জীবনের আলোছায়ায় শাম্ব চরিত্রের উত্তরণ
কৃষ্ণপুত্র শাম্ব। তিনি অসামান্য নায়ক। তাঁকে কেন্দ্র করেই সমরেশ বসু ‘কালকূট’ ছদ্মনামে লিখেছিলেন আসাধারণ এক ভ্রমণকাহিনী ‘শাম্ব’। তবে অন্যান্য ভ্রমণ কাহিনীমূলক উপন্যাসের সঙ্গে
এই উপন্যাসের বিস্তর ব্যবধান। এই ভ্রমণকাহিনীর স্বাদ যেমন অভিনব, যাত্রাপথ ততটাই গহন ও বন্ধুর। এই যাত্রাতে বাঁশীও বাজে, নিশানও ওড়ে। তবে সেই বাঁশি বাজে বনমাঝে কি মনমাঝে! নিশানটাও চোখের সামনে
ভাসে দূরান্বয়ী চিত্রকল্পের
মতো। রৈবতক পর্বতের কৃষ্ণনীল মহীরূহের সীমানা ছাড়িয়ে সবেগে
আন্দোলিত সেই নিশান ওড়ে অন্তরের অন্তঃস্থলে। সেই নিশান ও বাঁশীর ডাকে পুরাণকে অনুষঙ্গ করেই কালকূট যাত্রা করেন দ্বারকা নগরীতে। কৃষ্ণতনয় শাম্বর বিচিত্র জীবন সন্ধানের উদ্দেশ্যেই
তাঁর এই যাত্রা। আধুনিক সমালোচনার পরিভাষায় এই বিষয়টিকে ‘পুরাণের নবজন্ম’ বলা যেতে পারে। এই পৌরাণিক সত্তার মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে
বহমান সুদৃঢ় একটা অনুভব রয়েছে। তাই পুরাণের নবজন্মও ঘটতে দেখা
যায় বারবার বিভিন্ন লেখকের
হাতে, সমরেশ বসুও তার ব্যতিক্রম নন।
সমরেশ বসুর জন্ম হয় ১৯২৪এর ১২ই মার্চ। বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুর অঞ্চলে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়। তিনি ছোটবেলার ব্রতকথার দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত
হয়েছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি চলে আসেন নৈহাটিতে। তাঁর জীবন ছিল বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সম্পৃক্ত। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের কারখানায় কর্মরত
ছিলেন। তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট
পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এই সময় তাঁকে একবার জেলেও যেতে হয়েছিল। জেলে থাকা অবস্থাতেই তিনি রচনা করেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’। জেল থেকে ফিরে আসার পরেই তিনি স্থায়ী ভাবে লেখালিখি
শুরু করেন। প্রভূত পরিমাণে উৎপাদনশীল এই লেখক প্রায় দু’শটিরও বেশি ছোটগল্প এবং একশটিরও
বেশি উপন্যাস লিখেছেন। ১৯৫২ সালে আপাত দৃষ্টিতে আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধান’এ যে যাত্রা পথের শুরু
হয়েছিল, সেখানেই তাঁর ‘কালকূট’ ছদ্মনামের অবতারণা। তাঁর উপন্যাসে বিভিন্ন দিক ফুটে উঠেছে, যেমন রাজনৈতিক ঘটনাবলি, শ্রেণী সংগ্রামের দ্বন্দ্ব, পুরাণ, ইতিকথা ইত্যাদি। ভ্রমণ পিপাসু ভারতীয়দের ‘চরৈবেতি’ মন্ত্রের অবতারণা তাঁর
বিভিন্ন উপন্যাসে।
‘অমৃত কুম্ভের সন্ধান’ উপন্যাসে যে যাত্রা পথের
শুরু, সেই যাত্রা তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলিতেও অব্যাহত। ‘শাম্ব’ও তার ব্যাতিক্রম নয়। কৃষ্ণতনয় শাম্ব এক অসামান্য রূপবান যুবক। রমণীকূল তাঁর সঙ্গ লাভে ব্যাকুল। এমনকি দ্বারকা নগরীতে কৃষ্ণের ষোল হাজার রমণীও এই
অসামান্য রূপবান যুবকের সঙ্গলাভে পিপাসু – এই কথা কৃষ্ণকে অবগত
করেন স্বয়ং মহর্ষি নারদ। কৃষ্ণ দেবতা চরিত্র। কিন্তু সর্বোপরি মানুষের বৈশিষ্ট্য যুক্ত। লোভ, কাম, লালসা, ঈর্ষার উর্দ্ধে নন। তাই ক্রোধান্বিত হয়ে নিজের পুত্রকে নৃশংস অভিশাপ দেন। পিতার ঈর্ষা পুত্রের জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে আসে। সেই অভিশপ্ত জীবন থেকে শাম্ব কীভাবে মুক্তি পেল, সেই অসামান্য কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এই উপন্যাসে। দেবতা পুত্র হওয়া সত্ত্বেও যে অভিশপ্ত জীবন শাম্ব
বহন করেছিল এবং সেই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় তার চারিত্রিক উত্তরণ আমাদের আলোচ্য বিষয়।
সমরেশ বসু শাম্বর অভিশপ্ত জীবনের
উত্থান পতনের কাহিনী শুরুর প্রাক্কালে পুরাণ কেন্দ্রিক বেশ কিছু তথ্যের ভৌগোলিক সত্যতা নিরূপণ
করেছেন। আলোচনার প্রেক্ষিতে হয়তো তার অবতারণার প্রয়োজন
থাকতে পারে। মহর্ষি নারদ বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতে করতে দ্বারকায় আসেন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ
করার জন্য। অতি রমণীয় পর্বতের ওপর কুশস্থলীপুরীতে শ্রীকৃষ্ণের
বসবাস। সেখানে বসবাসকারী বৃষ্ণিবংশীয়
সকল ব্যক্তি ও সন্তান সন্ততিরা মহর্ষিকে অভ্যর্থনা জানায়। কৃষ্ণের অঙ্গনে প্রবেশ করা মাত্রই শ্রীকৃষ্ণ,
প্রদ্যুম্ন, এবং অন্যান্য বৃষ্ণি যাদবেরা মাননীয় অতিথিকে সাদরে অভ্যর্থনা জানায়।
সকলের ব্যবহারে মহর্ষি অত্যন্ত খুশি হলেও তাঁর দৃষ্টি পড়ে রমণী
পরিবৃত অপরূপ রূপবান কৃষ্ণপুত্র শাম্বর প্রতি।
শাম্ব রমণীদের সঙ্গে কামলীলারত রঙ্গরসিকতায় এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, মহর্ষির আগমন তাঁর
গোচর হয়নি। সোনার থেকেও উজ্জ্বল তাঁর
বর্ণ, পারিপার্শ্বিক সমস্ত জিনিস তাঁর দেহে প্রতিবিম্বিত
হয়-
“তাঁর আয়ত চোখে
সর্বদা কামনার বহ্নি অনল প্রজ্জ্বলিত হয় না, কিন্তু তাঁর মুগ্ধ দৃষ্টিতে এমন একটি
চিত্তজয়ী দুর্বার আকর্ষণ আছে, রমণী মাত্রেই
তাঁর মিলন আকাঙ্ক্ষায় কাতর হয়ে ওঠে।”
মহর্ষি নারদ তাঁর প্রতি
শাম্বর এহেন উপেক্ষার প্রতিশোধ স্বরূপ কৃষ্ণকে জানান, যে ষোলহাজার রমণীকে উদ্ধার
করে কৃষ্ণ ভর্তা স্বরূপ তাঁদের গ্রহণ করেছেন, তাঁরা সকলেই শাম্বর সঙ্গলাভে ব্যাকুল। কৃষ্ণ নারদের
কথা অবিশ্বাস করেন এবং প্রমাণ চান। মহর্ষি নারদ সুযোগের
অপেক্ষায় ছিলেন। বেশ কিছু কাল অতিবাহিত হবার পর একদিন রৈবতকের প্রমোদ কাননে কৃষ্ণ
তাঁর মহিষীগণ ও ষোলসহস্র রমণী সহ জলকেলীতে মগ্ন ছিলেন। এই সময় মহর্ষি নারদ শাম্বকে জানান যে, রৈবতকে তাঁর পিতা তাঁকে স্মরণ করেছেন। কৃষ্ণের প্রমোদ কানন ও
জলকেলী স্থানে কৃষ্ণ ছাড়া অন্য কারো যাওয়া নিষিদ্ধ -- একথা সর্বজন
বিদিত। কিন্তু মহর্ষির বাক্য মিথ্যা হতে পারে না, এই বিশ্বাসে শাম্ব
তৎক্ষণাৎ সেই প্রমোদ কাননে উপস্থিত হন। কিন্তু শাম্বর রূপ দর্শনে কৃষ্ণের ষোলসহস্র রমণী কামার্ত হয়ে
পড়ে। কৃষ্ণ উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও শাম্বকে নিয়ে তারা প্রগলভ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে
মহর্ষিকে দেখা মাত্র তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য রমণীরা জল থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
কিন্তু ঘটনার পরিণাম হলো বিপরীত। শ্রদ্ধার বদলে রমণীগণ তাদের প্রস্ফুটিত
যৌবন দেখাতেই অধিকতর তৎপর হয়ে ওঠে।
এমতাবস্থায় নারদের সঙ্গে কৃষ্ণের
দৃষ্টি বিনিময় হওয়া মাত্র কৃষ্ণ পূর্বে উল্লিখিত অবিশ্বাসের প্রমাণ পেলেন। একমাত্র কৃষ্ণের তিন স্ত্রী ছাড়া বাকি সমস্ত রমণীগণকে
কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তস্করের দ্বারা লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হবার অভিশাপ দেন। অস্বাভাবিক ক্রোধ ও ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে নিজের পুত্রকে
নির্মম অভিশাপ দেন এই বলে- “তোমার এই রমণীমোহন রূপ
নিপাত যাক। কুষ্টরোগের কুশ্রীতা তোমায় গ্রাস করুক।” মানুষের জীবনের বিচিত্র
অসূয়া তার আত্মজকেও গ্রাস করে। দেবতা হয়েও কৃষ্ণের অন্তর ঈর্ষায় বিদীর্ণ হয়ে ছিন্নমস্তা
রূপ লাভ করে। শাম্বর শত অনুরোধ ও মার্জনাও সেই অভিশাপের বদল ঘটাতে
পারে না। অভিশাপের কুশ্রীতা তাঁকে বহন করতেই হয়। তবে চরম দুঃখের মধ্যে
আশার আলো একমাত্র মহর্ষি নারদ, যিনি শাম্বকে অভিশপ্ত
জীবন থেকে মুক্তির পথ দেখান।
শুরু হয় শাম্বর জীবনের পথে যাত্রা,
অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। মহর্ষি নারদ তাঁকে মিত্রবনে সূর্য দেবতার পুজো করতে বলেন। কারণ এই সূর্যই সকল শক্তির উৎস। স্রষ্টা ও সময়ের ধ্বংসকারী, অমঙ্গল ও ব্যাধিনাশকারী। ইনি বিশ্বের রক্ষাকর্তা ও নিয়ন্তা। শাম্ব আত্মীয়স্বজন, পিতা-মাতা ও পত্নীকে ছেড়ে
মিত্রবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাঁর চেহারায় অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে। অত্যন্ত রূপবান কন্দর্পকান্তি যুবক কুৎসিৎ দর্শনধারী
এক কুষ্ঠরুগীতে পরিণত হয়। উপন্যাসে তাঁর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এইভাবে- “তাঁর নাসিকা মধ্যস্থল
দুই গিরিশৃঙ্গের ন্যায় ভগ্ন। তাঁর ভ্রূযুগল কেশহীন। সমস্ত মুখমণ্ডল মলিন কালিমালিপ্ত এবং তাম্রাভ। কোথাও রক্তাভ শুষ্ক ঘা
এবং অতি পলিত। বিশাল চক্ষুদ্বয়ের কৃষ্ণপুচ্ছসকল
পতিত হয়েছে। ফলে চোখ অতি রক্তাভ ও দগদগে দেখাচ্ছে। তাঁর সমগ্র দেহের চর্ম
স্ফীত, বিবর্ণ, হাত পা বিকলাঙ্গের ন্যায়। কেবলমাত্র চোখের দৃষ্টি
অতি করুণ, অসহায়।”
শাম্ব জীবনের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে। পিছনে পড়ে থাকে তাঁর রাজভবনের বিলাসিতাপূর্ণ
জীবন। আর সামনে থাকে অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়া মহাজীবন। মানুষ যখন অন্যায় করে, তখন সে সম্পূর্ণ
অন্য মানুষ থাকে। শাস্তি পাওয়ার পর সে পরিণত হয় সম্পূর্ণ অন্য মানুষে। শাস্তির কষ্ট মানুষের অন্তরকে শুদ্ধ করে তোলে। শাম্বর ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছিল। অতীত ফিরে আসে না। ভবিষ্যৎ মানুষের অজানা। হাতে থাকে শুধু বর্তমান। শাম্ব দুঃখ ও মনস্তাপ থেকে নিজের মনকে মুক্ত রেখে
অভিশপ্তহীন জীবনের প্রতি পা বাড়ান। রেসের মাঠে ঘোড়ার চোখের দু’পাশে আবরণ লাগানো হয়, যাতে সে শুধু সামনের পথটুকুই দেখতে পায়। শাম্বও সেভাবে কোনোদিকে দৃকপাত না করে অভিষ্ট লক্ষ্যে চলতে থাকেন। মূল ভূ-খণ্ডে পৌঁছে সমুদ্র তীর
বরাবর উত্তর দিকে চলতে শুরু করেন। সেখানে তিনি ধীবর পল্লীতে আশ্রয় লাভ করেন। সেখানকার সকলেই তাঁকে নরখাদক রাক্ষস ভেবে ভীত হয়। কিন্তু তাঁর শালীনতাপূর্ণ কথাবার্তায় সকলেই তাঁর
প্রতি প্রীত হয়, এবং তাঁকে খাদ্য ও পানীয় দান করে।
শাম্ব বহু নদ-নদী অতিক্রম করে, অরণ্যের ভিতর দিয়ে পাহাড়
ডিঙিয়ে পূর্বমুখে মিত্রবনের উদ্দেশ্যে হেঁটে চলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তিনি সহনশীল ছিলেন। অরণ্যের শ্বাপদকে দেখেও তিনি অকূতোভয়। কিন্তু গ্রাম এবং জনপদের প্রায় সর্বত্র তাঁকে অপরিসীম
লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। শাপমোচনের উদ্দেশ্যে শাম্বর জীবনের প্রতি এই যাত্রা
তাঁকে অনেক শিক্ষা দিয়েছিল। ভাগ্য বা নিয়তি অমোঘ। তাকে মেনে নিয়েই দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে
হয়। অতি দুঃখকেও সহ্য করার
শক্তি তিনি অর্জন করেছেন। কখনো ক্রুদ্ধ হয়ে কাউকে দোষারোপ তিনি করেননি। কৃষ্ণপুত্র হওয়া সত্ত্বেও কেন তাঁর এহেন ব্যাধি হলো, কেন তাঁকে এহেন শাস্তি
ভোগ করতে হলো, অন্য কারো কেন এমনি হলো না -- এই সমস্ত প্রশ্ন বাতুলতা
মাত্র। এই সমস্ত জীবন জিজ্ঞাসার
উত্তর সন্ধান করতে গেলে নিজের আত্মাকে কষ্ট দেওয়া এবং মনের অসন্তোষ ছাড়া আর কিছুই প্রাপ্ত
হয় না। শাম্বর জীবনে যখনই প্রবল বাধা এসেছে তখনই নিজেকে
এই বলে তিনি শান্ত থেকেছেন যে, ‘আমি অভিশপ্ত’। শাপমোচনই তাঁর জীবনের একমাত্র মোক্ষলাভ। কারণ কর্ম ও ভাগ্যের সমন্বয়েই সাফল্য। অতএব কর্মটা করে যেতে হবে। তার সঙ্গে ভাগ্য প্রসন্ন হলে সাফল্যের সূর্যোদয় অবশ্যম্ভাবী। এই তত্ত্বই শাম্ব মেনে চলেন।
এইভাবে সাতটি ঋতু অতিক্রম করার
পর শাম্ব চন্দ্রভাগা নদীর তীরে উপস্থিত হন। এক মাঝি তাঁকে নদী পার করে দেয়। মাঝির সঙ্গে কথোপকথনে শাম্বর কৃতজ্ঞ চিত্ত ও বিনয়ী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। চন্দ্রভাগা নদীতে অবগাহন করে তাঁর সর্বাঙ্গ পরম শীতলতায়
জুড়িয়ে যায়। পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় তিনি কিছু ভিক্ষুকের সঙ্গে
পরিচিত হন, যারা তাঁর মতোই কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত। শাম্বর মনে পড়ে মহর্ষি কথিত মিত্রবনের কথা। যেখানে গ্রহরাজ সূর্যকে ঘিরে থাকেন দেবতা, গন্ধর্ব, যক্ষ, প্রভৃতি। শাম্ব সেই মিত্রবনের কাথা জানতে চান এই সমস্ত মানুষদের কাছ
থেকে। কিন্তু তাদের অশ্লীল কথাবার্তা ও আচরণে শাম্ব অশান্ত হন। শাম্ব তাদের ভিক্ষার অন্ন গ্রহণ করেন, এবং নিজের পরিচয় জানান এই বলে যে, ‘আমার একমাত্র পরিচয় আমি
অভিশপ্ত’। এই ভিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন রমণী নীলাক্ষী শাম্বর
পরিচর্যার ভার গ্রহণ করেন। কিন্তু তার বদলে তিনি শাম্বকে শরীরী ভাবে কামনা
করেন। নীলাক্ষীর অতি কাতর অনুনয় সত্ত্বেও শাম্ব নিজেকে বিরত রেখে সংযমের পরিচয়
দেন। সারারাত্রি নক্ষত্র খচিত আকাশের নিচে কাটিয়ে ভোরবেলায় চন্দ্রভাগা
নদীতে স্নান করে সিক্তবস্ত্রে ভিক্ষুকগণ কথিত মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। অবশেষে শাম্ব মিত্রবনের পরম রমণীয় স্থানে উপস্থিত
হন এবং সূর্যদেবকে আরাধনারত অবস্থায় এক দিব্যজ্যোতি ঋষির দর্শন লাভ করেন। ঋষির কথামতো হৃদয়ে গভীর আস্থা
নিয়ে ঋষিকে অনুসরণ করেন। পুজো শেষে পদ্মের পাতায় শাম্ব ফল-মিষ্টান্ন গ্রহণ করেন। ঋষির কাছে তাঁর সুদীর্ঘ যাত্রাপথের বর্ণনা দিলেও তিনি যে কৃষ্ণপুত্র, একথা তিনি গোপন করেন।
বিবস্বান অর্থাৎ সূর্যের পরিচয়ে শাম্ব ঋষিকে যে তথ্য জানান, তাতে তাঁর প্রভূত জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণ ঋষি শাম্বকে এই
ব্যাধি থেকে উত্তরণের উপায় স্বরূপ সূর্যক্ষেত্রের
দ্বাদশ স্থান পরিভ্রমণের কথা বলেন। মুক্তির উপায় স্বরূপ
যে পথ শাম্বকে অতিক্রম করতে হবে, সেই পথ অত্যন্ত দুর্গম।
শাম্ব সম্পূর্ণ অবিচলিত চিত্তে সেই পথে গমন করতে উৎসুক হন। নিজের রোগ মুক্তির সঙ্গে
শাম্ব সেই কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত ভিক্ষুকদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু তারা ইতিমধ্যেই
বিশ্বাস হারিয়ে জীবনের সমস্ত আশা
ত্যাগ করে কেবল দিনগত পাপক্ষয় করছে। কিন্তু শাম্ব নিজেও ঐ ব্যাধিগ্রস্ত হলেও তিনি জ়ীবনের প্রতি আশা
ত্যাগ করেননি। নিজের অভিশপ্ত জীবনের মুক্তির আশায় তিনি ছিলেন যত্নশীল। জীবনের
কাছে হেরে যাওয়া এই সব মানুষদের মনে শাম্ব
পুনরায় মুক্তির বীজ বপন করেন। নতুন করে বেঁচে থাকার আনন্দের আশ্বাস দিয়ে সকলকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যান সেই দ্বাদশস্থান
পরিভ্রমণের উদ্দেশ্যে। এই দ্বাদশস্থান
পরিভ্রমণের ফলশ্রুতি উপন্যাসে সবিস্তারে বর্ণিত আছে।
শাম্ব মুক্তির উদ্দেশ্যে জীবনের পথে যাত্রা করেন। এও যেন কুরুক্ষেত্র
যুদ্ধযাত্রার মতো। শুধু এই যুদ্ধের
স্বরূপ আলাদা। এই যুদ্ধে জিততে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং অঙ্গীকারবদ্ধ। যাত্রার সময়
তাঁর সঙ্গে ছিল শিশু, বৃদ্ধ ও নানা বয়সের নর-নারী সহ মোট
সত্তরজন। বারোমাস পরে তিনি যখন ফিরে এলেন চন্দ্রভাগাকূলে, তখন শাম্ব ছাড়া আর মাত্র চোদ্দজন জীবিত। বেশিরভাগ লোক ব্যাধির
প্রাবল্যে মারা গেছে, কেউ বা বিভিন্ন স্থানে থেকে
গেছে। এইসময় তাদের সকলের দেহেই কিছু না কিছু পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। চন্দ্রভাগা
ও সিন্ধু সঙ্গমের জলে শাম্ব লাভ করেন একটি দারুমূর্তি যার সঙ্গে মিত্রবনের গ্রহরাজের
মূর্তির মিল আছে। এই মূর্তি কল্পবৃক্ষের দ্বারা তৈরি। ঐ মূর্তিকে শাম্ব কখনোই ত্যাগ করেননি।
সমস্ত ঋতু ও পথ পরিক্রমা করার সময় ঐ মূর্তিটি তিনি
কাঁধে বহন করেছেন। কিন্তু গ্রহরাজ বিগ্রহের পুজো করার অধিকার একমাত্র শ্বাকদ্বীপের ব্রাহ্মণদের। তাই
সূর্যদেবের পুজোর উদ্দেশ্যে সেখানকার ব্রাহ্মণদের ভারতবর্ষে নিয়ে আসার ভারও অর্পিত হয়
শাম্বর ওপর।
শুরু হয় শাম্বর নতুন যাত্রাপথ। শ্বাকদ্বীপের ব্রাহ্মণেরা
কেবল সূর্যোপাসক নন, কুষ্ঠব্যাধিকে দেহ থেকে আমূল ধ্বংসের চিকিৎসাবিধি একমাত্র
তাঁরাই জানেন। কল্পবৃক্ষ মূর্তি স্থাপনের জন্য বিশেষ মন্দির প্রয়োজন।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়ের মহান শিল্পীরা বাস করেন। তাঁদের ভারতবর্ষে
ভরণ-পোষণের ভার স্বরূপ শাম্ব নিজে শত্রুকে নিধন ও
পরাজিত করে যে সমস্ত ধন- সম্পত্তি লাভ করেছেন, তার দ্বারাই এই সমস্ত মহান শিল্পীদের ব্যয় নির্ধারিত হবে, মনস্থ করেন। শাম্ব এই উদ্দেশ্যে দ্বারকায় গমন করেন। সেখানে পিতা মাতা ও পত্নীর সঙ্গে দেখা
করলেও সেখানেই তিনি স্থায়ী হননি। পত্নী লক্ষণার কাতর অনুনয় সত্ত্বেও শাম্ব পুনরায়
রাজভবনের বিলাসবহুল সাংসারিক জীবনে গা ভাসিয়ে দেননি। কারণ জীবন সতত সঞ্চরণশীল ও
পরিবর্তনশীল। শাম্ব মাত্র একরাত্রি দ্বারকায় বাস করে তাঁর যাবতীয় মণিমুক্তা
অর্থ নিয়ে বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়কে মন্দির তৈরি করার জন্য প্রার্থনা জানান। তাঁরা
স্বীকৃত হলে শাম্ব পদব্রজে শ্বাকদ্বীপ যাত্রা করেন। পঞ্চতল
ভূমি অতিক্রম করে হিমালয়ের পাদদেশে পৌঁছতেই
তাঁর মাসাধিক কাল কেটে গেল।
শুরু হলো অন্তরীক্ষের অতি দুর্গম
পথ। পাহাড় পর্বত ও বন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গমনের সময় শাম্ব তাঁর জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা
সঞ্চয় করলেন। অন্তরীক্ষের কাছাকাছি গন্ধর্ব রমণী ও পুরুষরা সকলেই অতীব সুন্দর। এই
অধিবাসীরা কেউই তাঁর দেহ বিকৃতির জন্য খারাপ আচরণ করেননি। তাঁকে খাদ্য ও আশ্রয়
দিয়েছেন এবং
ইলাবৃতবর্ষের অধিবাসীদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ চলার জন্য শাম্বকে তাঁরা সাবধান করে
দিয়েছেন। অসুরদের সীমানা অতিক্রমের পর শ্বাকদ্বীপে গমনের আগে
সুরসেনাদের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ
হয়েছে। স্বর্গের প্রতিটি মানুষের পদধূলি তিনি গ্রহণ করলেও তাঁদের ব্যবহার খুব ভালো ছিল না।
দশটি ঋতু অতিক্রম করার পর শাম্ব শ্বাকদ্বীপে পৌ্ছান। শাম্ব মগ
সম্প্রদায়শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের
পাদ্যার্ঘ গ্রহণ করে তাঁকে পরিচয় এবং আগমনের কারণ সবিস্তারে
জানান। তাঁর আচরণে মগধশ্রেষ্ঠ
প্রীত হন। শাম্ব তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে অনুমান করেন যে, তাঁরা ইতিপূর্বে ভারতবর্ষে গিয়ে যে কোনো কারণেই হোক লাঞ্ছিত হয়েছিলেন।
শাম্ব পরিপূর্ণ
রাজোচিতবিনয় ও আশ্বাস সহকারে তাঁদের ভারতবর্ষে সুপ্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার করেন।
এছাড়াও তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্যের যাবতীয় আশ্বাস ও ভরসা দিয়ে আঠারোজন ব্রাহ্মণকে
পরিবার সহ যাবার জন্য অনুরোধ জানান। শাম্বর বিনয় এবং এত দিনের অমানুষিক ক্লেশ সহ্য
করার বৃত্তান্ত অনুধাবন করে মগধশ্রেষ্ঠ অনুমতি দেন। আঠারোটি পরিবার ভারতবর্ষে
আসেন শাম্বর সঙ্গে। শাম্ব এক মহা কর্মযজ্ঞের সূচনা করলেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এই
মগধের পরিবারগুলির জন্য গৃহ নির্মাণ করে তাঁদের প্রতিষ্ঠা করলেন। বাকি ছটি মগ ব্রাহ্মণ পরিবারকে নিয়ে উদয়াচলের
ওড্রদেশে লবণদধির তীরে উপস্থিত হলেন। সেখানে এই পরিবারগুলিকে প্রতিষ্ঠা করলেন।
একবছর পর তিনি যখন মিত্রবনে ফিরে আসেন, তখন সেখানে একটি ছোটখাটো নগরী তৈরি হয়েছে। সবাই নাম দিয়েছে
শাম্বপুর। শাম্ব বিন্দুমাত্রও উৎসাহিত হলেন না। সে অভিপ্রায়ও তাঁর
ছিল না।
এই মহাযজ্ঞের উদ্বোধন যখন শাম্বর মাধ্যমেই হয়েছিল, তখন বাকি কর্মের সমাধানও
তাঁর হাত ধরেই ঘটেছে। এই মহাযজ্ঞের ফলে তাঁর হৃদয় ও মনে অপূর্ব
পরিবর্তন আসে। বিরোধ ও আলস্য সেখানে কোনো বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। শাম্ব ছিলেন সুখে দুঃখে বিগতস্পৃহ, জীবনের কাছে হার না মানা
এক অসামান্য নায়ক। মিত্রবনের ঋষির নির্দেশ মতো বৎসরান্তে প্রতি চার
মাসে তিন স্থান ভ্রমণ করতে লাগলেন; মূলস্থান – মিত্রবন, কালপ্রিয় - কালনাথ ক্ষেত্র, উদয়াচলে সমুদ্রতীরে কোণবল্লভ
ক্ষেত্র। বাকি চোদ্দজন এই তিন স্থানে গমন করলেন। বারোবছর পর তিনটি মন্দির
পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হলো। শাম্বর অভিশপ্ত জীবনে ছায়াসঙ্গিনীর ন্যায় তাঁর পাশে
ছিলেন নীলাক্ষী। নীলাক্ষী উদয়াচলের মন্দিরে আজীবন বাস করার প্রার্থনা
জানান এবং শাম্বকে জানান যে, ‘তুমি আমার মহামৈত্র’। নীলাক্ষী সেই কোণাদিত্য ক্ষেত্রের নামকরণ করেন মৈত্রবন। সবশেষে মহর্ষি নারদের আগমন ঘটে। মহর্ষি শাম্বর কাছে জানতে চান, তিনি আর কখনো দ্বারকায় ফিরবেন কিনা।
কিন্তু কৃষ্ণতনয় শাম্ব তাঁর
জীবন দর্শনের কথা জানান। শাম্ব প্রকৃতই মুক্তি ও মোক্ষ লাভ করেছেন। আসলে অভিশাপটা একটা অজুহাত মাত্র। চরিত্রের কলঙ্ক এবং বিশাল কর্মযজ্ঞের সূচনার হেতু একমাত্র শাম্ব। শাম্ব যে উদ্দেশ্যে জীবনের পথে যাত্রা করেছিলেন, সেই উদ্দেশ্য তাঁর সফল
হয়েছে। কিন্তু এই দুর্গম যাত্রাপথে
তিনি জেনেছেন অভিশাপ কি, ব্যাধি কি, অভিশপ্ত জীবন কি! এই মহাজীবনের যাত্রাপথে
তিনি কখনো নিজের দুর্ভাগ্য পীড়িত জীবনের
জন্য কাউকে দোষারোপ করেননি। কারোর প্রতি ক্রোধ, অসন্তোষ বা ঘৃণা প্রকাশ করেননি। নিজেকে শান্ত রেখেছেন এই বলে যে, আমি অভিশপ্ত। তাই সবশেষে মহর্ষি গ্রহরাজ ‘শাম্বাদিত্য’ বলে সম্বোধন করেন। অভিশপ্ত জীবনের অতি দুঃখের দিনেও যিনি একফোঁটা অশ্রুপাত করেননি। ‘শাম্বাদিত্য’ সম্বোধনে তিনি আর চোখের জল ধরে রাখতে
পারেননি। এখানেই তিনি হয়ে ওঠেন রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ। কো্নো দেবতা পুত্র নয়। পৌরাণিক কাহিনীর আলেখ্য এক সংগ্রামী
নায়কের উত্তরণের ইতিহাস
যথার্থ।
চমৎকার। খুব উপকার হল।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ লেখা।জীবনের জন্য খুবই উপকৃত।অসংখ্য ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো পড়ে
উত্তরমুছুনthanks.
উত্তরমুছুন❤️
উত্তরমুছুনঅসাধারণ একটি তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।
উত্তরমুছুন