কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

অদিতি ফাল্গুনী

 

সমকালীন ছোটগল্প


বারগির, রেশম ও রসুন বোনার গল্প

(১)

‘কি আর বলি ফৌজদার হুজুর! বীরভূমে, ভাগিরথীর পশ্চিম কিনারে, এই অধমের একখানা আদং ছিল। বীরভূম, মালদা, বর্দ্ধমান আর রাজশাহীর যত রেশম চাষীদের বানানো রেশমি শাড়ি আর ধূতি এই অধমের আদংয়ে চালান হয়ে এসেছে বৈকি। বীরভূম থেকে রাজশাহী ত’ বেশি দূর নয়। রাজশাহী আর রংপুরেও চাষা বেটিরা এন্ডির গুটি কাটে বেশ। এণ্ডির রেশমপোকা পালতে আর পরে গুটি থেকে সূতা কাটা চাষা মাগিদের যেন ছেলেকে মাই দেওয়ার মতো সহজ কাজ!  কিšত্ত এই বারগিররাও এলো আর গ্রামকে গ্রাম সব মানুষ শুণ্য হয়ে যাচ্ছে। আমার এত বড় আদংটা ফাঁকা হয়ে গেল? হরি হরি! না আসে রেশম চাষী, না আসে এন্ডির কাপড় হাতে তাঁতী বেটিরা...মাইলের পর মাইল হাট নেই, বাজার নেই, খরিদ্দার নেই, তাঁতীও নেই, চাষাও নেই...সব যে উচ্ছন্নে গেল! বলি, নবাব আমাদের করছেটা কি? মা ভৈরবী কি তার কৃপা দৃষ্টি নবাবের মস্তক থেকে সরিয়ে নিয়েছেন?’

শ্রীজনার্দন দত্তের কপালে সকালের পূজার চন্দন তিলক এখনো মোছেনি। বরং শুকিয়ে চড়চড় করছে। চৈত্রের সকালে হাওয়া এই তেতে উঠছে ত’ আবার পর মুহূর্তেই ঈষৎ শীতল। সেই বিচিত্রগামী বাতাসে ধূতির উপর একটি রেশমের শালও উড়ছে জনার্দনের শরীরে।

‘ইয়ে...মানে বারগির বলতে কাদের কথা বলছেন? কিসিকো বাত শোচ মে আপ?’ গলা সামান্য কেশে প্রশ্ন করেন জনার্দনের সামনে বসা শ্রোতা মোহাম্মদ রেজা। তিনি হুগলি জেলার ফৌজদার। আসলে লাখনৌয়ের শিয়া মুসলমান হলেও ত্রিশ বছরের উপর হয় বাংলায় আছেন। প্রবল মদ্যপায়ী হিসেবে সুনাম বা দূর্নাম যাই থাকুক, মানুষ মন্দ নন। জনার্দন দত্ত মুর্শিদাবাদের অভিজাত শ্রেণীর একজন। ঠিক জগৎ শেঠের মাপের বড়লোক না হলেও বিত্তবান ত’ বটেই। আবার যৌবনে সেনাবাহিনীতে কাজের অভিজ্ঞতাও আছে। বীরভূমে তার রেশমের আদংয়ে খোদ আসাম থেকেও রেশম চাষী আর কারিগররা আসে। বীরভূম তার দেশের বাড়ি ও ব্যবসার কেন্দ্র হলেও মুর্শিদাবাদেও রেশমি বস্ত্র বিক্রির দোকান আছে তার। শোনা যায় খোদ নবাবের অন্দরমহলে জনার্দনের আদংয়ের রেশম বড় আদরের। জনার্দনের রেশম কুঠির কাপড় না এলে হারেমের খলিফারা বেগমদের কুর্তা সালোয়ারের জন্য কাপড় কাটার কাঁচি হতাশ হয়ে ছেড়ে দেন।

‘এই যা: আমরা বাঙালীরা ত’ আবার বারগিরদের বলি বর্গী! আমি মারহাট্টা দস্যুদের কথা বলছিলাম মহাশয়।’

‘তাজ্জব কে বাত। এ্যায়সা কভি নেহি শুনা। এমন তো আগে শুনি নি! বর্গীরা আবার বারগির হলো কবে? ’

‘ওদের নাম বারগিরই। মারহ্ট্টাা দেশের সেনাবাহিনীতে যারা সবচেয়ে নিচের সারির সৈন্য, তাদের মারাঠি ভাষায় বারগির ডাকে। আমি যৌবনে সে দেশে ছিলাম কিছুকাল। তাই জানি। আমাদের বাঙালী জিহŸায় এখন বর্গী নামটিই বেশি চালু হয়ে গেছে।’

মোহাম্মদ রেজার অভ্যাগতদের অভ্যর্ত্থনা কক্ষে এক কায়স্থ পরিচারক এসে জনার্দন দত্তের সামনে পেতলের গড়গড়া রেখে যান। রেজা সাহেব ইতোমধ্যেই অতিথির অনুমতি সাপেক্ষে আলাবোলায় ঠোঁট রেখেছেন। সবার জাত-ধর্ম রক্ষার দিকেই কড়া নজর তার। মুসলিম অতিথি এলে সুবিধা এই যে যেকোন মুসলিম পরিচারক এসেই অতিথিকে ধোঁয়া বা পানীয় পরিবেশন করতে পারে। কিন্তু হিন্দুদের এত জাত! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, সদগোপ, গন্ধবণিক...সে এক মুশকিলের বিষয়! সাদা রঙের ডাচ, ওলন্দাজ আর ইংরেজরাও আসে মাঝে মাঝে তার কাছে। ধূম্রের চেয়ে বোতলই তাদের কাছে অধিকতর প্রেমাষ্পদ।

‘তাই? এমনটা এই প্রথম শুনলাম মহাশয়! ভারি আশ্চর্য লাগছে!’ মোহাম্মদ রেজা একটি অলস হাই গোপন করে বলেন। কাল রাতে প্রায় ভোর রাত অবধি পান হয়েছিল। প্রায় রাতেই এমনটা হয়ে যায়। সেই পানের খোঁয়ারি কাটতে কাটতে পরদিন মধ্যাহ্ন লেগে যায়। কাজে-কর্মে মন দিতে কষ্ট হয়। কিন্তু, এ নিয়ে কোন বোধ নেই তার। পান করেন বলেই তিনি নিষ্পাপ। এই যে শ্রীজনার্দন দত্ত নামক লোকটি তার সামনে বসে...সে হয়তো সারা জীবনেও কখনো পান করেছে কিনা ঠিক নেই। কিন্তু পান করে না বলেই ত’ ঠান্ডা মাথায় রেশম চাষী আর তাঁতীদের রক্ত চুষে আর চন্দননগরে ওলন্দাজদের সাথে রেশম ব্যবসার বড় বড় চুক্তি লাভ আর কোটি টাকার মুনাফা করা এই লোকটির চেয়ে মোহাম্মদ রেজা কি মানুষ হিসেবে খারাপ? কভি নেহি। হতে পারে এই জনার্দন দত্ত প্রতিদিন গঙ্গা স্নান করে কপালে তিলক এঁকে তবে পথে বের হয়, তাতে কি? মোহাম্মদ রেজা নামাজ না পড়তে পারেন কি শরাবও একটু বেশি টানতে পারেন। তবু অন্য আর দশটা জেলার ফৌজদারদের মতো তিনি কখনো বিনা দোষে কারো গর্দান নিতে যাননি। কোন গরীবের ঘরে আগুন দেওয়ার কাজও করেন নি। তবে, যুদ্ধ করতে আজকাল তার আর ভাল লাগে না। ভাল লাগে এক পেয়ালা শরাব সামনে নিয়ে বসে ফার্সিতে রুবাই লিখতে কি গুনগুন করে গজলের সুর ভাঁজতে। যুদ্ধে বড় সিপাহসালারের খেতাব পাওয়া কি এই জনার্দনের মতো ব্যবসা করে অনেক টাকা কামানোর কোন ধান্ধাই তার নেই।

‘আশ্চর্যের আর কি হুজুর? শুনুন বলি। মারহাট্টার সেনাবাহিনীতে যারা উঁচুর দিকের সৈন্য তাদের অস্ত্র আর ঘোঢ়া তাদের নিজেদেরই। আর একদম নিচুর সৈন্য হলো এই বারগিররা। এদেরকে অস্ত্র আর ঘোঢ়া দিতে হয় খোদ সেদেশের রাজাকেই। নিচুর দিকের সৈন্য বলেই মায়া মমতা একেবারেই নেই এই বারগিরদের। একে ত’ গোটা মারহাট্টা দেশ একটা কঠিন পাথরের পাহাড়ে ভরা এলাকা। গাছ কি ফসল কিছুই চোখে পড়বে না আপনার। সেই আবহাওয়ায় মানুষগুলোও নিতান্ত খটমটে। আরে মেয়েমানুষেরা পর্যন্ত সেখানে শাড়ি পরে আমাদের পুরুষদের ধূতি পরার মতো মালকোঁচা মেরে। কথা বলে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে আর চড়া গলায়। কথা হলো এই বারগিররা এ কি শুরু করলো আমাদের দেশে এসে? নবাব আলীবর্র্দী খাঁ কি কোন প্রতিকারই করবেন না? চাষী, গেরস্থ, তাঁতী থেকে শুরু করে এই আমরা যারা একটু ব্যবসা করে দু'বেলা দু’টো অন্ন মুখে দিই...সবার ঘরই যে শ্মশান হতে চললো!’

‘বর্গী বা বারগিরদের সম্পর্কে এত কিছুই আমি জানতাম না। কিšত্ত, মহাশয়...আপনার দেশ ও রেশমের বড় আদংটি বীরভূমে। সেখানে আপনার দুই পুত্রই যতদূর জানি আপনার ব্যবসার দেখভালের বেশির ভাগ দিক সামলায়। আপনি নিজে থাকেন মুর্শিদাবাদে। হুগলির এই সামান্য ফৌজদার আপনাকে কি সেবা করতে পারে?’

‘কোন ফৌজদারই সামান্য নয় হুজুর!’ মাথা নাড়েন জনার্দন, ‘সে নবাব আলীবর্দী খাঁ সাহেবের রাজধানী মুর্শিদাবাদের ফৌজদার হোন আর যেখানেরই হোন না কেন? হুগলি কম কিসে হুজুর? কত বড় বন্দর! এখানে ডাচ, ওলন্দাজ আর ইংরেজ এক ঘাটে গড়াগড়ি খায়। এর ইজ্জতের সাথে কার তুলনা? আমরা ব্যবসা করি কিনা, বাংলার বড় বড় সব শহরেই আমাদের সাথে অনেক ক্ষুদে দোকানদার, রেশম চাষী, তাঁতী...সবার সাথেই আমাদের কারবার! সব শহরের ফৌজদারকেই আমাদের নজরানা দান কর্তব্য...’

এইটুকু বলে একটু বিনয়ে গদগদ হাসির ঝিলিকমাত্র উপহার দিয়ে গড়গড়া থেকে হাত সরিয়ে, গায়ের রেশমের চাদরের ভেতর থেকে একটি রেশমের থলে বের করে জোড় হাতে নমষ্কার করে মোহাম্মদ রেজার দিকে এগিয়ে দিলেন। ভেতরে ঝনাৎ করে উঠলো কি প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা? অন্য অনেক নিলর্­জ্জ ফৌজদারের মতো উপহারদাতার সামনেই থলে খুলে দেখতে তাঁর রুচিতে লাগে।

‘এর কোন প্রয়োজন ছিল না। তবু, এনেছেন যখন তখন আর কি বলি? শুকরিয়া! আলহামদুলিল্ল-াহ!’ জীবনের ত্রিশটা বছর বাংলায় বাস করা লাখনৌয়ের শিয়া মোহাম্মদ রেজা বিলক্ষণ ভাল বাংলা বলেন। এমনকি বাক্যের ভেতরে ফার্সি বা উর্দু শব্দ যত কম পারা যায় ব্যবহার করেন। একটা ভাষাকে তার মতো করেই, তার সমস্ত শব্দ সমেত বলা উচিত।

‘আজ বরং আমি উঠি। আরো কয়েকটা কাজ আছে। আপনারও ত’ দুপুরের বিশ্রাম নেবার সময় হয়ে এলো!’

‘না, আর একটু বসেন।’ ইঙ্গিতে হাত নাড়েন মোহাম্মদ রেজা, ‘মনে হচ্ছে বারগিরদের সম্পর্কে ভালই জানেন আপনি। আমি ত’ ফৌজদার হয়েও শরাব আর শায়েরির খবর যত রাখি ততটা জঙ্গের খবর রাখি না। তবে যতদূর মনে হয় নবাব আওরঙ্গজেব মারাঠা সেনাপতিদের মোঘল সম্রাটের মসনবদার বানানোর চেষ্টায় ভাল হতে গিয়ে বুরা হলো...আপনারা বাঙালীরা যাকে বলেন খারাপ হলো!’

‘কেন? আওরঙ্গজেবের আর যে সমস্যাই থাক, কাউকে মসনব দিতে যাওয়াটা কি দোষের?’

‘কিন্তু মারহাট্টার হিন্দু আর বাঙালার হিন্দুতে অনেক তফাৎ আছে মহাশয়! বাংলায় এসে দেখি এখানে ব্রাহ্মণও আরামসে মাছ খায়। কালি পূজায় পাঁঠার মাংস ভি খায়। মছলি আর গোশত খেয়েও ব্রাহ্মণ থাকা এক বাংলাতেই সম্ভব। ঔর বাংলার হিন্দু ত’ বটেই, মুসলমানও পারলে যুদ্ধ করে না। কিšত্ত রাজপুতানা আর মারহাট্টা দেশের হিন্দুও যুদ্ধ না করতে পারলে শান্তি পায় না। সেখানের মুসলমানদের কথা না হয় বাদই দিলেন। আওরঙ্গজেব মসনব দিতে চাওয়ায় কোন কোন মারাঠা জমিদার বা সেনাপতি সেই টোপ গিলেছে ঠিকই, কিন্তÍ স্বাধীনচেতা অনেকেই এতে বিরক্ত হয়েছে। অপমান হয়েছে তাদের এই প্রস্তাবে। আর সেই বিরক্তি কার উপর আর ঝাড়বে? মোগল বাদশাহির সবচেয়ে শানদার এই সুবা বাংলাতেই তারা হামলা করে চলেছে। এত ফসল, এত কাপড়া, মশলা...আর কোথায় মিলবে?’

(২)

এই নিয়ে চারবার এদেশে আসা হলো সুরনাথ সালগাঁওকরের। প্রথম সে এসেছিল বিক্রম সংবর্ত ১১৪৭-এ। এই বাঙালা মুল্লুকের পাঁজি-পুঁথিতেও সেই বছরকে ১১৪৭ই নাকি বলা হয়। গোয়ায় তার মামাবাড়িতে যেখানে এখন ডাচ-পর্তুগিজ-ইংরেজ ফিরিঙ্গিতে ভরে গেছে...সেখানে আজকাল সাদা মানুষদের পাঁজির সন-তারিখও কেউ কেউ বলে। সাদা মানুষদের পাঁজি খুব অদ্ভুত। সেটা প্রায় পাঁচশ’ নব্বই বছরেরও বেশি...পাঁচশ’ একানব্বই, বিরানব্বই...হুম্, পাঁচশ’ তিরানব্বই বছর এগোনো। সেই পাঁজির হিসাব ধরলে সুরনাথ এদেশে এসেছিল প্রথম ১৭৪০ সালে। এগারো বছর পার হয়ে গেল। ফিরিঙ্গিদের পাঁজি অনুযায়ী এখন ১৭৫১ সাল আর বিক্রম সংবর্ত মানলে সালটা হবে ১১৫৮। এই এগারো বছরে দফায় দফায় এসেছে সে। মহারাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর এক তুচ্ছ বারগির সে। বারগির সেই সৈন্য যে কিনা এতই গরীব যে তার ঘোঢ়া আর বন্দুক খোদ রাজাকেই যোগাতে হয়। বড় সেনাপতি বা রাজপুত্র কি সাদা-সিধা কোন বণিক ঘরেও সে জন্মায় নি যে ঘরের জোয়ান ছেলে যুদ্ধে যাবার সময় নিদেনপক্ষে একটা ঘোঢ়া আর একটা তলোয়ার কেনার পয়সা অন্তত: বাপ-কাকা বা মায়ের বংশে মামা দিতে পারবে। সে বারগির। মহারাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর সেই ক্ষুধার্ত অংশ যারা খরায় পুড়ে যাওয়া দাক্ষিণাত্যের বিস্তীর্ণ পাহাড় ও মালভূমি পার হয়ে রক্তের নিদারুন অংশুমান হাহাকারে ছায়া ও ফসল, সম্পদ ও নিদ্রা, গান ও পাখির ডাকের জনপদ বাংলার দিকে ছুটে চলে...যদি সেই ছায়া ও মেঘের দেশ থেকে তারা লুণ্ঠন করতে পারে একটুকরো ছায়া কিম্বা একমুঠো মেঘ...অন্তত: কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি জল...যদি সেই দেশের তাঁতে বোনা নরম কাপড়...সূতি, রেশম আর মসলিনের মতো নরম যত কাপড় আর তাঁত চালাতে বসা কাপড়ের চেয়েও কোমল...সূতি, রেশম আর মসলিনের তšত্তর মত সূক্ষè সে দেশের মেয়েদের তারা হরণ করতে পারে...যদি সেই শান্ত, নিদ্রাতুর আর সদা স্বপ্নের ভারে এলায়িত সেখানকার সুখী মানুষদের কাছ থেকে এতটুকু ঘুম আর এতটুকু স্বপ্ন তারা ডাকাতি করে তাদের রুক্ষ মালভূমি আর পাহাড়ের জীবনে নিয়ে যেতে পারে...সাধে কি বাংলার নবাব আলীবর্দি খাঁ শেষ যুদ্ধে কলিঙ্গদেশ মারাঠাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন? সাবাশ পেশোয়া বালাজি বাজি রাও! তার নির্দেশেই ১১৪৯ বিক্রম সংবর্তের বছরের একদম শুরুর মাহিনাতেই নাগপুর থেকে তারা সার সার ঘোঢ়া ছুটিয়ে বর্শা আর বল্লম হাতে ঢুকে পড়ে মোগলের সুবা বাংলার বর্দ্ধমান জেলায়। বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্যই বারগির। ঘরে যাদের রুটি নেই। তাই শত্রæর দেশে যে কোন লুটতরাজ চালাতে যাদের কলিজায় এতটুকু হোঁচট লাগে না! আর এই বারগিরদের চালনায় মহারাষ্ট্রের নামী সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিত। পন্ডিত বংশে জন্ম হলেও তাঁর চরিত্রে ক্ষত্রিয় স্বভাব বেশি। নবাব আলীবর্দী খান তার বাহিনী নিয়ে উড়িষ্যার কটক হয়ে বর্দ্ধমানে ঢুকলেন ভাস্কর পন্ডিতের বারগিরদের একহাত দেখে নিতে। কিšত্ত ভাস্কর পন্ডিত যেমন চতুর তেমনি নির্মম। বর্দ্ধমান শহরে বাংলার নবাবের ফৌজ পৌঁছানোর আগেই যেহেতু পৌঁছে গেছে তার বারগির বাহিনী, নবাবের ফৌজ পৌঁছতে পৌঁছতে ততদিনে গোটা শহরের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। বর্দ্ধমান শহর থেকে সামান্য দূরে সম্রাট তাঁর শিবির গাড়লেন। শহরের মুচি কি ভিস্তিঅলা থেকে শুরু করে বাজারের ক্ষুদে দোকানদার, চাল ডাল কি গমের আড়তদার, সব্জি ফিরিঅলা, কামার, রংমিস্ত্রি কি ঠেলাঅলা ত’ বটেই, বড় বড় শেঠ, ব্যবসায়ী কি আমির পরিবারের মানুষজনও ভাস্কর পন্ডিতের নজরদারির ভেতর বন্দি হয়ে গেল। ফলে, বাংলার নবাব আলীবর্দী খানকে কে আর সাহস করে তার বাহিনীর জন্য একমুঠো চাল কি গমও একবেলা পাঠায়? ওদিকে তাদের বারগিরদের আর একটি দল বর্দ্ধমান শহর ছাড়িয়ে আরো চল্লিশ মাইল ভিতর অবধি লুঠ চালালো। মারহাট্টা বারগিরদের কর্ডন ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকবার এক মরীয়া ও শেষ প্রচেষ্টা নবাব আলীবর্দী চালালেন বৈকি, কিšত্ত নবাবের দরবারের ইরাণী আমির মীর হাবিব...ভয়ানক উচ্চাকাঙ্খা তার...বাংলার নবাবের সাথে মারহাট্টার বাহিনীর এই অবরোধ পাল্টা অবরোধের সময় হঠাৎই এক রাতে গোপনে দূত পাঠিয়ে ও পরে নিজেই ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রাচীরের এপারে এসে ভাষ্কর পন্ডিতের সাথে দেখা করে, আঁতাত করে গেলেন। মীর হাবিব ইরানী হলেও বাংলায় আছে দুই পুরুষ ধরে। ফলে মীর হাবিবের কাছ থেকে বারগিররা পেল বাংলার পথে-প্রান্তরে যুদ্ধ চালানোর ক্ষেত্রে খুঁটিনাটি প্রতিটি পরামর্শ, এই মুল­ুক সম্পর্কে মীর হাবিবের সমস্ত জানাশোনার সুফল তারা পেল। ভয়ানক মানুষ বটে এই মীর হাবিব। আরে, হাজার হোক দু’পুরুষ হলেও তো এই দেশে বাস করছিস! শোনা যায়, মীর হাবিবের পিতা ইরাণী হলেও গর্ভধারিনী মা বাঙালী। তা’ বাঙালী মায়ের সন্তান হয়ে এই দেশটাকে বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে লোকটার এতটুকু সঙ্কোচ হলো না? লুট আর লুটের অভিযানে বারগিরদের নিমন্ত্রণ জানালো সে-ই। ভোলা কি যায় মুর্শিদাবাদের দাহিপাড়া অভিযানের কথা? তাদের বারগিরদের ঘোঢ়া একটার পর একটা ঢুকে পড়ছে বাজার আর জনপদগুলোর ভেতর দিয়ে...ডান হাতের জ্বলন্ত মশাল তারা ছুঁড়ে মারছে চারপাশের দোকানপাটে...হাটের বাঙালীরা প্রবল চিৎকার আর উ™£ান্ত কান্নায় যে যেদিকে পারে ছুটছে আর তাদের মুখে ক্রমাগতই একটি শব্দ শোনা যাচ্ছে: ‘বর্গী! বর্গী!’ বাঙালীরা বোধ করি ‘বারগির’ শব্দটি বলতে পারে না। ছুটতে ছুটতে বাঙালী পুরুষদের পরণের পোশাক খুলে যাচ্ছে কোমর থেকে, মেয়েদের শাড়ি আলুথালু, ‘বর্গী এলো রে! হে ভগবান! পালাও পালাও! হায় আল্লাহ! ও মাগো! বাবাগো! বর্গী!’ মুর্শিদাবাদের নামী হিন্দু রইস আদমি জগৎ শেঠের বাসা থেকেই তিন লাখ রুপি তারা লুটে নিল। নবাব আলীবর্দী বর্দ্ধমান থেকে আবার দ্রæতই ছুটে এলেন মুর্শিদাবাদে। রাজধানী বাঁচাতে। তারা বারগির সৈন্যরা, ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে, এবার ছুটলো কাটোয়া...দু’ধারে সারি সারি গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালাতে জ্বালাতে। সেই খান্ডব দাহন শেষ না হতেই প্রতি মাসে দেখতে না দেখতে কিভাবে কিভাবে যেমন নারীর শুকনো, খটখটে শরীরে রক্তের ঢল নামে, ঠিক সেই ভাবে বাংলার শুকনো খটখটে আকাশে এলো বর্ষা। বাংলার বর্ষা এক অদ্ভুত বিষয়। মহারাষ্ট্রেও বৃষ্টি হয় বটে। কিন্তÍ এই বৃষ্টির যেন কোন সীমানা নেই। আর এদেশের একটু পরপরই ছোট ছোট খাল আর নদীগুলো...পাহাড়ি নদী নয়...নদী তারা সমতলের...দেখতে দেখতে আকাশ ছাপানো বৃষ্টিতে কেমন ভরে ওঠে! খালগুলো ভরে ওঠে সাদা আর লাল অজস্র ছোট ছোট পদ্মের মতো এক ধরণের ফুল...বাঙালীরা কি একে ‘শাপলা’ বলে?  সেবারের সেই বর্ষার সময় থেকেই তাদের মারহাট্টা সৈন্যদের মূল শিবির...সার সার তাম্বু... কাটোয়াতেই গাড়া হলো। মীর হাবিব ত’ আছেই মারহাট্টা বাহিনীর সাথে। হুগলির মদ্যপ ও কবি ফৌজদার মোহাম্মদ রেজাকে জেলে পোরা হলো। ভাষ্কর পন্ডিত এবার দায়িত্ব তুলে দিলেন শেষ রাওয়ের হাতে। গঙ্গার পশ্চিমে রাজমহল থেকে মেদিনীপুর আর যশোর অবধি মারাঠা বারগির রাজ কায়েম হলো। শেষ রাও তাদের প্রধান নেতা। মীর হাবিব মারাঠা রাজের পক্ষে বাংলার দেওয়ান হলেন। বাংলার সমস্ত পরগণায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব জমিদারকে তিনি চিঠি দিলেন এই নয়া বারগির ও মারহাট্টা রাজকে চৌথ খাজনা দিতে। ওদিকে গঙ্গার পশ্চিম তীর থেকে হাজারে হাজার বাঙালী তখন তাদের চোদ্দ পুরুষের বসতি ছেড়ে ছুটছে গঙ্গার পূর্বদিকে...বারগির সৈন্যদের হাত থেকে তাদের মেয়েদের ইজ্জত রক্ষা করতে। আহাহা, কতদিন হয় পাহাড় আর মালভূমি ছাওয়া মহারাষ্ট্রের গ্রামে কি শহরে মর্দানা ধাঁচের শাড়ি পরা, ঈষৎ পুরুষালি মেজাজের বউদের ফেলে তারা এসেছে। তারপর শুধু ঘোঢ়ার পিঠে ছুটে চলা, আগুন ধরানো, খুন আর লুঠ। রাতে পথের পাশে যেখানে যখন পিঠ পাততে পারা যাচ্ছে, সেখানেই ঘুম। তাদের শরীরের ক্ষুধা নেই নাকি? পুরুষের ভয়ানক ক্ষুধা? বারগিরদের ভেতর যারা বিবাহিত, অভ্যস্ত যারা নিয়মিত স্ত্রী আস্বাদনে, তারা লুট করা বাঙালী মেয়েদের মাধ্যমে ঘরের বউয়ের অভাব পূরণের চেষ্টা যতদূর সাধ্য করে নেয়। আর যে সদ্য তরুণেরা এদেশে এসেছে অবিবাহিত, তাদের এখানে এই লুট হওয়া মেয়েদের মাধ্যমেই প্রথম পুরুষ হতে পারার ছাড়পত্রের অনুমতি ভাষ্কর পন্ডিত আর শেষ রাও ত’ দিয়েই দিয়েছেন। সুরনাথ নিজে অবশ্য বিবাহিত। বিয়ে হয়েছে তার বাল্যবয়সেই। স্ত্রী সাবিত্রী তেমন সুন্দরী নয়। ইতোমধ্যেই দুই সন্তানের মা। কিšত্ত তার রূপ বা শরীর নিয়ে ইদানীং নতুন কোন বাসনা আর সুরনাথ নিজের ভেতর অনুভব করে না। এখানে এই বাংলায় অবশ্য প্রচুর লুণ্ঠিত নারী আছে। চাইলে বাসনার পরীরা এখানে শ'য়ে শ'য়ে ডানা মেলতে পারে। কিšত্ত, তুমি এমন কেন সুরনাথ? ঘোড়া, তলোয়ার আর কামান চালানোর দ্রুততায় ইতোমধ্যেই খোদ শেষ রাওয়ের সুদৃষ্টি অর্জন করেছো! কিন্তু, গৃহস্থের ঘরে আগুন দিতে, বণিকের শেষ পণ্যটুকু কেড়ে নিতে তোমার হাত আজো কাঁপে কেন? তোমারই সহযোদ্ধারা যখন রাতের বেলা আগুন জ্বালিয়ে তাঁবুর ভেতর এদেশের মেয়েদের নিয়ে অনি:শেষ হল্লায় মাতে, তুমি তাঁবুর বাইরে নাঙা তলোয়ার হাতে মারাঠা ঘাঁটি পাহারা দিতে দিতে শিউরে ওঠো কেন? পৌরুষের এই বীভৎস হল­ায় সতীর্থ সৈনিকেরা তোমাকে যখন ডাকে...এদেশের রেশম আর মসলিনের কোমল সূতার চেয়েও নরম মেয়েগুলোকে মাটিতে ফেলে, মারহাট্টার রুক্ষ পুরুষেরা যখন একের পর এক এদেশের সবুজ মৃত্তিকাকে চিরে ফেলার মতোই তাদের বিদীর্ণ করতে উদ্যত হয়...আর ধর্ষণকারীরা যেহেতু প্রায়শ:ই সাম্যবাদী...তাই তারা তোমাকেও আহŸান জানায়...তুমি কিভাবে নানা কৌশলে এড়িয়ে যাও? হায় সুরনাথ! শরীর নাই তোমার? তোমার শরীর কি জাগে না? কিছুতেই জাগে না? কিšত্ত এভাবেই বুঝি পাপকে তুমি এড়াতে পারবে মনে করো? সম্ভ্রমহারা নারীর কান্না, বহ্ন্যুৎসবে আক্রান্ত গৃহস্থ, সর্বস্ব হারানো কৃষক, তাঁতী অথবা বণিক...এদের সকলের দীর্ঘশ্বাস এড়াতে নি:শব্দ দেবতার মন্ত্রপাঠই কি তোমাকে বাঁচাতে পারবে মনে করো? কিšত্ত, কি করব আমি? আমি সুরনাথ সালগাঁওকর...মহারাষ্ট্রের যে গ্রামে আমার জন্ম...সেখানে আজ দশ সন হয় বৃষ্টি হয় না...আজ দশ বছর সেখানে কোন ফসল নেই। খরা আর অজন্মাআমার এক দিদি দাক্ষিণাত্যের মন্দিরে দেবদাসী হিসেবে বিক্রি হয়েছে আর এক দিদি গোয়ায় পর্তুগিজদের রক্ষিতা। ...তখনো আমি কিশোর। আজ এই দস্যুবৃত্তি ছাড়া আমার আর কি-ইবা অবলম্বন? আমার দেশে বাংলার মতো না চাইতেই জমিতে ফসলের হিল্লোল নেই! এত নদী নেই। নেই এত মৎস্য ও পাখির আমিষ। আমি সুস্থ দেহের যুবক পুরুষ...ভিক্ষা ত’ করতে পারি না! মনকে বোঝাও সুরনাথ। ঈশ্বরের কি অধিকার আছে হিন্দুস্থানের একের পর এক প্রদেশকে বঞ্চিত করে বাংলাকে এত রূপ দেবার? যে দেশের মাটিতে এত ফসল যে গৃহস্থ অকাতরে কি হেলা-ফেলায় ফেলে রাখে তার ধান, ফলের বাগান কি মশল­া? আর পাখিরা এসে খুঁটে খায় যত ফলবীজ আর শস্যের দানা? হায়, পাখি এসে খুঁটে খায়। পাখির হাতে নষ্ট হবার থেকে মানুষের পেটে দানাপানি যাওয়া কি বেহতর নয়? তবে আর অন্য প্রদেশের মানুষদের দোষ কি যদি এখানে এসে কিছু খাবার নিয়ে যায়? চাই কি জোর করেই?

(৩)

রেশমের গায়ে যখন গুটি ধরে তখন বিভাবতীর অসম্ভব আনন্দ হয়। তাঁতীর ঘরের মেয়ে সে। বালবিধবা। এমন নয় সে ব্রাহ্মণের ঘরের বালবিধবা। তাদের জাতে মেয়েদের আবার বিয়ে হয় বা হতে পারে। কিšত্ত আজকাল ব্রাহ্মণদের নকল কে না করছে? বামুনের মতো হতে পারাতেই যেন আনন্দ। বিভাবতীর বিয়ে হয়েছিল যখন তার পাঁচ বছর বয়স। স্বামী হারালো সে ন'য়ে। স্বামী নারায়ণ বসাক সাপে কাটা পড়ে মারা গেল যখন তখন সেই বালকের বয়স বারো। দু’জনা তারা প্রায়ই মারামারি করতো। না, তখনো বিভাবতীর ঋতু হয়নি। বিভাবতীর বাবা তল­াটের নামী রেশমচাষী। রেশমপোকার চেহারা দেখেই সে বলে দিতে পারে কেমন পোক্ত হবে এই সূতা। তার রেশমের থান আশপাশের অনেক রেশম আদংয়ে চালান হয়। নয় বছরের বিধবা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বাবা সত্যচরণ বললেন, ‘এখন থেকে এই রেশমের কাজে হাত দে মা। মন দিতে পারলে ভাল সূতা কাটুনী হতে পারবি।’ সেই শুরু। ধীরে ধীরে রেশমের সাথেই যেন বিয়ে হলো বিভাবতীর। তার সমস্ত মন জড়িয়ে গেল রেশমের বহুবর্ণ সূতায়। নীল, হলুদ, রক্তাভ, পীত, সবুজ কি সাদা যত রেশম কাপড়ের থানে। আর পাশাপাশি চলতে লাগলো দিনমান বাবার রেশমগুটি পালা আর সূতা কাটার পাশাপাশি বিধবার একাদশী, ব্রত, বারবেলা, নিরামিষ-হবিষ্যি, পাঁচালী পাঠ। সব মিলিয়ে কেমন আনন্দেই দিন কাটে তার! সংসারে তাদের শান্তি কম নয়। বাবা এখনো জীবিত। মা অবশ্য বিভার শৈশবেই দেহ রেখেছেন। এজন্যই বাবা আরো বেশি মমতাবাণ। তিন ভাই ও ভ্রাতৃবধূরা স্বস্তিপরায়ণ। দুই দিদি পতিগৃহে। সে এ বাড়ির সবচেয়ে ছোটমেয়ে হয়ে যে বালবিধবা এই দুঃখেই বাড়ির কেউ তাকে কোন কুবাক্য বলে না। এমনকি ভ্রাতৃবধূরা অবধি নয়। বছর তিনেক আগে বাবা দেহ রাখলেন...দেহ রাখার আগে যখন তাঁর শ্বাস উঠেছে...বাড়ির তিন দাদা আর বৌদিদের ডেকে...সবার সামনে তিনি বললেন, ‘বিভা মা আমার গত কয়েক বছর রেশমের কারবারে আমাকে যেমন গায়ে-গতরে খেটে সাহায্য করেছে, এমন কোন পুত্র সন্তানও করে না। আমার দুই মেয়ে স্বামী গৃহে সুখী। বিভা বালবিধবা। আমি জানি যে তোমরা ভাই ও ভাইবউরা তাকে দেখবে। তবু, নারায়ণ করুন কোন অশান্তি না হয় তাই জীমুতবাহনের দায়ভাগ নিয়ম মেনেই আমার বিধবা ও নি:সন্তান কন্যা বিভাবতীকে আমার রেশম বাগানটা তার মৃত্যু অবধি তাকে দিয়ে যেতে চাই। ন'তে বিধবা হওয়ার পর থেকে আজ বিভা ষোঢ়শী। এই সাত বছরে তার চরিত্র বিষয়ে একটি কলঙ্কের কথা তল­াটের কোন শত্রæও বলতে পারে নি। তাই এই স্থাবর ভিটা বাড়ি আর আমার প্রায় পঞ্চাশ বিঘা ধানী জমি তোমাদের তিন পুত্রের হলেও আমার রেশম বাগানটা আমি সমাজের আর দশজন গণ্যমান্য গুরুজনের সামনে, ভট্টাচার্য মশায়দের ডেকে বিভাবতীর নামেই বন্দোবস্থ করতে মনোস্থির করেছি। বিভার মৃত্যুর পর যেহেতু সে বিধবা ও পুত্রহীনা, এই রেশম বাগান আবার তার ভাই বা ভাইদের অবর্তমানে ভ্রাতুষ্পুত্রদের হাতেই যাবে? তোমাদের কোন আপত্তি নেই তো?’ নিরীহ বড় এবং ছোটদা আপত্তি না করলেও ঠ্যাটা মেজদা একটু আপত্তি তুললো, ‘পুত্র বা পুত্রের পুত্র থাকা অবস্থায় কন্যা কিছু পায় কি? আরো যে কন্যার পুত্র নেই?’

বিভার বাবা একথায় অল্প দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘অনেক বড় বড় অবস্থার বামুন কায়েত ঘরের বালবিধবা মেয়েদের দেখেছি বাপের মৃত্যুর পর ভরার নৌকায় চালান হতে কি নবাবের কুঠিতে নাচনেওয়ালি হয়েছে কি কাশিতে কুকুর-বেড়ালের জীবন কাটাচ্ছে। বিভা তোমাদেরই মায়ের পেটের বোন। আমার রেশমের চাষে তার মতো কেউ খাটে নি। শ্রম দ্যায় নি। তবু, তোমাদের অমতে আমি কিছু করবো না!’

বড়ভাই-ই তখন সায় দিল, ‘আপনি ওকে দিন বাবা। আমাদের অমত নেই।’

‘জয় গুরু!’ বাবা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে চোখ মুঁদলেন।

...তা’ বিভাবতীর বাবা মেয়েকে কিছু বাংলা আর অঙ্ক লিখতে-পড়তে শিখিয়েছিলেন তার বালিকা বয়সেই। শুধু গুটি পোকা পালতে আর সূতা কাটতে জানলেই হয় না। রাজশাহী থেকে নবাবের খাস শহর মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত জালের মতো ছড়িয়ে থাকা বাংলার অসংখ্য রেশমের আদং বা দোকানের কারবারিদের কাছে মাল পৌঁছানোর ব্যবস্থা, রেশমের চালান, চাষীদের দেখা-শোনা করতে এই পড়াশোনাটুকু জানা নিতান্ত জরুরি। পিতার মৃত্যুর পর আরো তিন বছর চলে গেছে। বিভাবতী ভাইদের সংসারেই থাকছে বটে। কিন্তু, তার নাম আড়াল করে ফেলেছে ভাইদের নাম। প্রয়াত সত্যচরণের কণ্যা ঘরে বসেই তল্লাটের নাম করা রেশমের কারবারি হয়ে উঠেছে। বীরভূমের সবচেয়ে বড় রেশমের আদংয়ের মালিক...মুর্শিদাবাদের জনার্দন দত্তের দুই ছেলে হরিকিশোর আর প্রাণকিশোর দত্ত নাকি বিভাবতীর বাগানের রেশমের নামে পাগল! অদেখা বিভাবতীকে নিয়ে দুই দত্তভ্রাতার স্ত্রীরা নাকি প্রায় সন্ধ্যায়ই স্বামীদের সামনে অশ্রুপাত করে। নাকের জলে চোখের জলে একাকার হয়। কে জানে এসব কথার সত্য মিথ্যা? বাজারে হরেক গল্পও আছে বিভাবতীকে নিয়ে।

‘আহা, ভারি সুন্দরী মেয়ে! চম্পক কলি গৌরবর্ণ। বৈধব্যের উপবাস সংষ্কারাদি মেনে মেনে একটু শীর্ণকায়া। তবে কালো আর লম্বা চুল। বালবিধবা তবু আজো অকলঙ্ক!’

‘আরে রাখো এসব বাজে কথা! যে মেয়ে কিনা একা হাতে তল্লাটের সব নামকরা রেশম কারবারিদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে, ঘরের তিন/তিনটা দাদাকে ভেড়া বানিয়ে নিজেই বাপের নাম ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সে মেয়ে কিনা পারে? কামরূপ-কামাখ্যা থেকে আসা ডাকিনী-যোগীনী কিনা তাই কে জানে? চাইলে ও আস্ত নবাবকে জলে গিলে খেতে পারে!’

‘রাখো দেখি বাজে কথা। ঐ মেয়েকে তার জন্মের সময় থেকে চিনি। ভারি ভালো মেয়ে। এত শান্ত! আজ তার কারবার ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। তবু, আর দশটা কর্মচারী মেয়ের সাথে এক উঠোনে বসে সে আজো নিজের হাতে সূতা কাটে । আবার বিধবার আচার-বিচারে সে বামুনের মেয়ের সাথেও পাল­া দেয়। সন্ধ্যার পর ফের বসে পাঁচালি-পুঁথি নিয়ে। নিজের হাতে ভাইয়ের ছেলে-পিলেদের খাওয়ায়। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি শুধু কাজ আর কাজ! তাইতে না স্বভাব-চরিত্তির ঠিক আছে!’

‘একা মেয়েমানুষ- দেখব কতদিন ঠিক থাকে?

(৪)  

‘ঠাকুরঝি!’ বড়বৌদি বিভার ঘরে ঢুকলেন। বিভা তখন মাত্রই জলে ভেজানো সাবু দানা, কলা, নারকোলের টুকরো আর আখের গুড় মেখে একাদশী সন্ধ্যার খাবারের বন্দোবস্ত করছিল। বাবার মৃত্যুর পর প্রথম তিন বছর তা-ও একরকম চলছিল। সম্প্রতি মেজ আর ছোট দাদা আলাদা হয়েছেন। বিভাকে রেশম বাগান দেওয়ার পিতৃ-সিদ্ধান্ত ও তাতে বড় দাদার অনুমোদনের বিরোধিতা করতেই তাদের আলাদা হওয়া। নবাবের দিওয়ানি বিভাগে মামলা ঠুকবে বলেও তারা হুমকি দিয়েছে। ছোটদাদা শুরুতে এমনটা ছিল না। মেজদাদাই তাকে উস্কেছে, ‘বাড়ির মেয়ের গল্প হাটে-বাজারে শোনা যায় এমনটা কেউ কখনো শুনেছে? গেরস্থের মেয়ে ত’ না যেন কাশিমবাজার কুঠির নাচনেওয়ালী বাঈজি!’

‘শিবু, দেবু- তোরা বের হয়ে যা বলছি!’ বড়দার গলার স্বর গমগম করে উঠেছিল।

মেজদার জিহ্বা কুৎসিততর হয়ে উঠেছিল, ‘যাব বৈকি। তুমি না বললেও আলাদাই হয়ে যাব। বাবার শেষবয়সে ধরলো ভীমরতি...আর তুমি কি তার পুত্রসন্তান না হিজড়ে সন্তান-’

‘চোপ্!’

‘চোপ বললেই চোপ? আমাদের দু’ভায়ের ভাগের ধানীজমিগুলো আলাদা করে লিখে দিলেই হয়। তুমি থাকো তোমার পেয়ারের নাচনেওয়ালী বোণকে নিয়ে। তোমার আর কি? জন্ম ইস্তক হাঁপানির রোগী। কোন খাটনির কাজ করতে পারো না। তাই পাছে ছোট দুই ভাই মাথার ওপর ছড়ি ঘোরায় সেই ভয়ে ভাইদের ছেড়ে বোণকে ধরেছো এই আশায় যে অবলা মেয়েমানুষ শেষতক তোমার কথাই শুনবে! ছি: দাদা...আমাদের উপর আর একটু ভরসা করলে পারতে! ছেলে সন্তানকে ছেড়ে মেয়ে সন্তানকে সম্পত্তি লিখে দেবার কথা কে কবে শুনেছে?’

সেই থেকে আলাদা। আচ্ছা, মেজদার কথা কটু হলেও সত্যই হয়তো? বড়দা যদি বারোমাস হাঁপানির রোগী না হতো, তাহলে কি বাবার এই সিদ্ধান্ত এত অবলীলায় মেনে নিত? সুরা ও বাঈনাচ আসক্ত মেজো ও ছোট ছেলে আর হাঁপানিগ্রস্থ বড় ছেলেকে দেখেই কি পিতা সত্যচরণও বালবিধবা বিভাবতীর কাঁধেই চাপিয়ে দিয়েছিলেন পরিবারের সবলতম পুত্র সন্তানের দায়িত্ব? বিধবা কন্যার জীবনের নিরাপত্তার পাশাপাশি নিজ প্রাণের অধিক রেশম বাগান রক্ষার একটি গোপন উদ্বেগও কি ছিল না তাঁর? যেহেতু তিনি জানতেন যে কন্যা হলেও বিভাবতী পুত্র সন্তানের চেয়েও ধীর-স্থির, কর্তব্যনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী? তবু মানতেই হয় যে বিভা ভাগ্যবতী। তার মতো স্থৈর্য্য আর কর্তব্যবোধ নিয়ে অনেক ঘরেই অনেক বালবিধবা থাকে। বাপ-ভাইয়ের অবহেলায় তাদের দিন শেষ হয় বাজারের কুঠিতে কোন পুরুষের রক্ষিতা হিসেবে কি আক্ষরিক অর্থেই গলায় দড়ি দিয়ে। এই চৈত্রে বিভাবতীর বয়স কুড়ি হবে। মেয়েমানুষের কুড়ি বছর কি যে সে কথা? স্বামী বেঁচে থাকলে এতদিনে সে তিন/চারটে ছেলে-মেয়ের মা হয়। তার বয়সী এ গ্রামের বহু সধবার এখনি মাই ঝুলে গেছে। কিšত্ত বিভাবতী...মা হয় নি বলেই...ঠিকমতো নারী জীবন পেয়েও পায় নি বলে...সেই ন’বছর বয়স থেকে আজ এগারোটি বছর ধরে পুরুষের দায়িত্ব পালন করতে করতে...তার শরীর যেন বয়স পেরোনো কুমারীর মতো বা বন্ধ্যা রমণীর মতো দৃঢ় অথচ পেলব। ইসশ্...শুধু যদি মা ডাকটি শুনতে পেত বিভাবতী! মেজদা আর ছোটদা ত’ আলাদা হয়েই গেল। ওদের ছেলে-মেয়েরা কেমন আছে কে জানে? বড়দার প্রথম তিন মেয়ে হয়ে চার নম্বরে পুত্র সন্তান। তিনটি মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। এগারো, আট আর সাতে। ছেলে যদুনাথের বয়স দুই। তার দুষ্টুমি দ্যাখে কে? ফুটফুটে মুখের ছেলেটি হেসে হেসে শুধু বলে, ‘পিছি- একতা গল্প বলো না!’

...তখন দিনমান রেশম সূতা কেটে, কর্মচারীদের দিয়ে জনার্দন দত্তের আদংয়ে চালান পাঠানো শেষে, টাকা-কড়ির হিসাব গোনা-গুনতির পর সন্ধ্যার ফলাহার সেরে বিভাবতী যদুনাথকে বুকে চেপে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী আর লালকমল ও নীলকমলের গল্প শোনায়। আর যেসব সন্ধ্যায় যদুনাথ দিনমান দুষ্টুমি করে ঘুমিয়ে পড়ে, সেসব সন্ধ্যায় মাটির প্রদীপে সলতেয় আলো উস্কে দিয়ে বিভাবতী রামায়ণ পড়ে। খুব বেশি পড়তে পারে না। কারণ বড় বৌদি এসে ঢোকে, ‘ঠাকুর ঝি, এসো চুল বেঁধে দিই!’

বড়বৌদি তার চেয়ে অনেকটাই বড়। দশ বছরের বড় ত’ হবেই। হাঁপানি রোগী স্বামীর বুকে অহোরাত্র তেল ঘষার পরও পরোক্ষভাবে এই ছোট ননদের কর্তৃত্বের সংসারে কথা-বার্তায় সামান্য ক‚টাভাস সত্তেও ননদিনীর সাথে তাঁর ব্যবহার একদম খারাপও নয়। এছাড়া বড় বৌদি ঈষৎ রঙ্গপরায়ণাও, ‘আমার সন্ন্যাসিনী ননদিনী আজ কেমন আছে? সত্যি বলি আমি তোমার মতো অবস্থা হলে চরিত্র রক্ষা করতে পার্ত্তুম না! কবে কোন্ কাঠকুড়ানীর ছেলের গলায় মালা দিয়ে ভিটে-মাটি ছেড়ে বহুদূর চলে যেতাম!’

বিভাবতী এসব কথায় সতর্ক থাকে। বৌদি কি তার মনের তলদেশের কোন খবর জানতে চায়? আবার কখনো কখনো বৌদির গলায় সত্যিকারের মমতাও জমে, ‘এই চুল-এই রং-নাক-চোখ! এ জন্মে  সব বিফলে গেল! হরি, আমার তিন মেয়েও ত’ শ্বশুরবাড়ি। কার কপালে কি আছে কে জানে?’

কখনো কখনো বৌদি আবার সম্পূর্ণ উল্টা কথাও বলে, ‘মেয়েমানুষের মুক্তি কিসে জানো? যখন সে হয় কুমারী নয় বিধবা! স্বামী থাকা মানেই রাজ্যির যন্ত্রণা! এই যে তুমি...কোন পুরুষ মানুষের ধারটি ধারতে হয় না...নিজেই নিজের কর্তা...বলি, তুমি সধবা থাকলে বাবা কি তোমাকে এত কিছু দিয়ে যেতেন? আর সধবা মানে শুধু স্বামীর মন যোগাও! শুধু স্বামীর মন যোগাও!’

বিভাবতী নিজেও একথা বহুবার ভেবেছে। সধবা হলেই কি খুব ভাল থাকতো সে? সারাদিন চোদ্দ মানুষের রান্না, বছর বছর বাচ্চা...তাতেই বা কি এমন হাতি-ঘোঢ়া আসত যেত বিভাবতীর? আর সবাই যে বলে শরীর! কই, তেমন কোন ডাকই যে সে নিজের ভেতর শুনতে পায় না!

‘ঠাকুরঝি! খবর শুনেছো গো?’

পঞ্চমবারের মতো অন্তর্বতী বড়বৌদি ঘরে ঢোকে।

‘কি খবর না বললে বুঝি কি করে?’

‘আর বোলো না- তোমার বড় দাদা সাম্বৎসরিক হাঁপানি রোগী হলে কি হয়...শরীর একটু ভাল ঠেকলেই ওনার চন্ডীমন্ডপের তাসের আসর ঠিক আছে। আজ সেখানে গিয়েই শুনতে পেয়েছেন যে কোথাকার কোন্ বর্গী সৈন্যরা নাকি এই গঙ্গার পশ্চিমের ধারের সব গ্রামগুলোতে আগুন দিতে দিতে ছুটে আসছে। বীরভূমের অনেক রেশমের আদং নাকি এর ভেতরেই ওরা লুট করেছে। তাঁতীরা সব এদিক ওদিক পালাচ্ছে। আমাদের গ্রামেও নাকি আসতে দেরি নেই?’

এমন কথা এর ভেতর বিভাবতীর কাণেও এসেছে। ঘরে থেকেই দিনরাত বাইরের সাথে ম্যালা কারবার তার। তার কারখানার পুরুষ তাঁতী আর ফেরিঅলারা যারা তার কাছ থেকে কাপড় নিয়ে জনার্দন দত্তের ছেলেদের আদং অবধি যায় তাদের কাছ থেকেই শুনেছে যে মারাঠা বর্গীরা ছুটে আসছে মশাল আর তলোয়ার হাতে। রেশম কুঠিগুলো লুট হয়ে যাচ্ছে মালদা, বর্দ্ধমান থেকে বীরভূম অবধি। এরপর তারা ঢুকে পড়বে রাজশাহী অবধি। তাঁতীরা নাকি এর মধ্যেই প্রাণ ভয়ে সব পালাচ্ছে। বড় শহরগুলোয় ধান-চালের গুদাম বা আড়তগুলোও লুট হয়ে যাচ্ছে। সেই আগুন কি বীরভূম আর মেদিনীপুরের সীমান্তবর্র্তী এই রাধানগর গ্রাম পর্যন্ত ধেয়ে আসবে?

(৫)  

দাক্ষিণাত্যের ঘোঢ়াগুলো একটু হাল্কা গড়নের হয়ে থাকে। সামনের পা দু’টো তাদের ছুটে চলার সময় অধিকাংশ সময়েই শূন্যে ভেসে থাকে। শুকনার মৌসুমে তাই মারহাট্টা বাহিনীকে আর দেখতে হয় না! তাদের দক্ষিণী ঘোঢ়াগুলো শত্রুব্যুহ ভেদ করে, শত্রুসৈন্য ছিন্ন ভিন্ন করে বাতাসে সমানে ছুটতে থাকে। বাংলার নবাবও কম সমরকুশলী নন। তিনি জানেন ইতিহাসের আদি পর্ব থেকেই পাঞ্জাব, উত্তর ভারত, সিন্ধু, দাক্ষিণাত্য, আফগানিস্থান, পারস্য, আরব কি মধ্য এশিয়া থেকে বহিরাগত যে বাহিনীই এখানে এসেছে, বাংলার বৃষ্টি আর নদ-নদীই তাদের শত্রæ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া এই সমতলের শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর উপর লুট-তরাজ, অগ্নি সংযোগ কি খুন-খারাবি চালানো কি আর এমন কষ্টের? কাটোয়ায় ভাস্কর পন্ডিতের মারহাট্টা বাহিনী দু/তিন মাস হয় তাম্বু খাটিয়ে একটু যে শান্ত সে অন্য কোন কারণে নয়। বর্ষা এখনো শেষ হয় নি। পথ ঘাটে এখনো কাদা শুকায় নি। শুধু দক্ষিণী নয়, পৃথিবীর কোন দেশের ঘোঢ়াই এখন বাংলার পথে এসে সুবিধা করতে পারবে না। ওদের পাল্টা আঘাত হানার এখনি সময়। সুরনাথের মনে থেকে থেকেই ক’দিন কুডাক ডাকছিল। আলীবর্দী খানকে এক দফা হারানো, হুগলির মদ্যপ ফৌজদারকে আটক করা, মুর্শিদাবাদ, বর্দ্ধমান আর বীরভূমের কিছু রেশম কুঠি আর চালের আড়ত লুট করাই কি যুদ্ধে জেতা? কিন্তÍ সুরনাথ মারাঠা সেনাবাহিনীর এক বারগির মাত্র। যতই তার বন্দুকের নিশানা অব্যর্থ হোক, যতই আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে ঘোঢ়া তার চাবুকের নিচে ছুটে চলুক...সে কি সত্যিই ক্ষমতা রাখে স্বয়ং ভাস্কর পন্ডিত কিম্বা শেষ রাওয়ের কাছে গিয়ে যুদ্ধ সাজানোর বুদ্ধি বাতলাতে? তাকে বেকুব বা বেয়াদব ভাববে না সেনাপতিরা? তখন হয়তো এই ছোট-খাট চাকরিটাই চলে যাবে।

...সুরনাথের অনুমান ফলেছিল। সেদিন মাঝরাতের দিকে বৃষ্টি হয়ে ভোর রাতে বৃষ্টির ছাঁট কমে এসেছিল। হঠাৎই বাংলার নবাবের বাহিনী বজ্র বৃষ্টির মতো আচমকা আছড়ে পড়লো তাদের শিবিরের উপর। তাঁবু আর লুটের মাল ফেলে বারগিরদের ছুটতে হলো এদিক ওদিক। অবশ্য বাংলার সীমান্তের প্রতিটি জায়গাতেই ভাস্কর পন্ডিত ইতোমধ্যেই কিছু বাড়তি সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছিলেন। ক্ষুব্ধ ভাস্কর দূত পাঠিয়ে তাদের সবাইকে জড়ো করে কাটোয়া থেকে পলায়নপর বারগিরদের নিয়ে ছুটলেন মেদিনীপুরের দিকে। ওদিকটায় বাংলার নবাবের সৈন্য তেমন মোতায়েন নেই বলেই আগেই খবর পেয়েছেন তিনি।

(৬)

‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে,

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?’

...নিচু স্বরে আর ভীরু গলায় এদিক ওদিক চেয়ে, খোকার পিঠে মৃদু চাপড়ে গান গাইতে থাকে বিভাবতী। দস্যি খোকা খুকুদের কিছুতেই যখন আর ঘুম পাড়ানো যায় না, তখন এই বর্গীর নয়া গান গাইলে নাকি ছেলে মেয়ে শান্ত হয়ে যায়। বিভাবতী নিজে মা না হলেও গেল ক’দিন ধরে পাড়ায় আশপাশের মা-মাসি-পিসি-খুড়ি-জ্যাঠি-দিদিমা-ঠাকুমাদের দুষ্টু বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে এই গানই গাইতে দেখছে। বলতে গেলে বীরভূম আর মেদিনীপুরের সীমান্তের গ্রাম রাধানগরের অধিকাংশ মানুষ গঙ্গার পূর্ব দিকে চলে গেছে। গোটা গ্রামই শূণ্য। হাঁপানি রোগী বড় দাদা আর পঞ্চম বারের মত অন্তসত্তা বৌদি যিনি এখন গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে, বড় দাদার দুই বছরের পুত্র সন্তানকে নিয়ে একা বিভাবতী কোথায় পালাবে? তবু পালাতে হবে বৈকি। রাধানগর থেকে কয়েক ক্রোশ দূরেই তাদের মামাবাড়ি নয়নগড়ে আজ সন্ধ্যার ভেতরেই গা ঢাকা দিতে হবে। ঘরের কাজের লোক সব পালিয়েছে। বাবার সময় থেকে বিভাবতীদের রেশম কুঠির বিশ্বস্ত পাহারাদার জয়নাল সর্দার অবশ্য এই বিপদে বিভাবতীদের ছেড়ে পালায় নি। হয়তো মুসলমান বলেই জয়নাল চাচার ভয়-ডর কম। কিছুটা ডাকা বুকা আর দুর্দ্ধর্ষ প্রকৃতির। জয়নাল চাচাই আজ সন্ধ্যায় একটি গরুর গাড়ি এনে বিভাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবে মামাবাড়ি নয়নগড়ে। নয়তো হাঁপানি রোগী বড় দাদা আর আট মাসের অন্তসত্তা বৌদি ও দু’বছরের খোকার সাধ্য কি পায়ে হেঁটে কোথাও যায়?

‘উমম্ম্...মা...’ খোকা তারস্বরে চেঁচায়। ক’দিন হয় রেশমের কাজ সবই পড়ে আছে। বড় বউদির হাতে-পায়ে জল আসায় বেচারা একটু শুয়েছে। খোকাকে তাই বিভারই দেখতে হয়। বিকালের আগেই তারা সবাই যদি গরুর গাড়ি চাপে, তাহলে অসুস্থ দাদা বউদির একটু বিশ্রাম নিয়ে নেওয়াই ভাল।

‘পিছি, খেলা কব্বো। আমাকে একটু উঠানে নিয়ে চলো!’

‘না- উঠানে রোদ। লক্ষী খোকন, গান শোন বাবা।’

বিভা আবার গান ধরে, ‘ধান ফুরালো পান ফুরালো/ খাজনার উপায় কি?

আর ক’টা দিন সবুর করো/ রসুন বুনেছি।’

‘উঠানে যাবো------’

খোকা বিভার কোলে হাত-পা ছুঁড়ে তারস্বরে চেঁচায়।

‘ওরে বাবারে! যাচ্ছি- চল্, তোকে বর্গীর হাতেই দিতে হয়!’

সাদা শাড়ি কালো পাড় এক হাতে গোড়ালি থেকে সামান্য তুলে, আর এক হাতে খোকাকে কোলে চেপে ধরে উঠানে বের হয় বিভাবতী। সত্যি সত্যিই কি দশা ঘর-বাড়ির! ঘরে কাজের লোক না থাকায় উঠান লেপা হচ্ছে না বেশ কিছুদিন। ধান সেদ্ধ করে উঠানে রোদে দেবারও কেউ নেই। বর্গী আসার আতঙ্কে এই দিন পনেরোতেই গ্রামটা দেখতে দেখতে ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে উঠলো। অবস্থা এমন যে সারা দিন-রাত দরজা-জানালা আটকে থেকে, নিজের বাড়ির উঠানে দিনে-দুপুরে পা রাখতেই ভয়ে সারা হয়ে যাচ্ছে বিভাবতী। অন্য সময় সে ভিটের পেছনে কারখানা, আরো খানিকটা দূরে রেশম বাগান, পুকুর, গ্রামের বাঁশবাগান, মন্দির, তাদের ভিটের সাথে লাগোয়া সব্জি ক্ষেতে ঘুরে বেড়ায়। হাজার হোক সে এ গ্রামের মেয়ে। বউ ত’ নয়। তার ঘুরে বেড়াতে খুব সমস্যা নেই। খোকার দাপাদাপিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠানে নামতেই বিভার খেয়াল হয় কিছুক্ষণ আগে খিড়কি দুয়ারের পেছনের ঠাণ্ডা কুয়োর জলে স্নান করে অবধি চুল তার এখনো শুকায় নি বলেই বাঁধাও হয় নি। দুপুর বেলায় অন্য সময় মেয়ে-বউরা ভেজা চুল উঠানে শুকায়। এটাই নিয়ম। কিšত্ত এই পোড়ো গ্রামে দুপুর বেলা সে এই বয়সের মেয়ে খোলা চুল ছেড়ে নেমেছে...

‘ভুত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি।

রাম-লক্ষণ বুকে আছেন, ভয়টা আবার কি?’ 

...নিজে নিজেই বিড়বিড় করতে করতে বিভা খোকাকে কোল থেকে নামিয়ে উঠানে দাঁড় করাতে গেলে খোকা আবার কেঁদে ওঠে, ‘নামবো না!’

এবার বিভা সত্যিই বিরক্ত হয়। এক হাতে ভেজা চুলগুলো এলো খোঁপা করতে করতেই খোকার পিঠে মৃদু একটা চাপড় মারে সে, ‘যা পাজি ছেলে! এক মুহূর্ত শান্তি নেই!’

খোকা এবার দ্বিগুণ রোষে হাত-পা ছোঁড়ে, ‘মা- পিছি আমাকে মেরেছে-’

‘বজ্জাত ছেলে! আবার নালিশ!’ বলতে না বলতেই বিভার হঠাৎই মনে হয়...কি আর মনে হবে...চোখের সামনে স্পষ্টতই কয়েকটা লম্বা আর কালো রঙের মানুষ এসে খাড়া হলো। তাদের দিকে চোখ তুলে না চাইলেও উঠানে দুপুরের রোদে তাদের ছায়া ত’ পড়েছে। মানুষগুলোর কপালে রক্ত চন্দনের তিলক। মাটির ওপর দাঁড়ানো হলেও দশ/বারো জনের এই দলের সাথে তিন/চারটা ঘোঢ়াও আছে। নিজেদের ভেতর ভিন্ন এক ভাষায় কথা বলছে তারা। ছোরা, ত্রিশূল আর বন্দুকও আছে দেখি একজনের সাথে। ...কি করবে? দৌড়ে কি পালাবে এখন বিভা? কোনদিকেই বা পালাবে? শেষপর্যন্ত তার অদৃষ্টে এই ছিল? এই গ্রাম কিম্বা পাশের গ্রাম কিম্বা পাশের গ্রামের পাশের গ্রামের কোন্ নারী কয় পুরুষ আগে কখনো মোগল, কখনো পাঠান, কখনো ফিরিঙ্গি কি কখনো মগের ছোঁয়া লেগে জাতে ভ্রষ্ট হয়েছে, হয়েছে কুলের কলঙ্ক, লুণ্ঠিতা হয়ে চিরতরে ভ্রষ্ট হয়েছে আর সেই সাথে ভ্রষ্ট হয়েছে, শাপগ্রস্থ হয়েছে তাদের চোদ্দ পুরুষ...সেই সব মেয়েরা যারা কেউ পাঠান বা মোগল সৈন্যের বউ হয়েছে, হয়েছে মগ বা ফিরিঙ্গির বউ...চিরতরে জন্মভূমি যাদের ছাড়তে হয়েছে এবং যাদের আর কখনোই দেখা যায় নি...সেই সব নারীদের বিদেশী পুরুষের হাতে লুণ্ঠনের খবর বা গল্প বা রূপকথা শীতের রোদে উঠানে বসে পাড়ার মা-দিদিমা-জ্যেঠিমা-খুড়িমাদের কাছ থেকে শুনতে শুনতে কখনো সেই মেয়েদের প্রতি দুঃখ, কখনো বিজাতীয় পুরুষের হাতে নিগৃহীত হওয়ায় তাদের প্রতি ঘৃণা আবার কখনো বুঝি গা ছমছম করেছে অজানা আনন্দেই...চারপাশের তামাক খাওয়া, বউ পেটানো গৃহস্থ পুরুষেরা নয়...কোন্ অচেনা পুরুষের ঘোঢ়ায় চেপে বহু পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে যে মেয়েরা বিদেশ বিভুঁইয়ে চলে গেছে বা যেতে হয়েছে যাদের তারা বুঝি রূপকথার রাজকুমারীদেরই মতো হবে...বিভাবতীরও যদি অমনটি হতো...ছি: কি অলক্ষুণে ভাবনা! একে ত’ বিধবা মেয়ে, তাতে যত রাজ্যের মন্দ চিন্তা! ছি: বিভাবতী! তোর মরণ নেই? মরণ মরণ করতে করতেই কি মরণ এভাবে সাক্ষাৎ সামনে এসে খাড়া হয়? আরো দ্যাখো মাত্রই না চুল বাঁধতে দু’হাত তুলেছে সে। তার আঁচল কি বুকের উপর থেকে একটু সরেছে? আর যমদূতের মতো এতগুলো বিদেশী পুরুষ? বাবা সত্যচরণ বসাক, ঠাকুরদা লক্ষীরঞ্জন বসাক, ঠাকুরদার বাবা কৃপাসিন্ধু বসাক, তারও উপরে স্বর্গত: কমলপ্রসাদ বসাক...সাত পুরুষের নাম জানে বিভাবতী...বাবা শিখিয়েছিলেন...সবাই কি আজ বিভারই দেহটির দোষে নরকবাসী হবে? তবে কেন এতদিন আচারে সংস্কারে নিজেকে এত শক্ত করে বেঁধে রেখেছিল সে? যদি এই তার অন্তিম পরিণতি হয়? যদি এমন মৃত্যুদূতের মতো...এরাই নিশ্চয়ই বর্গী...দশ/বারো জনা বর্গী সৈন্য তলোয়ার আর ঘোড়া নিয়ে ঠিক তারই বিরাণ উঠানের রোদে, তারই সামনে এসে দাঁড়ায়? যখন সাদা থান পরনে হলেও তার লম্বা আর কালো, রিঠা ঘষা চুলগুলো সমানে দুপুরের বাতাসে উড়ছে? আর যখন খোঁপা বাঁধার জন্য হাত উঁচু করতে গিয়ে স্পষ্টত:ই বুকের আঁচল হয়তো একটু সরে গেছে? দুপুরের রোদে ঝলসে উঠেছে তার কাঁচা হলুদ রং?

‘বাবা- মা-’ বিভা চোখ বুঁজে উঠানের মাটি দুই পায়ে চেপে ধরার শেষ চেষ্টা করে। মা ত’ কোন্ শৈশবেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে! মা যদি সেদিন বিভাকেও তার সাথে করে স্বর্গে নিয়ে যেতেন, তবে আজ চোদ্দ পুরুষকে নরকবাসী করার দায় একা তার ঘাড়ে বর্তায় না!

(৭)

মানুষের জীবন সত্যিই বড় অদ্ভুত। এই যে বিদেশী মানুষটা যার ভাষা জানে না বিভা...যার কথা বোঝে না বা বলতে পারে না...লোকটিরও বাংলা নিয়ে প্রায় একই অবস্থা...তার সাথে আজো বিভার কি সম্পর্ক তা-ও নিশ্চিত নয়...তবু, দ্যাখো হয়ত সেই বিভার জীবনের প্রথম পুরুষ...এই ভাবনা ভাবতে গিয়ে পুনরায় গোটা শরীর ত্রাসে কেঁপে উঠল কি তার? না, আনন্দের কাঁপুনি এটা বিভা। মনকে মিথ্যা বলে কি লাভ? বিভার স্বামী ত’ নাবালক অবস্থায়ই মরেছে। তখন বিভাও নাবালিকা। গ্রামে বাবার বাসায় যখন ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে সে, যৌবন ঝলসে উঠেছে শরীরে...আশপাশের অনেক প্রতিবেশী এমনকি আত্মীয় পুরুষের চোখেও লোভ ছিল...ইশারায় আমন্ত্রণ ছিল...তাদের কাউকেই পুরুষ হিসেবে চোখেই লাগে নি তার। শরীর যেন বেড়ে উঠেছিল শরীরের মতই স্রেফ আপনমনে। কিšত্ত সেই শরীরে বিভাবতীর নিজস্ব নারী মন বা মনটির বেদনা তখনো জড়িত হয় নি। জড়িত হয় নি কোন আকাঙ্ক্ষা ও আকঙ্ক্ষা প্রসূত হাহাকার। যুবতীর শরীরে পরিশ্রমী কিশোরী কি হাসিখুশি এক শিশুই ছিল বোধ করি। বয়ষ্কদের অর্থ-কড়ি, রেশম-ধানের কারবারের অঙ্ক নিয়ে ভাবনা বা উদ্বেগ শিখে উঠলেও তখনো শরীর নিয়ে কোন উদ্বেগ হয় নি তার। তবু, এহেন উদ্বেগহীন আর শরীর থেকেও শরীরহীন বিভার শরীরের উঠানেই বছর খানেক আগের দুপুরে আছড়ে পড়েছিল দশ বারোজন সশস্ত্র বর্গী।

...পরপর কিসব বীভৎস ঘটনাই ঘটে গেল এক দুপুরে! সেই জনা দশ বারো বর্গী প্রথমে তাদের নিজস্ব ভাষায় খুব ধমকে কি কি জানি বলেছিল বিভাকে। তারপর বিভার চোখের সামনেই তলোয়ারে দু’টুকরো করেছিল তারা খোকনকে। এতটুকু শিশু মৃত্যুর ভয়ে নীল হয়ে ‘পিছি!’ ‘পিছি!’ বলে জড়িয়ে ধরতে এসেছিল তাকে। ছোট ছোট দুই মুঠো বাড়িয়ে খোকন তার দিকে ছুটে আসার সময়ই এক বর্গী তাকে শূন্য থেকে আছড়ে ফেলে পায়ে পিষে থেঁতলে মেরে ফেললো। ঘরের ভিতর ঢুকে হাঁপানি রোগী দাদা আর গর্ভবতী বৌদিকে টেনে-হিঁচড়ে উঠানে এনে নেহায়েত বাহুল্য বিবেচনায় দু'টো গুলি খরচ করা হলো। রূপার লক্ষীনারায়ণ প্রতিমা লুট হলো। লুট হলো বাড়ির মেয়েদের সোনার গহনার বাক্স। তাদের ভিটে লাগোয়া ছোট্ট রেশম কুটিরের রেশমি যত থানকাপড়। এই করতে করতে বিকেলের ছায়া গড়িয়ে আসা অবধি উঠানের উপর বিভা ক্ষণে সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে ক্ষণেই সংজ্ঞা হারাচ্ছিল। না, তলোয়ার হাতে এক বর্গী তাকে ক্রমাগত পাহারা দিয়ে চললেও তখনো সৈনিকেরা তার গায়ে হাতটি রাখে নি। কিšত্ত এ বাড়ির সব সম্পদ লুঠ হলে পর...সন্ধ্যা প্রসারিত হবার আগেই...বিভার ব্যপারে তারা সচেতন হলো...তিন/চারজন মিলে তাকে টানতে যাবার সময়ই এই দু/তিন ঘণ্টা একটা ঘোঢ়ায় বসে যে লোকটি সবকিছু দেখছিল...যে এই বাড়ির একটি সূতাও স্পর্শ করে নি কিšত্ত হয়তো সে-ই এই জনা দশ/বারো মানুষের নেতা...সে হঠাৎই প্রবল হুঙ্কার দিয়ে উঠলো! যারা বিভাকে টানছিল, তারা সর্দারের ধমকেও আকর্ণবিস্তৃত হাসলো। কি জানি বললো তারা তাদের সর্দারকে। সর্দার পাল্টা কি বলায় লোকগুলো একদম নরম হয়ে, সর্দারকে পাল্টা কুর্নিশ করে...পারলে বিভাকেও কুর্নিশ করে...এমন যতেœর সাথে তাকে উঠিয়ে দিল আর একটি ঘোঢ়ায়। সর্দার এই প্রথমবারের মতো বিভার চোখের দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে কি ছিল কে জানে... এক উঠান রক্তের ভেতর বড় দাদা, গর্ভবতী বৌদি আর খোকার লাশের সামনে দিয়ে ঘোঢ়ায় বাহিত হতে হতে বুঝি সর্দারের সেই অদ্ভুত কোমল চাহনিই তাকে সাহস যোগানোয় সারা দুপুরে বিভা প্রথমবারের মতো কেঁদে উঠে বাংলায় পরিবারের তিনজনের সৎকারের দাবি করে...আর, সর্দারও বাংলা বুঝুক না বুঝুক বিভার অন্তরের কথা বুঝি ঠিকই টের পেল।

‘এখানে লাশ হয়ে পড়ে থাকবে। এই ভিটাতেই একটু আগুন দিতে দাও আমায়...’

লাশ তিনটির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে কাঁদতে থাকায় সর্দারের লম্বাটে শ্যামবর্ণ মুখের রেখাগুলো আরো নরম হয়ে ওঠে। সর্দার আবার কিছু বলে তার দলের লোকদের। লোকগুলো ভ্রু কুঁচকালেও অমত করে না। বিভাদের উঠানেই পড়ে থাকা কিছু চেরা কাঠ বা লাকড়ি, পাটখড়ি আর গোবরের ঘুঁটিতে লোকগুলো আগুন ধরায়। স্ফীতকায় উদরদেশের এক মৃতা নারী, একটি শিশু ও এক পুরুষের শবদেহ পাশাপাশি সাজিয়ে তারা বিভাকে ঘোঢ়া থেকে নামিয়ে হাতের ইশারায় মুখাগ্নি করতে বলে। তিনজনের মুখে আগুন গুঁজে দিতে যতক্ষণ। পুনরায় বিভাকে তারা ঘোঢ়ায় তুলে দিয়েছিল আর সেই ঘোঢ়া ছুট লাগায় জনশূন্য রাধানগর গ্রামের পরিত্যক্ত যত বাগান, ফসলী জমি আর জলাজমি ছাড়িয়ে দূরে...

সেই সন্ধ্যাতেই তার বিশ বছরের জীবনে প্রথম তন্দ্রা ও জাগরণ, চেতন-অচেতন, মৃত্যু ও জীবনের ভেতরকার ভারি সঙ্কীর্ণ ও অপরিসর সাঁকোর ভেতর দিয়ে, ঘোঢ়ার পিঠে ও একদল অচেনা আর সশস্ত্র পুরুষের প্রহরায় অজানা পথে ছুটে যেতে যেতে বিভা উপলব্ধি করেছিল...তার শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরায় রক্তের উল­াসে অনুভব করেছিল...সামনের ঘোঢ়ায় এই দলের সর্দার যে যুবকটি...তলোয়ার-মশাল-বন্দুকে আপাত: ভয়ঙ্কর এই মানুষটি যতক্ষণ বেঁচে আছে...এই লম্বা, ঈষৎ শ্যামলা আর কাটা কাটা চোখ-মুখের ছেলেটি তাকে ঘিরে থাকবে প্রবল মমতায়...মেয়ে হয়েও রেশম বাগানে দিনরাত গুটি পোকা বাছা, সূতা কাটা, তাঁতী আর ফিরিঅলাদের সাথে টাকা নিয়ে ঝগড়া, হাঁপানি রোগী দাদার ধানী জমির বর্গাদারদেরও দেখভাল করে দিনকে দিন পুরুষ হয়ে ওঠার কাল চলে গিয়ে নিকটজনের মৃত্যু আর বসতবাড়ির ভিটায় আগুন ধরানো ছদ্মবেশে তাকে ঘিরে ধরেছে এ তাবৎকাল তার অজানা ও অদেখা কোন সুর...যা তাকে নুইয়ে দিচ্ছে কষ্টে, ভয়ে ও উল্লাসে...ঘোঢ়ার পিঠের প্রবল দুলুনিতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

‘মাইজি!’ 

উড়িয়া মাঝি কিছু বলে যার অধিকাংশই বিভাবতী বোঝে না। সুরনাথই কি বোঝে? চারপাশে বিস্তীর্ণ হ্রদ। চিল্কার হ্রদ কি? সকাল পার হয়ে দুপুর আসছে। সুরনাথ বিভাবতীর দিকে চেয়ে একটু হাসে। এবার বিভাবতীরও হাসি এলো। দেড় বছর আগের সেই জীবন মৃত্যুর হিসেবের বাইরের দুপুর গড়ানো সন্ধ্যায় ভাই, ভ্রাতৃবধূ ও ভ্রাতুষ্পুত্রকে হারিয়ে যে বিভাবতীকে বর্গীরা তুলে দিয়েছিল একটি ঘোঢ়ায়, আরো কতক্ষণ পর কে জানে সেই ঘোঢ়সওয়াররা পৌঁছে গিয়েছিল এক খোলা মাঠে! সেখানে সার সার কাপড়ের তাঁবু যার চারপাশে আগুন জ্বলছিল। সর্দার যুবকটি বিভাবতীকে নিয়ে গেল এক মাঝবয়সী লোকের সামনে। মাথা নুইয়ে কিছু বলার সময়েও অন্ধকারে তাঁবুর পাশে জ্বালানো আগুনে যুবকের মুখের বিষাদ স্পষ্ট পড়তে পারছিল বিভা। কি চাইছে এই ছেলে? এই মাঝবয়সী লোকটির হাতে বিভাকে সে তুলে দিতে চাইছে? কিšত্ত মাঝবয়সী লোকটি হাসল। হাত নেড়ে কি যেন সে বললো যুবককে। যুবকের সঙ্গীরা সে কথায় হা-হা- করে হেসে উঠেছিল। আর যাকে উদ্দেশ্য করে হাসা হলো, সে তার লম্বা মাথাটি নুইয়ে ফেললো লজ্জায়। সঙ্গীরা কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে যুবককে তাদের ভাষায় কি যেন বলেই চললো, বিভার দিকে আঙুল তুলে দেখাতে লাগলো...বিভা কিছু বুঝলো আবার বুঝলো না...রাতে তাকে ঘুমাতে দেওয়া হলো সর্দার যুবকটির সাথে একই তাঁবুতে। তার আগে তাকে খেতে দেওয়া হয়েছিল। বিভা ততক্ষণে বুঝেছে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন আর গ্রন্থিহীন জীবনের পাকে সে জড়িয়ে যাচ্ছে যেখানে ফেলে আসা জীবনের কোন রীতি-নীতিই খাটবে না। নিকটজনের মৃত্যুতে অশৌচ পালন, উপবাস...এসব যেন কোন্ দূর স্বপ্নের পারে রেখে আসা! অথবা সে নিজেই আছে কোন ঘোর দু:স্বপ্নের ভেতর? এখানে এই তাঁবুগুলোয় প্রচুর বাঙালী মেয়েকে দেখতে পেল সে। তাদের কেউ কেউ তারই মতো সম্পূর্ণ নতুন। কান্না হাসির ভেদাভেদ ভুলে তারই মতো স্তব্ধ হয়ে আছে সেই নতুন মেয়েরা। কোন কোন মেয়ে আবার এরই ভেতর মানিয়ে নিয়েছে। তারা হাসি-ঠাট্টা করছে; সাথের বিদেশী ও বিভাষী পুরুষের জন্য রান্নাও চাপাচ্ছে। একটু সুশ্রী চেহারার মেয়েরা হয়তো একটি তাঁবুতে একজনের সাথে থাকছে। সাধারণ চেহারার মেয়েরা একা তিন/চারজনের তাঁবুতে। যে মাঝবয়সী লোকটির সামনে যুবক সর্দার তাকে প্রথমে নিয়ে গেছিল, তার পাশে এক অসম্ভব সুন্দরী নারী। আদ্যোপান্ত সে মখমলের ঘাগড়া আর জড়োয়া গয়নায় ঝলমল করছে। তাঁতী ঘরের বালবিধবা বিভাবতী এমন পোশাকের মেয়েমানুষ জন্ম ইস্তক দ্যাখেই নি! অনেক পরে সে জেনেছিল ঐ মেয়ে এক নামকরা নাচনেওয়ালী ও এবারের বাংলায় যুদ্ধ অভিযানে শেষ রাওয়ের সঙ্গিনী। যুবক সর্দার...তার নাম বুঝি সুরনাথ...এ নামেই সবাই ডাকছে তাকে আর এ নামেই সে সাড়াও দিচ্ছে...ইতস্তত: ভঙ্গিতে নিজেই একটা শালপাতার ঠোঙায় কিছু খাবার এনে রাখলো বিভাবতীর সামনে। হাত দিয়ে ইশারা করে সে, ‘খাও!’

...বিভাবতী তার ভেজা দু’টো চোখ তুলে পুনরায় সুরনাথের দিকে তাকায়।

‘আরে খাও!’ সুরনাথ এমন কোন ইশারা পুনরায় করতে গিয়েই থমকে যায়। বুঝি বা তার মনে পড়ে যায় ঘণ্টা কয়েক আগেই সে ও তার সঙ্গীরা এই তরুণী বিধবার বাড়িতে হামলা চালিয়ে...কি সম্পর্ক এই মেয়ের সাথে সেই গর্ভবতী নারী, এক শ্বাসকষ্ট রোগী পুরুষ ও একটি ছোট বাচ্চার সাথে সে জানে না...তিন/তিনটি বা ভাল করে বললে চারটি প্রাণীকে মেরে, রূপার দেবমূর্তি থেকে শুরু করে কয়েক মণ রেশম আর সোনা-দানা লুঠ করে এই মেয়েকে নিয়ে এসে তাকে খেতে বলাটা হয়তো ঠিক নয়। মেয়েটি বিধবা কেন? বাংলায় বাল বিধবার সংখ্যা বেশি। যদিও এখানকার পুরুষরা যুদ্ধ করে না। এখানকার ধানী জমি আর বৃষ্টির দিনে ছোট ছোট সাদা লাল পদ্মের মতো এক ধরণের ফুলে ছেয়ে যাওয়া জলের মতোই মেয়েরাও এখানে অকৃপণ রূপসী। এই রূপসীকে বিধবা বানিয়ে ভগবানের কোন্ উদ্দেশ্য সফল হয়? কুমারীকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া গেলেও বিধবাকে কি বিয়ে করা যায়? বিধবার জীবনে স্বামীর পরেও অন্য কোন পুরুষের সংসর্গ ঘটলে তার জায়গা আর সংসারের বাইরেই! সুরনাথ এই বাঙালী বিধবার জীবনে কোন্ অনিষ্ট করতে এই বাংলায় এসেছে?

‘সুরনাথ!’ কেউ সজোরে হাঁক পাড়লে সে সেদিকে চলে যায়। অন্য এক ফৌজি এসে বিভাবতীকে একটি তাঁবুর ভেতর আঙুল নির্দেশ করে বসতে বলে। গুটিসুটি সেখানেই বসেছিল বিভাবতী। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল সে জানে না। যখন ঘুম ভাঙ্গে, নিজেকে সে তখন আবিষ্কার করে তার দিকে ধ্যানস্থ মুগ্ধতায় তাকিয়ে রয়েছে সুরনাথ। বিভাবতী বুঝলো এতক্ষণ তার ঘুমন্ত মুখের দিকে প্রবল মোহ আর বিষ্ময়ে চেয়ে দেখছিল সুরনাথ। এভাবেই শুরু। শুরুতে বর্গীদের হাতে নিহত দাদা, বৌদি আর ভ্রাতুষ্পুত্রের কথা মনে পড়ে প্রবল কষ্ট হতো বিভাবতীর। ইচ্ছা হতো না সুরনাথদের কাউকেই সে ক্ষমা করে। পরে ধীরে ধীরে মনে হলো বা তার মনে হতে থাকলো যে বাবা মা’র মৃত্যুর সাথে সাথে সংসারে তাকে ভালবাসার কেউই তেমন ছিল না। হাঁপানি রোগী দাদা তার ঘাঢ়ে সব পরিশ্রম চাপিয়ে নিশ্চিত ছিলেন। বৌদি বিধবা ননদিনীর কোন দোষ না পেয়েও তার চরিত্র নিয়ে সদা কটাক্ষ মুখরা ছিল। বরং এই দস্যু সুরনাথ তাকে ভালবাসে। যদি সে ভালবাসা খুব ক্ষণস্থায়ীও হয়...তবু...

(৮)

শ্রাবণের শেষ থেকে মাঘের শুরু। এই চার/পাঁচ মাসেই আমূল বদলে গেছে বৈকি বিভাবতীর জীবন। আর জীবন সম্পর্কে যেসব কথা সে এতদিন ধরে শিখেছে সেসবও। শিবিরে শিবিরে কিছু বর্গী পুরুষের সাথে তারা কিছু বাঙালী মেয়েও চলেছে। কেউ ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আবার কারো কারো...শুনতে ঘৃণা লাগতে পারে...প্রেম হয়েছে। বিভাবতীর যেমন হয়েছে সুরনাথের সঙ্গে। সত্যি বলতে এমন সুখী কখনো সে ছিল না। যদিও সুরনাথ তার স্বামী নয়। নিজেদের ভেতর পরষ্পর যেটুকু ভাঙ্গা মারাঠি আর ভাঙ্গা বাংলা তারা বলতে শিখেছে, তাতে বিভাবতী জেনে গেছে যে দূর মহারাষ্ট্রের পুনার এক গ্রামে সুরনাথের বিয়ে করা বউ সাবিত্রী আর দু’টো ছেলেও আছে। বিধবা বিভাবতী যদি কুমারীও হতো, তবু সুরনাথ তাকে বিয়ে করে অন্তত: দ্বিতীয় স্ত্রী করতে পারতো। কিšত্ত বিধবাকে কি করে বিয়ে করে? যতদিন এই যুদ্ধ আছে, ততদিন সুরনাথ তার পাশে আছে। যুদ্ধের শেষে সুরনাথ যদি তার দেশে ফিরে যায়...এখানটায় এসে তাঁবুর ভেতর বসে মাথা একদম ধরে যায় বিভাবতীর...কি হবে তখন? সে জানে সে সুরনাথের বিবাহিতা স্ত্রী নয়, কিšত্ত কিকরেই বা ভাবে যে সে নিছকই রক্ষিতা? আর যদি সুরনাথের সাথে যৌথতার...বিভাবতীর জীবনে পুরুষের সাথে প্রথম যৌথতার এই যাপনকে সমাজ যদি ‘রক্ষিতা’র জীবনই বলে...বিভাবতীর কঠোর তপস্যার বৈধব্য কি এমন ভাল ছিল? এখানে সুরনাথের সাথে থাকতে শুরু করার ক’দিনের ভেতরেই তার সাদা থান ঘুচে গেছে। সারা বাংলার লুট করা বিবিধ বর্ণের রেশম শাড়ি উঠেছে তার গায়ে, বিবিধ গহনা ও আভরণ। এই শিবিরে গত পাঁচ/ছ’মাসে তার চোখের সামনেই এক একজন বর্গী পুরুষ...নাকি বারগির...বারগিররা তিন/চার বার করে তাদের সঙ্গীনী বদলালো...সুরনাথ ত’ তাকে এখনো ছেড়ে দেয় নি...কিšত্ত ছাড়তে কতক্ষণ? আচ্ছা যখন ছাড়বে তখন না হয় কাঁদবে বিভাবতী। আপাতত: সে হাসবেই বরং। কখনো এত ভাল কেউ বাসেনি তাকে যেমন সুরনাথ বেসেছে। যদি সেই ভালবাসা অভিনয়ও হয়। সুরনাথ মাঝে মাঝে কি কি যেন বলে তাকে। নিজের ভাষায় পাগলের মতো আদর করতে করতে। পূজার জন্য তোলা সকালের প্রথম ফুলের মতো নরম সেই সব স্পর্শে সুরনাথেরও কি কোন আর্তি, কোন প্রেম নেই? হতেই পারে না। আর যে এত কোমল, এতটাই নিবেদিত ভালবাসার মূহুর্তগুলোয়...সে কি সত্যিই ভালবাসে দেশে ফেলে আসা তার স্ত্রীকে? ওহ্, সুরনাথের শরীরে পৈতা দেখেছে বিভাবতী। সুরনাথ কি জানে সে তাঁতীর মেয়ে? জানলেই বা। বিয়ে করার দায় যেহেতু নেই, কাজেই সে রাজকন্যা হোক আর চণ্ডালকন্যাই হোক...কি যায় আসে?

‘বিভাবতী!’

সুরনাথ অস্ফুটে শ্বাস ফ্যালে। ঘুমন্ত বিভাবতীর অজস্র চুলে ঠোঁট রেখে সে সারারাত ফিসফিস করে চলে, ‘আমি কি করব তোমাকে নিয়ে? স্বয়ং শেষ রাও তোমার কারণে আমার উপর বিরক্ত। ওদের কথা হলো যুদ্ধের সময় যোদ্ধারা এমন হাজার হাজার মেয়ে পায়। কয়েকদিন আনন্দ করে ছেড়ে দ্যায়। তোমাকে আমার ভালবাসা, তোমাকে আমার ছাড়তে না পারায় তারা আমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছেন। কিšত্ত আমি কি করি বলো? পনেরো বছর বয়সে যে মেয়েটির সাথে দেশে আমাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল...তখনো আমি পুরুষ হয়ে উঠি নি...কিছু বুঝতে পারার আগেই তার সাথে আমার থাকা শুরু হয়...সন্তানের জন্ম  দিতে হয়...তার ভেতর কোন আনন্দ ছিল না! কিšত্ত তোমাকে যে মূহুর্তে আমি প্রথম দেখি...সাদা শাড়ি আর এলো চুলে...আমি আমার সমস্ত শরীরে সেদিন প্রথম আনন্দ পাই...তোমাকে শিবিরে আনার এক মাসের মাথায় ভোররাতে মশালের আলোয় তোমাকে যখন প্রথম আলিঙ্গন করি...ঘ্রাণ নিই তোমার দীর্ঘ কালো চুলের...বাংলার লাল রেশমের শাড়িতে তোমাকে প্রথম যেদিন সাজাই...আমার আর পুনায় ফিরে যেতে ইচ্ছাই করে না...ভয় লাগে, ঘৃণা লাগে সেকথা ভাবলে...যদিও দুই ছেলে আছে আমার...কিšত্ত বাংলার কোন গ্রাম কি এই ‘বারগির’কে আপন করে নিয়ে জায়গা দেবে যদি এমনকি তোমার মতো এক বাঙালী মেয়েকে আমি সন্তানও দিই? আমাকে নিয়ে তোমার ভয় আর উদ্বেগ আমি বুঝি। হায়, আইন আর ধর্মের দোহাই মানলে তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্কই নেই। হতেও পারে না। যুদ্ধ শেষ হলে আমার দেশে ফিরে যাবারই কথা। তবু, কোন অনুযোগ নেই তোমার। তবু, তুমি তোমাদের এই ছায়া ঢাকা দেশের মতোই শান্ত। এত শান্ত দেশ তোমাদের আর তোমরা মানুষগুলো এত ঠান্ডা যে আমরা বারগিররা তোমাদের সব ফসল লুট করে নিয়ে গেলেও তোমরা আমাদের দোষ না দিয়ে মিছিমিছি কোন্ ছাই বুলবুলি পাখির ঘাঢ়ে দোষ চাপাও! আর আছে আশা তোমাদের। অবিনশ্বর আশা! এই দ্যাখো না মহারাষ্ট্রের নাগপুরের রাজা রঘুজি ভোঁসলের নির্দেশে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় তাঁর প্রতিনিধি রাজা সাহু নির্দেশ দিয়েছেন যে তোমাদের বাঙালীদের এখন আমাদের ‘চৌথ’ খাজনা দিতে হবে। আলীবর্দি খাঁ চৌথ দিতে সম্মতও হয়েছেন। এদিকে তোমাদের সব ফসল শেষ! তবু বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর গান বানাচ্ছো তোমরা আমাদের নিয়ে। ভেবে ভেবে সারা হচ্ছ কিভাবে খাজনা শোধ করবে? বাংলা কি তোমার মতোই শ্রান্ত ও ঘুমন্ত বিভাবতী? যেদিন থেকে তুমি আমাকে দেখেছ, তোমার দু’চোখের পাতায় স্বপ্ন। এই বারগিরকেও বিশ্বাস করো? এই হত্যা ও লুণ্ঠনকারীকেও? তোমার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছি আমি আর আমার সৈন্যরা, তোমার স্বজনদের হত্যা করেছি...তবু আমাকে আলিঙ্গন দিতে তোমার দ্বিধা হয় নি! নাকি এই বাংলার ফাঁদ? বাঙালী মেয়েদের ফাঁদ? হাজার অত্যাচারেও রা কাড়েনা? ঘুমপাড়ানি গানে তোমরা আমাদেরও ঘুম পাড়িয়ে দাও? বহিরাগত বারগিরদেরও? বিজিত অলক্ষ্যে জয় করে বিজয়ীকে? বহিরাগতের আর স্বদেশে ফিরে যাবার পথ থাকে না? এই দেশের মৃত্তিকা আর নারীর প্রেমে জড়িয়ে যায় সে! বিভাবতী! তুমি সেদিন ভাঙ্গা মারাঠিতে যে রূপকথা শুনিয়েছো আমাকে...সোনার কাঠি আর রূপার কাঠি আর ঘুমন্ত রাজকণ্যার গল্প? একবার জাগো! বিভা!’

...নৌকার ভেতর আবার ঘুম ভাঙ্গে বিভাবতীর। সুরনাথের কাঁধে তার মাথা।

‘আমরা কোথায় চলেছি?’

‘আমার নিজের দেশে আমি আর ফিরব না বিভাবতী! সেখানে আমি তোমাকে সম্মান দিতে পারব না! বারগিরের জীবনও আমি আর চাই না। এই দস্যুতা, এই লুণ্ঠন, এই ক্রমাগত ঘোঢ়ার পিঠে বন্দুক বাগিয়ে ছুটে চলা! এজন্যই তো ভোর রাতে শিবির থেকে তোমাকে তুলে এনে নৌকায় উঠলাম! আলীবর্দী নবাবের সৈন্যরা এই মুহূর্তে যুদ্ধে এগিয়ে। আমরা চলে এসেছি উড়িষ্যার চিল্কার পার অবধি। কিন্তু মহারাষ্ট্র থেকে আরো সৈন্য আসছে। আমি প্রাণ ভয়ে পালাচ্ছি না। সামনে বাংলা আর মহারাষ্ট্রের আরো লম্বা লম্বা যুদ্ধ চলবে। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা শ্মশান হয়ে যাবে। আমি এই যুদ্ধে আর দস্যুবৃত্তি করতে চাই না! আমার আর বীর হবার শখ নেই।’ 

‘কিšত্ত, যদি কেউ আমাদের ধরে ফ্যালে?’

‘পারবে না। এই চিল্কার হ্রদ ধরে ভাটিতে গেলে আরো কিছুদূর গিয়েই আবার গঙ্গার মুখ মিলবে। সেখান থেকে আবার পিছু বাইলে আমরা...তোমার দেশ...বাংলায় ফিরে যাব। তুমি ত’ রেশম বুনতে পার। আমাকে রেশম বোনা শেখাবে?’

‘সে যে সব পুড়ে গেছে!’

মুচকি হাসে সুরনাথ। বিভাবতীর ঈষৎ স্ফীত গর্ভে হাত রাখে, ‘কি যে একটা গান গুনগুনিয়ে করো তুমি সবসময়! কি জানি তুমি বুনবে?’

বিভাবতীর সাদা দাঁতগুলো নীল আকাশের নিচে ও ততোধিক নীল চিল্কা হ্রদের জলে হাসিতে বিচ্ছুরিত হয় অজস্র টোপা টোপা সাদা রসুনের মতো...গুনগুন করে ওঠে সে আহ্লাদে...গত দু’মাস ধরে গর্ভে এক নতুন প্রাণ স্পন্দন টের পাবার পর থেকে যে গানে সে থেকে থেকেই তার অনাগত শিশুকে প্রায়ই শোনায়, ‘ধান ফুরলো পান ফুরলো - খাজনার উপায় কি- আর ক’টা দিন সবুর করো...’

‘আমাকে তাঁত বোনা শেখাও...ধান আর পানের আবাদ, রেশম আর রসুন বোনা, বিভাবতী!’

‘আমাদের একসাথে থাকা যদি কেউ মেনে না নেয়?’

‘তবে মুসলমান হয়ে যাব। কিম্বা, ফিরিঙ্গিরা সাগরপাড় থেকে তাদের যে নতুন ধর্ম নিয়ে আসছে, তার ছাতার নিচে ঢুকে পড়ব। ভয়ের কিচ্ছু নেই!’

...সুরনাথ পুনর্বার শক্ত করে চেপে ধরে বিভাবতীর ডানহাত।

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন