কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

০৩) অন্তরা চৌধুরী




ঐতিহাসিক উপন্যাসের আঙ্গিকে শক্তিপদ রাজগুরু

উপন্যাস আধুনিক কালের সৃষ্টি এই উপন্যাসেরও আবার বেশ কিছু শ্রেণীবিভাগ আছে যেমন সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, আঞ্চলিক প্রভৃতি উপন্যাসের অভ্যন্তরে রয়েছে একটি নিটোল কাহিনীবৃত্ত, চরিত্র, সংলাপ, পরিবেশ, পটভূমি,  রচনাশৈলী এবং উপন্যাসের জীবন দর্শন ইতিহাসকে প্রেক্ষাপটে রেখে জীবনকে দেখবার চেষ্টা করা হয় ঐতিহাসিক উপন্যাসে অর্থাৎ ঐতিহাসিক উপন্যাস মানেই কিন্তু ইতিহাস নয় ইতিহাসের তথ্যকে অবলম্বন করে ঔপন্যাসিক সাহিত্যের সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেন এখানেই পার্থক্য হয়ে যায় Historical fiction আর fictional historyর মধ্যে অতীতে যা ঘটে গেছে, ইতিহাস তাই বহন করে অর্থাৎ ইতিহাস হলো সারস্বত  সত্য আর সাহিত্য ইতিহাসকে উপাদান হিসেবে গ্রহ রে সেই কাহিনী বর্ণনা করে,  যা অতীতে কোনদিন ঘটেনি আর ভবিষ্যতেও কোনোদিন ঘটবে না।

ইতিহাস বিশেষ সত্যের কথাই বলে, আর সাহিত্য হতে গেলে তাকে নির্বিশেষ সত্যে  উত্তীর্ণ হতে হয়। ইতিহাসের তথ্য সাহিত্যের চিরন্তন সত্যে সার্বিক দ্যোতনা পেয়ে যায়। এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের বেশ কিছু উপাদান থাকে যেমন - ইতিহাসের কিছু নির্দিষ্ট তথ্য, তৎকালীন সমাজ, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ঐতিহাসিক কিছু চরিত্র আর ইতিহাস সম্ভাবিত কিছু চরিত্র।
 
বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসের সূচনা হয়েছিল ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের রোমান্সধর্মী রচনা ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’(১৯৫৭)এর মাধ্যমে। তবে ইতিহাসের তুলনায় কল্পনার প্রাধান্য এখানে অত্যন্ত বেশিনবজাগরণের প্রবল অভিঘাতে জীবনের প্রতি যে তীব্র  অনুসন্ধিৎসা জেগে উঠেছিল, তারই অনিবার্য ফলশ্রুতিতে ইতিহাসের প্রাঙ্গনে দৃষ্টি দিয়েছিলেন লেখকেরা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার সর্বপ্রথম ও সার্থক শিল্পী তাঁর উপন্যাসে ইতিহাসের তথ্য ও সাহিত্যের সত্যের যথার্থ মেলবন্ধন ঘটেছে যেমন দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, চন্দ্রশেখর, রাজসিংহ প্রভৃতি।

বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস রচনায় যে রাজপথ খুলে দিয়েছিলেন, সে পথে অনেকেই আগ্রহী  হয়ে উঠেছিলেনসমকালের রমেশচন্দ্র দত্ত এ বিষয়ে সর্বাধিক কৃতিত্বের অধিকারী।  বঙ্কিমযুগের অপর একজন লেখক প্রতাপচন্দ্র ঘোষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও প্রথম পর্বে ঐতিহাসিক উপন্যাসের আদর্শে বৌঠাকুরাণির হাটরাজর্ষি লিখেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের স্পষ্ট প্রভাব ছিল এই দুই উপন্যাসে। “প্রেমের অহিংস পূজার সঙ্গে হিংস্র শক্তি পূজার বিরোধ” দেখানোই ছিল রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য। স্বপ্নকুমারী দেবী ও অনুরূপা দেবীও ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছিলেন। তার পরবর্তী কালে তারাশঙ্করের রচনায় আমরা ঐতিহাসিক উপন্যাস রূপে পাই গণ্ণাবেগম অন্যদিকে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও প্রমথনাথ বিশির ঐতিহাসিক উপন্যাসের পরিচয়ও আমরা বাংলা উপন্যাসে পেয়েছি।

সবচেয়ে আধুনিকতম ঐতিহাসিক রোমান্সধর্মী উপন্যাসের পরিচয় পাই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুমি সন্ধ্যার মেঘ, গৌড়মল্লার, তুঙ্গভদ্রার তীরে প্রভৃতিতে তার লঘু  কল্পনা ইতিহাসের রঙ্গীন কাহিনীকে বহুলাংশে আবৃত করেছে। লেখকের উদ্দেশ্য ছিল ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোমান্স রসে আত্মমগ্ন হওয়া।

শক্তিপদ রাজগুরুর জন্ম ১৯২২ সালে, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার গোপেবন্দী এলাকায়। তাঁর স্কুল জীবন কেটেছে মুর্শিদাবাদের বাছটোপি টি এন ইন্সটিটিউশনাল স্কুলে। পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর লেখালেখির সূচনা  ১৯৪৫ সাল থেকেতাঁর প্রথম উপন্যাস দিনগুলি মোর, যা উদ্বাস্তুদের জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে রচিত। আর তাঁর রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি হলো মণিবেগম,  লক্ষণাবতী, বহ্নিবন্যা, লালবাঈ ও সোমনাথ এই উপন্যাসগুলির মধ্যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের আতিশয্য সর্বত্র লক্ষ্য করা গেছে 

মণিবেগম শক্তিপদ রাজগুরু রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস। মণিবেগম ছিলেন মীরজাফর আলি খাঁয়ের অন্যতম পত্নী। প্রথম জীবনে তিনি দিল্লীর নর্তকী ছিলেন। পরে সিরাজউদ্দৌলার বিয়ের সময় নাচের মুজরোয় বুব্বু ও মণি মুর্শিদাবাদে এসে উভয়েই মীরজাফরের নজরে পড়ে তার পত্নী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে নবাব নজমউদ্দৌলা  এবং সৈয়ফউদ্দৌলা মণিবেগমের পুত্র এবং তারা বালক বয়সেই নবাব হন। এজন্য  মণিবেগম তাদের অভিভাবিকা রূপে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। এই উপলক্ষ্যে  তৎকালীন বাংলার ইংরেজ ও বাঙালি প্রায় সকল রাজপুরুষের সঙ্গেই তাঁর পরিচয়  হয়। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, অপরূপ সৌন্দর্য ও প্রচুর অর্থ দ্বারা মণিবেগম তাঁর উচ্চাভিলাষ সার্থক করেছিলেন। স্বয়ং মীরজাফর জীবিত থাকা কালেও মণিবেগম শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সেই সময় যে অবাঞ্ছিত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তার জন্য মণিবেগমের প্রভাব বহুলাংশে দায়ী। এর  প্রকৃত প্রমাণ বুব্বুর নাবালক পুত্র মোবারকউদ্দৌলা মসনদে বসলে মণিবেগমই তাঁর অভিভাবিকা রূপে রাজকার্য পরিচালনা করতেন, বুব্বু বেগম নয়।

ক্লাইভ এবং হেষ্টিংস উভয়েই মণিবেগমকে অনুগ্রহ করতেন। হেষ্টিংসের সঙ্গে তাঁর বিশেষ ঘনিষ্টতা ছিল। মীরকাশিমের পর ইংরেজরা বাংলার সিংহাসনে অন্য কাউকে বসাতে চাইলে মণিবেগম ইংরেজকে পাঁচ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে তা মীরজাফরের জন্য বজায় রাখেন। বুদ্ধি ও রূপের জৌলুষে মণিবেগম বীণকার ওয়াজেদ আলি, মীরজাফর  ও হেস্টিংসকে তার হাতের পুতুল তৈরি করেসামান্য বাঁদী থেকে তিনি হয়ে ওঠে   বাংলার শাসনকর্ত্রী। সে সময় মুর্শিদাবাদের চিত্র, নবাব পরিবারের বিলাস-ব্যসন-বৈভবের উজ্জ্বল চিত্র এবং তৎকালীন কলকাতার অবক্ষয়িত বাবু সমাজের ব্যাভিচারের দৃশ্য ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে।

সেই সময় একদিকে ইংরেজ, অন্যদিকে দেবী সিং, গঙ্গা গোবিন্দ সিং, রেজা খাঁর   অত্যাচার ও শোষণে বাংলা শ্মশানভূমিতে পরিণত হয়েছিল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে ধ্বংসের বীভৎস ছবি ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। পিটারসন কমিশনের রায়ে দেবী সিং ও রেজা খাঁর বন্দি হওয়া, মণিবেগমের পুত্রদের মৃত্যুতে ক্ষমতা হারানো, মণিবেগমের সঙ্গে হেস্টিংসের অবৈধ গোপন সম্পর্ক, নন্দকুমারের ফাঁসী, দুর্নীতিগ্রস্ত রেজা খাঁর পদচ্যুতি প্রভৃতি কাহিনী বর্তিত হয়েছে একটি ক্রূর নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে

হেস্টিংস স্বদেশে ফিরতে চাইলে মণিবেগম তাঁর অতৃপ্ত প্রেমকে চরিতার্থ করতে চেয়েছিলেন জীবনে ভালোবাসার স্বাদ পাইনি! ব্যর্থ প্রেম তোমায় ঘিরে উঠেছিল উপন্যাসের শেষে দেখা যায়, ইংরেজ সরকারের আদেশে মণিবেগম জাফরগঞ্জ প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাঅতীতের কুকর্মের অনুশোচনায় তার জীবনদ্বীপ নিভে আসে। কিন্তু লেখক  উপন্যাসের শেষ পর্বে মণিবেগমের চরিত্রে বেদনার বড় করু লাগিয়েছেন মণিবেগম আজও কাঁদে। জাফরগঞ্জ প্রাসাদের উত্তরকোণের জীর্ণ সমাধি স্তুপ আজও  সন্ধ্যায় মুয়েজ্জিনের কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত হয় মাটির অতল থেকে সেই ব্যর্থ কান্নার সুর
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                শক্তিপদ রাজগুরুর আরেকটি ঐতিহাসিক উপন্যাস হলো লক্ষণাবতী বাংলার সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেনের রাজধানী লক্ষণাবতীতে বিভিন্ন ঘটনার কাহিনী চিত্রিত   হয়েছে এই উপন্যাসে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হলেন রাজা লক্ষণ সেন তিনি ব্রাহ্মণধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করার ফলে বিক্ষুব্ধ বৌদ্ধশক্তি এবং অন্যদিকে বিদেশী  তুর্কীদের আক্রমকে তিনি তরান্বিত করেন সেইসঙ্গে সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট না হয়ে ভোগবিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন দুঃখ দুর্দশায় জর্জরিত দেশের সাধার মানুষ  রাজশক্তির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে দুপুরবেলায় রাজপ্রাসাদে লক্ষসেন আহারের সময় খবর পা যে, বখতিয়ার খিলজী সসৈন্যে প্রাসাদ আক্রম করতে আসছেন  মাত্র অষ্টাদশ অশ্বারোহীর(!) অতর্কিত আক্রমণে রাজা লক্ষণ সেন পরাজিত হন

রাজনৈতিক ঘটনার পাশাপাশি গোপালদেবের সঙ্গে জনপদবধূ ও পরে ভিখারিণী বিদ্যুৎপর্ণা এবং সেনাপতি অরিন্দমের সঙ্গে রাজকন্যা তন্দ্রার প্রণয় কাহিনী  উপন্যাসটিকে কিছুটা রোমান্টিক আবেশ দান করেছে শেষ অংশে তন্দ্রা-অরিন্দমের  ঘর বাঁধার মধ্যে লেখক নতুন জীবনের নতুন আশার বার্তা দান করেছেন পাঠকের কাছে এইভাবে -  বাংলার ঘরে ঘরে অন্তহীন সব হারানোর অন্ধকারে ওরাই জ্বালে  সন্ধ্যার দীপশিখা, জাগরণের নতুন ইঙ্গিত আনে পাঞ্চজন্য শঙ্খের সুরে সুরে...  আগামীকালও বাঁচবে, মুক্তির পথ সন্ধান করবে অন্তহীন সেই বেঁচে থাকা

গুজরাটের বিখ্যাত সোমনাথ মন্দির গজনীর সুলতান মামুদ কর্তৃ ক আক্রমণ ও লুণ্ঠনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাস্তব ও কল্পনার রসে লেখক সোমনাথ নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেছিলেনদেবশর্মাকে কেন্দ্র করে রাজনর্তকী শুভার  প্রণয় ও দেবশর্মা দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে জীবনের অবশিষ্ট দিন দেবতার চরণে আশ্রয়  লাভ, সোমনাথ মন্দিরের মাহাত্ম্য বর্ণনা, আলবেরুণির অসহায়ত্ব এই উপন্যাসে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষ করা হয়েছে। মন্দির ধ্বংসের পর দেবশর্মা শুভাকে গ্রহণ করতে  আগ্রিহী সে নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকে আমি দেবতার দাসী, সোমনাথদেবের  উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃতা। মানুষের সব কামনার উর্দ্ধে

শক্তিপদ রাজগুরু পরাজয়ের কাহিনীবৃত্ত অঙ্কন করতে গিয়ে ইতিহাসের প্রতি নিষ্ঠার  পরিচয় দিয়েছেন। দুএকটি বিষয়ে লেখক ইতিহাস প্রসঙ্গের সঙ্গে আত্মিক কোনো   যোগসূত্র গড়ে তোলেননি। তবুও সামগ্রিকভাবে ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর উপন্যাসে ইতিহাস নিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাহিত্যের রসবোধ।  একদিকে ইতিহাসের জীবনচর্যা, অন্যদিকে চিরন্তন মানবপ্রকৃতি, তার বিচিত্র কামনা বাসনা সুখ দুঃখের অনন্ত জগৎজীবনের বিভিন্ন বিচিত্র রাগিনী ইতিহাসের আধারে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে তার লেখনীতে। তিনি মণিবেগম, বুব্বু বেগম, লক্ষণাবতী, শুভা,   দেবশর্মা, আলবেরুণী প্রভৃতি ইতিহাস এবং ইতিহাস সম্ভাবিত চরিত্রগুলির সহায়তায় ইতিহাসে প্রেক্ষাপট রচনা করেছেন। ইতিহাস রচনার সঙ্গে জীবনের গভীর রসবোধের  পরিচয় রয়েছে এই সমস্ত চরিত্র ও কাহিনী অংশে। এইভাবে কখনো প্রেক্ষাপট রূপে, আবার কখনো বা প্রত্যক্ষরূপে ইতিহাস তাঁর উপন্যসের অঙ্গীভূত হয়েছে। এবং এখানেই ঔপন্যাসিক শক্তিপদ রাজগুরুর বিশিষ্টতা।

1 কমেন্টস্:

  1. ভালো লাগলো পড়ে।কিছু অজানা জানলাম শক্তিপদ রাজগুরুর ঐতিহাসিক উপন্যাস নিয়ে।

    উত্তরমুছুন