে থাকেন কাশতে কাশতে। গলা-বুক ধ’রে সেলের দেওয়ালে ঠেস্‌ দিয়ে বসে পড়েন। আলো নেভে। তখনও কাশি আর কথাগুলো শোনা যাচ্ছে। আসতে আসতে ফেড হয় স্বর। আবহে গানের সুরটা বাজতে থাকে। পর্দা নামে।)
                                                                                 
                                                       [শেষ]
…………………………………………………………………………………………………………………………................

ঋণ :
সৈয়দ হবিবল্লাহ্‌ লজগী, লীডস্‌ বিশ্ববিদ্যালয়   
অরুণ ঘোষ  
শ্যামশ্রী দাস
দেবাঞ্জন দাস
Shola Jawid’— Voice of Communist Party of Afghanistan (Maoist).  
Tudeh Party of Iran.
Organizations of Iranian People’s Fedai Guerrillas.
Communist Party of Iran (Marxist-Leninist-Maoist).   
সংশোধন পুনরাবৃত্তি সম্প্রসারণ’— সুশোভন সরকার, বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস অনুসন্ধান (দ্বাদশ খণ্ড)  






0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন