কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

তপনকর ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


শীৎকার

ছোট ছোট লাফ। ছোট লাফে ছোট বাধাগুলো ঘোচানো। এই কর, সেই কর— এটা আনো, সেটা আনো বা, এখানে যাও, সেখানে যাও।

কিছুই করা হয় না। যাওয়া হয় না। আনতেও ইচ্ছে করে না। কাজ জমতে থাকে– সেই ঝকমারিতে হাজার ফ্যাকড়া। জমিয়ে রাখা কাজে ফ্যাসাদ বাড়ে।

পুরনো খবরের কাগজ স্তুপাকার। সে-সব রাখবার জায়গা ছাপিয়ে পড়ার টেবিল ছাপিয়ে ড্রেসিং টেবিলের নিচে, সিঁড়ির নিচে।

কিছুই না, লোক ধরে কাগজগুলো বিক্রি করতে হবে। রবিবার আসে, যায় — অর্ণবের সময় আর হয় না। বৈশালীর নিয়মিত তাগাদয়, সে বলেই যায় — ঠিক সামনের সপ্তাহে। এ-ভাবেই সপ্তাহের পর সপ্তাহ।

অ্যাডেনিয়ামের টব পাল্টাতে হবে। গোড়া এতটাই মোটা, যে কোনদিন টব ফাটিয়ে দেবে। নতুন বড় মাপের টব কেনা, তার আগে সার মাটি তৈরি, তারপর পুরনো থেকে নতুন টবে গাছ বসানো — এত ঝামেলা সামলে ওঠা অর্ণবের ক্ষমতার বাইরে।

অথচ বাধাগুলো না টপকালেই নয়।

সব থেকে বড়ো বাধা বই-এর তাক আর পড়ার টেবিল। অগোছালো, এলোমেলো বই, খাতা, পেন। সময়ে অসময়ে, সুযোগ পেলেই বৈশালী এই নিয়ে অভিযোগ করবে — কী করেছ জায়গাটা। একটার উপর আরেকটা। বইগুলো তো বই-এর তাকে রাখতে পার। তারপর বৈশালীর ঝাঁঝ বাড়ে — তাক ঠাসা বইয়ের দিকে চোখ রেখে বলে, আর একটা বইও কিনবে না। এত বই, পড় না তো সব…

ঝামেলা ঝঞ্ঝাটের তালিকায় এক নম্বরে বাজার করা, যা এড়ানো যায় না। যদিও অর্ণবের না-বাজারের দিন বেশি, তারই মধ্যে হাঁ-বাজারের দিন যত এগিয়ে আসে — এটা নেই, ওটা নেই বা, আলু মেরে কেটে একদিন, মাছ তো হবেই না —অতএব নিরামিষ। বৈশালী হরিমটরের ভয় দেখালে অর্ণবকে বাজারের থলি হাতে বেরোতেই হয়।

তবু ছোট ছোট লাফে ঝামেলা মেটাতে ভালোবাসে অর্ণব। ওদিকে বৈশালী চরম লাফে, সদা সর্বদা। ধুমধাড়াক্কা মার কাটারি কিছু একটা। বকেয়া রাখা বৈশালীর অভিধানে নেই।

অনেক শেষ না হওয়া গল্প আছে অর্ণবের। ভাঙাচোরা সে-সব গল্প এগোতে না এগোতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে। সে-সব গল্প শেষ হয় না, অথচ সুযোগ আছে এই ভরসায় হারিয়েও যায় না। টুকরো টুকরো না-গল্প, না-কিছু হয়ে অর্ণবকে কাহিল করে তোলে।

কাকুর গল্প যেমন। কখনো শেষ হয় না। অথচ শুরু হলেই আনন্দে ভরপুর। তারপর হঠাৎই মাঝপথে উধাও। মাঝে মাঝে ঝলক দিয়ে ওঠে। অর্ণব তখন আলোয় আলোকিত। আবার হঠাৎ হারিয়ে যায় কাকু। হারানোর কষ্ট তখন তার গলা থেকে বুকে। সে হাওয়া টানতে পারে না। তার শরীর কাঁপতে থাকে।

ছোট ছোট কাজের সঙ্গে এই টুকরো টুকরো গল্পগুলো অর্ণবের সমস্যার কারণ। সংখ্যায় এরা বেড়েই চলেছে। কাজগুলো যা হোক শেষ হয়, নিখুঁত না হলেও, বৈশালীর মনোমত না হওয়ায় এবং তার জন্য খিটিমিটি হলে-ও, অর্ণব ব্যাপারটা থেকে বেরোতে পারে। সে ধরেই নিয়েছে, সীমাহীন এই সমস্যার সমাধান নেই, একটু অসুবিধে, একটু খারাপ লাগা, তবু মেনে নিতে হবে।

কিন্তু গল্পগুলো তাকে সমস্যায় রাখে। ভালো হত যদি স্মৃতি থেকে কিছু মুছে যেত। পাঁচ ছ লাইনের গল্পগুলোর শুরু আছে, তারপর থম মেরে জুবুথুবু — আর এগোতে পারে না —সংখ্যায় অগুনিত — এরা না থাকলে অর্ণব কেমন থাকত — হয়তো অন্য এক অর্ণব বা, এই অর্ণব আরও বুদ্ধিমান হয়ে, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন এবং ধাপে ধাপে উপরে ওঠার সিঁড়ির ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা থাকা একজন, বৈশালী যা চেয়েছিল এবং পায়নি, বৈশালীর অনেক বন্ধুরা যা পেয়েছে — একজন সফল মানুষ, যা সে চেষ্টা করলেই, যা সে পারেনি  শুধুমাত্র আলস্যের জন্য – যারা এই কথাগুলো বলে, বৈশালী বা তার বন্ধুরা বা আত্মীয় স্বজন — তারা কেউ অর্ণবের ছোট ছোট গল্পগুলোর কথা জানে না। জানে না এদের হঠাৎ হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ওঠার কথা আর গল্পে  দু চার লাইনের বেশি এগোতে না পারার কথা। এ-কারণে তার স্নায়ু বিপর্যয়। অবসাদ। সেই কবে থেকে ওষুধ। ডাক্তারের ঠিক করে দেওয়া ওষুধের মাপ— কখনো কম, কখনো বেশি, নিয়মিত চেক আপ। এটা দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা, শর্টকাট নেই। খেতেই হবে ওষুধ, যেতেই হবে ডাক্তারের কাছে।

ডায়াবেটিস বা থাইরয়েড গ্রন্থির অসুখে তো এ-রকমই, ঊর্ধ্ব রক্তচাপ বা, হার্টের সমস্যা— ওষুধ ছাড়া একদিনও না— যতদিন বেঁচে থাকা — তো জীবনভোর এই ওষুধ আর ডাক্তার তো অর্ণব একা নয়— হ্যাঁ, তার যদিও স্নায়ু বিপর্যয়, যে কারণে অবসাদ— কিন্তু এটা স্বাভাবিক। তাদের অবশ্য ছোট ছোট কাজ জমে পাহাড় হয় না অথবা অনেক শেষ না হওয়া গল্পে তারা অসহায় বোধ করে না।

গল্পে কাকু আসে আবার চলেও যায়। নতুন ক্ষত তৈরি হয় না আর। শুরুর ক্ষত আর বোজেনি। নতুন কিছু  হবার নেই। ফলে পুরনো ক্ষতে শুধু স্মৃতির প্রলেপ।

অথচ কাকু মানেই আলো। সে দিন বা, রাত, সকাল অথবা বিকেল — যা হোক, রাতের অন্ধকার আলো হয়ে উঠতে পারে। বর্ষার মেঘে ঢাকা আকাশে হাজার ওয়াটের চোখ ঝলসানো আলো!

কাকুর স্নায়ুরোগ। অবসাদ। মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের রসায়ণে ভারসাম্যের অভাব। অবসাদ সহ্য করতে না পেরে কাকু হারিয়ে গেল। অর্ণবকে বলেছিল, একদিন এমন ভাবে চলে যাব, দেখবি কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না।

সে কথা অর্ণব কাউকে বলেনি। যাবার আগে কাকু তাকে দুটো জিনিস দিয়েছিল। কাকুর কবিতার খাতা আর একটা সাদা খাম। খামের ভিতর একটা চিঠি। এক নারীর প্রেমের সম্পর্ক ছেদ করতে চাওয়ার চিঠি, মানসিক ভারসাম্য হারানো একজন কীভাবে সেই নারীর কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল তার বর্ণনা।

মাত্র একবার, আর কোনদিন অর্ণব সেই চিঠি পড়েনি। কাকু চলে যাবার পর, কাকুর কবিতার খাতা অবশ্য খুলেছে।

কাকু অর্ণবকে বলেছিল, একদিন তুই আমার মতো কবিতা লিখবি। তোরও নার্ভের গোলমাল হবে।

কাকুর কন্ঠস্বর চিল সরু আর মিহি।সুর করে নিজের কবিতা পড়ত।স্মৃতি থেকে বেশি।গলা থাকত নিচু পর্দায়। বন্ধ দরজার ওপাশে ব্যঙ্গ আর বিরক্তি। হুল বেঁধানো কথা— গরম বেড়েছে। তাল মিলিয়ে পাগলামি। অথবা, ভাতের চিন্তা নেই — চালিয়ে যা আঁতলামি —

আলোর গল্প আরো একটা — তিন্নি। কিন্তু সে-টা এসেই চলে যায়। বাকি সব গল্প অন্ধকারের। বিদ্রুপ, হেনস্থা, পরিহাস আর অপমানের গল্প। একটা শুরু হতে না হতেই অন্ধকার আর একটা গিলে নেয়। একটার পরে একটা। ঘন অন্ধকারে ডুবে যেতে তাকে অর্ণব। তখন হয়তো সে মাছ কিনছে। রূপোলী পার্শে বা ডিম ভরা ট্যাংরা— বৈশালীর পছন্দ। বৈশালী প্রতি মুহূর্তে বোঝায়, কীভাবে সে ঠকে যাচ্ছে। সাবধান করে। মাছ কেনার সময় দাড়িপাল্লার দিকে নজর রাখতে বলে।

সেই দাড়িপাল্লার একদিকে ট্যাংরা, কালো পিচ্ছিল, জ্যান্ত। পাঁচশো গ্রামের বাটখারা অন্যদিকে।

দাড়িপাল্লার দু দিকে চোখ রেখে সতর্ক হবার চেষ্টা চালায় অর্ণব। পারে না। তার চোখ একদিকের কালো পিচ্ছিল অন্ধকারে আটকে যায়। আর তখনই কালো ধোঁয়া।

এতক্ষণ যা হোক, সামলাতে পারছিল। ছোট ছোট অন্ধকারের সাথে তার লুকোচুরি ছিল। কিন্ত এত বড়ো আকৃতির কালো ধোঁয়া থেকে বেরোতে পারে না। মাথা ঘুরে পড়ে যাবার সময় হাতের থলির কথা মনে পড়ে। থলির ভিতরের ট্যাংরারা তার টলমলে অবস্থা থেকে উদ্ধার করে। এখানে কিছু ওলট-পালট মানেই বৈশালীর অশান্তি। এই বিপদে সে কাকুর শরণাপন্ন হয়। একটু আলোর জন্য — কাকুর সুরেলা স্বরের কবিতা শুনতে চায়। শোনার জন্য সে ছটফট করে।

আর তিন্নি। পাশের বাড়ির তিন্নি। ছোট থেকে একসাথে। তিন্নির ক্যানসার— ও-ই বয়সে।রোগ ধরা পড়ার পর মাত্র চার মাস— তিন্নি চলে গেল। তার আগে মাঝে মাঝেই জ্বর। হায়ার সেকেন্ডারিতে ভর্তি হয়েও স্কুলে একদিনও না। তার জ্বরতপ্ত ঠোঁটে আঙুল রেখে তিন্নি  অর্ণবকে বলেছিল, আমি তোকে ভালোবাসি। তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না।

অর্ণব ভয়ে কাঁপছিল। কোনো রকমে বলতে পেরেছিল, পড়াশোনা শেষ করে…

তিন্নির ফ্যাকাশে ঠোঁটের স্পর্শ আজও তার আঙ্গুলে। এই স্পর্শ অন্ধকার থেকে অনেকবার অর্ণবকে বের করে এনেছে।

তিন্নির গল্পই খুব ছোট, শুরু হতে না হতেই হারিয়ে যায়। এ-ই গল্পটার আরম্ভ আচমকা আর যে কোন অবস্থা  থেকে, মহূর্তের উদ্ভাসে অর্ণবকে মুক্তি দেয়। বাকি যা কিছু, বিরাট শূন্য, সেখানে খড়কুটোর মতো ভেসে থাকে তিন্নির, 'তোকে ভালোবাসি 'কথাটা।

আজ পরাশর আসবে। রাতে নেমন্তন্ন।

পরাশর বন্ধু সে-ই স্কুলবেলা থেকে। স্কুল ছেড়ে যেতেই সে ব্যবসায়। পেল্লায় বড়লোক। কোটি টাকার টেন্ডার, লেটার অব ক্রেডিট, ব্যাংক গ্যারান্টি। গল্পকথা নয়, তার প্রমাণ, এধার ওধার ছড়ানো ছিটানো যেটুকু, তা না কী হিমশৈলের চূড়া মাত্র আর তাতেই বৈশালীর চোখ কপালে। অর্থ বা বিত্তে এই মাপের মানুষ, সে যতই অর্ণবের ছোট বয়সের বন্ধু হোক না কেন, তাদের সঙ্গে সমানে সমানে — বৈশালী উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে না পেরে বলেছিল, আপনাকে দেখে মানুষের শেখা উচিত।

পরাশর তিনমাস আগে শেষ এসেছিল। আর ছিল নীলাব্জ— অর্ণবের  কবিবন্ধু। এতদিনে অর্ণবের দুটো মাত্র কবিতার বই, নীলাব্জর বইসংখ্যা পনেরো ছাড়িয়েছে। ছোট-বড়ো-মেজ-সেজ সব ধরনের পত্রিকায়তার সাবলীল যাতায়াত। অনায়াস ও দুরন্ত গতি তার। কয়েকটা পুরস্কারও পেয়েছে। দু-তিনবারের সাক্ষাতেই সে বৈশালীর নীলু।

দু-তিনমাস অন্তর খানাপিনার ব্যবস্থা তার বাড়িতে। গত ছ-মাসে যদিও দু-বার এবং আজ তৃতীয়বার, কিন্তু প্রস্তাব আছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্যদের বাড়িতে হবে।

আজ সকালে পড়ার টেবিল, বই আর খুচরো কাগজ গোছাতেই অনেকটা সময়। ওদিকে বৈশালী এক টুকরো কাপড় নিয়ে ঘুরছে। ধুলো দেখলেই ঝাঁপিয়ে সাফ।

আজ পরাশরদের জন্য বিশেষ বাজার— তাই পরাশর অতিরিক্ত সতর্ক। কিন্তু মুরগির মাথা ধড় থেকে আলাদা হতেই অর্ণবের ঠিকঠাক থাকাটা হোঁচট খায়। এক টুকরো অন্ধকার তার মাথার ভিত্তিতে, এক কোণে ঢুকে পড়ে।

অর্ণব ঝুঁকি নেয় না। সরাসরি কাকুর ঘরে ঢুকে যায়।

হুইস্কির বোতল সাজিয়ে কাকু। গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। মাঝে মাঝে কবিতা, কাকুর সুরেলা কন্ঠের উচ্চারণে অর্পণ কেঁপে ওঠে।

এই কবিতা, এই উচ্চারণে সে কতবার শুনেছে। তার ছোটবেলায় কিছুই সে বুঝত না, কিন্তু আকর্ষণ ছিল। অন্ধকার তার জীবনে অনেক পরে, একদিন চাপ চাপ অন্ধকারে সে-ও ঢুকে পড়বে। কাকু তো বলেই দিয়েছিল, 'তোর দশা আমার মতো হবে।

পরাশর হা হা করে হাসছিল তার বিদেশ ভ্রমণের গল্পের সময়। হাসতে হাসতে বলছিল সেই সব রঙিন পৃথিবীর কথা। দু তিনটে দেশ বাদে পৃথিবীর সবটুকু চেটেপুটে নিয়েছে। অর্ণবকে বলেছিল, যাতায়াতের ভাড়া যোগাড় কর, বাকি দায়িত্ব আমার।

বৈশালী তখন জড়ানো গলায়— এবার কিন্তু যাবই যাব। কোন কথা শুনব না। অন্তত সিঙ্গাপুর বা মালেশিয়া।

ওদিকে নীলাব্জ তার প্যারিস ভ্রমণের গল্পে। লন্ডন, ফ্রাঙ্কফুর্ট দু'বার। বাংলাদেশ তো যখন তখন। আর অর্ণবের পাসপোর্ট পর্যন্ত করানো হয়নি।

 আলো থেকে অন্ধকারে অর্ণব। ভালো থেকে খারাপ। টেবিল থেকে গ্লাস তুলে নিয়েছিল। একসময় সে-ও মাঝে মধ্যে, যখন নিষেধ ছিল না, অ্যান্টি ডিপ্রেশন ওষুধ খেতে হত না, সেই দিনগুলোতে সস্তার রাম— অর্ণব উপভোগ করত।

হাল্কা সোনালী হুইস্কি এক চুমুকে। গ্লাস শেষ করে হাঁপাতে হাঁপাতে অনেকগুলো অবাক চাহনি অগ্রাহ্য করে আরও এক গ্লাস। আবার এক চুমুকে।

অন্ধকার কেটে আলোয় আলোকিত ফাঁকা মাঠ। মাঠের শেষে ত্রিকুট পাহাড়ে সে আর বৈশালী। রুক্ষ পাথরের খাঁজে খাঁজে বৃষ্টির জমা জলে লাল নীল মাছ। আাকাশ দেখা যাচ্ছে না এতটাই ঘন উঁচু উঁচু গাছ। সূর্যের আলো ছিল না, তবু হাজার ওয়াটের হাজার হাজার আলোর ঝলকানি–অর্ণবের চোখ বুজে এসেছিল।

অর্ণব আঙুল দিয়ে চোখের পাতা টেনে ধরে কিছু দেখতে চাইছিল, কিন্ত পারেনি। সে কিছু শুনতে চাইছিল না, তবু শুনতে পারছিল। হো হো করে হাসি। পরাশর হাসছে, নীলাব্জ হাসছে। পাড়া প্রতিবেশী, তার সহকর্মীরা, পরিচিতজনেরা—সবাই হাসছিল।

অর্ণবের গলা থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বের হচ্ছিল। সেই গোঙানি কেউ শুনতে পায় না। যেমন তার অন্ধকার কেউ দেখতে পায় না, বুঝতে পারে না।

তারই মধ্যে অর্ণব চেষ্টা করছিল ছোট ছোট বাধাগুলো পার হতে। কবিতার লাইনগুলোই তার ভরসা। কত শব্দ উঠে আসে অন্ধকার থেকে। বিষণ্ণ সেই সব শব্দ তাকে বিপন্ন করে তোলে।

অর্ণব আলো খুঁজছিল। আদিগন্ত ছড়ানো আলোয় স্নান করে ঘুমের অতল থেকে জেগে উঠতে চাইছিল। জেগে উঠে সে কিছু দেখতে চাইছিল। কিন্তু দেখতে পায়নি। শুধু শুনতে পাচ্ছিল, আশ্লিষ্ট শীৎকার। কামনাতুর সেই স্বর, কাছে না দূর্বল, হামাগুড়ি দিয়ে কোথাও একটা যাওয়ার চেষ্টা করতেই নরম আলোর স্পর্শ  নিয়ে তিন্নি।

তিন্নি বলেছিল, যেও না— ওখানে আরো অন্ধকার।

বড়ো না মাঝারি— মাছ কাটতে গিয়ে প্রশ্নটা অর্ণবকে। অর্ণব কাকুর দিকে তাকিয়ে মনে করতে চেষ্টা করে, বৈশালী কী বলেছিল। কাকু এগিয়ে আসে। অর্ণবের হয়ে উত্তর দেয়, বড়ো। প্রত্যেক টুকরো একশ গ্রাম।

অর্ণব  অবাক হয়ে বলে, জানলে কী করে? বৈশালী তো এরকমই বলেছিল।

কাকু হাসে। বলে, অত  ঢকঢক করে খাবি না। ছোট ছোট চুমুকে সময় নিয়ে শেষ করবি।

থলে ভর্তি বাজার নিয়ে ফেরার পথে অর্ণব তিন্নির সঙ্গে দেখা করে। তিন্নি ঘুমোচ্ছিল। অর্ণব ওর সাদা ফ্যাকাশে ঠোঁটে আঙুল রাখে। তিন্নি হাসে। বলে, ভয় পেও না। আমি তো আছড়ে। আজ সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকব।

অর্ণব তিন্নিকে চুমু খেতে চায়। তিন্নি সাবধান করে।—এখন না। মা বাবা পাশের ঘরে। যদি চলে আসে। কিছুদিনের মধ্যেই ভালো হয়ে উঠব। তখন যত খুশি—

অর্ণব কথা শোনে না। তিন্নিকে বুকে টানে। তিন্নি খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে, আমি তো কথা দিয়েছিলাম। এত তাড়া কেন?

লাল পাপড়িতে অর্ণব ঠোঁট ছোঁয়ায়। খুব সাবধানে। যেন ভেঙে না যায়।

শিশির ভেজা পাপড়ি থরথর করে কেঁপে ওঠে। তিন্নি বলে, আলো নিভিয়ে দাও।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন