ব্যাগের মধ্যে একগুচ্ছ নির্জনতা...
সকাল থেকেই বৃষ্টি ঝরছে। ঝিরঝিরে নয়, একদম ক্যাটস
অ্যান্ড ডগস। এই বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করলেই ভেজা
যায় না, তার জন্য প্রস্তুতি লাগে। না না ভেজার জন্য ছাতা, বর্ষাতি লাগে না, লাগে ঐরকম বৃষ্টি হতে পারার
ইচ্ছে। নিজেকে ভিন্ন ধাতুর না ভাবতে পারার দ্যোতনা। এটা খুব সহজ নয়, আবার খুব যে কসরৎ
করে পেতে হবে,
তাও নয়। ‘আমাদের সময়ের নায়ক’ - লেরমন্তভের হাতে তৈরি
হয়েছিল, তাকে অর্ডার দিয়ে বানানো যায়নি। অগ্নি রায়ের সাথে
পরিচয়টাও মিরাক্যাল। অনেকটা ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে হাতে কার্বন এসে লাগল। এটা দ্যুতি ছড়াচ্ছিল
না, কিন্তু ত্বক বুঝতে পারে ত্বকের ভাষা,
যেমন কবিতা কবিকে চিনে নেয়। হাত কেটে গেলে ছোটবেলায় নানু দুর্বা-ঘাস ছেঁচে হাতে
লাগিয়ে দিত। এটা মহৌষধের মতো কাজ করত, যাকে এখন এন্টিবায়োটিক বলছি। কবিতা, গদ্য, নানা ধরনের টেক্সট পড়তে
পড়তে বেশ অনেককাল গেল। বয়সের হিসাবে সেটা বেশি নয়, সময়ের হিসাবে দীর্ঘ। উড়োজাহাজে চেপে অগ্নির
বই দিল্লি থেকে ঢাকায় এলো, সূর্যাস্তের সঙ্গদোষ, ‘ব্যাগের মধ্যে
নির্জনতা’। প্রথম যেটা হয়, কয়েকদিন বইটার গন্ধ
শোঁকা, কবিতাকে অনুভব করা। সুব্রত চৌধুরীর প্রচ্ছদে
চোখ আটকে গেল। ব্যাগের মধ্যে ঢোকবার
নিরন্তর ইচ্ছা। যে ব্যক্তি নির্জনতা খোঁজে তার অবয়বহীন অবয়ব। বইয়ের গন্ধ শোঁকা, গরম তেলে চিকেন ফ্রাই সব চলছিল। সময় মতো এর মধ্যে অন্য সব ঘড়িও চলছিল ঠিক
ঠিক। বইয়ের পাতা ওল্টাতেই অভ্যুত্থান, শিলাবৃষ্টি। একটা ক্রুসেড হতে
হলে অনুসরণকারীরা নিজেকে উৎসর্গ করে, আর অগ্নি রায়ের অভ্যুত্থান ঘটে মগজের ভেতরে, একদম অষ্টমে। রক্তের শেলগুলো ভেঙে
ভেঙে দ্বিগুন, চতুর্গুন হয়। অগ্নির অভ্যুত্থানে
পাত্র উপচে পড়ছে, তাকে ধারণ করার মতো লোক এ তল্লাটে কম। প্রবল শিলাবৃষ্টিতে
চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়
পালাবার সব পথ। পোড়া কাকের মতো বুকে হেঁটে কতদূর আর যাওয়া যায়? গ্ল্যাসিয়ার, প্রধান বরফ বুকে হেঁটে কতটা পথ যেতে পারে? হয়তো কোনো সূর্যাস্ত
পর্যন্ত, নয়তো কোনো কোরকের
জেগে ওঠবার কাল পর্যন্ত। বরফ কাটতে কাটতে একসময় জলও ভেঙে যায়। চোখে-মুখে এসে লাগে টুকরো টুকরো
জলকণা। এই জল নোনা, এই জল কেদাক্ত, এই জল সিঁদুররাঙা। এই জল তোটক, এই জল লুব্ধক। জল তরঙ্গ শুনতে
শুনতে গওহরজান, মালকাজানদের নাচের
মুদ্রা রক্তে শিরশিরে অনুভূতি জাগায়। অগ্নির ভাষায় একটা ভাষা ভাঙার অস্ত্র আছে। এজন্য মিসাইল, বুলডোজার, হামাম দিস্তা কোনো কিছুরই
প্রয়োজন হয় না। সুররিয়াল ঘরানার ভেতরে থেকে তার বাইরে, ছন্দের ভেতরে থেকে তার
বাইরে, দৃশ্যের ভেতরে থেকে
তার বাইরে। ভাইস-ভার্সা। এই হচ্ছে ব্যাগের
মধ্যে নির্জনতার লেখক, কবি। তার করাতকলে কাটা পড়েছে শরণার্থী শেষ মেলট্রেন, বাসি বিবাহের ক্লান্ত হুলুধ্বনি, নৈশ ক্যালেন্ডার আরও অনেক
অনেক প্রত্নতত্ত্ব। ত্বকের বিপ্লব ঘটাতে কবি ছুঁচ বৃষ্টির আবহ তৈরি
করেন। অগ্নি তাঁর কবিতায় এমন একরকম দৃশ্যের
অবতারণা করেন, যেখানে
সন্ধ্যাবেলায় কবরের ফুল সব লুট হয়ে যায়। চিরন্তনতা কবি জানেন, আর তা যত ক্লিশেই
হোক তা অবধারিত - এই যে অমোঘ বোঝাপড়া, একে কোনো কিছুর
সাথে তুলনা করা যায় না। সময়, হ্যাঁ একমাত্র সময়ের চোখ দেখতে পায় এই অশান্ত অথচ নিবিড়
বাস্তবতাকে। সময়েরও দাঁত আছে, শিং আছে; খুঁড়ে নেয় আরও আরও নিবিড়
সময়কে।
মৃত্যু অগ্নির কাছে একটি যমজ শব্দ, যেমন জীবন। এই যে দেখতে পারার
মন-মগজ এটা বাংলা কবিতার ভাষা এবং চিন্তার যে সঞ্চালন
সেখানে ভীষণ আলাদা এবং একা। মৃত্যুকে জীবনের সমার্থক করে দেখতে পারাটা
পশ্চিমা সাহিত্য ও জীবনে এক স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু বাঙালির যে সংস্কৃতি
সেখানে এ ধরনের মেন্টোফ্যাক্ট কবিতায় ভিন্ন ধরনের চিন্তার
ইঙ্গিত দেয়। বর্তমান এবং পরবর্তী প্রজন্মের কবিতায় এ ধরনের
গতি বাস্তবতা গতিজাড্যতাকে ভেঙে তৈরি করতে পারবে নতুন কোনো বাস্তবতাকে। যা তলিয়ে গেছে
আটলান্টিক, ভারত, বঙ্গোপসাগরের অতল গভীরে বা
যার হয়তো এখনও জন্ম হয়নি। তাকে, সেই প্রত্নকে বা নতুনকে প্রাণ আর শব্দ দিয়ে
অগ্নির মতো তৈরি করতে পারবে এক সমান্তরাল পৃথিবীর। এক মহা মহা পৃথিবীর। আমেন!
ব্যাগের মধ্যে
নির্জনতা :
অগ্নি রায়
প্রকাশক:
গাঙচিল
প্রচ্ছদ :
সুব্রত চৌধুরী
মূল্য :
৭৫ টাকা (ভারতীয়)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন