কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ৮২

 

করোনা ভাইরাস জনিত বিশ্বব্যাপী সংক্রমিত মহামারী এবং অতিমারীর সাংঘাতিক দাপট এখনও অব্যাহত আছে। প্রতিদিনই মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে, তাদের মৃত্যু হচ্ছে, আবার অনেকেই সুস্থ হয়েও উঠছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লকডাউনের দরুন সবরকম কাজ ও কারবার থমকে দাঁড়িয়েছিল, সামাজিক ব্যবস্থা ও সম্পর্ক বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, মৃত্যুর আশঙ্কায় মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল, এখন অবশ্য সেই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে, দোকান-বাজার সচল হয়েছে, বিভিন্ন অফিসে ও কারখানায় কর্মোদ্যোগ চালু হয়েছে। যদিও এই চালু হওয়ার তুলনায় এখনও বন্ধ বা অবরুদ্ধ থাকার তালিকা দীর্ঘ। শিক্ষাঙ্গনগুলি এখনও খোলা সম্ভব হয়নি, বিনোদনের কেন্দ্রগুলিও নিঝুম হয়ে আছে। সারা বিশ্বের মানুষ প্রতীক্ষায় দিন গুনছে, কবে সেই মৃতসঞ্জীবনীর মতো এসে উপস্থিত হবে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন। আমরা আশা করতেই পারি, শরীরে এই প্রতিষেধক প্রবেশের পরে আমরা এই মহামারী এবং অতিমারী থেকে সম্ভবত পরিত্রাণ পাব। হয়তো নতুন করে আর সংক্রমণের শিকার হব না। বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত আবশ্যিক পারস্পরিক দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধি নিষেধ শিথিল হবে। কোথাও জনসমাগমে বাধ্যতামূলক আর কোনো বাধা থাকবে না। আগের মতোই আমরা একটু একটু করে ফিরে পাব আমাদের সেই সহজ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন। সঙ্গীতশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তীর গানের কথায় বলা যায় – ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে’। 

 

প্রকৃতি নিজের নিয়মেই চিরদিন যেমন উন্মত্ত হয়েছে, তেমনি নিজের নিয়মেই শান্তও হয়েছে। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। এই নিয়ম মেনেই সীমাহীন ব্রক্ষ্মান্ড প্রতিনিয়ত চলেছে, চলছে এবং চলবেও। আর সেই নিয়মেরই অন্তর্গত যাবতীয় সৃষ্টি ও ধ্বংসের ধারাবাহিকতা। সেই সৃষ্টি ও ধ্বংসের কর্মকান্ড এতই বিশাল ও ব্যাপক যে, তার অনুমান ও সন্ধান আমরা পৃথিবী নামের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহে বসবাস করে কতটুকুই বা করতে পারি! আমাদের জানার পরিধি আর কতটুকু! আর সেই পরিধি এতটাই তুচ্ছ যে, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ অজানার তল খুঁজে না পেয়ে, এক আজগুবি অলৌকিক শক্তির কল্পনা করে তারই হাতে সব সৃষ্টি ও ধ্বংসের দায় দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিজেদের সঙ্গেই নিজেরা ছলনা করে চলেছে। তবে হতাশারও কিছু নেই। সংখ্যায় সংখ্যাগুরু না হলেও পৃথিবীতে সেইসব মানুষেরা আছেন, যাঁরা যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন সমাজ ও বিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং কোনো অলৌকিক ক্ষমতা ও শক্তিকে নয়, মানুষের নিজের মধ্যে যে নিহিত ক্ষমতা শক্তি ও মেধা আছে তার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন প্রায়োগিক কাজে ব্রতী হন এবং জীবন সমাজ ও বিশ্বকে আরও বেশি বাসযোগ্য করে তোলেন। আর এইসব মানসিকতার মানুষের জন্যই আমরা প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করি।

 

কালিমাটি অনলাইন ব্লগজিনের প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে আবার বিনীত  অনুরোধ জানাই, আপনারা এই ব্লগজিনে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা পড়ে আপনাদের অভিমত ফেসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে নয়, বরং ব্লগজিনে প্রতিটি লেখার নিচে যে কমেন্ট বক্স আছে, সেখানে পোস্ট করুন। আর ব্লগজিনের শ্রদ্ধেয় লেখক-লেখিকাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনাদের লেখার লিংক শুধুমাত্র ফেসবুকে এবং হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করবেন, লেখাটি নয়, যাতে আগ্রহী পাঠক-পাঠিকারা ব্লগজিনে প্রবেশ করে আপনাদের লেখা পড়তে পারেন।

 

সবার সুস্থতা একান্তভাবে কামনা করি। 

   

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com                   

দূরভাষ যোগাযোগ :           

08789040217 / 09835544675 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

 

কথনবিশ্ব


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১




বহু বছর হল বিদেশি সিনেমা দেখি। এখন তো প্রায় প্রতিরাতে অভ্যেস হয়ে গেছে। হলিউড, ইউরোপিয়ান, লাতিন আমেরিকান, এশিয়ান – খুঁজে বের করার চেষ্টা করি কারা ভাল কাজ করছে। কাদের চিন্তাভাবনা আমাদের মনে ছাপ ফেলছে। এমনকি কোভিডের সময়ে এই হতাশা আর ধৈর্যচ্যুতির সময়েও প্রায় প্রতি মাঝরাতে চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে এলে আমার কম্পিউটারে রিল ঘুরতে থাকে। তো, সিনেমা নিয়ে বলতে শুরু করলে সাধার ভাবে ঠিক যেখানে শুরু করা উচিৎ, ‘গন উইথ দ্য  উইন্ড’ (১৯৩৯), ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১), ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ (১৯৪৯)... এরকম কয়েকটা ছবি নিয়ে, যারা বিশ্ব সিনেমার ভাষা আর নির্মাশৈলির পথ  দেখিয়েছে, আমি আপাতত সেই রাস্তা দিয়ে যাব না। বরং এই করোনার আবহে সময় কাটানোর জন্য ভাইরাস বিষয়ক যে বেশ কিছু হলিউড সিনেমা দেখলাম, শুরুর লেখাতেই তার ভেতর দু্টো বেছে নেব এক বিশেষ কারণে। একটা ২৫ বছর, আরেকটা  ৯ বছর আগের ছবি। কিন্তু দুটোই মনে আশা জাগায়। ভাইরাসকে পর্যুদস্ত করে সুস্থ সমাজের আশা।

প্রথম সিনেমার নাম ‘আউটব্রেক’। ১৯৯৫ সালেরপরিচালক ডব্লু পিটারসেন। মুখ্য চরিত্রে ডাস্টিন হফম্যান, মর্গ্যান ফ্রিম্যান, রেনি রুশো। ছায়াছবি শুরু হচ্ছে নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী জোশুয়া লিডারবার্গের এক ভুলতে না পারার মত উক্তি দিয়ে – ‘যতদিন ভাইরাস থাকবে, ততদিন পৃথিবীতে মানুষের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখা কঠিন’। এই ছবি ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে এক ডাক্তার দম্পতির প্রাণপণ  লড়াইয়ের ছবি। ছবির প্লট এইরকমঃ ১৯৬৭ সালে যুদ্ধবিদ্ধস্ত আফ্রিকার এক সেনা ছাউনিতে মোটাবা নামক এক প্রাণঘাতী ভাইরাস পাওয়া যায় (এই ভাইরাসের চরিত্র অনেকটা বাস্তবের ইবোলা ভাইরাসের মত)। একে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়া থেকে রুখে দেওয়ার জন্য এবং এর অস্তিত্ব গোপন রাখার জন্য আমেরিকা সেই সেনা ছাউনি বোম ফেলে নিশ্চিহ্ন করে দেয়কিন্তু ২৮ বছর পর, ১৯৯৫তে, আফ্রিকার অন্য এক গ্রামে আবার সেই একই রকম সংক্রম ও পরপর মৃত্যুএই  ভাইরাস হাওয়াবাহিত নয় কিন্তু একের সংস্পর্শে আরেকজন এলে সেও সংক্রমিত হয়। আমেরিকান সেনাবাহিনীর এক ডাক্তার-কর্নেল তার টিম নিয়ে সেখানে গিয়ে ভাইরাসের নমুনা এনে পরীক্ষা করলেন। এবং সেনাবাহিনীর উচ্চতম কর্তৃপক্ষ গোপনে দেখলেন, ২৮ বছর আগের ও পরের এই ভাইরাসের গঠন প্রায় এক। অর্থাৎ মোটাবা ভাইরাস কোনওভাবে ফিরে এসেছে। সেই ডাক্তার-কর্নেল কর্তৃপক্ষকে আরো সাবধান করলেন যে এই ভাইরাস কিন্তু আমেরিকাতেও ছড়াতে পারে। যদিও কেউ তার কথায় আমল দিল না। কিছুদিন পর হঠাৎ দেখা গেল, আমেরিকার প্রত্যন্ত এক শহরতলী সিডার ক্রিকে এই ভাইরাসের সংক্রম ঘটেছে সেই ডাক্তার-কর্নেল পরীক্ষা করে দেখালেন যে আফ্রিকা আর সিডার ক্রিকের ভাইরাস গঠনগত ভাবে এক হলেও আমেরিকায় এসে এই ভাইরাস মিউটেশন করে নিজের প্রোটিন কোড বদল করে নিয়েছে। তার চারপাশে এখন অসংখ্য স্পাইক যার ফলে এই ভাইরাস এখন হাওয়ায় ভেসে থাকতে পারে, হাওয়ায় সংক্রম ঘটাতে পারে। সেনাবাহিনী এসে পুরো শহরতলী সিল করে দিল।  আক্রান্তদের কোয়ারেন্টাইন করে দেওয়া হল। এবং সেই ডাক্তার-কর্নেল ও তার স্ত্রী খুঁজে বের করলেন যে আফ্রিকার এক বিশেষ প্রজাতির সাদা-কালো বাঁদর হচ্ছে এই মোটাবা ভাইরাসের হোস্ট। অর্থাৎ সেই বাঁদরদের থুথু থেকেই এই ভাইরাস ছড়ায় কিন্তু তাদের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি বলে এই ভাইরাস তাদের কাবু করতে পারে না। এরপর এক টানটান নাটুকেপনার মাধ্যমে মুভি শেষ হয় সেই বাঁদরকে, যাকে আফ্রিকা থেকে আমেরিকা আনা হয়েছিল, খুঁজে পেয়ে তার রক্ত থেকে সিরাম থেরাপির মাধ্যমে এবং সেনাবাহিনীকে ঐ শহরের ওপর বোম ফেলতে না দিয়ে। সবশেষে দেখা যায়, সিরাম থেরাপির মাধ্যমে সিডার ক্রিকের বেশিরভাগ মানুষ আস্তে আস্তে ভাল হয়ে উঠছে

যদিও এই ছবির শেষদিক অনেকটা বাজার-চলতি হিন্দি সিনেমার মত, তবুও সামগ্রিকভাবে দেখে মনে হল, এই সিনেমার সঙ্গে  বর্তমানের করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর নিচের মিলগুলো পাচ্ছি-

১) করোনা ভাইরাসের ইতিহাস বেশ পুরনো। ঘেঁটে দেখতে পেলাম, প্রথম এই ভাইরাস খুঁজে পাওয়া যায় ১৯৩১ সালে। মুরগির দেহে। মানুষের দেহে প্রথম করোনা ধরা পড়ে ১৯৬০ সালে। তারপর বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন রূপ মানুষের দেহে ধরা পড়েছে। ২০০৩এ সার্স-কোভ, ২০০৫এ এইচ-কোভ, ২০১২য় মার্স-কোভ। করোনা ভাইরাসের সর্বশেষ রূপ এই কোভিড-১৯। ২০১৯ সালে ধরা পড়েছে বলে একে কোভিড-১৯ (COrona VIrus Disease-19) নাম দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এই কোভিড-১৯ বেশ কিছু বছর পর ফিরে আসা করোনার এক নতুন অবতার।  

২) এই ভাইরাসের গোল পৃষ্ঠতল জুড়ে প্রচুর প্রোটিন স্পাইক। এবং যা কিছুদিন আগেও হাওয়াবাহিত ছিল না বলে ‘হু’ জানিয়েছিল, আজ তারাই বলছে কোভিড-১৯ হাওয়ায় ২৫ ফুট পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ কোভিড-১৯ নিজেকে  অনবরত মিউটেশন করে চলেছে।  

৩) হু বলছে, এই ভাইরাস সংক্রমণের মুশকিল হল, এতে আক্রান্ত ৮০% মানুষের দেহে কোন উপসর্গ বোঝা যায় না। তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা (অ্যান্টিবডি) ভাল বলে এই ভাইরাস তাদের দেহে ২-২১ দিন থেকে তাদের মাধ্যমে আরেক দেহে চলে যায়। বাকি ২০% মানুষের দেহে, যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল নয়, তাদের দেহেই এর উপসর্গ ফুটে ওঠে। এবং সেখানেও এই ভাইরাস ৪৯ দিন পর্যন্ত জীবিত  থাকতে পারে। বুঝুন কান্ড! মানে আমার বা আপনার দেহে এই ভাইরাস এখন, এই মুহূর্তে, লুকিয়ে আছে কিনা আমরা বুঝতেই পারব না, যদি আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল হয়। অথচ আমরা দিব্বি অন্যদের সংক্রমিত করে চলব। ঠিক সিনেমার ঐ বাঁদরটার মত।  

৪) ভাইরাস বাহিত রোগের এক কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থার নাম প্লাজমা-থেরাপি বা সিরাম-থেরাপি (বলে রাখা ভাল যে রক্তের প্লাজমা আর সিরামের ভেতর একটা ছোট পার্থক্য আছে)। এই সিনেমার শেষ ভাগে সেটাই দেখানো হয়েছে। বেশির ভাগ  দেশ ইতিমধ্যেই কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে এই চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছে ও সফল হয়েছে। ভারতেও প্লাজমা-থেরাপি করে বেশ ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে। এটাই এই ছবির সেরা পাওয়া




আজ থেকে ২৫ বছর আগের এক কল্প-সিনেমা। কিন্তু ভাইরাস ঘটিত রোগের বিরুদ্ধে এত সংগঠিত চিত্রায়ন দেখে একটু উৎসাহী হয়ে ছায়াছবির নামের লিস্টে দেখলাম কারা কারা আছেন। অবাক হয়ে দেখি, একজন চিফ মেডিকেল অফিসার। পাঁচজন মেডিকেল পরামর্শদাতা। একজন টেকনিকাল গবেষক। আরেকজন টেকনিকাল পরামর্শদাতা। সবার ওপরে একজন রিসার্চ হেড। এদের ভেতর তিনজন পি-এইচ-ডি বা ডি-এস-সি, তিনজন এম-ডি। বোঝাই যাচ্ছে সেই সময় এই সিনেমা ঠিকঠাক ফুটিয়ে তোলার জন্য এরা এত রিসার্চ করেছিলেন যে আজ করোনার আবহেও এই সিনেমা কত প্রাসঙ্গিক। 

 

দ্বিতীয় ছবি ‘কন্টাজিয়ন’। ২০১১ সালের। পরিচালক স্টিভেন সোদারবার্গ। মুখ্য চরিত্রে লরেন্স ফিশবার্ন, ম্যাট ডেমন, কেটি উইন্সলেট, মারিয়ন কোটিলার্ড (কেটি  ও মারিয়ন দুজনেই খুব সুন্দরী নায়িকা এবং অস্কার প্রাপ্ত, ফলে এই ছবি আরো আকর্ষক হয়ে উঠেছে)। এই সিনেমা আউটব্রেক-এর তুলনায় অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক। এবং তদ্দিনে সার্স-কোভ বা এইচ-কোভ মানুষের দেহে সংক্রম ছড়িয়েছে। ফলে এই সিনেমা বানানোর সময় পরিচালকের হাতে ভাইরাস সংক্রমণের অনেক তথ্য ছিল। তবুও অবাক হলাম, ন’বছর আগের এই ছায়াছবি  যেন অবিকল আজকের কোভিড-১৯এর অবস্থা। এমনকি নিজের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য একটি প্রদেশ যেভাবে প্রকৃত তথ্য লুকিয়ে রাখছে, সেটাও এখানে দেখানো  হয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণের পর সাসপেন্স বজায় রেখে প্রতিদিনের হিসেবে এই  ছবি এগিয়ে চলে যাতে প্রতিদিন কত সংক্রম হয় সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। ছবির  প্লট অনেকটা এইরকমঃ এক মাঝবয়েসি মহিলা, কোম্পানি এক্সিকিউটিভ, অফিসের কাজে হংকং থেকে আমেরিকায় বাড়ি ফেরার দুদিন পর হঠাৎ খিঁচুনি সহ পড়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্ত্তি হন এবং কোন এক অজানা রোগে সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। ঐ মহিলার স্বামী হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় খবর পান যে বাড়িতে তাদের ছেলেও ঐ একই সময়ে মারা গেছে। মহিলার স্বামীকে কোয়ারেন্টাইন করা হয় কিন্তু দেখা যায় যে তার দেহের ইমিউনিটি সিস্টেম ভাল থাকার জন্য এই অজানা রোগ ওনাকে আক্রম করতে পারে নি। আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে এবং  পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় এই অজানা রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাসকে ‘নোভেল ভাইরাস’ MEV-1 নাম দেওয়া হয়। এর উপসর্গ হিসেবে দেখা যায় প্রচন্ড জ্বর ও শ্বাসকষ্ট। এবং আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ বা ছুঁয়ে দেওয়া কোন বস্তু থেকে এই রোগ ছড়াতে থাকে। আমেরিকার অনেক প্রদেশে লক-ডাউন ঘোষণা করে দেওয়া হয়। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষিদে আর অভাবের জ্বালায় লুঠপাট ও অরাজকতা শুরু করে‘হু’ সেই মাঝবয়েসি মহিলাকে এই ভাইরাসের প্রথম মৃত হিসেবে ঘোষণা  করার পর হংকং-এ থাকাকালীন ম্যাকাউ–এর ক্যাসিনোয় উনি কাকে কাকে সংক্রমিত করেছেন সেটা খুঁজতে থাকে। আমেরিকা এই নোভেল ভাইরাসের জিনোম ডিকোড করে দেখতে পায় এর ভেতর বাদুড় আর শুয়োরের জিন মিশে আছে। আমেরিকার এক বিজ্ঞানী এক কৃত্তিম ভাইরাসের সাহায্যে এই ভাইরাসের টীকা আবিষ্কার করেন। কিন্তু জীবজন্তুর ওপর প্রয়োগ শেষ করে তা মানুষের দেহে প্রয়োগ করতে অনেক সময় লাগবে বলে এক ডাক্তার স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের দেহে এই টীকা প্রয়োগ করে দেখেন তা কাজ করছে। অবশ্য ততদিনে আমেরিকায় ২৫ লাখ আর পৃথিবীতে আড়াই কোটি মানুষ মারা গেছে। এরপর আমেরিকান সরকার এই টীকা লটারি করে জন্মদিন অনুযায়ী একে একে সমস্ত নাগরিকদের দিতে শুরু করে। সবশেষে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখায় যে ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দিন, চিনের কোন  এক জঙ্গলে এই রোগের সংক্রমিত বাদুড় একটুকরো খাবার এক শুয়োরের ফার্মে ফেলছে, সেটা এক শুয়োর খাচ্ছে ও সংক্রমিত হচ্ছে, সেই শুয়োর ম্যাকাউ-এর  ক্যাসিনোয় রান্নার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং শুয়োরের ভাইরাস আক্রান্ত শেফ সেই মহিলার সঙ্গে করমর্দনের জন্য এগিয়ে এলেন। তার থেকেই সেই মহিলার দেহে সংক্রম ছড়াল। তারপর অন্যান্যদের।

ছবিতে নাটকীয়তার প্রয়োগ না করে পরিচালক ডিটেলিং-এর দিকে বেশি নজর দিয়েছেন। ফলে এই সিনেমা আজকের আবহে আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং এর প্রতি ধাপ যেন বারবার কোভিড-১৯এর কথা মনে করিয়ে দেয়। বাদুড় থেকে সংক্রম ছড়িয়ে পড়ছে চিনের মাংস বাজারে, সেখান থেকে মানুষে।  তারপর মাস্ক পরা থেকে শুরু করে ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্স, কোয়ারেন্টাইন, লক-ডাউন, জিন গবেষণা, কৃত্রিম ভাইরাস বানিয়ে এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি - আজকের করোনাকে থামানোর জন্য এই মুহূর্তে যা যা করা হচ্ছে,  তার সব এই ছবিতে আছে।

এই ছবির টেকনিকাল পরামর্শদাতা ছিলেন অন্তত এক ডজন বিশেষজ্ঞ। সবার ওপরে রিসার্চ হেড ছিলেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনফেকশন অ্যান্ড ইমিউনিটি-র অধ্যক্ষ প্রফেসর ইয়ান লিপকিন, যাকে আমেরিকার সেরা ভাইরাস রোগ বিশেষজ্ঞ বলা হয়। এরা সবাই চেয়েছিলেন এই সিনেমায় একুশ শতকের ভাইরাস সংক্রান্ত সম্ভাব্য মহামারী বা অতিমারীর চিত্র নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে, যাতে জনগ ভবিষ্যতের কথা ভেবে সচেতন হয়। আমার মতে, করোনার আবহে  এই ছবি একবার দেখলে মন্দ লাগবে নাঅন্তত এই সময়ে দাঁড়িয়ে করোনার প্রভাব কী রকম হতে পারে সেটা বোঝা যাবে। এবং ভাইরাসের সাথে সাথে সমাজে কীভাবে রাজনীতি বা ব্যক্তিগত স্বার্থ ছড়িয়ে পড়ে, সেটাও একঝলক দেখে নেওয়া  যাবে।

তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই সিনেমা দুটো দেখে খুশি হয়েছি এক অন্য কারণে। এই দুটো ছবি গল্পচ্ছলে দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি যদি কোন মারণ রোগ দেয়, তাহলে প্রকৃতির ভেতরেই তার নিরাময়ের বীজ লুকিয়ে থাকে। সেটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে খুঁজে নিতে হয়। এবং কোভিড-১৯এর মত ঘাতক ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক বা চিকিৎসার পদ্ধতি কী কী হতে পারেভাবলে অবাক হবেন, এই মুহূর্তে আমরা কিন্তু অনেকটা সেই দিকেই এগোচ্ছি। আসুন, একঝলক দেখে নিই  এখন কোভিড-১৯এর বিরুদ্ধে গোটা পৃথিবীর কোন্‌ ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের মনে আশা জাগাচ্ছে প্রতি ক্ষেত্রেই মূলত রোগির অ্যান্টিবডি আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

১) প্লাজমা থেরাপিঃ কোভিড-১৯ আক্রম থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের রক্ত  থেকে প্লাজমা নিয়ে সেটা ল্যাবে প্রসেস করে এখনকার আক্রান্তদের চিকিৎসা করা হচ্ছে। ঐ প্লাজমার ভেতর থাকে শক্তিশালী অ্যান্টিবডি যা কোভিড-১৯এর বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা দেয়। এই পদ্ধতিকে বলে প্লাজমা থেরাপি। ঠিক যেরকম ‘আউটব্রেক’-এ দেখানো হয়েছে। আগেই বলেছি যে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ ইতিমধ্যেই কোভিড-১৯এর বিরুদ্ধে এই চিকিৎসা চালাচ্ছে ও সফল হয়েছে।

২) আর-এন-এ থেকে করোনা প্রতিষেধকঃ যেহেতু কোভিড-১৯ একটি আর-এন-এ প্রধান ভাইরাস, তাই এর জিন থেকে কিছু উপাদান নিয়ে যদি মানুষের দেহে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়, তাহলে এই ভাইরাসের প্রোটিন স্পাইকের মত নতুন কিছু স্পাইক তৈরি হবে। এবং সেই নতুন প্রোটিন স্পাইক ইমিউনিটি দেবে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত কোভিড-১৯কে প্রতি পদে মেরে ফেলতে চাইবে। বেশ কিছু দেশ এই রাস্তায় এগোচ্ছে।

৩) কৃত্রিম ভাইরাস থেকে করোনা প্রতিষেধকঃ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা  এই নিয়ে কাজ করে প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন হিউম্যান ট্রায়াল চলছে। এই পদ্ধতি একদম ‘কন্টাজিয়ন’ সিনেমার মত। শিম্পাঞ্জীর শরীরে থাকা জ্বর-সর্দি-কাশির ভাইরাসকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাহায্যে কোভিড-১৯ সাইজের প্রোটিন স্পাইক-ওয়ালা ভাইরাসে পরিত করা হয়েছে যা মানুষের শরীরে ইঞ্জেক্ট করলে  কোভিড-১৯এর বিরুদ্ধে ইমিউনিটি তৈরি করবে

৪) স্টেম সেল থেরাপিঃ শিশু জন্মের আগে সে মায়ের গর্ভে মরা বা গর্ভপত্রের  (প্লাসেন্টা) ভেতর থাকে। তার সঙ্গে মায়ের যোগাযোগ রক্ষা করে তার নাভি থেকে মায়ের অমরা পর্যন্ত একটা নল (আমবিলিকাল কর্ড)। জন্মের সময় সেই অমরা  প্রায় পুরোটাই বাইরে বেরিয়ে আসে। অমরা আর এই নলের ভেতর থাকে কিছু আশ্চর্য কোষ, যার নাম স্টেম সেল। সেইসব কোষ থেকে বিজ্ঞানীরা বানিয়ে ফেলেছেন এক ধরনের স্মার্ট কোষ যার প্রোটিন প্রায় মৃত্যুমুখী করোনা রোগীকে আবার সুস্থ করে তুলেছে। ইজরায়েলে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ইতিমধ্যেই ১০০% সাফল্য এসেছে। এবার এটা অনেকের জন্য কীভাবে কম সময়ে কম খরচে করা যায়, সেটাই চ্যালেঞ্জ।

 


যাইহোক, কোভিড-১৯কে হারাতেই হবে। বিজ্ঞানের হাত ধরে এক নতুন সূর্যোদয় দেখার আশায়। আর সেজন্যই এই সিনেমা দুটোর কথা প্রথম লেখাতেই তুলে আনলাম। পরের বার আবার ভাইরাস নিয়েই আরো কয়েকটা সিনেমার কথা লিখব, একটু অন্যরকম স্বাদের। দেখতে পাবেন, সেখানেও আজকের পৃথিবীর সঙ্গে কীভাবে মিল উঠে আসছে।  


শিবাংশু দে

 

অর্ধসত্যে কামাচ্ছন্ন হে সুন্দর - ২       



  


তুঙ্গভদ্রার তীরে

বিট্ঠল মন্দির ও কৃষ্ণবাজার এলাকাটি বিরূপাক্ষ মন্দির থেকে উত্তর-পূর্বে তিন কিমি মতো। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের স্বীকৃত কেন্দ্র ছিলো এই অনুপম নির্মাণটি। পনেরো শতকের প্রথম দিক থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কখনও তৈরি হওয়া শুরু  হয়েছিলো তার। সম্ভবত দ্বিতীয় দেবরায় থেকে শুরু করে কৃষ্ণদেবরায়, অচ্যুতরায় এবং সদাশিবরায়ের রাজত্ব পর্যন্ত নির্মাণ জারি ছিলো। ১৫৬৫ সালে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তার সৌন্দর্যীকরণ সমানে চলেছে। মন্দিরে পাওয়া নানা শিলালিপি থেকে বহু পুরুষ ও মহিলা দাতাদের নাম জানা যায়। অর্থাৎ একটা সামগ্রিক যোগদান ছিলো এর নির্মাণে। মন্দির পরিসরটি পূর্বমুখী। প্রধান দ্বার বা গোপুরমটি ছাড়া আরও দুটি গোপুরম আছে দুই পাশে। প্রধান মন্দির বা মহামণ্ডপটি রয়েছে কেন্দ্র স্থলে। বাকি মণ্ডপ ও দেবালয়গুলিও পূর্বমুখী। সমগ্র পরিসরটি ৫০০x৩০০ ফিট মাপের। মন্দিরগুলির গড় উচ্চতা পঁচিশ ফিট।

মন্দির পরিসরের বাইরে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত জুড়ে রয়েছে টানা বিপণীর সারি। প্রায় এক কিমি দীর্ঘ পাথরের সারবাঁধা স্তম্ভগুলি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সারা এলাকাটি মানুষের কাছে 'বিট্ঠলপুরা' নামে পরিচিত। এখানে আলওয়র পরম্পরার একটি বৈষ্ণব মঠ ও তীর্থ ছিলো। উত্তর দিকের পথটিতে রামানুজ স্বামীর নামাঙ্কিত একটি মন্দিরও রয়েছে।

হাম্পি শহরের উত্তর সীমা জুড়ে তুঙ্গভদ্রা নদী । নদী পেরোলে আনেগোন্ডি, অঞ্জনাদ্রি পাহাড়, কিংবদন্তির কিস্কিন্ধ্যা। সচরাচর বিট্ঠল মন্দিরটি হাম্পিতে দর্শকদের শেষ দ্রষ্টব্য থাকে। এই মন্দিরটি কৃষ্ণদেবরায়ের শেষ কীর্তি এবং হাম্পির মতো পুরাতাত্ত্বিক সোনার খনিরও সেরা সম্পদ, মুকুটমণি। উত্তর কর্ণাটক, মধ্য ও পশ্চিম অন্ধ্র এবং দক্ষিণ মারাঠাওয়াড়ার ভূমিগত বিন্যাসে বিপুল মাপের নানা আকারের  প্রাকৃত সৌন্দর্যময় পাথরের প্রাচুর্য চোখে পড়ে। সেগুলির মধ্যে কিছু বালিপাথর আর পরিমাণে সংখ্যাগুরু গ্র্যানাইট গোষ্ঠীর পাথর। হাম্পি শহরের অন্যান্য দর্শনীয় দিকচিহ্নগুলির প্রতি যথাসাধ্য সময়ের পরিসর রেখেও বিট্ঠল মন্দিরের জন্য  অন্ততঃ চার-পাঁচ ঘন্টা বরাদ্দ রাখতে হয়। বাহন-আড্ডা  থেকে মন্দির বেশ খানিকটা পথ, চড়াই পথ ধরে উপরের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সেখানে পর্যটন দফতর থেকে খোলা সফরি গাড়ির ব্যবস্থা করা আছে। এই গাড়িগুলি বৈদ্যুতিক ব্যাটারিতে  চলে। পথশ্রম থেকে সময় সাশ্রয়ই এই বাহনগুলিতে চড়ার প্রধান কারণ, নয়তো হেঁটে যেতেই ভালো লাগে।

অল্প চড়াই। দুধারে বিশাল বর্তুল মসৃণ পাথরের সাজানো সরণী। মাঝেমধ্যে কিছু প্রত্ন অবশেষ। কোথাও সবুজ, কোথাও একটু জল। গাড়ি এসে দাঁড়ায় একটি সমতল বাঁধানো গাড়ি আড্ডায়। এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে। সামনের দিকে চাইতেই একটি প্রায় আকাশছোঁয়া গোপুরম চোখে পড়লো, যার শিখর অংশটি প্রায় ধ্বস্ত। তবু রাজকীয় তার গরিমা। এগিয়ে যাওয়া, পূর্ব গোপুরটির দিকে। এটাই প্রধান প্রবেশপথ। নীচের অংশটি চিরাচরিত দক্ষিণী পাথরের ভাস্কর্য, কিন্তু শিখরের অংশটি পোড়া ইঁটের গাঁথনি দিয়ে নির্মিত হয়েছিলো। সম্ভবত কম সময়ে কাজ সাঙ্গ করার তাড়ায়। সেই অনুপম ভাস্কর্যগুলি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিলো তালিকোটার যুদ্ধে পরাজয়ের পর। তার চিহ্ন সারা শিখর জুড়ে। গোপুর পেরিয়ে ভিতরের চত্বরে পা দিলেই যেটা চোখে পড়ে, সমগ্র নির্মাণটির জ্যামিতিক ছন্দ। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা নানা মন্দির, মণ্ডপ, কারুকাজ একসঙ্গে আকর্ষণ করতে থাকে চুম্বকের মতো।



এই যেমন বিট্ঠল মন্দিরে যখন যাই। একটি গোপুরম পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেই চোখ চমকে ওঠে প্রথমে। তারপর সেই উজ্জ্বলউদ্ধার ছড়িয়ে যায় মনে, মস্তিষ্কে। অবাক হয়ে দেখি তার স্থাপত্যের জ্যামিতিক জাদু। অভাবনীয় শিল্প আর সমৃদ্ধি। হৃদয়খোঁড়া বিশাল গোপুরমগুলি। যারা শেষ হয়ে গিয়েছিলো দুর্বৃত্তদের মশালের লেলিহান শিখায়। একটাই সৌভাগ্য এই চত্বরে কেউ কামান দাগেনি শেষপর্যন্ত। নয়তো এই সৌন্দর্যও অধরা থেকে যেতো আমাদের। মূল নির্মাণগুলি - মহামণ্ডপ, কল্যাণমণ্ডপ, রঙ্গমণ্ডপ, দেবীমন্দির ও গরুড়রথ।

 

ইতরের দেবতা

দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতবর্ষের একটা বিস্তীর্ণ ভূভাগে ইতরযানী সমাজের এক লোকদেবতা ছিলেন। মহারাষ্ট্র, গোমন্তক, কর্ণাটক, অন্ধ্র, এমনকি তামিলদেশ পর্যন্ত ছড়ানো ছিলো তাঁর রাজপাট। তিনি ছিলেন অন্ত্যজের দেবতা। প্রথমে তাঁর পুজো হতো এক খন্ড কালোপাথরকে ইষ্ট ভেবে। পরবর্তীকালে রূপ বদলালো। কিন্তু সে রূপ একজন রাখাল বালকের প্রতীক। দু'টি হাত কোমরে দিয়ে সে যেন গরুবাছুর চরাচ্ছে। গ্যালিলি পর্বতের অপরপারে যেন সেই মায়াবী রাখাল। খ্রাইস্ট ইজ মাই শেফার্ড। আদিম পশুপালক কৌম সমাজের  রাজা হবার যে স্বপ্ন আর লড়াই সারা বিশ্ব জুড়ে চোখে পড়ে, তারই আরেকটা নিদর্শন। নানা নাম পেয়েছেন তিনি কালান্তরে, বিঠোবা, পাণ্ডোবা, বিট্ঠল, পাণ্ডুরঙ্গ। মহারাষ্ট্রের ইতরযানী জনজাতি, ওয়রকরি সম্প্রদায় অথবা কর্ণাটকের হরিদাস গোষ্ঠী। তাঁদের দেবতা এই বিট্ঠল। তিনি ব্রাহ্মণ্য প্যান্থিয়নের কুলীন দেবতাদের কেউ ন'ন। ইতর শ্রমজীবী মানুষজনের সান্ত্বনার আশ্রয়। মহারাষ্ট্রের পন্ধারপুরে তাঁর মূল মন্দির। কিন্তু এই দেবতার ইতিহাস এখানেই থেমে থাকে না।  

কিংবদন্তি ছাড়া দেবতার জন্ম হয় না। বিট্ঠলেরও গপ্পো আছে। সব কিংবদন্তির মতো ধর্ম ও রাজনীতির ভারসাম্য সামলে মানুষের মুখে মুখে তৈরি হওয়া গপ্পো। আমাদের অর্বাচীন পুরাণ, স্কন্দ ও পদ্ম, দু'টিতেই বিট্ঠল বা বিঠোবাকে নিয়ে গপ্পোকথা রয়েছে বিস্তর। বিট্ঠল উপকথা সৃষ্টি হয়েছে পুণ্ডলিক (পুণ্ডরীক) নামে এক ভক্তকবিকে কেন্দ্র করে। স্কন্দপুরাণে বলা হচ্ছে, সাধু পুণ্ডলিক ছিলেন অত্যন্ত পিতৃমাতৃভক্ত। একবার গোবর্ধন থেকে কৃষ্ণ 'গোপাল' বেশে পুণ্ডলিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। গোপালের সেই শিখীপাখা চূড়া, পাচনবাড়ি, গরুর পাল, মকরকুণ্ডল আর শ্রীবৎস চিণ্হ দেখে পুণ্ডলিক তাঁকে চিনতে  পারেন। তখন ভক্ত তাঁর ভগবানকে অনুরোধ করেন ভীমানদীর তীরে তিনি যেন অবস্থান করেন। তাহলে সেই স্থান একসঙ্গে 'তীর্থ' ( মানে জলাশয়ের সমীপে পুণ্যস্থান) ও 'ক্ষেত্র' (মানে পবিত্র ভূখণ্ড) দুয়েরই স্বীকৃতি পাবে। কৃষ্ণ সম্মত হলেন এবং সেই ভীমানদীর পারে অবস্থিত হলেন 'বিট্ঠল' বা 'বিঠোবা' রূপে। সেই স্থানটির নাম আজ পন্ধারপুর।    

অন্য মতে যে গপ্পোটি, সেটি আরো ইন্টারেস্টিং। এটি পদ্মপুরাণে পাওয়া যায়।  পুণ্ডলিক প্রথমে ছিলেন অত্যন্ত পত্নীপ্রাণ (পড়ুন, কামপরবশ স্ত্রৈণ। তুলসিদাস-রত্নাবলীর গপ্পো মনে পড়ে কি?) এইজন্য তিনি প্রবীণ অসুস্থ পিতামাতাকে অবহেলা করতেন (চিরকালীন ভারতবর্ষের তত্ত্ব, বৌমুখো ছেলে বাবা-মা'কে দেখে না)। এইখানে কুক্কুট মুনির প্রবেশ। এই মুনি পুণ্ডলিককে কী মন্ত্র দিলেন জানা নেই, কিন্তু পুণ্ডলিক পলকে পিতামাতা-অন্ত প্রাণ হয়ে গেলেন। পন্ধারপুরে যখন এসব ঘটনা চলেছে, তখন দ্বারকায় রাধাদেবী গেটক্র্যাশ করে সরাসরি কৃষ্ণের দরবারে এসে হাজির। বলা নেই কওয়া নেই, তিনি রাজসভায় গিয়ে কৃষ্ণের অঙ্ক অধিকার করে বসে পড়লেন। আর নড়েন চড়েন না। কৃষ্ণ তাঁকে কোলচ্যুত করার কোনও চেষ্টাও করেন না। তাঁর চিরাচরিত স্বভাব। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন কৃষ্ণের বিয়ে করা পাটরাণী স্বয়ং রুক্মিণী (প্রসঙ্গতঃ লর্ড কৃষ্ণের বিয়ে করা মোট ওয়াইফের সংখ্যা ১৬১০৮)। রাধার তাতেও কোনও হেলদোল নেই। এ হেন অপমানে গোসা করে রুক্মিণী দ্বারকা ছেড়ে বহুদূরে পন্ধারপুরের কাছে দন্ডীবনে এসে অধিষ্ঠান করলেন। এসব দেখে কৃষ্ণেরও খোঁয়ারিও একটু ভাঙলো। তিনি ব্যস্ত হয়ে পট্টমহিষীকে খুঁজতে বের হলেন। শেষে  দণ্ডীবনে এসে পৌঁছোলেন তিনি। সেখানে পুণ্ডলিকের বাড়ির কাছে রুক্মিণীকে খুঁজে পেয়ে দ্বারকারাজ পুলকিত। প্রচুর সাধ্যসাধনা করে কনহাইয়াজি বৌয়ের গোসা ভাঙলেন।  কিন্তু বৌ'কে নিয়ে দ্বারকা ফিরে গেলে তো ফের অশান্তি। রাধা তখনও দ্বারকায় পুরো রোয়াবে মজুদ। রাধারমণ নিরুপায় হয়ে ভক্তের শরণ নিলেন। ভক্ত পুণ্ডলিক বাড়ির বাইরে একটা ইঁট পেতে প্রভুকে বললেন, ঠাকুর, এই ইঁটের উপর তুমি বিরাজিত হও। সস্ত্রীক বিট্ঠলরূপে ভীমানদীতটে পুণ্ডরীকপুরে (পরবর্তীকালের পন্ধারপুর) অধিষ্ঠান করো। এখন থেকে ভক্তজন যুগলে বিট্ঠল-রুখুমাই বিগ্রহ বানিয়ে পুজোআচ্চা করবে। ঠাকুর রাজি হলেন। পুণ্ডলিক ছিলেন বিষ্ণুপূজক ব্রাহ্মণ। তাই নতুন ব্যবস্থায় ইতরজনের দেবতা বিট্ঠল, ব্রাহ্মণ্য দেবকূলে বিষ্ণুর নবরূপ গ্রহণ করে একটা স্থায়ী জায়গাও করে নিলেন। ইতিহাস বলছে পুণ্ডলিক নামের এই ভক্ত তেরো শতকে হোয়সলরাজ সোমেশ্বরের দাক্ষিণ্যে পন্ধারপুরের এই মন্দিরটি ও তীর্থক্ষেত্রটির পত্তন করেছিলেন। কন্নড় সন্ত পুণ্ডলিক ছিলেন ওয়রকরি বিট্ঠলপূজক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান প্রচারক। যদিও ষষ্ঠ শতকেই রাষ্ট্রকূটদের তাম্রশাসনে বিঠোবা কাল্টের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু তা ছিলো পুণ্ডলিকের বিট্ঠল চেতনা থেকে পৃথক তত্ত্ব।

এভাবে  পশুপালক আহির-যাদবদের লৌকিক দেবতা আকৃতিহীন বিঠোবা দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে প্রবল লোকপ্রিয়তা পেয়ে গেলেন। গণভিত্তির দৌলতে অভিজাতমনস্ক সনাতন বিষ্ণুপূজক ব্রাহ্মণ্য মেনস্ট্রিমেও যোগ দিলেন। আগেই লিখেছি, এই দেবতার উল্লেখ পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক থেকে নানা দস্তাবেজে পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁকে মূলস্রোতের ধর্মে জুড়ে ফেলার কৌশলটা সম্ভবতঃ ছিলো দশম শতকে আদি শঙ্করের। আমরা দেখেছি এই ভাবেই নীলাচলে নিষাদের দেবতা জগন্নাথকে বিষ্ণুর বাঁধনে ধরে ফেলেছিলেন তিনি। শঙ্করের নামে 'পাণ্ডুরঙ্গস্তোত্র' বলে একটি বিট্ঠল পূজামন্ত্রও প্রচলিত আছে। বিষ্ণুরূপ নেবার আগে বিট্ঠলের ক্রমবিকাশ হয়েছিলো শিব, বুদ্ধ ও জৈন তীর্থংকরের রূপে। বাবাসাহেব আম্বেদকর পন্ধারপুর মন্দিরের বিট্ঠলের মূর্তিটিকে বুদ্ধের মূর্তি বলে উল্লেখ করেছিলেন। রামকৃষ্ণ ভান্ডারকর অবশ্য বলেন বিঠোবা কন্নড় ভাষায় বিষ্ণুবাবার অপভ্রংশ। বস্তুতঃ প্রথমপর্বে পন্ধারপুর ছিলো শৈব তীর্থ। শৈব ব্রাহ্মণ পুণ্ডলিক ক্রমে বিষ্ণুর অনুগত হয়ে পড়ায় বিট্ঠলও 'হর'রূপ থেকে 'হরি'রূপে পরিবর্তিত হয়ে যা'ন। বিট্ঠলের মুকুটে লিঙ্গরূপে শিব অবস্থান করেন। অবশ্য এই 'হর'রূপেরও আগে তিনি বুদ্ধরূপে বা জৈনদেবতারূপে বিরাজমান ছিলেন।  তার সাক্ষ্যও রয়েছে নানা পুথিতে। এমন কি লোককথা অনুযায়ী 'অস্পৃশ্য' মাহার সম্প্রদায়ের মানুষই বিট্ঠলের প্রধান উপাসক ছিলেন এককালে। এ প্রসঙ্গে সর্বজনগ্রাহ্য তথ্য হলো, বিট্ঠল বা বিঠোবা ইতর কৌমসমাজের লোকদেবতা। তাঁর আর্যায়ন হয়েছিলো ব্রাহ্মণ্যধর্মের নিজস্ব প্রয়োজনে।

প্রাথমিক গৌরচন্দ্রিকা পর্বে আবার ফিরে আসি। দেবতা বিট্ঠলের প্রতি ভক্তি বোধ করি না অবশ্যই। কিন্তু আগ্রহ রয়েছে বিট্ঠল নামের সেই প্রেরণাটির প্রতি। যাঁকে ইষ্ট ভেবে মধ্যযুগে সন্ত নামদেব, সন্ত একনাথ, সন্ত তুকারাম, সন্ত জনাবাই, সন্ত জ্ঞানেশ্বর প্রমুখ শূদ্র, অন্ত্যজকুলে জাত সেরা ভারতসন্তানরা সারাদেশে সমতা ও প্রেমধর্মের প্রচার করেছিলেন। বিট্ঠলের 'মন্দির' ব্রাহ্মণরা দখল করে নিলেও এই সব মনস্বী বিট্ঠল বা বিঠোবা নামক প্রতীকটিকে আলাদা রাখতে চেয়েছিলেন।  ব্রাহ্মণ্য ছুঁতমার্গী লোকাচারকেন্দ্রিক বিগ্রহের বাইরে একটি ইতরযানী বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিট্ঠল তাই এক সমন্বয়ের দেবতা। ঠিক 'ভারতবর্ষ' নামক দেশটির মতোই। বিট্ঠল দেবতা দিয়েছেন 'অভঙ্গ' নামে মরাঠি বা কন্নড় ভক্তিগীতির একটি রম্য স্রোত। দিয়েছেন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য কীর্তি রাজধানী হাম্পিতে বিজয়বিট্ঠলকে উৎসর্গ করা একটি মন্দির। এই মন্দিরের কথা বলবো বলেই এই দীর্ঘ 'শিবের গীত'।

 

''তুলসিমালেয়া হাকুভুডাক্কে আরসনাগি নাচুতিদ্দে

সরসিজাক্ষ পুরন্দর বিট্ঠলনু তুলসিমালে হাকিসিদানু...'' (পুরন্দরদাস বিট্ঠল)

 

 (ক্রমশ) 


ফারহানা রহমান

 

আবুল হাসান: সে এক লাবণ্য ধরে




কবে কখন প্রথম আবুল হাসান পড়া শুরু করেছিলাম সেটা এখন আর মনে নেই। তবে জীবন যখন হতাশার যন্ত্রণায় নিমজ্জিত হয় তখন কবি হাসানের কবিতাই একমাত্র ভরসার স্থল হয়ে ওঠে এখনো। আবুল হাসানের কবিতার কথা মনে পড়ে তা হচ্ছে কবি শেলীর সেই বিখ্যাত উক্তি - সেই গানগুলিই হচ্ছে সুমধুর যা আমাদের দুঃখকাতর চিন্তার কথা প্রকাশ করে (Our sweetest songs are those that tell of saddest thought)।

কীটসের কবিতায় যে তীব্র বেদনাবোধ অথবা র‍্যাঁবোর কবিতায় জীবনের যে নিদারুণ যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি আমরা লক্ষ করেছি, কবি আবুল হাসানের দ্যুতিময় কবিতায়ও সেইসব অনুষঙ্গ উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। আবুল হাসান তাঁর ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবনযন্ত্রণার যে অভিজ্ঞান অর্জন করেছিলেন, সেটাই তাঁর কবিতাকে এক মহৎ শিল্পে মহিমান্বিত করেছে। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমি তাই পাঠক হিসেবে বিশেষ এক ঘোরের মাঝে ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। হাসানের কবিতা তখন আর তাঁর নিজের থাকে না, হয়ে ওঠে সর্বজনীন। তাঁর প্রতিটি কবিতাই রাত্রির নৈঃশব্দ্যের মতো ধ্যানমগ্ন। তিনি ছিলেন এমনই এক আজন্ম বিশুদ্ধ কবি যিনি নিজের জীবনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করেই কবিতা লিখেছিলেন। অল্প বয়সেই একজন সৃজনশীল কবি হিসেবে তাই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন হাসান। মাত্র এক দশকের কাব্যসাধনায় আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে অর্জন করেছিলেন বিশিষ্ট স্থান। প্রতিভাবান না হলে এরকমটা সম্ভবপর ছিল না। কবি হাসান আত্মত্যাগ, দুঃখবোধ, মৃত্যুচেতনা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নৈঃসঙ্গচেতনা, স্মৃতিমুগ্ধতা এবং মুক্তিযুদ্ধকে কবিতার বিষয়-আশয় করে নিয়েছিলেন। যাপিত জীবনে খুব আধুনিক একজন মানুষ ছিলেন না তিনি, তবে সাহিত্যজীবনে তিনি ছিলেন প্রবল আধুনিক এক কবি। একদিকে গ্রামীণ জীবনের প্রতি টান, অন্যদিকে শহরবাসের মিথস্ক্রিয়া তাঁর কবিতায় প্রোথিত করেছিল আধুনিকতার বীজ। থেকেও না-থাকা আবার না-থেকেও থাকাই ছিল তাঁর স্বভাব। সে কারণেই বোধহয় তাঁর চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা খুব একটা বিচলিত করতো না তাকে।

একজন কবির উপর তাঁর সময়ের যে গভীর প্রভাব পড়বে, সেটাই তো স্বাভাবিক ও অনস্বীকার্য় বিষয়। সময়, যুগ-যন্ত্রণার নানা ঘটনাপ্রবাহ কবিমানসে যে অন্তরযাতনার সৃষ্টি করে, বিশেষ করে আধুনিক নগরজীবনের উন্মেষের ফলে ব্যক্তিজীবনে যে সামগ্রিক জটিলতার সৃষ্টি হয়, তাই কবিমনকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। সময়, স্বদেশ, সংগ্রাম আবুল হাসানের মনের গভীরে যেমন কম্পন সৃষ্টি করেছিল, একইভাবে ঢেউ তুলেছিল দুঃখ-বেদনা, নেতি-নৈরাজ্য, সংশয়, আত্মক্লেশ আর আশাহীনতাও। হাসান এইসব ক্লেশ ও ক্লেদকে ধারণ করে হয়ে  উঠেছিলেন আধুনিকতার ঋদ্ধ ঋষি। এসবই কবির অন্তর্গত বোধ ও উপলব্ধিতে কখনো যুগিয়েছে আনন্দ ও সুখ, কখনো বা অপার বেদনা। কবি আবুল হাসান এমন একসময়ের কবি যখন বাংলা কবিতায় নগরজীবনের নানা দিকের উন্মেষ ঘটে চলেছে। এই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও ছিল চরম উত্তাল। এই সময়কার কবিদের মধ্যে বিশেষ করে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, ইমামুর রশীদ, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, সাযযাদ কাদির প্রমুখ কবির কবিতায় অন্তর্গত ক্ষরণ ও রাজনীতির প্রত্যক্ষ উপস্থিতির সুস্পষ্ট ছাপ পরিলক্ষিত হয়।

মাত্র ঊনত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন হাসান। কিন্তু এই স্বল্পজীবন পরিসরে রচিত অসংখ্য কবিতায় তাঁর শাণিত বোধ, আবেগ ও প্রজ্ঞার তীব্র সমন্বয় ঘটেছিল।  আবুল হাসানের অধিকাংশ কবিতা বাহ্যিক ও অন্তর্গত জীবনের টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্বের প্রত্যক্ষ সংশ্লেষে অনবদ্য। এতে সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে প্রেম বিরহ রাজনীতি শোষণ বঞ্চনা তথা সমাজের যাবতীয় বিষয়-আশয়। অন্যায় অত্যাচার নিপীড়ন বৈষম্য হতাশা অভাব অনটন নৈরাজ্য ইত্যাদি সমস্ত কিছুর সমন্বিত রূপ হাসানের কবিতা। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর কবিতা জীবন ও সমাজের বিশাল  ক্যানভাসের প্রতিচ্ছবি। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ ও যন্ত্রণার উপস্থাপন তিনি এমনভাবে করেছেন যা চুড়ান্ত পর্যায়ে নৈর্ব্যক্তিক ও সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে।

১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপারার বর্নি গ্রামে নানার বাড়িতে কবি আবুল হাসান জন্মগ্রহণ করেন। আবুল হাসানের ডাকনাম ছিল ‘টুকু’। প্রত্যেকটি মানুষেরই মনোভূমি গঠনে তাঁর পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। কবি হাসান তাঁর মাতৃ ও পিতৃ দুকূলেরই শিক্ষা-সংস্কৃতি-সুরুচির উজ্জ্বল উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন। উচ্চশিক্ষিত সংস্কৃতিবান মার্জিত রুচির আত্মীয়দের অপত্য স্নেহ ও আদর, প্রগতিশীল চিন্তার আবহ ও উদারনৈতিক সান্নিধ্য আবুল হাসানের অগ্রসর মানস নির্মাণে বিশেষ ভুমিকা পালন করেছিল। এভাবেই তাঁর সামাজিক ভাবনা, রাজনৈতিক চিন্তা, জ্ঞানপিপাসু মানসিকতা ও শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ভাবনা গড়ে ওঠে। হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত গোপালগঞ্জের বিস্তীর্ণ জনপদ, মধুমতি নদী, শ্যামল-সবুজ চর, পাখা-পাখালির অবাধ বিচরণ, সাঁই বাবার সানাই – এরকম অনেক কিছু তাঁর কবিমানস গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। সারাবছর ধরে সেসব গ্রামে চলতো পালা-পার্বণ, মেলা, যাত্রাগান, জারীগান, কবিগান, নাটক, কীর্তনের আসর। তাঁর আদর্শ শিক্ষাগুরু ছিলেন স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক রুস্তম আলী মোল্লা। এরপর বাবার চাকরির সুবাদে আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। আরমানিটোলা স্কুলে পড়ালেখার সময় থেকেই আবুল হাসান নিয়মিত কবিতা লিখতে শুরু করেন।

আবৃত্তি, অভিনয়, কবিতা লেখা, গান শোনা, কোরআন পাঠের মাধ্যমে সে-সময়েই তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যৌবনের প্রথম ঋতুতেই তিনি জীবনানন্দের বরিশালে গিয়ে হাজির হন। তখনই তার পরিচয় ঘটে ষাটের তরুণ কবি-লেখক হুমায়ুন কবির, শশাংক পাল, মাহফুজুল হক খান, আবুল হাসনাত প্রমুখের সঙ্গে। বরিশাল ও ঢাকার নানা কাগজে তাঁর অনেক কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। এই সময়েই সময় তিনি বরিশালের মেয়ে সুলতানা রাজিয়া খোন্দকারকে ভালোবেসে ফেলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ব্রজমোহন মহাবিদ্যালয় থেকে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।

১৯৬৫ সালে আবুল হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্জন সম্পন্ন করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই হাসান সাহিত্যচর্চায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন। এই সময়টিতে তিনি ঢাকার তরুণ কবিদের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আসেন এবং আস্তে আস্তে পদার্পণ করেন ‘উদ্বাস্তু-উন্মুল’ যৌবনে। পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেলে আবুল হাসান অর্থের প্রয়োজনে পত্রিকায় চাকরি নেওয়ার কথা ভাবতে থাকেন।

শৈশব থেকেই হাসান বাতজ্বরে ভুগছিলেন। যৌবনে উপনীত হওয়া মাত্রই তা  ভাল্বজনিত হৃদরোগে পরিণত হয়। বাংলাদেশে তাঁর হৃদরোগের উন্নত চিকিৎসা হয়নি, ফলে তিনি চিকিৎসার জন্য পূর্ব জার্মানীতে যান। তাঁর হৃৎপিণ্ডের অসুখ  প্রথম ধরা পড়ে ১৯৭০ সালে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে পুনরায় অসুস্থ হয়ে ঢাকার হলিফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এখানেও অবস্থার উন্নতি না হলে বন্ধুদের আন্তরিক সহযোগিতায় এবং বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে পূর্ব জার্মানি পাঠানো হয়। প্রথমিক চিকিৎসার পর তিনি খানেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং হাসপাতালের বেডে শুয়েই আবার কবিতা লেখা শুরু করেন। এসময় তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক  গড়ে ওঠে শিল্পী গ্যাব্রিয়েলার সাথে। গ্যাব্রিইয়েলার সঙ্গেই তিনি বার্লিনের বহু জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছিলেন এবং একাধিকবার গ্যাব্রিয়েলার বাসাতেও তিনি বেড়াতে গিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের শুরুতেই হাসান আবারও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। জার্মান ডাক্তাররা তাদের সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে তাঁকে চেকোস্লোভাকিয়ায় চিকিৎসার জন্য পাঠান। কিন্তু ততদিনে তাঁর হৃৎপিণ্ড প্রায় অকেজো হয়ে গেছে, যা সারিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল জটিল অস্ত্রোপচারের। কিন্তু সেই ধরনের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয় সুবিধা না থাকায় সে দেশের চিকিৎসকরা অপারেশনের ঝুঁকি নিতে চাননি। এই জটিল পরিস্থিতিতে বার্লিনের চ্যারিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আবুল হাসানকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে আবুল হাসান চ্যারিটি হাসপাতাল থেকে মুক্ত হয়ে সপ্তাহখানেক তাঁর জার্মান বান্ধবী গ্যাব্রিয়েলার বাসায় ছিলেন। তারপর ১৯৭৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে বার্লিন ত্যাগ করেন।

১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা পৌঁছেন। পরবর্তী্তে ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর তিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। অবশেষে মাত্র ২৯ বছর বয়সে পিজি হাসপাতালে ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান।

তাঁর জীবনীকাররা বলছেন, আবুল হাসান ১৯৭০ সালে এশীয় কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। ঐ একই সালে ভারতের কলকাতা থেকে সমগ্র পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বশীল কবিদের প্রকাশিত সংকলন ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থে তাঁর লেখা ‘শিকারী লোকটা’ স্থান পায়।

১৯৭২ সালে ‘রাজা যায় রাজা আসে’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই  আবুল হাসানের কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর অসুস্থ অবস্থাতেই ১৯৭৪ সালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘যে তুমি হরণ করো’ প্রকাশিত হয়। হাসপাতালের বেডে  শুয়ে শুয়েই তিনি তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক’র পাণ্ডুলিপি তৈরি করা  থেকে প্রুফ দেখা সব কাজই করেছেন। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক’। এরপর ১৯৮৫ সালে তাঁর মৃত্যুর ১০ বছর পর   নওরোজ সাহিত্য সংসদ ‘আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা’ প্রকাশ করে। হাসান বেশ কিছু সার্থক ছোটগল্পও রচনা করেছিলেন। ১৯৯০ সালে মৃত্যুর ১৫ বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আবুল হাসান গল্প সংগ্রহ’। কবিতা ও গল্প ছাড়াও তিনি  জার্মানি থেকে ফিরে এসে ‘কুক্কুরধাম’ নামে একটি বৃহৎ কাব্য রচনার পরিকল্পনা  করেছিলেন। যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তা শেষ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।

জীবদ্দশায় আবুল হাসানের যে তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় তার প্রতিটিই আলাদা বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। কবি হিসেবে আবুল হাসানের বিশিষ্টতা তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা থেকেই সাক্ষরিত হয়ে যায়। তিনি যে মনে-প্রাণে একজন বাউল ছিলেন এবং হ্যামলেটের মতো নিঃসঙ্গ দুঃখবোধ ও প্রশ্নাতুর ছিলেন, তা তাঁর ‘প্রশ্ন’ কবিতায় দেখতে পাই।

চোখ ভোরে যে দেখতে চাও

রঞ্জন রস্মিটা চেনো তো?

বুক ভোরে যে শ্বাস নিতে চাও

জানো তো অক্সিজেনের পরিমানটা কত?

এতো যে কাছে আসতে চাও

কতটুকু সংযম আছে তোমার?

এতো যে ভালোবাসতে চাও

তাঁর কতটুকু উত্তাপ সইতে পারবে?

 

হাসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাজা যায় রাজা আসে। এই কাব্যগ্রন্থটি শিল্পঋদ্ধিতে অনন্য ও তাঁর নিটোল গাঁথুনির জন্য অতুলনীয়। আবুল হাসানের এসব কবিতা আমাদের এমনই অভিভূত করে রাখে যে কবিতা পাঠের সময় তাঁর হৃদয়গ্রাহী বিবরণ আমাদের মাঝেও  একধরনের নিঃসঙ্গতা ও বিষণ্ণতা এনে দেয়। ‘আবুল হাসান’ নামক কবিতায় নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে রহস্যময়তা সৃষ্টি করেছেন।  তিনি নিজেকে এমন এক পাথরের সাথে তুলনা করেছেন যা কেবলই লাবণ্য ধরে, যে পাথর উজ্জ্বল অথচ মায়াবী ও করুণ। তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙক্তি পাঠককে ভাবায়, নিয়ে যায় গূঢ় অভিজ্ঞানের রাজ্যে যেখানে দর্শন ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বৈরথ মিশে একাকার হয়ে গেছে। কবিতাটি পড়ে একবার মনে হয় কবি হাসানকে বোধ হয় অনেক জানা হয়ে গেল, আবার একই সঙ্গে মনে হয় কিছুই জানা গেলো না। এমনই ছিলেন হাসান –

সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর আর্দ্র, মায়াবী করুণ এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?

এটা কি পাথর নাকি কোন নদী? উপগ্রহ? কোন রাজা?

পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ?

মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা? তীব্র তিমির তমোহর

কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অক্ষর?

[রাজা যায় রাজা আসে]

 

কবিতার মাধ্যমে মানব মনের আবেগের নিঃসরণ হয়, তাই হয়ে ওঠে বিষয় ও ব্যক্তির কথন। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বোধন। কবিতায় দোত্যিত হয় দ্বিতীয় জীবন, দ্বিতীয় মানুষ ও দ্বিতীয় পৃথিবী। আনন্দ ও যন্ত্রণার মিলনেই কবিতার সৃষ্টি। এই  কারণেই মাত্র একুশ বছর বয়সেই হাসান বলেছিলেন, ‘সব ভালো কবিতাই আমার কবিতা’। কবিতার এই অমোঘ আকর্ষণেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রত্ব ত্যাগ করে বরণ করে নিয়েছিলেন যন্ত্রণায় দীর্ণ কৌমার্য। এ কারণেই তাঁর হয়নি সংসারধর্ম, বাণিজ্য। আমৃত্যু কেটেছে দুঃখ, দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার মাঝে। তবুও তিনি দুঃখবরণ করেই সাধারণের উদ্দেশে বলেছেন :

বদলে দাও, তুমি বদলাও

নইলে এক্ষুনি

ঢুকে পড়বে পাঁচজন বদমাশ খুনী,

যখন যেখানে পাবে

মেরে রেখে যাবে,

তোমার সংসার, বাঁশী, আঘাটার নাও।

বদলে যাও, বদলে যাও, কিছুটা বদলাও!

[বদলে যাও, কিছুটা বদলাও]

 

তাঁর বন্ধুরা জানিয়েছেন, কবিতা রচনায় ক্লান্তিহীন ছিলেন হাসান। সাহিত্য সৃষ্টিতে ছিলেন আজন্ম অতৃপ্ত। সাহিত্যের জন্য নিদারুণ এই পরিশ্রমকে তিনি বলতেন ভালোবাসার পরিশ্রম। কবিকে তাই সিসিফাসের মতো পাথর তোলার কর্ম সাধনায় অক্লান্ত হতে হয়। তাতে শরীর কোথায় গেলো, সংসার-সংঘ-রাষ্ট্র কথায় গেলো, অর্থ-বিত্ত-বৈভব এলো কিনা সেসব ভাববে সাধারণ লোকে, কবি নয়। তাই তো কবি হাসানের জানার ইচ্ছে হয়েছিল পণ্যের বাজারে কি সবকিছুই পণ্য হয়ে যায়? ভাব-অনুভাব-মহানুভবতা, জীবনবোধ কি নগরসভ্যতায় এসে ইস্পাতের দৃঢ় মোড়কে আটকা পড়বে? বাস্তব-অবাস্তবতার মধ্যে আবেগের সরলতা কি অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছে দিনদিন? ‘ব্লেড’ কবিতাতে আমরা তারই চমৎকার শৈল্পিক বিবরণ দেখতে পাই:

লিমিটেড কোম্পানীর কোকিল স্বভাবা মেয়ে,

তাকে যদি ডাকি, ওহে ইস্পাতিনী ঘরে আছো

মোড়কের মায়াবী অন্দর থেকে মুখ লুকায় সে,

বলে, আরে, এযে সে ইতর নাগর।

 

হাসানের কবিতার ভাষা, শব্দ প্রয়োগ, উপমা, অলংকার, গীতিধর্মীতার মধ্যেও যন্ত্রণাদগ্ধ কবির প্রতিচ্ছবি লক্ষ করি। যদিও এই যন্ত্রণাবিদগ্ধতা কবিকে সামাজিকতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে বরং এই বেদনাবোধ হাসানের কবিতার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। কখনো প্রেম, দেশপ্রেম, দ্রোহ-বিদ্রোহ ইত্যাদি আকারে এ বেদনা উদ্ভাসিত।

 

‘উচ্চারণগুলি শোকের’ এমন একটি কবিতা যেখানে গভীর মর্মবেদনায় মুক্তিযুদ্ধকালীন অনুষঙ্গ প্রতিভাত হয়েছে। চারপাশ দেখে কবির মনে উদ্দীপ্ত বেদনার প্রকাশ ঘটেছে এইভাবে:

ছোটো ভাইটিকে আমি

কোথাও দেখি না

নরম নোলক পরা বোনটিকে

আজ আর কোথাও দেখি না!

কেবল পতাকা দেখি

কেবল উৎসব দেখি,

স্বাধীনতা দেখি,

তবে কি আমার ভাই আজ

ঐ স্বাধীন পতাকা?

তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?

 

হাসানের যে তুমি হরণ করো কাব্যগ্রন্থটি আরও উজ্জ্বল। কবিতা ও কবিদের বিষয়ে হাসান একবার বলেছিলেন, “আমাদের বাড়িঘর কিছুই নেই। আছে কবিতা, গরীব কবিতা আর গরীব ক্ষিধে।” কবিতা বিষয়ে তাঁর উচ্চারণ ছিল রুক্ষ, কর্কশ, ব্যাঙ্গাত্মক ও হেঁয়ালিপূর্ণ। অর্থ নয়, বিত্ত নয়, প্রতিপত্তি নয়, এমন কি চূড়ান্ত অর্থে নারীও নয় – কবিতা, শুধু কবিতাই আরাধ্য হয়েছিল হাসানের জীবনে।

কবির কষ্ট নিয়ে তিনি আরও বলেছেন:

কবি যতবার কাঁদে এদেশেও অনাচার মৃত্যু আর রক্তারক্তি বাঁধে

কবির মৃত্যু নিয়ে আজো দ্যাখো ঐখানে লোফালুফি

ঐ তো পদ্মায় ওরা কবির ভাসন্ত মরদেহ নিয়ে খেলছে, খেলছে।

[কবির ভাসমান মৃতদেহ]

 

অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, রাজনীতি-সমাজমনস্কতা, দেশপ্রেম প্রভৃতি তার কবিতাকে করে তুলেছে মহীয়ান। সর্বোপরি তিনি ছিলেন জীবনের বিশুদ্ধতার পক্ষে। তার স্পষ্ট উচ্চারণ এমনটিই প্রমাণ করে:

প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না

আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম – কেন আমি

সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী

হয়েছি হিরণদাহ, হয়েছি বিজন ব্যথা, হয়েছি আগুন!

 

হাসানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ পৃথক পালঙ্কের কবিতাগুলিও অনন্য। জীবনের অনিবার্য সত্য — কল্পনা ও সৃজনশীলতায়, শিল্প ও সুন্দরের জগতে অবস্থানের স্পৃহাকে পলায়নপর মনোভাব বলা যায় না। কারণ, কল্পনাও একধরনের বাস্তবতা, অন্তর্গত বাস্তবতা। হাসান পলায়নবাদী ছিলেন না, কারণ, তিনি শিল্পকে খুঁজেছেন মানুষের মাঝে, প্রেমের মাঝে:

থাকুক দুচোখে দুর্ভিক্ষের দাহ,

করুক আবার আন্ধার আঁধিব্যাধি

আমাদের প্রেম না পেল কবির ভাষা

কাব্যচূড়ায় আমরা তো বাধি বাসা।

[যুগলসন্ধি]

 

কবিতার পাণ্ডুলিপির উপর আঁকাআঁকি করা ছিল হাসানের অভ্যেস। তাঁর কবিতার বিচিত্র চিত্রকল্প, উপমা ও শব্দের ব্যবহারে ছিল জীবনের উদ্ভাস। তিনি ছিলেন অনন্ত কল্পনাপ্রবণ এবং সূক্ষ্ণ শিল্পবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। তাঁর কবিতার শব্দবিন্যাস, প্রকরণ, কাঠামো, বিষয় নির্বাচন, স্বর ও প্রতীকের অনন্যতা আমাদের অভিভূত করে। এই কবিতাটির কথা ধরা যাক:

চলে গেলে - তবু কিছু থাকবে আমার : আমি রেখে যাবো

আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি।

জল নেমে গেলে ডাঙা ধরে রাখে খড়কুটো, শালুকের ফুল :

নদীর প্রবাহপলি, হয়তো জন্মের বীজ, অলঙ্কার - অনড় শামুক!

[অপরূপ বাগান]

 

প্রেমের প্রতি মানবীয় যে আদিম আকাঙ্ক্ষা থাকে, হাসানের কবিতায় তা পরিস্ফুট। হাসান কখনো এঁকেছেন ব্যর্থতার ছবি, কখনো সফলতার। প্রেমের সঙ্গে সুন্দরের বা কদর্যতার মিশ্রণ বা দ্রোহ আলাদা মাত্রায় উত্তীর্ণ হয়েছে হাসানের কবিতায়। আর স্বতন্ত্র পথের যাত্রী হিসেবেই তার কণ্ঠস্বর ভিন্নতর ও আলাদা। হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায়ও একটু সুস্থ বোধ করলেই তিনি লিখেছেন অসাধারণ সব কবিতা। কয়েকটি দৃষ্টান্ত:

(১)

 

অসুখ আমার অমৃতের একগুচ্ছ অহঙ্কার!

আত্মার অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ক্ষুধিত জানয়ারের

রোমশ বলশালী শরীরের দুটি সূর্যসমান রক্তচক্ষু

 

(দুই)

 

হায় সুখী মানুষ, তোমরাই শুধু জানলে না অসুখ কত ভালো কত চিরহরিৎ বৃক্ষের মতো শ্যামল

কত পরোপকারী, কত সুন্দর।

 

(তিন)

 

আমি অসুখে যেতে যেতে এক চক্কর তোমাদের নরকে

সব সুখি মানুষদের দেখে এলাম – এটাই বা কম কি!

লিখেছেন ‘রোগ শয্যায় বিদেশ থেকে’ বা ‘শাদা পোশাকের সেবিকা’ শিরোনামের অতুলনীয় সব কবিতা।

আবুল হাসানের কিছু নাতিদীর্ঘ কবিতা রয়েছে। বিষয়বস্তু ও প্রকাশশৈলীর কারণে যা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এরকমই এক অসম্ভব বেদনাবোধের অনুষঙ্গ ‘মোরগ’ কবিতায় লক্ষ করা যায়। রিলকের কথায় একজন কবি জীবনে মাত্র কয়েকটি বার-বার পড়ার মতো কবিতা লেখেন। আবুল হাসানের এই ‘মোরগ’ কবিতাটি আমি বারবার পড়েছি আর ভেবেছি জীবনে কতবার মোরগের খুন হওয়ার দৃশ্য দেখেছি, কিন্তু কখনো কী ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছি এমন একটি কবিতার একটিমাত্র চরণও:

ঘুরে ঘুরে নাচিতেছে পণ্ডিতের মতো প্রাণে

রৌদ্রের উঠানে ঐ নাচিতেছে যন্ত্রণার শেষ অভিজ্ঞানে!

পাখা লাল, শরীর সমস্ত ঢাকা লোহুর কার্পেটে!

মাথা কেটে পড়ে আছে, যায় যায়, তবুও নর্তক

উদয়শঙ্কর যেন নাচিতেছে ভারতী মুদ্রায়!




হাসানের কবিতা শিল্পবোধ আর মানবজীবনের সূক্ষ্ণতম অনুভূতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। এভাবে জড়িয়ে থাকার কারণেই হাসানের কবিতা লাভ করেছে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা। কবিতা জীবনবিচ্ছন্ন কোনো ব্যাপার নয়, আধুনিক জীবনযন্ত্রণা এতে প্রতিফলিত হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। শিল্পের কাছে জীবনের তো এরকমই প্রত্যাশা থাকে। এই যে অনুভব, এই যে জীবনের কথা, তারই সফল বাস্তবায়ন আমরা লক্ষ করি তাঁর ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ কবিতাটিতে:

ঝিনুক নীরবে সহো

ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও

ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও।

 

জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি এমন বেশকিছু কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে হাসানের ‘অগ্রন্থিত কবিতা’য়। কবি হাসান ছিলেন প্রকৃতপক্ষেই একজন বোহেমিয়ান ও উদ্বাস্তু মানুষ। রোগ-শোক, নিঃসঙ্গতা আর সন্তের মাধুর্য মিলে-মিশে ছিল তাঁর জীবনে। এই নিয়ে তার উচ্চারণ:

স্পেনীয় কবির মতো নয়, কতদূর ঘোড়সওয়ার

করডোভা নগরী জেনে কাজ নেই। তার চেয়ে ঋত্বিকের

তিতাসের বালুর ভিতর জল, মিত সভ্যতার জল, মাছের

জালের জল খুঁড়ে তুলতে হবে শব্দকে। এবং দেখতে হবে

একটি বেদের শিশুর অবুঝ হিল্লোলে ধানক্ষেতে নাচতে

নাচতে ভেঁপুর বাজনায় যেন হাস্যমুখী স্বর্গ হয়ে যায়।

(কবিতা)

 

প্রেম কবিতার গুরুত্বপূর্ণ প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে কবির মনে। প্রেম এমন এক চিরঞ্জীব শক্তি যা কবিকে দেয় অপার অনুপ্রেরণা, যদিও তা হতে পারে কখনো আনন্দ ও আশা সঞ্চালনকারী, কখনো-বা বেদনার নানা রঙে বহুবর্ণিল। কবিতায় হাসান লিখছেন:

যতো আনো ও-আঙুলে অবৈধ ইশারা

যতো না জাগাও তুমি ফুলের সুরভী

আঁচলে আগলা করো কোমলতা, অন্ধকার

মাটি থেকে মৌনতার ময়ূর নাচাও কোন

আমি ফিরব না আর, আমি কোনদিন

কারো প্রেমিক হবো না

প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী চাই আজ

আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবো।

[প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী]

 

ব্যাঞ্জনাময় বাক্য ও স্বর হাসানের কবিতায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে উদ্ভাসিত। কবি হিসেবে মৌলিক হয়ে উঠবার দিকেই সবসময়ই ঝোঁক ছিল তাঁর।

সে কবে কখন বোলো সোনার পিণ্ডের মতো

মূল্যবান মুহূর্তগুলো ছুঁড়ে দিয়ে

শয়তানের ধাঙর তালুতে বাজাব অশ্লীল তালি?

বোলো হে কখন ধ্যানের মতো চিররীতি সাজুজ্যের দায়ে

মৃত্যুর লোবান শুঁকে মরে যাবো ফসিল সত্তায়?

‘শিল্প তো স্বাতীর বুকে মানবিক হৃৎপিণ্ড’ - এখানে প্রেম ও মানবতাকে কবি সমীকৃত করেছেন।

মানুষের একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা ও মৃত্যুচেতনা হাসানের কবিতার প্রধান প্রধান অনুষঙ্গ। আশা-নিরাশা, মৃত্যুচিন্তার কথা তাই বারবার বিষয় হয়ে উঠেছে তার কবিতায়:

মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না।

আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে

আমার মৃত্যুর আগে বলে যেতে চাই

সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন

[জন্ম মৃত্যু জীবোনযাপন]

 

কিম্বা

দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদী রাখবো না আর আমার ভেতর

[কালো কৃষকের গান]

তবে কেবলি হতাশার কবি ছিলেন না হাসান। মাঝে মাঝে তাঁকে আশাবাদীও হতে দেখি - “সেখানে বুনবো আমি তিন সারি শুভ হাসি, ধৃতি পঞ্চইন্দ্রিয়ের / সাক্ষাৎ আনন্দময়ী একগুচ্ছ নারী…/ ও জল ও বৃক্ষ ও রক্তপাত, রাজনীতি ও নিভৃতি, হরিৎ নিভৃতি। এইরকম বহু কবিতার পংক্তিতে তিনি লিখে গেছেন তাঁর স্বল্প আয়ুষ্কাল আর জীবনের কথা।

হাসানের মধ্যে ছিল আধুনিক মানুষের স্মৃতিমুগ্ধতা ও আত্মমুখিনতার নানা প্রবণতা। তিনি ছিলেন হার্দিক রক্তক্ষরণের রূপকার। বয়সের সীমানা ছাড়িয়ে নিজের সম্পর্কে তাই এভাবেই বলেতে পেরেছেন:

গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর আমিও ভবঘুরেদের প্রধান ছিলাম।

জোৎস্নায় ফেরা জাগুয়ার চাঁদ দাঁতে ফালা ফালা করেছে আমারও

প্রেমিক হৃদয়!

আমিও আমার প্রেমহীনতায় গণিকার কাছে ক্লান্তি

সঁপেছি

বাঘিনীর মুখে চুমু খেয়ে আমি বলেছি আমাকে উদ্ধার দাও!

সক্রেটিসের হেমলক আমি মাথার খুলিতে ঢেলে তবে পান করেছি মৃত্যু

হে কবি কিশোর।

[গোলাপের নীচে নিহত যে কবি কিশোর]



নান্দনিক দিক থেকেও হাসানের কবিতা ভাস্মর। “প্রতীক উপমা, চিত্রকল্প আর অলংকার ছাড়া লেখকের সৃষ্টিজগতে আত্মপ্রকাশের আর কোনো পথ নেই এবং সেখানে পাঠকের উপলব্ধি সেতু সৃষ্টি করে এক অজানা তীরের সঙ্গে – বলেছিলেন প্রখ্যাত মনোসমীক্ষক কার্ল গুস্তাভ য়ুং। কবিতাকে, মনে হয় এই আপ্তবাক্যের প্ররোচনায় নান্দনিকতায় অভিনব কিন্তু উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন কবি আবুল হাসান। তিনি নানা রঙের উজ্জ্বল বর্ণ দিয়ে কোমল, কঠিন সিক্তরসে চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। হাসানের খুব কঠিন বা কষ্টের বিবরণেও আছে সানাইয়ের সুরের কোমলতা, বিষাদ, যা পাঠকের শ্রুতি ও মননকে স্নিগ্ধ করে তোলে।

আবুল হাসান গত হয়েছেন বহুদিন, তবু আজও তাঁর বাজানো সানাইয়ের সুর শুনতে পাই আমাদের হৃদয় মন্দিরের একতারায়। তিনি ছিলেন পূর্বাহ্ণে ফোঁটা অপরাহ্ণের এমনই এক ফুলকলি, যা পরিপূর্ণ পরিস্ফুটনের আগেই ঝরে গেছে। তাঁর এই অকাল বিদায় আমাদের চিরকালই অভিভূত ও বিষণ্ণ করে রাখবে। আমরা বারবার স্নাত হবো তাঁর কাব্যসলিলে আর মনে পড়বে সুকান্তর মতোই, তবে ভিন্ন আরেক আধুনিক কবির কথা।