কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

গৌরাঙ্গ মোহান্ত

 

কায়সুল হকের কবিতা: 'পিপাসার আশ্চর্য নিখিল'

 


'যাকে আমরা বাস্তব বলি তাই বিকার্য শুধু কটি স্বপ্নই বুঝি অবিনাশী, মৃত্যুহীন।'

'স্বপ্নের চারু কারু' অন্নদাশঙ্কর রায় প্রসঙ্গে কবি কায়সুল হক বিকার্য বাস্তবতার প্রতিকূলে স্বপ্নের অবিনাশিতা নিয়ে যে প্রগাঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তার সপ্রমাণ স্বাক্ষর তিনি উৎকিরণ করেন 'জ্যোৎস্নার বকযন্ত্রে পরিশ্রুত' কবিতার ভূমণ্ডলে।

ওয়ালডেন-আকৃষ্ট ইয়েটসের ইনিসফ্রি-নির্জনতা আত্মপ্রচার-বিমুখ এ কবির মগ্ন চৈতন্যে বিস্তার করে এক শিল্পিত আধিপত্য; 'কারো অতল কান্নার মতন' স্তব্ধতা কবির সংবেদী স্নায়ুকে উদ্বেলিত করে 'সারারাত'। কায়সুল হক মালদহ জেলার বতুয়া থানাস্থ তাজপুর গ্রামে ভূমিষ্ঠ হন ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ; ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ হতে রংপুরে আরম্ভ হয় তাঁর অবস্থিতি। একদিন আমি দূরভাষে কবির সকাশে প্রশ্ন তুলি, 'কোনটি আপনার জন্মভূমি'? ধাত্রেয়ী রংপুর কবির ছায়াস্নিগ্ধ বাসভূমি, চৈতন্যলোকের প্রতীকী ধরিত্রী। রবীন্দ্রনাথের মতো হয়তো তিনি অনুভব করেন, 'মানুষের বাসস্থান পৃথিবীর সর্বত্র। মানুষের বস্তুত বাসস্থান এক। মানুষের কাছে পৃথিবীর কোনো অংশ দুর্গম নয়। পৃথিবী তার কাছে হৃদয় অবারিত করে দিয়েছে' (রবীন্দ্রনাথ ২০ খ- ৪২১)। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ হতে ঢাকায় বসবাসের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত রংপুরের অকৃত্রিম প্রতিবেশ-পরিমণ্ডল কায়সুল-মানসের পরিপুষ্টি বিধানে সক্রিয় থাকে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ হতে তিনি আধুনিক ধ্যান-ধারণার পিয়াসী হয়ে ওঠেন। তখন সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত 'পূর্বাশা' পত্রিকার মাধ্যমে তিনি অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে পরোক্ষভাবে পরিচিত হন। তাঁকে তিনি 'বাঙালি যুক্তিবাদী মনীষী লেখক' হিসেবে বিবেচনা করেন এবং তাঁর নিকট থেকে 'শিল্পী হওয়ার দীক্ষা' গ্রহণ করেন (কায়সুল জ. পাক্ষিক ৪৬)। অন্নদাশঙ্কর তাঁর প্রবন্ধে অজ্ঞেয়বাদী বারট্রান্ড রাসেলকে 'সংজ্ঞাতীত সত্যের পূজারী ' হিসেবে অভিহিত করেন; রাসেলের 'পূজা মুক্ত মানবের পূজা, দাস মানবের নয়'। তিনি মানুষকে 'মুক্ত দেখতে চান, জীবিত দেখতে চান' (অন্নদাশঙ্কর ৯৬)। রবীন্দ্রনাথও রাসেলকে 'প্রখর আলোকে দীপ্যমান' চিত্তের অধিকারী রূপে প্রত্যক্ষ করেন (রবীন্দ্রনাথ ২৬ খ- ৫৩৮)। 'যুক্তিবাদী হওয়ার পথ অন্বেষণে নিবিষ্ট' হয়ে কায়সুল হক প্রথম যৌবনেই বারট্রান্ড রাসেলকে দীক্ষা গুরুর মর্যাদা দান করেন (কায়সুল জ. পাক্ষিক ৪৬)। রাসেলীয় দর্শনে আবিষ্ট কায়সুল হক স্বসংস্কৃতিসঞ্জাত বিশ্বমানবিকতাবোধ ও আত্মোপলব্ধির নিরঞ্জন প্রস্রবণে অভিষিক্ত হবার জন্য প্রতিনিয়ত রবীন্দ্রনাথের সন্নিধান কামনা করেন। তাঁর ভাষ্য, 'পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার সাধনায় র বীন্দ্রনাথ আরাধ্য' (কায়সুল স্বদেশ, সংস্কৃতি ৯)। জীবনানন্দের কাব্য 3 জীবনবোধের প্রভাবও কায়সুল হকের ওপর দুর্নিরীক্ষ্য নয়। সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার সূত্র ধরে জীবনানন্দের সঙ্গে তাঁর গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পঞ্চম দশকে কায়সুল হক কবিতার স্বপ্নঋদ্ধ ভূখণ্ডে আত্মানুসন্ধানে ব্রতী হন। একজন কবিকে 'কাল্পনিক ইংরেজি-মার্কা দশক নামক ঐতিহাসিক যুগসংখ্যায়' চিহ্নিত করা অর্বাচীনতার নামান্তর মর্মে বিষ্ণু দে অভিমত প্রকাশ করেন (বিষ্ণু দে ২৩৮)। কায়সুল হককে শুধু মাত্র পঞ্চম দশকের কবি হিসেবে বিবেচনা করা সঙ্গত নয়; তাঁর কাব্যিক আবেদন শাশ্বতিক বলে উপলব্ধ হয়। যদিও তিনি কবি শামসুর রাহমানের মতো অতিপ্রজ কাব্যকার নন, তাঁর সৃষ্ট কাব্যসম্ভার উপলব্ধি-বিভূতি-প্রত্যয়গত দিক থেকে বিশিষ্টভাবে ব্যঞ্জনাদীপ্ত। তাঁর প্রথম কাব্য 'শব্দের সাঁকো' ১৩৮১ বঙ্গাব্দের বৈশাখে, দ্বিতীয় কাব্য 'রবীন্দ্রনাথের নিরুপম বাগান' ১৪০৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে, প্রবন্ধ গ্রন্থ 'স্বদেশ, সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথ' ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে এবং 'আলোর দিকে যাত্রা' ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়।

'কী সুন্দর এ পৃথিবী'

পৃথিবীর সৌন্দর্য, নিসর্গ-অরণ্য-ঋতুর চমৎকৃতি কায়সুল হকের করোটিতে জাগায় উৎকর্ষী উৎকম্পন। 'মায়াবী আকাশ সচকিত করে' 'গোলগাল চাঁদ' লাফ দিয়ে উঠলে কবি মুগ্ধ হন। 'পূর্ণিমার চাঁদ'-এর সাথে তিনি অনুভব করেন সপ্রেম অনুবন্ধ; 'জ্যোৎস্নার গুঁড়ো মেখে পাখির শুভ্র পালকের মতো নিজেকে ছড়িয়ে দিতে' তিনি 'সুখ' বোধ করেন। 'গাছের পত্রালি' যখন ঝরে যেতে শুরু করে তখন নিসর্গপ্রেমী কবির নিকট 'সুন্দরের স্নিগ্ধরূপ' তিরোহিত হয়; 'আকাশের চাঁদকে তখন শুধু ফ্যাকাশে বেল্লিক ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।' অরণ্য 'পৃথিবীর সিঁথির সিঁদুর'; অরণ্যহীন ভূখণ্ড বরণ করে বৈধব্য-পীড়ন। একজন স্বাপ্নিকের 'inner weather'-এর সঙ্গে বৃক্ষের 'outer' আবহের সম্পর্ক রবার্ট ফ্রস্ট যেমন আবিষ্কার করেন (Frost 252), তেমনি কায়সুল হক 'মানুষের হৃৎস্পন্দন'-এর সঙ্গে 'পত্রাদির কম্পন'-এর সাযুজ্য প্রত্যক্ষ করেন।

বৈদিক যুগের আদিকবি বর্ষার বিমল ধারায় অনুসন্ধান করেছেন অমোঘ সঞ্জীবনী। ঋগ্বেদের একটি সূক্তে শুনি বর্ষার সমাগমে মণ্ডুকের মুক্তির ধ্বনি (শ্রী হিরণ্ময় ১৮১-১৮২)। কায়সুল হকও 'উতল শ্রাবণ'-এ দেখেন, 'অতি পুরাতন মেঘদূত/ নবীনতা নিয়ে ফিরে আসে।' 'যৌবনকে খুঁজে নিতে' তখন তিনি 'বৃষ্টির ধবল ধারায়' স্নাত হন। 'মাহ ভাদর'-এ বিদ্যাপতির মতো 'শূন্য মন্দির মোর' বলে তিনি বিরহ-মথিত ব্রজবুলি উচ্চারণ করেন না। 'আকাশ ছাড়পত্র না' দিলে কবিতায় তিনি ভরে তোলেন শূন্য প্রহর। কায়সুল হক একদিন 'হেমন্ত আকাশ থেকে' ঝরতে দেখেন 'শিশিরের মতো উৎসব'। সেই থেকে জীবনানন্দের মতো তিনি হেমন্ত-অনুরক্ত হয়ে ওঠেন; তাঁর 'মনের মাটিতে একেবারে নিজের মতন ক'রে/ সমস্ত সময় ধ'রে হেমন্তে র রৌদ্র আর শিশিরের কণা' ঝরতে থাকে। জীবনানন্দের হৈমন্তিক ভূমণ্ডল শস্য-সমৃদ্ধি, আলস্য, লাবণ্য, পূর্ণতা, সভ্যতা-সংকট, বিনষ্টি ও জীবন-জীবনান্তের সংশ্লেষণে প্রোজ্জ্বল (নরেশ কবিতা ১১০)। কায়সুল হকের হৈমন্তী ভূখণ্ড নির্জনতা, প্রেম, মাধুর্য, ঋদ্ধি, সংস্কৃতি ও দীপ্তির সুষম সংযোগে সমুদ্ভাসিত। নরেশ গুহ 'হেমন্তের ঢালু বেলায় নরম রোদে ঘুরে ঘুরে' প্রেয়সীকে হৃদয়ের কথা শোনাবার জন্য 'লগ্ন' কবিতায় ব্যাকুলতা অনুভব করেন (নরেশ ২১)। আর কায়সুল হক হেমন্তের নির্জন পরিবেশে প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে পূর্ব-কথিত পঙ্ক্তিমালা রোমন্থন করেন :

'কখনও কি পাণ্ডুর আকাশ তোমাকে বিষণ্ণ করে?

বেদনা শিশির হয়ে ঝরেছে কি সারা রাত ধ'রে?

লেখা হয়ে গেছে নাকি সেখানে তোমার অদ্বিতীয় এই নাম?

 ... ... ...

আকাশের নীলিমায়

হে নারী, তোমার স্তন হয়েছে পূর্ণিমা;

বিস্ময়কর সে মধুরিমা।'

('মনোনীতা, তোমার জন্যে' ১১-১২)

হেমন্ত কায়সুল হকের কবিতার একটি বহুমাত্রিক প্রতীক। কখনও তা জ্যোতির্ময় জগৎকে, কখনও তা চেতনাত্মক সত্তাকে প্রকট করে তোলে। কবির চৈতন্য-ভাষ্যের নিদর্শন :

'এই হেমন্তের কাল উল্লাসের চিরদীপ্রতায়

চৈতন্যের বীজমন্ত্র রেখে যায়।

কৃষকের ঘরে ঘরে মাঙ্গলিক উৎসবের সূচনায়

হয়ে ওঠে এই ঋতু এক শাশ্বত প্রান্তর

যেখানে প্রাণের ঋদ্ধতায় উচ্চারিত অস্তিত্বের স্বর।'

('এই যে এখন' ১৬-২০)

বৃহদারণ্যক উপনিষদে অসৎ হতে সৎস্বরূপে, অন্ধকার হতে আলোকে ও মৃত্যু হতে অমৃতলোকে উর্ত্তীণ হবার প্রার্থনা উৎকীর্ণ রয়েছে : 'অসতো মা সদ্গময় তমসো মা জ্যোতির্গময় মৃত্যোর্মামৃতং গময়েতি' (অতুলচন্দ্র ৬৮৮)। ঔপনিষদিক এ প্রার্থনার প্রতিধ্বনি প্রমূর্ত হয় কায়সুল হকের হেমন্ত-বন্দনায় :

'হেমন্ত, তোমার শিশিরের জলে ধুয়ে দাও

আমার হৃদয়, ছুঁয়ে যাক

অমল প্রাণের ডাক

বিষণ্ণ আমাকে

বিদ্বেষের অন্ধকার থেকে নিয়ে যাক

আমাকে আলোর সমুদ্দুরে—'

('হেমন্তের লোকালয় ও আমি' ১-৬)

'তোমার ইচ্ছার ধ্বনি বেজে ওঠে হৃদয়ের তারে'

প্রেম, মানবিক সম্পর্ক, স্মৃতি, নষ্টালজিয়া, নিঃসঙ্গতা কায়সুল হকের কাব্যের প্রসাদ-মাধুর্যকে করেছে প্রগাঢ়। কৈশোরোত্তীর্ণ কালে যে সঙ্গিনীকে নিয়ে কবি চেতনার সিঁড়িতে পা রাখেন তাকে সহসা মনে হয় 'অপ্সরী', কবি-সৃষ্ট 'প্রতিমা অপরূপ'; সে 'বশীকরণের মন্ত্র। কবিতার জন্মদাত্রী'। কবি উ পলদ্ধি করেন 'প্রেম জন্ম দেয় এক নতুন সত্তার/ নারীকে বুঝতে শুরু করি। বৃক্ষের মতন প্রাণদায়িনী সে—বিশল্যকরণী'। এ মঞ্জরিত নারীর চিত্তে প্রতিধ্বনিত হয় 'প্রেমের মহার্ঘ রূপময় ধ্বনি', কবি তার লালিত্য-তত্ত্ব-মাহাত্ম্য উন্মোচন করেন:

'বৃক্ষের স্বভাব নিয়ে দেখি পত্রালির

প্রথম উন্মেষে যৌবনশ্রী;

কখনও আবার ফাল্গুনের দীপ্রতা শরীরে তার।

ইচ্ছার ধবল পালে লাগিয়ে হাওয়া

ডেকে নেয় প্রিয়তমা নারী হৃদয়ের কারুকাজে

বিশল্যকরণী নিত্য হয় মুকুলিত।

এদিকে প্রথার বেড়া ভেঙে প্রেম দেখি হৃদয়মথিত গান—

প্রেয়সীর হাতের গোলাপে যেন বিনম্র চুম্বন।’

('জীবনের খড়কুটো' ২৬-৩৪)

প্রিয়চিকীর্ষু নারীর সিঁথি 'কল্যাণের শিখা' ও 'মঙ্গলপ্রদীপ' রূপে কবির নিকট প্রতিভাত। 'সাহসিকতার প্রতাপলালিত মন' নিয়ে নারী বন্ধু হয়ে ওঠেন বলে কবি হৃদয়ঙ্গম করেন, 'শরীর মনে পূর্ণ বিকাশই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বে আসীন করে...'। কবির স্মৃতি 3 অতীত বিধুরতা প্রধানত প্রেম-উৎসারিত 'কনক রোদের মতো' যে নারী 'আনন্দের নদী হয়ে ডেকে নিয়েছিলো একদিন' নিবিড় মমতায় আজো কবিকে 'ডাকে তার নরম আঙুল'। কবির 'পঞ্চাশ বছরের স্মৃতি' প্রাচীনতায় হারিয়ে যায় না :

'কত স্নিগ্ধ কিংবা রুক্ষ বাক্য আমরা বিনিময় করেছি বন্ধুতা নিয়ে।

নারী-পুরুষের আলাদা আলাদা সত্তা সেখানে অনুপস্থিত। রুচিশীল

সব কৃতি নতুন ভোরের সোনালি রশ্মি নিয়ে কম্পমান। মুহূর্ত অমরত্ব পেয়েছে

আলিঙ্গনে। আমরা পটুয়া হয়ে গড়ে নিয়েছি উভয়ের এমন মূর্তি

যেখানে বিবর্ণ কোনো রঙের ছোপ পড়েনি।

আমরা উভয়ে পেতে চেয়েছি সুন্দরের স্পর্শ—'

('স্মৃতি সব দুয়ার খুলে এসে দাঁড়ায়' ১৯-২৪)

স্মৃতিবিধুর কবি বন্ধু-রিক্ত পরিবেশে বিপন্নতা বোধ করেন। 'অত্যাগসহনো বন্ধুঃ' প্রেমাস্পদদ্বয়ের মধ্যে যিনি অপরের ত্যাগ সহ্য করতে পারেন না এরূপ স্বজন বিরল বৈকি! 'উদয়াস্ত ঘুরে ঘুরে সারাটি শহর' কবিও এমন কারো দেখা পান না 'যাকে নির্দ্বিধায় বন্ধু বলা যেতে পারে'। কবির নিকট সমগ্র পরিবেশ হয়ে ওঠে বিষাদাচ্ছন্ন; 'বিষণ্ণ মেয়ের চোখ' তখন 'ম্লান জ্যোৎস্নার ভেতর আকাশ'-এর প্রতিমান। প্রাতিস্বিক চিত্রকল্পেও কবির করুণ একাকিত্ব হয় স্ফুটিত, 'আমার দুঃখের সরোবরে আমি একা'। কবিতা, কবির বিবিক্ত প্রহরের পরম সখা। 'জীবনের গভীরে আরেক/ জীবনকে উপলদ্ধি' করার জন্য কবি সার্বক্ষণিকভাবে শরনাপন্ন হন এ সখার।

'সময়ের কালো দাগ হতেছে উজ্জ্বল সম্ভবত'

'জীবনের থরে থরে' সজ্জিত 'মঙ্গলের আল্পনা'-র প্রতি কায়সুল হকের সানন্দ দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকলেও ইহজাগতিক অমঙ্গলবোধ তাঁর চেতনাকে নিষ্কৃতি দেয় না। মঙ্গল-অমঙ্গলবোধ ও আশা-নিরাশার স্বাভাবিক দোলাচলতা কবির আধুনিক জীবনবোধকে উন্মোচন করে। কবি কালের 'রুগ্ন বোধির ভিতরে' আশোকের অবলুপ্তির কথা প্রচার করেন। 'মানুষের প্রাণের শিকড়ে' তিনি প্রত্যক্ষ করেন কীটের আবাস যার 'গাঢ় চিহ্ন' সর্বত্র পরিব্যাপ্ত বলে 'নিমেষেই গুঁড়ো হয় আশার মিনার'। ফাল্গুনের সজীবতা-শূন্য ধূসর শহরে দৃশ্যমান হয় 'সুতীক্ষ্ণ নখরে দীর্ণ প্রাণের মৃণাল'। ইয়েটস তাঁর কবিতায় তমসা-ঘোর রাজনৈতিক নৈরাজ্যের রূপকল্প চিত্রণের পাশাপাশি খ্রিস্টীয় মূল্যবোধের বিপ্রতীপ পরিস্থিতি ও জান্তব দেবতার অভ্যুত্থান কল্পনা করেছেন :

Things fall apart; the centre cannot hold;

Mere anarchy is loosed upon the world,

The blood-dimmed tide is loosed and everywhere

The ceremony of innocence is drowned;

('The Second Coming' 3-6)

ইয়েটসের মতো কায়সুল হকও পতনচিহ্নিত কালবেলার শব্দচিত্র অংকন করেন :

মানুষের হৃদয়ের থেকে প্রেম প্রীতি ভালোবাসা,

অবলুপ্ত আজ, উল্লসিত সুন্দরের হন্তারক;

অনাথ পৃথিবী শুধু শোনে সর্বনাশা

ঘন্টার বিরামহীন ধ্বনি।

নেই ত্রাতা, নেই কোনো সাহসী নায়ক;

দূষিত রক্তের চাপে স্ফীত আজ প্রতিটি ধমনী;

গলিত শবের মতো

সুস্থতা ভাগাড়ে আছে প'ড়ে;

('কালবেলা' ১-৮)

কায়সুল হকের এ অমঙ্গলবোধ নির্বেদ-উৎসারিত, 'সযত্নচর্চিত', 'মাত্রাজ্ঞানরহিত' ও অপ্রতিকার্য নয়। শার্ল বোদলেয়ারের মতো নিশ্চয়ই তাঁর প্রতীতি জন্মে না যে, 'The strings that move us are held by the Devil! We find charm in disgusting things; every day we go a step further down towards Hell, withouth horror, through stinking darkness: (Baudelaire 4). বোদলেয়ার স্বর্গ-সন্ধানী নন; কায়সুল হক 'অন্তরের অমল নির্দেশ'-এ স্বর্গের স্বরূপ অন্বেষণ করেন। শেলির মতো তিনি আশাবাদ পোষণ করেন, 'এইতো ক'দিন পর। কাঙ্ক্ষিত বসন্তকাল কড়া নেড়ে এসে দাঁড়াবে, ভাস্বর/ স্বপ্নরা মেলবে পাখা'। তিনি অসন্দিগ্ধ যে, 'অমল নদী এক ধুয়ে দেয় গ্লানি গভীর গভীরতর ভালোবেসে'। তাঁর 'শাণিত আলোর নদী' অভীপ্সিত 'প্রাণের বিকাশ'-কে করে সুনিশ্চিত।

'জীবনের মতো দেশ'

দেশ-সমাজ, মাটি-মানুষের জন্য কায়সুল হকের মমত্ববোধ ও অনুচিন্তন অতলস্পর্শী। বিজয়-পূর্ব প্রবাসকালে উদ্বাস্তু কবি যখন 'স্মৃতির আগুনে ক্লেদ পুড়িয়ে-পুড়িয়ে' নিজেকে নির্মাণ করতে থাকেন তখন 'উজ্জ্বল বিজয়' সম্পর্কে তিনি হন সুনিশ্চিত। 'লাশের ভেলা' সজ্জিত 'ন'মাসের দীর্ঘবেলা' পেরিয়ে 'জীবনের ঋদ্ধ কাল'-এ সারা দেশ হয়ে ওঠে 'একমনপ্রাণ' যা 'জীবনকে আশীর্বাদের মতন' সাতপাকে ফেলে বেঁধে। কবি মেহনতি মানুষের উন্নয়নের জন্য সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়ে চিন্তামগ্ন হন। 'আঁধারের হিম' ও যুক্তিহীনতার প্রসারতার কারণে তাঁর দৃষ্টিতে সামাজিক অগ্রগমন হয় ব্যাহত; 'ফলে আবিলতায় ঢাকা পড়ে/ আমাদের পরিপার্শ্ব।/ মনের আনন্দে আমরা জতুগৃহে প্রবেশ করতে থাকি'। কবি বিশ্বাস করেন 'বোধের প্রসার না ঘটলে' এবং 'প্রতিবাদী না হলে সমাজকে পাল্টানো যায় না'। সুভাষ মুখোপাধ্যায় উদ্যত 'সঙিন' এবং 'বাঁধার দেয়াল' উপেক্ষা করে 'দুহাতে অন্ধকার ঠেলে ঠেলে' যেমন 'দুরন্ত দুর্নিবার শান্তি' উপহার দেয়ার শপথ গ্রহণ করেন (সুভাষ ৪১) কায়সুল হকও তেমনি অন্ধকার অতিক্রম করে জীবনের মুক্তি অন্বেষণের অভীপ্সা ব্যক্ত করেন :

আমি সব বাঁধা ডিঙোতে ডিঙোতে

সমাজের নতুন রূপের কাছে পৌঁছাতে চাই

যেখানে জীর্ণতার গ্লানি স্পর্শ করবে না।

যেখানে অন্ধকারের বিবর হা মেলে নেই।

আন্দোলনের পর আন্দোলন

অন্ধকার সরানোর আন্দোলন।

মনের সব দরজা জানালা খুলে রাখার বহতা নদী

আমাকে পৌঁছে দেবে মানুষের মহামিলনে।

('নতুনের সন্ধানে সুমনের গান' ১৮-২৫)

'রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারণ ক'রে বুঝে নিই পরিপূর্ণতার রূপ'

শৈল্পিক, ঐতিহ্যিক ও তাত্ত্বিক প্রয়োজনে চতুর্থ দশক থেকে রবীন্দ্রনাথ দুষ্পরিহর হয়ে উঠেছেন। দেবেশ রায়ের স্পষ্টোক্তি, 'এই ঘটনাটি আমরা সব সময় খেয়ালে রাখি না যে রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে যাঁরা কাব্যকল্পনায় ও প্রকরণে বা উপন্যাস নির্মাণে বা মননসংগঠনে রবীন্দ্রনাথকে পেরোতে চাইছিলেন, তাঁরাই রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাকে আমাদের শিল্পচর্চার ও জীবনযাপনের ঐতিহ্যে পরিণত করার জন্যে সেই চল্লিশের দশক থেকেই লেখালেখি করে আসছেন' (দেবেশ ৩১২)। রবীন্দ্রনাথকে পরিগ্রহণের ক্ষেত্রে যাঁরা অম্লান প্রয়াস গ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, হুমায়ুন কবির, অন্নদাশঙ্কর রায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ কবি-মনীষীগণ অগ্রগণ্য; এঁদের সঙ্গে কৃতবিদ্য কায়সুল হকের দীপিত প্রয়াসও তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রতীত হয়। বিষ্ণু দে রবীন্দ্রনাথকে '... প্রায় ঐশ্বরিক প্রকৃতির মতো, বছরে বছরে ঋতুতে ঋতুতে সংকট ও উন্মোচনের আনন্দরূপেন বিভাসিত শত রূপে' প্রত্যক্ষ করেন (বিষ্ণু ২৩৯)। কায়সুল হক রবীন্দ্রনাথকে 'বাঙালি সংস্কৃতির বিধাতা', 'সর্বার্থ আধুনিক মানুষ' 'মনুষ্যত্বের অতন্দ্র প্রহরী' ও 'বৈশ্বিক মানব' হিসেবে মূল্যায়ন করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর ঐকাগ্রের সকারণ ব্যাখ্যা, 'মানুষের সপক্ষে তথা মানবিকতার পক্ষে তাঁর বক্তব্যের স্পষ্টতা এবং আধুনিক মননশীলতা ও শিল্পবোধই তাঁর প্রতি আমাদের পক্ষপাতিত্বের প্রধান কারণ' (কায়সুল স্বদেশ, সংস্কৃতি ৮৩)। রবীন্দ্রনাথের 'নিরুপম বাগানে' কবি কায়সুল হকের 'ভ্রমণের শেষ নেই'। কবির সনম্র স্বীকৃতি:

রবীন্দ্রনাথের হাত ধ'রে হাঁটতে হাঁটতে

আমরা তো চিনতে শিখেছি

গাছ ফুল পাখি গুল্মলতা

চিনতে শিখেছি মাস ঋতুর চেহারা।

('পুরোহিত হে বৈশাখ' ৭-১০)

রবীন্দ্রনাথের দাক্ষিণ্যে নিসর্গের রূপবৈচিত্র্যই শুধু উন্মোচিত হয় না, 'চড়াই উৎরাইয়ের সমারোহ', অন্ধকার ও 'আলোর নাচন' সংবলিত দ্বন্দ্বসংকুল জীবনের পূর্ণ স্বরূপও হয় উদ্ঘাটিত। জীবন যে 'কোনো সরল রেখায় আঁকা পট নয়' রবীন্দ্রচেতনা তা সহজেই করে পরিস্ফুট:

'...তিনিই তো এত রকমের

শিল্পিত সম্ভার দিয়ে দন্দ্বে ফেলে দিয়েছেন আমাদের।

আর তাই তাঁকে না হলে আমাদের এক মুহূর্ত চলে না;

সুকুমার বোধের যে শিরোমণি তিনি।

সব জাগরণের ভূখণ্ড তিনি; আমাদের সত্তার বিশাল মহীরুহ।'

('আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথ' ১৪-১৮)

কবিতার মতো প্রবন্ধেও তিনি অভিন্ন প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, 'রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতিসত্তার ভূখণ্ডের প্রায় সবটাই জুড়ে বিরাজিত। ঈদৃশ সর্বত্রগামী প্রতিভার সন্ধান পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। নানা পরিপ্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যাবে' (কায়সুল স্বদেশ, সংস্কৃতি ৩২)। কায়সুল হক রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কর্মে খুঁজে পান 'আমাদের সংস্কৃতির এমন ঋত্বিককে যিনি মগ্ন থেকেছেন আমাদের অর্থাৎ বাঙালি জাতির স্বপ্নলোক তৈরীর কাজে' (কায়সুল স্বদেশ, সংস্কৃতি ১৬)। তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুবর্তী হয়ে স্বীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের হীরকদ্যুতিতে স্বদেশ ও ভাষার নব উদ্ভাসন কামনা করেন :

আমার স্বদেশ

আমার ভাষা নতুনভাবে নির্মিত হোক রবীন্দ্রনাথের

অনুশাসন মেনে;

('নুতনের সন্ধানে সুমনের গান' ৩৫-৩৭)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন