কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

সুপর্ণা বসু

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৬


যুদ্ধ

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর অন্যান্য দিনের মত আজ আর বিশ্রাম নিল না সুমেধা। অবশিষ্ট খাবারটুকু ফ্রিজিং করে রাতের রান্না বসাল। যদিও শরীরটা একটু বিশ্রাম চাইছে। কিন্তু উপায় নেই। আজ কবিতা উৎসবে নন্দনের একতারা মঞ্চে তার কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান আছে। রান্নাঘরে এসে ঢুকলেন সুমেধার শাশুড়ি মঞ্জরি। তাঁর চোখে সমূহ বিরক্তি। বাড়ির বউয়ের এই ধিঙ্গিপনা তাঁর পোষায় না!

সুমেধা দ্রুত তৈরি হয়ে নিল। প্রসাধন বলতে চোখের পাতায় সামান‍্য একটু কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক। আগে কোমর ছাপানো চুলের কেশবিন্যাসে একটু বেশি সময় যেত। এখন সে বালাই নেই। একটু কোমিং করে নিলেই হলো। ইরানে যখন হিজাব না পরার অপরাধে মাহসা আমিনীকে মেরে ফেলা হলো, সেদিন প্রতিবাদে  নিজের লম্বা চুল কেটে ফেলেছিল সুমেধা। মঞ্জরি আঁতকে উঠে বলেছিলেন--

--একী করেছ তুমি সুমেধা?

--মেয়েটাকে ওরা শুধু মাথার ক’গাছা চুল দেখা গেছে বলে মেরে ফেললো?

-- কোন মেয়েটাকে?

--ইরানী মেয়েটাকে!

--তাতে তোমার কী? তা বলে তুমি নিজের মাথা এভাবে মুড়োবে?

বিষয়টা এতদূর গড়িয়েছিল যে উৎপল সাতদিন কথা বলেনি সুমেধার সাথে। সুমেধা সারারাত বালিশ ভিজিয়ে কেঁদেছিল সেই ইরানী মেয়েটার জন্য! নাকি নিজেরই জন্য?

তবু নন্দনে পৌঁছতে একটু দেরিই হয়ে গেল। শুনেছিল এই উৎসবে একই মঞ্চে কবিতা পাঠ করতে আসছেন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ইউক্রেনের একজন কবি। সুমেধা দেখল সেই শঙ্খবলাকার মত কবি মেয়েটিকে। তার পরনে সাদাপ্যান্ট টপ। কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা সোনালি চুল। কোমরে জড়ানো ক্যাঙ্গারু-পাউচে একটি মাস তিনেকের ফুটফুটে শিশু। খানিক দূরে তার জোড়াটিকেও দেখতে পেল। ফর্সা রং নীল চোখ আর একমাথা সোনালি চুলের যুবক। স্ত্রীগর্বে কিঞ্চিত গর্বিত যেন! সুমেধা বুকের ভিতরে সামান‍্য জ্বলুনি টের পেল। এতগুলো বছরে উৎপল কোনোদিন সুমেধার কবিতা শুনতে চায়নি। কোনো অনুষ্ঠানে দর্শক শ্রোতার আসনেও তাকে দেখা যায় না।

কী অপূর্ব কবিতা পড়ল বিদেশীনি! তাঁর শরীরে বারুদের গন্ধ ছিল কিনা জানা নেই, তবে ঠোঁটে ছিল কথার ঘূর্ণি! যুদ্ধ, প্রতিবাদ আর ভালবাসার কথা! ত্রাসের সূচ সেলাই করতে পারেনি তার তেজস্ক্রিয় ঠোঁট! ছিঁড়ে নিতে পারেনি জিভ জীবনের আস্বাদ থেকে।

সুমেধা জানে সন্ধ্যেবেলা উৎপল অফিস থেকে ফিরলে যথারীতি একটা খাপ পঞ্চায়েত বসবে। ঘরে ফিরে রাতে অশান্তিও বাদ যাবে না। সেই অশান্তিতে গোলাগুলি না চললেও রাতের ঠান্ডা বিছানায় দুজন বিমুখ মানুষের ভিতর পুড়তে থাকবে আস্ত একটা কিয়েভ শহর।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন