কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

০৪) অর্ক চট্টোপাধ্যায়


পৈটিক

এদেশে আসার পর থেকেই কমলেশের পেটের ভেতর শব্দ হয়: ভুড়ভুড়, ভড়ভড়, ভুটভুট, ভটভট, ভূতভূত। দেশে থাকাকালীন যে একেবারে হতো না তা নয়, কিন্তু তখন সে শব্দাদি ছিল পেট খারাপের দান বা উপসর্গ। এমন যত্রতত্রের সঙ্গী ছিল না। এখন নিত্যকর্ম পদ্ধতি। খিদে পেলেও ভুটভুট আর খাবার খেলেও ভটভট। যখন তখন বলা নেই কওয়া নেই পেট ডেকে ওঠে। মাঝে মাঝে কমলেশের মনে হয়, একজনের  ভিসায় বুঝি দুজন এসেছে দেশান্তরে... পেটান্তরে। আর থেকে থেকে ডাক পেড়ে সে নিজের সেঁধিয়ে যাওয়া অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। একে রোজকার ভুটভুট, তায় আবার এই সাউন্ড, পেটের ভেতর ডলবি ডিজিটাল, সিঙ্গল স্ক্রিন থেকে মাল্টির দিকে পাল্টি খেয়েছে! প্রথম প্রথম কমলেশের মনে হতো এ বুঝি পরবাসের অভিশাপ তারপর   আস্তে আস্তে ঠাহর হলো, না, এদেশে সবার পেটেই এমন প্রাত্যহিক গম্গমানি। একদিন ট্রেনে বসে আছে, আর সামনের সীটে একটা কাপল বেশ মেজাজে ঝগড়া করে চলেছে, এমন সময় হঠাৎ ছেলেটির পেট সরগরম হতেই মেয়েটার কী হো হো হাসি! কমলেশ তখন পৈটিক শব্দের উপকারিতার কথা ভাবছে, একটা শিওর ব্রেকাপ বাঁচিয়ে দিল এযাত্রা। তারপর আরেকদিন এক সেমিনারে জনৈক বক্তৃতার শেষে সুন্দরী একটি মেয়ে যেই না তার সিরিয়াস প্রশ্নটা করবে বলে মাইক্রোফোনের ওপর ঝুঁকেছে, পেট গমগমিয়ে উঠলো আর তারপর মাইক। তার মুখটা তখন দেখার মতো ছিল। ওই   মুহূর্তটাতেই সে সব থেকে সুন্দর। ধীরে ধীরে পেট পয়জারে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো কমলেশ। নতুন এক বন্ধু বলেছিল, এই বড় শহরে যেখানে সর্বত্র আরশিতে নিজেকে এক ঝলক দেখে নেবার প্রলোভন, সেখানে হাঁটতে হাঁটতে যেদিন উল্টোদিকের গ্লাস ওয়ালে আর নিজেকে দেখে নেবে না, সেদিন বুঝবে তোমাকে নিজের ভেতর সেঁধিয়ে নিয়েছে এই শহর। এখন রাতের বেলা বাড়ি ফেরার সময় আর কাচের ভেতর নিজের ছবি খোঁজে না কমলেশ, যেন সম্পূর্ণ হয়েছে তার অভিযোজন। বাড়ির কাছাকাছি একটা স্ট্রেচে হেঁটে যাবার সময় পেছনের লাইটপোস্টের আলোয় পাশের বিল্ডিংএর গায়ে তার দু’দুটো ছায়া তৈরি হয়, যার একটা তার মতোই এগিয়ে যাচ্ছে, আর আরেকটা  প্রথম ছায়ার প্রান্তবিন্দু থেকে উল্টোদিকে হেঁটে পিছিয়ে যাচ্ছে গটগটিয়ে। একজন যেখান থেকে ভেতরে ঢুকছে, আরেকজন সেখান থেকেই বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে, একই মুহূর্তে।  নিজের থেকে দূরে যাওয়া আর নিজের কাছে আসা -- এই দুটোকেই বিপদজনকভাবে এক বলে মনে হয়। প্রতিদিন ফেরার পথে সে বাড়ির যতটা কাছে আসে, ঠিক ততটাই দূরে সরে যায়। ওহ! ছায়া ছায়া করতে গিয়ে আসল কথাটাই তো বলতে ভুলে গেছি: যেদিন রাতে বাড়ি ফেরার সময় কমলেশ প্রথমবার দুটো ছায়ার কাটিং পয়েন্টটা দেখতে পেয়েছিল, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ থেকে তার পেট গম্গমানি পুরোপুরি বন্ধ। খালি মুখ খুললে হামেশাই, বলা নেই কওয়া নেই, এইরকম সব শব্দ বেরিয়ে আসতো; তবে মুখ থেকে বেরোতো, পেট থেকে আর নয়! ভুড়ভুড়... ভড়ভড়... ভুটভুট... ভটভট... ভূত ভূত...


(‘জার্নি ৯০জ’-এর এপ্রিল ২০১৪ মুদ্রিত সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত) 


1 কমেন্টস্: