ধারাবাহিক উপন্যাস
একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী
(৪৪)
সাঁঝ একটু হাসল। বলল, আর তারপরই ও টার্গেট করল তোকে। একজন সফল মানুষকে। আর জিতেও
নিল। গোটা দুনিয়ার নজর পড়ল ওর দিকে। যেটা অনির্বেদ বা শ্রমণের ক্ষেত্রে হয়নি, সেটাই
হল। ও লোকের কাছে একটা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল। একটা হৈচৈ পড়ে গেল। একজন সফল মানুষকে
জিতে নেওত্যার চ্যালেঞ্জই আলাদা। তার ওপর সে আবার এনগেজড। এ একটা অ্যাডভেঞ্চারই বটে।
রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা।
ঠিক তাই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিশ্রুত বলল। আর মনের দিক থেকে ওর ওপর কী অসম্ভব
নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি আমি। ও সেটা বুঝে গেছে আর বুঝেই আগ্নেয়র সঙ্গে পুরনো খেলাটা শুরু
করেছে। কিন্তু ওকে আমি বুঝিয়ে দিয়েছি, আমি নির্মাল্য নই।
তাই বোধহয় দিশারীকে তোর এখন প্রয়োজন। তাই না? এটা প্রমাণ করার জন্যই।
এটা প্রমাণ করার কিছু নেই। সবাই জানে আমি নির্মাল্য নই। তুই জানিস না, শ্রমণ?
জানি। শ্রমণ বলল।
তাহলে? এই লেকটা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে আমার জীবনে দিশারী কী ছিল। আমার হৃদয়ে
কতটা জায়গা জুড়ে আছে ও। আমি আত্মপ্রতারণা করছিলাম সাঁঝ। কিন্তু এবার আমাকে ফিরতে হবে।
আমি স্বস্তি চাই। মেহুলী আমাকে দিয়েছে শুধু অস্বস্তি সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা। আমি ক্লান্ত,
বিধ্বস্ত। পুড়ে যাচ্ছি আমি।
আমি আমার ফুলের বাগানে ফিরতে চাই। যেখানে দিশারী ছাড়া আর কেউ নেই।
শ্রমণ কিছুক্ষণ নিবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকে বিশ্রুতর দিকে। তারপর বলে, এত সহজে ক্লান্ত
হয়ে যাস তুই? আমাকে দ্যাখ। আমাকে যা সামলাতে হয় না। অবশ্য তোরা ওসব বুঝবি না।
কথাটা বলেই শ্রমণ আর দাঁড়ায় না। বিশ্রুত আর সাঁঝ চমকে ওঠে। অন্ধকার লেকের দিকে
তাকিয়ে কথাটার মানে বোঝার চেষ্টা করে। শ্রমণ কখনও কিছু বুঝতে দেয়নি। কিন্তু বিশ্রুত
জানে, হৃদয় জানে, সাঁঝ জানে, সে কোনও সাধারণ মানুষ নয়। কিন্তু অসাধারণ মানুষও তো কখনও
কখনও নিজেকে প্রকাশ করে ফেলে। এরকমই অসতর্ক কোনও মন্তব্য ছুড়ে যায়। সে নিজে হয়ত কিছুই
টের পায় না। কিন্তু পাশে যদি কোনও সহৃদয় মানুষ থাকে, তবে সে ঠিক টের পেয়ে যায়। কী বিপুল
ত্যাগ করে চলেছে সে। কী বিপুল চাপ সহ্য করে চলেছে দিনের পর দিন। অন্য কেউ হলে বিলাপে,
দীর্ঘশ্বাসে, আত্মপ্রচারে গোটা দুনিয়া আলোড়িত করে দিত। কিন্তু শ্রমণ শুধু দেয় ওই সামান্য
অসতর্ক আভাস। কিন্তু সেটাই কি যথেষ্ট নয় বিশ্রুতর কাছে? সাঁঝের কাছে?
কয়েকদিন পর হৃদয় ফোন করে প্রাইভেট সেক্রেটারিকে। বলে, আমি আপনার কাছে একবার যেতে
চাই।
বেশ তো! তিনি বলেন। একটা সময় দেন তিনদিন পর। বিকেল পাঁচটায়। আগের সেই দিন আর নেই।
এখন তিনি অনেক বেশী ব্যস্ত।
বিশ্রুত একটু বিরক্ত হয়। বলে, কেন তুই যেতে চাচ্ছিস ওখানে? মেহুলীর কাছ থেকে আমি
খবর পেয়েছি। দিনের পর দিন তোর আর আমার নামে যাচ্ছেতাই গিয়ে বলেছে বিহান। আগ্নেয় আর
অতলান্ত। আমরা নাকি স্বেচ্ছাচারী। ফুলের বাগানটাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছি।
টাকা চুরি করেছি। অন্যদের খাটিয়ে মেরেছি। আর প্রাপ্য কিছুই দিই নি। আমাদের অসম্ভব উঁচু
নাক। দম্ভ। আমরা কাউকে নিজেদের সমকক্ষ মনে করি না। সবাইকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি। এসবের
একটা বিহিত করা উচিত। আমাদের উচিত শাস্তি হওয়া উচিত। ইত্যাদি ইত্যাদি।
সে এসব বিশ্বাস করেছে?
অবিশ্বাসই বা করবে কেন? আমরা কোনওদিন তাকে গ্রাহ্য করেছি? আমাদের বিরুদ্ধে সে ফুঁসছে।
বিশেষ করে তোকে সে ঈর্ষা করে। নিজের প্রতিপক্ষ ভাবে। সে জানে, ফুলের ব্যাপারে তোর জ্ঞান
কত গভীর, আর তার নিজের যোগ্যতা কত কম। অথচ তার সাফল্য অনেক বেশী। সে তোকে ছাড়বে কেন?
বিহান এমনি এমনি অত খাতির করত না অতলান্তকে। এখন ও প্রাইভেট সেক্রেটারর খুব কাছের মানুষ।
অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য। তুই কেন যাচ্ছিস ওখানে?
কেন জানিস? হৃদয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর বলে ফুলের বাগানটাকে বাঁচাতে চাই।
কথা বলে দেখি, ওদের কম্পানি থেকে যদি কোনও সাহায্য পাই। এব্যাপারেও কি বিহান বাধা দেবে
বলে তোর মনে হয়? ও কি ফুলের বাগানকে ভালোবাসত না?
ঠিক আছে। তুই চেষ্টা করে দ্যাখ। এবার রাজি হয় বিশ্রুত। হয়ত ওর মনেও একটু আশা জেগে
ওঠে।
প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করবে বলে হৃদয় রওনা হয়। মনে খুব আশা। হয়ত একটা
সুরাহা হবে।
ঠিক এই সময় হঠাৎ বিহানের ফোন এল। হৃদয় তুই কোথায়? আমি প্রাইভেট সেক্রেটারির অফিস
থেকে বলছি।
আমি আসছি।
মিনিট পনেরো আগে আসতে পারবি?
চেষ্টা করছি। বোধহয় পারব না। পাঁচটায় তো পৌঁছানোর কথা।
জানি।
হৃদয় একটু তাড়াহুড়োই করে। ও সবসময় ঠিক সময়ে পৌঁছাতে চেষ্টা করে। পরে যেমন পৌঁছতে
চায় না, তেমনই আগে পৌঁছনোও ওর পছন্দ নয়। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে...
পনেরো মিনিট নয়, হৃদয় মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ওদের অফিসে পৌঁছতে পারে। ঘোরানো সিঁড়ি
দিয়ে উঠতে উঠতেই ওর একটু সন্দেহ হয়। খুব অন্ধকার সেই সিঁড়ি। কোথাও কোনও আলো নেই। এই
অফিসে আগেও এসেছে ও। তাই অসুবিধা হয় না।
দোতলায় উঠে দ্রুত প্রাইভেট সেক্রেটারির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। খুব হাঁপাচ্ছিল
ও। অন্তত এই ঘরে আলো জ্বলার কথা। প্রাইভেট সেক্রেটারি আর বিহানের থাকার কথা। কিন্তু
দরজায় তালা ঝুলছে। ভেতরে অন্ধকার। কোথায় গেল ওরা? ও যে আসছে, সে কথা তো ওরা জানে।
হৃদয় এদিক ওদিক তাকায়। এমন সময়ে দেখতে পায় একজন বেয়ারা ওকে দেখে এগিয়ে আসছে। হৃদয়
জানতে চায়, উনি কোথায়? প্রাইভেট সেক্রেটারি?
উনি তো বেরিয়ে গেলেন।
বেরিয়ে গেলেন? আমার আসার কথা ছিল যে!
তা তো জানি না। লোকটি নিরুপায়ের মতো বলে। সত্যিই সে কিছু জানে না।
কতক্ষণ আগে বেরিয়ে গেলেন? হৃদয় জানতে চায়।
এই তো গেলেন। তা দশ মিনিট আগে।
ঠিক পনেরো মিনিট। বিহান পনেরো মিনিটের কথাই বলেছিল। হৃদয় ফোন করে বিহানকে। তারপর
বলে,
আমি পৌঁছে গেছি।
বিহান কি হেসে উঠল একটু? ঠিক বুঝতে পারল না হৃদয়। বিহান বলল, আমরা তো বেরিয়ে এসেছি।
কেন? তোরা জানতি না আমি আসছি? হৃদয়ের গলায় ঝাঁঝ।
জানতাম। তোকে বলি নি, পনেরো মিনিট আগে আসতে?
পনেরো মিনিট আগে বেরোলে পনেরো মিনিট আগে এসে লাভ কী? কথা হত কখন? সবই যখন জানতি,
আমায় আসতে বললি কেন? শুধু শুধু এলাম আমি।
এসব আমায় বলছিস কেন? এবার বিহানের গলাতেও ঝাঁঝ। তুই প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে
কথা বল।
গম্ভীর গলা তার। সে বলল, হ্যাঁ হৃদয় বলো...
আমি এসেছিলাম।
হ্যাঁ, একটা জরুরি কাজে...
যেন হৃদয়ের আসাটা কোনও ব্যাপারই না। থাকবে না জেনেও ওকে অনায়াসে আসতে বলা যায়।
ও ফিরে গেলে কিছুই যায় আসে না। ও এতটাই তুচ্ছ, গুরুত্বহীন।
হৃদয় বলে, আমাকে জানাতে পারতেন...
বিহান তো তোমায় জানিয়েছে...।
কখন জানিয়েছে? আমি তো তখন রাস্তায়।
তোমাকে ফিরে যেতে বলে নি?
না, আসতেই বলেছে, তবে পনেরো মিনিট আগে।
হঠাৎ প্রাইভেট সেক্রেটারির গলার স্বর পালটে যায়। তিনি গর্জে ওঠেন, তুমি মিথ্যে
বলছো...
হৃদয় হতভম্ব হয়ে যায়। তারপর বলে আমি রাখছি।
বিশ্রুত সব শুনে বলে, তোকে তাচ্ছিল্য করতে, অপমান করতেই ওরা ডেকেছিল। পুরোটাই সাজানো
ব্যাপার। তোকে ডেকেও পালিয়ে গেল। বুঝিয়ে দিল, তোকে অনায়াসে ডাকা যায়। ডেকেও দেখা না
করে চলে যাওয়া যায়। তুই শুধু শুধু এসে ফিরে গেলেও ওদের কিছু যায় আসে না। এদের কাছে
সাহায্য চাইতে গেছিলি তুই?
তুইও তো বুঝিস নি। হৃদয় বলে। ঠোঁটের কোণে করুণ হাসি।
আমি তো তোরই মতো। বিশ্রুত জড়িয়ে ধরে হৃদয়কে। ওর চোখের কোণে জল। তারপর বলে, মানুষকে
কত সহজে আমরা বিশ্বাস করি। ভালোবাসি।
এটাই তো আসল কথা। হৃদয় বলে। তাই তো তুই দিশারীকে ফিরে পেলি। ওই ভালোবাসার জোরে...
একটা কথা ছিল হৃদয়। হঠাৎ বলে ওঠে বিশ্রুত।
কী রে?
একটু সঙ্কোচ নিয়ে বিশ্রুত বলে, লোকে বলে আমি নাকি নিজের পেশায় একজন সফল মানুষ।
সাফল্য কী, আমি জানি না। তবে গত কয়েক বছর ধরে আমি কিছু টাকা জমিয়েছি। সেটা তোকে নিতে
হবে ফুলের বাগানের স্বার্থে। আমাদের সবার আরও একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য।
সেটা হয় না বিশ্রুত। তুই অনেক করেছিস। কিন্তু তোর প্রয়োজনের টাকা আমি নিতে পারবো
না। তোরও একটা জীবন আছে। তাছাড়া দিশারী কী বলবে?
বন্ধু, এই টাকা তোকে নিতেই হবে। ফুলের বাগানের কথা ভেবেই আমি জমিয়েছি। আমি জানতাম,
এরক একটা দিন আসবে। আমার এটা অধিকার।
ঠিক আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে হৃদয়। এরপর আর কথা চলে না। তোর অধিকারের জায়গা
এটা...। আমি বলার কে? আমি নেব।
এই সময়েই একদিন শ্রমণের সঙ্গে সাঁঝের দেখা হয়ে গেল। সমুদ্রের ধারে একটা চারদিক
খোলা রেস্তরাঁয়। সন্ধে হবো হবো করছে। অবিরাম আছড়ে পড়া ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে সমুদ্রের
ধার দিয়ে ওরা হাঁটছিল। শ্রমণ জানতে চেয়েছিল, অতলান্তের কী খবর?
আমার সব খবরই পুরোনো। নতুন খবর সব বেদপর্ণার কাছে।
শ্রমণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর বলে, কেন মানুষ এরকম করে?
সাঁঝ হাসে। তারপর বলে, সব মানুষ তোর মতো নয় বলে...
আমার কথা বাদ দে। শ্রমণ উড়িয়ে দেয়।
কেন? সাঁঝের চোখে কৌতুক। বলে, তোর কথাই এখন আমার সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে। একটার পর
একটা দিদি। শেষে ভাগ্নী। এই দুনিয়ায় এরকম একজন মানুষ! দায়িত্ব, কর্তব্য এগুলো এখন হাতের
ময়লা হয়ে গেছে। যে যার মতো ঝেড়ে ফেলতেই ব্যস্ত। আর তুই? পর্বতপ্রমাণ দায়িত্ব ছিল তোর
ঘাড়ে। অন্য কেউ হলে কবেই পালিয়ে যেত। ওই যে তুই বাইরে চলে গেছিলি, সেভাবেই যেত। কিন্তু
আর ফিরে আসত না। তুই কী করলি? নিজের বুক পেতে দিলি। তোকে প্রণাম করতে ইচ্ছা করে আমার।
সত্যিই শ্রমণের বুকে আনন্দের ঢেউ ওঠে। তারপর বলে, অন্য কেউ তো এভাবে বল;এ না। তুই
খুব উদার। তোর হৃদয় খুব বড়ো...
তোর মতো নয়। সাঁঝ বলে। একটা কথা ছিল। এবার তুই নিজের দিকে তাকা। ভাগ্নীর বিয়েটাও
তো হয়ে গেল। বিপুল খরচ। একটার পর একটা। কিন্তু তোরও তো জীবনে থিতু হওয়া দরকার। এবার
তোর উচিত...
খুব লজ্জা পায় শ্রমণ। তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে।।কিন্তু তেমন কেউ তো...
তুই ঠিক হৃদয়ের মতো। হঠাৎ বলে ওঠে সাঁঝ।
আমি আমার মতো। শ্রমণ বলে।
হৃদয়কে তুই এড়াতে চাস। অথচ হৃদয়কে ছাড়া তোর চলে না।
কিন্তু ওর মধ্যে কী যেন একটা আছে। কী যেন একটা। খুব টানে আমাকে। আর খুব ভয় হয়।
কিন্তু হৃদয়ের কথা থাক। ঠিক এই মুহূর্তে...
আমি এখন হৃদয়ের বাড়িতেই যাব।
থাক না। শ্রমণ বলে। আমরা বরং...
হঠাৎ সাঁঝ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শ্রমণের বুকে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন