১৯৮৬
সেই রাতে চাঁদ ছিল পূর্ণিমা, শনিবার, আমরা সদল গেলাম পল্টুদাদের বাড়ি। ওদের বাড়িতে বুস্টার আছে। বাংলাদেশ দেখাচ্ছে বিশ্বকাপ। ইতালি-বুলগেরিয়ার প্রথম ম্যাচ। ১৯৮৬। পরদিন রাজীব গান্ধীর তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রী অজিত পাঁজা ঘোষণা করলেন, বাকি সব খেলা দেখাবে দূরদর্শন। হেভি
কথাটা তখন সদ্যজাত। আমরা বললাম, হেভি। রাত জেগে
ফুটবল দেখার সেই শুরু।
আমার তখন নবম শ্রেণী, আমার তখন দাড়ি। কচি তারা। ক্ষুরোপযোগী নয়। গাল বেয়ে ধীরে নামছে যেন শীতল সরীসৃপ। সাত দরিয়া তেরো নদীর পারে, মেক্সিকোয় একটা ম্যাচ শেষ। পরবর্তী আর একটা ম্যাচের মধ্যবর্তী টাইমজোনে
দাঁড়িয়ে আমার বয়ঃসন্ধি।
সেই মধ্যবর্তী অপেক্ষায় কোনও হোমটাস্ক ছিল
না। আমরা সদলবল সেইসব নিঝুম
জুনরাত স্পর্শ করতাম। মোড়ে জটলা, তর্কের জট। দেশভাগের স্পষ্ট দোটানা। বৃদ্ধ সক্রেটিস বৃদ্ধ
জিকোকে ডজ করে বেরিয়ে যাচ্ছে দামাল দিয়েগো। উল্লাসে উল্লাসে জন্ম হতে চলেছে
প্রতিস্পর্ধার।
সেই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে, কেবল অপুদা ঠিক খুঁজে নিয়েছে ঝুমুরদিকে ওদের পেছনের গেটে।
আজি যত তারা তব আকাশে। নিচু গলায় কথোপকথন। অক্ষর বিনিময়। গভীর রাতের ম্যাচ। আমি
বোকা জুনিয়র। আকাশ ততক্ষণে মেঘ জমে জমে মেঘলা। আমাদের পিঠে ঘাম জমে জমে ঘামাচি। আর ব্রাজিল
ভেঙে ভেঙে আর্জেন্টিনা।
আঁটোসাঁটো খাটো মানুষটা স্রেফ বাঁ-পা চালিয়ে একাই ভেঙে দিল ব্রাজিল-ব্লক। ব্রাজিলের
পাশাপাশি আর্জেন্টিনার সমর্থকদের জন্ম হলো। ইস্ট-মোহনের মতো আড়াআড়ি
ভেঙে গেল আবেগের মানচিত্র। এ যুদ্ধ-পাগলামি লিপ-ইয়ারের মতো প্রতি চার বছর অন্তর আসে। ছিয়াশির বিশ্বকাপ এই লিপ-ইয়ারে
নয়া রঙ দিল। হলুদ- সবুজের পাশাপাশি নীল-সাদা ডোরা।
একই ম্যাচে মারাদোনা একটা গোল করছে হাত দিয়ে, আর একটা পা দিয়ে। প্রথমটা ঈশ্বরের হাত।
ঈশ্বরবাবু রেফারি নামক তৃতীয় নয়ন নিঁখুত এড়িয়ে অন্যায় হাত চালিয়েছেন। ন্যায়
প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষুদে রাজপুত্র ঈশ্বরকে করল চ্যালেঞ্জ। মাঝমাঠ থেকে একা ছ'জনকে পরপর কাটিয়ে তিনকাঠির নাগাল। হতভাগা
পিটার শিলটন জাল থেকে বল কুড়িয়ে এনে দেখল তার দলের ইংরেজি জানা হাঁদাভোঁদা-নন্টেফন্টেরা দাঁড়িয়ে। বেবাক। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ উদ্ধার করে
বিপক্ষের শ্যামলা-সাঁটুলরা হর্ষমাতাল। আর ওদের লিডার বেঁটে
বাঁটুল ঈশ্বরের টাকে চাঁটি মেরে বলছে, গোলটা পা দিয়ে করতে হয় জেঠু, হাত দিয়ে নয়!
এভাবে ঈশ্বর আর শয়তানের এক্কা-দোক্কা দেখতে দেখতেই আমাদের বড় হওয়া। অসহনীয়
দুপুরের পর তখন আমাদের কৈশোরে একটা বিকেল ছিল। গোধূলি গগন আর মেঘ। ফুটবল লিক, সর্ষেও ব্যর্থ, আমরা আধদামড়া হয়েও ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতাম। বা
দাড়িয়াবান্ধা। কো-এড খেলা। দাঁড়িয়ে পড়ত অপুদা-ঝুমুরদিও। ঝুমুরদিকে অপুদা ছুঁয়ে দিতেই
ঝুমুরদি আউট। জানতাম সেদিন রাতেও অক্ষরযাত্রা অনিবার্য। বাজারে এস এম এস আসতে তখনও
ঢের দেরি।
১৯৮৬। রাত ন'টায় নুক্কড় বাঁধা। তখন টিভি সিরিয়ালে মানুষ
চমকালে একবারই ঘুরত। তিনবার নয়। মাতাল-মুচি-হাবিলদার-ঝি-নাপিত-সাইকেল সারানোর মিস্তিরি-পানবিড়ির দোকানদারদের নিয়ে সিরিয়াল হতো তখন।
হরি-খোপড়ি-কাদেরভাই-করিম মিঞা-রাধা-মধু-টিচারজি-গুরু। ছোট ছোট জীবনের ছোট ছোট দুঃখ-সুখ। কোনও ষড়যন্ত্র প্রবণতা নেই। তাও খোপড়ি
মাতাল, গণপত হাবিলদার বা ঘঞ্চু ভিখারির জীবনের গল্প শুনতাম হাঁ করে।
নুক্কড়ের হরি আর মধুর মতো প্রেম ছিল অনেকটা
আমাদের অপুদা-ঝুমুরদির। গুপ্তা শেঠের মেয়ে মধু। সাইকেল-মিস্তিরি হরিকে গুপ্তাজি পছন্দ করবে কেন? ঝুমুরদির বাবা ইনকাম ট্যাক্স ল-ইয়ার। ওদের বাড়ি টেলিফোন আছে। রঙিন টিভি।
শোকেসে অনেক গণেশ। অপুদা কলেজে থার্ড ইয়ার। টিউশন করে আর মোড়ে আড্ডা মারে। মারাদোনা আর কৃশাণুর ভক্ত। বাড়িতে দু'জনেরই ছবি। মারাদোনার ছবির নিচে লেখা – চরণ ধরিতে দিয়েগো, দিয়োগো আমারে...
কিন্তু সব ৮৬, বিল্লা নাম্বার ৭৮৬ নয়। সব পাখি ঘরে আসে। সব
নদী। নুক্কড় বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের মোড়েও আর অপুদা আসে না। চাকরির পরীক্ষার
প্রস্তুতি নিচ্ছে। ৮৬ শেষ হলো ডিসেম্বরের এক অবর্ণনীয় সকালে। পরীক্ষা শেষ, রেজাল্ট বেরোবে বেরোবে, সেই সকালে খবর পেলাম স্মিতা পাটিল মারা
গেছেন। ধুপ সে না নিকলা করো রূপ কি রানী – দেখে নয়, আর্ট ফিলিম বলে একটি বস্তু ছিল তখন, টিভিতেও দেখাত, সেখানেই চক্র বা মন্থন বা মির্চ মশালা দেখে
ভালোবেসে ফেলেছিলাম স্মিতা পাটিলকে। কে
যেন বলেছিল, সন্দীপ পাটিলের বোন। খুব অবিশ্বাস করিনি। বস্তুত আমরা তখন সব বিশ্বাস করতাম।
অপুদা পরে ব্যাঙ্কে চাকরি পেল, কিন্তু ঝুমুরদির সঙ্গে ওর বিয়ে হয়নি। ঝুমুরদি
বর-বাচ্চা নিয়ে মাঝে মাঝে আসে। আমার মেয়ের সঙ্গে
খেলে ওর ছোট মেয়ে। অপুদা বদলি নিয়ে অন্ধ্রে চলে গেছে। দিয়েগো আর কৃশাণুর ছবিদুটো
কে জানে কোথায়?
মেয়ের চিৎকার কানে আসছে – নেইমার, নেইমার! আবার বসে পড়ি টিভির সামনে। কিন্তু টিভির পর্দায় ও কে? কে
ছুটছে? দিয়েগো? দিয়েগো ছুটে চলেছে, ছিটকে যাচ্ছে ডিফেন্ডার, সামনে হাবা পিটার শিলটন। মেয়ের চিৎকার –
নেইমার! নেইমার! আমি দেখছি এ তো অপু! অপু ছুটছে রেলগাড়ি দেখবে বলে, পেছনে পড়ে থাকে আমাদের মোড়, ভাঙা আখর, দাড়িয়াবান্ধা, ঝুমুরদি আর দুর্গা – স্মিতা পাতিল।
স্মৃতির আখর... জিয়া নস্টাল।
উত্তরমুছুনশ্রাবণী দাশগুপ্ত।