কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১৮

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৬০


‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিন প্রকাশিত হয় প্রতি মাসে। আর তাই আলাদা করে কোনো সংখ্যাকে সেই মাসের বিশেষ সংখ্যা রূপে প্রকাশ করার কোনো প্রয়োজন হয় না। এই যেমন ৬০তম সংখ্যাটি প্রকাশিত হচ্ছে আশ্বিন মাসে। আশ্বিন মাস মানেই শারদ মাস এবং দুর্গাপুজোর মাস। অনেক পত্র পত্রিকা তাই আশ্বিন মাসের সংখ্যাকে শারদ সংখ্যা বা পুজো সংখ্যা রূপে প্রকাশ করে থাকেন। ঠিক যেমন বছরের অন্যান্য মাসে প্রকাশিত সংখ্যাকে সেই মাসের প্রাসঙ্গিকতায় নববর্ষ সংখ্যা, ঈদ সংখ্যা, বড়দিন সংখ্যা, বইমেলা সংখ্যা ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকেআমরা অবশ্য এই ৬০তম সংখ্যাটিকে কোনো বিশেষ  সংখ্যা রূপে অভিহিত না করে অন্যান্য সংখ্যার মতোই আশ্বিন সংখ্যা বা অক্টোবর সংখ্যা রূপে প্রকাশ করলাম।

তবে সব সময়ই তৎকালীন প্রাসঙ্গিকতার একটা আলাদা গুরুত্ব বা মহত্ব থাকে। প্রভাব থাকে। আমরা তা কখনই অস্বীকার করতে পারি না। যেমন আশ্বিন মাসে আয়োজিত দুর্গাপুজোর একটা প্রভাব থাকেই হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী মানুষের মনে। অনুরূপ প্রভাব থাকে ইসলামধর্মে বিশ্বাসী ও খৃষ্টানধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরও মনে অন্য প্রাসঙ্গিকতায়সেই প্রভাব আমরা লক্ষ্য করি তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্য, শিল্প,  কলা, সংস্কৃতি, স্থাপত্য, শৈলী সর্বত্র। আবার যাঁরা কোনো ধর্মেই বিশ্বাসী নন, আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, যাঁরা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী নন, তাঁদের সৃজনকর্মে লক্ষ্য করা যায় মানবধর্মের প্রভাব, রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় যা উল্লেখ করেছেন  ‘মানুষের ধর্ম’ নামে। এবং এটা উল্লেখ করা বাহুল্য মাত্র যে, মানুষের অর্জিত সব ধর্মের মধ্যে মানবধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। যে ধর্মে উপনীত হতে পারলে যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের যাবতীয় বিধি-নিষেধ, সংকীর্ণতা, নীচতা, গোঁড়ামি, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। প্রকৃত ‘ধর্ম’র যা মূলতত্ত্ব ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’, সেই ভাবনাকে স্পর্শ করা যায়।    

দুঃখের কথা, আমরা নিজেরা মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করলেও মানুষের মর্যাদার কথা বিস্মৃত হই অনেক ক্ষেত্রে। অথবা ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারি না, একজন মানুষের অন্য মানুষের প্রতি কর্তব্য কী, দায়িত্ব কতটা। কবি চন্ডীদাস তো সেই কবেই উচ্চারণ করেছিলেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’, অথচ আমরা কেউ কেউ যেন উদগ্রীব হয়ে থাকি কীভাবে মনুষ্যত্বকে আরও নিচে টেনে নামানো যায়। এটা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। আর এই সর্বনাশের মূলে সমানেই প্ররোচনা  এবং রসদ যোগান দিচ্ছে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি। মনুষ্যত্বকে খর্ব করার এবং ধ্বংস করার দুটি মোক্ষম অস্ত্র। এসব কোনো নতুন কথা নয়, কোনো নতুন বিশ্লেষণও নয় আপনাদের কাছে; বরং আমরা সবাই  জানি কোন্‌টা সত্য আর কোন্‌টা সঠিক। কিন্তু সব কিছু জেনে  বুঝেও যদি আমরা ‘বোবা-কালা-দৃষ্টিহীন’ সেজে বসে থাকি, তাহলে ‘স্বখাত সলিলে’ ডুবে মরা ছাড়া আর তো কোনো বিকল্পও নেই!

সবাই ভালো থাকুন। অন্তত ভালো থাকার চেষ্টা করুন। শুভেচ্ছা।  


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
KajalSen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India


<<<< শারদ অর্ঘ্য >>>>


অলকরঞ্জন বসু চৌধুরী



বিকাশের দুর্গা সিরিজ দেখে... ... 
















<<<< কথনবিশ্ব >>>>


শিবাংশু দে




কুশারিবাগান ৭







তোমার মোহনরূপে

রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার যে অভ্যেস এখন শ্বাসক্রিয়ার মতো অবিরলঅনর্গল্তার পিছনে একটা দীর্ঘ প্রস্তুতি রয়েছে এই অভ্যেসটি আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও বড়ো হতে থাকে আমার শরীরের দৈর্ঘ্যপ্রস্থমনের মধ্যে গড়ে ওঠা নানা রকম বেড়াতাদের ভাঙা আবার গড়ে তোলার যে খেলাযা সংক্ষেপে আমার ঐহিক জীবনতাকে জড়িয়ে ধরে আঙুরলতার মতো সেও আকাশের দিকে হাত বাড়াতে চায় রবীন্দ্রসঙ্গীত এই মুহূর্তে জীবনে যে পর্যায়ের  ছায়াবিস্তারী মহীরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছেসেখানে মুগ্ধতাপ্রেমসম্মোহনআকর্ষণ ইত্যাদি শব্দ অপরিসর মনে হয় একটা শব্দ কিছুটা কাছে যেতে পারেসেটা হলো পরিপূর্ণতা আমাদের প্রজন্মের সৌভাগ্যগত একশো বছরের অধিক কালতিন-চার পুরুষ ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক যে শিল্পধারা গড়ে উঠেছেতার শ্রেষ্ঠ ফলগুলি আস্বাদন করার সুযোগ আমরা পেয়েছিএর ভালো দিকটা হলোমানুষ হয়ে জন্মাবার সূত্রে একটা সেরা সম্পদ লাভ আর নেতিবাচী দিকটারস উপভোগের মাত্রাটির মান আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয় এই শিল্পে সের্গেই বুবকা বা এডুইন মোজেসের দল বা তোমারি তুলনা তুমি প্রাণতাঁদের খেলা সাঙ্গ করে বাড়ি ফিরে গেছেন একসঙ্গে আকাশে অগুন্তি নক্ষত্র ছিলো যখনতার শ্রেয়ফল আমাদের নসিব হয়েছিলো আবার যখন অন্ধকার আকাশে একটি-দু'টি মিটমিটে তারা নিষ্প্রভ সীমাবদ্ধতায় কোনমতে জেগে থাকার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলোতার সাক্ষী থাকার সুযোগও হয়েছে আমাদের এরকম একটি সময়ে কাগজে পড়েছিলুমআনন্দ পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে এক শিল্পী এমন উচ্চমানের রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছেনযাকে সেই তোমারি তুলনা ইত্যাদি বলা যেতে পারে তাঁর নাম তার আগে আমি শুনিনিনামটি অবাঙালিসুলভ

সুমন যেমন হঠাৎ এসে আমাদের বাংলাগান শোনার অভ্যেসটি আমূল বদলে দিয়েছিলেনতেমনি রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রায় সমসময়ে যিনি এই কাজটি করেছিলেন তাঁর নাম মোহন সিং খঙ্গুরাসবার মোহনদা তিনি প্রায় আকৈশোর শান্তিনিকেতনবাসী শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যে নারীকণ্ঠের কিন্নরী শিল্পীর সংখ্যা পরুষদার্ঢ্যের কণ্ঠশিল্পীর থেকে বেশ অধিক সত্যিকথা বলতে অশোকতরু ছাড়া এই মুহূর্তে আর কারো নাম মনে পড়ছে না পরিশীলিতসুরেলা কণ্ঠগভীর  প্রস্তুতি ধীমান পরিবেশনাপুরুষশিল্পীদের মধ্যে এই সব লক্ষণ অবিরল না হলেও কয়েকজন শিল্পী নিশ্চয় ছিলেন যাঁরা এই শিল্পরীতিটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন রসিকজনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার ক্ষমতা তাঁদের ছিলো কিন্তু  পঙ্কজকুমারের ঘরানা পূর্ণতা পাবার পরসাধারণ শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের এক অন্যতর শৈলী লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে এই লোকপ্রিয়তা  রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বনিযুক্ত অভিভাবকদের নির্দেশিত শুদ্ধতার মাত্রাবোধকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায় রবীন্দ্রসঙ্গীত যে শুধু নিভৃত গৃহকোণে গুনগুনানো নিজের মুদ্রাদোষে একলা হয়ে থাকা এককের গান নয় বা ব্রাহ্মমন্দিরের যান্ত্রিক ভক্তসম্পূটসেই অবস্থানটি শক্তি পেয়েছিলো পঙ্কজকুমারের আজীবন প্রয়াসে তিনি এতো অধিকমাত্রায় রবিসঞ্জীবিত ছিলেন যে হয়তো সম্পূর্ণভাবে নিজেও বোঝেননিভবিষ্যতের দেওয়াল লিখন তাঁর সঙ্গীতভাবনাকেই স্বাগত জানাবে একটি শব্দ দিয়ে মোহনদা সেদিন রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বোঝাতে চেয়েছিলেনযার অমোঘত্ব প্রশ্নহীন কিন্তু হয়তো আজকের দিনেও অনেকের মনে তা নিয়ে দ্বিধা থাকতে পারে শব্দটি ছিলো 'ম্যাজেস্টিক'




মোহনদার শান্তিনিকেতনের বাড়িটিতে পৌঁছোনোর শাখাপথটি সংকীর্ণ রথের গৌরবে তৃপ্ত মানুষদের একটু হেঁটে তাঁর দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছোতে হবে এটি কোন উল্লেখনীয় বিশেষত্ব নয়কিন্তু আমার মনে এর একটা প্রতীকী ইশারা এলো রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাছে পৌঁছোতে গেলে অনিবার্যভাবে কিছুটা ধুলোমাটির পথে হেঁটে যেতে হবে রাজার রথে চড়ে তার কাছে সরাসরি পৌঁছোনো যায় না অথচ অনেক 'রাজা' সে কথা বোঝেন না এমন অভিমান তেনাদেরএমনি অভিমান...

গলিটির শেষে দু'টি দোতলা বাড়ি বাঁদিকের বাড়িটিতে মোহনদার ভদ্রাসন বারান্দায় জুতো খুলতে খুলতে শুনি ঘরের ভিতর তানপুরা যন্ত্রের গুঞ্জন ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখি মোহনদা বসে আছেন একটি নিচু আসনেতানপুরা যন্ত্রটি থেকে সুর উঠে আসছে মেঝেতে মাদুরপাটি পাতা রয়েছে অভ্র-শ্রীলা তাঁর স্নেহধন্যসেই অধিকারে আমারও স্বাগত সেই গৃহে পিছনের দেওয়ালে দু'টি প্রতিকৃতিপন্ডিত ধ্রুবতারা যোশি এবং পন্ডিত অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায় দুই গুরুর স্নেহচ্ছায়ায় আশ্রিত শিষ্য সেইখানে বসে সুরসাধনা করেন সামনের কাচের আলমারিতে আরো প্রতিকৃতির সঙ্গে দুজনের মুখের ছবিযাঁরা এখন নয়নের মাঝখানে বসবাস করেন পুত্র বিক্রম এবং তাঁর মাতৃদেবী একাকী যাবো না অসময়েএরকম প্রতিশ্রুতি তাঁরা দিয়েছিলেন কি না জানা নেই; কিন্তু সেভাবেই চলে গেছেন

একপাশে একটি টিভিতার উপর বেশ কয়েক খন্ড রবীন্দ্ররচনা সংকলনের পঞ্জাবি অনুবাদ আমরা গিয়ে মাদুরে বসি

মোহনদার প্রথাবদ্ধ সঙ্গীতশিক্ষা মূলতঃ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রবীন্দ্রসঙ্গীতে আগ্রহী হয়েছিলেন পরবর্তীকালে তাঁর শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে গভীরপাঠ তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এক ভিন্ন গরিমা দিয়েছে প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারে তিনি শুধু পথিকৃৎই 'এখনও একম অদ্বিতীয়ম গত একশো বছর ধরে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকারেরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন এখনও কেউ কেউ গেয়ে থাকেন কিন্তু তা একান্তভাবে তাঁদেরই গান হয়ে থেকে যায়রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠতে পারে না এই ঘটনাটি আমার বিস্ময় উদ্রেক করে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতশিক্ষার ভিত্তি চারতুকের ধ্রুপদ ফরম্যাটে সামান্য কিছু ব্যতিরেকে তাঁর প্রায় সব গানই চারতুকের রচনা অর্থাৎ ধ্রুপদের পরিমার্জিত অনুশাসন কখনও রোদের মতোকখনও ছায়ার মতোতাঁর গানকে অনুসরন করে চলে কিন্তু প্রথাগত ধ্রুপদ বা অন্য আঙ্গিকে শিক্ষিত শাস্ত্রীয় কণ্ঠশিল্পীরা যখন তাঁর গান গাওয়ার প্রয়াস করেনসেখানে রবীন্দ্রসৃষ্টির পরিমার্জনা প্রকৃত প্রস্তাবে সঞ্চারিত হয় না সেশিল্পী রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হো' বা অজয় চক্রবর্তীঘটনাটি একই থাকে




মোহনদা' এখনও একমাত্র ব্যতিক্রম তাঁর শাস্ত্রীয় শিক্ষার গভীরতা রবীন্দ্রনাথে একান্ত সমর্পণ এবং তার সঙ্গে কণ্ঠসম্পদতাঁর গীত রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এক অন্যতর মাত্রা দেয় তিনি একাধারে শান্তিদেবের স্ফূর্তিসুবিনয়ের নিষ্ঠা এবং পঙ্কজকুমারের ঔদাত্ত আত্মস্থ করেছেন এই গরিমাটি আমরা অন্য কোনও শিল্পীর মধ্যে পাইনি রবীন্দ্রসঙ্গীতে 'ম্যাজেস্টিক' শব্দটির প্রয়োগ কীভাবে হয়তিনি নিজে তার মূর্ত উদাহরণ

পন্ডিত ধ্রুবতারা যোশি এক বিরল প্রতিভা এনায়ত খানের প্রিয় শিষ্য ছিলেন তাঁর কাছ থেকে সেতারের তালিম হাসিল করে ছিলেন বহুদূর কিন্তু হঠাৎ তাঁর শরীর বিশ্বাসঘাতকতা করে অতিদ্রুত ঝালা তানতোড়া করার সময় তাঁর আঙুলগুলি অবশ হয়ে যায় অনেক চিকিৎসা করেও আরোগ্য হন না তিনি নিরাশ শিষ্যকে এনায়ত কণ্ঠসঙ্গীতে তালিম নিতে বলেন তখন তাঁর গুরু ' এনায়তের ঘনিষ্ট সুহৃদ ফ্যয়েজ খান অকালপ্রয়াত প্রাণের বন্ধুর অনুরোধে অফতাব--মৌসিকি যোশিজিকে তাঁর শ্রেষ্ঠকোটির তালিম দেন যোশিজি সম্ভবত ভারতবর্ষে একমাত্র শিল্পীযাঁর এটওয়া ঘরানার যন্ত্রের তালিম আর আগ্রা ঘরাণার কণ্ঠসঙ্গীতের তালিম হাসিল হয়েছিলো বাল্যকালে পিতৃহারা উস্তাদ বিলায়তকে সহি ঘরানার তালিম দিয়েছিলেন যোশিজি বিলায়ত শিক্ষার্থী থাকার সময় লখনউতে যোশিজির বাড়িতেই থাকতেন দুজনে দুজনকে খলিফা বলে স্বীকার করতেন মোহনদার কণ্ঠসঙ্গীতে তালিম এহেন যোশিজির কাছে তার সঙ্গে পন্ডিত অশেষ বন্দোপাধ্যায় আর পন্ডিত ওয়াঝেলওয়ারের শিক্ষা এটওয়াআগ্রাবিষ্ণুপুরসমস্ত ঘরানার মণিমুক্তো সংগ্রহ করে তিনি তাঁর ভান্ডার পূর্ণ করেছিলেন

রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাঁর অভিষেক অনেক পরে

আড্ডা দিতে দিতে প্রশ্ন করলুমকীভাবে তিনি গানের নেশায় পড়লেন? তিনি পিছিয়ে যান অনেকদূর বহুদিন আগে রাজস্থানের এক ব্রাহ্মণ পরিবার জীবিকার সূত্রে পঞ্জাবে এসে বসতি করেন লুধিয়ানা থেকে অল্পদূরে লটালা গ্রামে স্থিত হয়ে তাঁরা পরবর্তীকালে শিখধর্মে দীক্ষিত হন সেই পরিবারেই স্বাধীনতার কিছুদিন পরে মোহনদার জন্ম তাঁর পিতৃদেব ছিলেন সঙ্গীতরসিক মোহনদা চন্ডীগড়ে ইশকুলের পাঠ সাঙ্গ করার পর গানের তালিম নিতে ব্যগ্র হয়ে পড়েন তাঁর পরিবারের এক গুরুজন একসময় শান্তিনিকেতনে এসে থেকেছিলেন কিছুদিন কিশোর মোহনদার আগ্রহ দেখে তিনি তাঁকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে তালিম নিতে অনুপ্রেরিত করেন সতেরো বছরের কিশোর তখন থেকেই শান্তিনিকেতনের অচ্ছেদ্য অঙ্গ সঙ্গীতভবনে শিক্ষার্থীতারপর সেখানেই অধ্যাপনা সঙ্গে পাওয়া অগণিত গুণ মুগ্ধ ছাত্রছাত্রীশ্রোতৃদল আর শান্তিনিকেতনী সঙ্গীতের এক নতুন ধারা

শান্তিনিকেতনে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুপ্রেরণা তথা গুরু ছিলেন দুজনশান্তিদেব ঘোষ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় 'শান্তিদা' আর 'মোহরদি' কাছে তাঁর কৃতজ্ঞতা জানান অকপটে টিভি'তে সময় একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিলো কলকাতায় অনুষ্ঠিত স্বামীজি সংক্রান্ত একটি আলেখ্যের পুনঃপ্রচার অনুষ্ঠানটিতে মোহনদা বেশ কটি গান গেয়েছিলেন যখন সেই গানগুলি পর্দায় আসছিলোতখন আমরা শিল্পীর সঙ্গে একযোগে শুনছিলুম আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে আলোচনাও চলছিলো তার ফাঁকে ফাঁকে আমি তাঁকে প্রশ্ন করিএই মুহূর্তে রবীন্দ্রসঙ্গীতে যে  ধরনের পরিবেশন আমরা দেখছিসেখানে তাঁর মতে কীসের অভাব আছে? বিষয়টি নিয়ে অনেক ভেবেছেনতাঁর কথায় তা স্পষ্ট তিনি তাঁর অনুভূতিটি প্রকাশ করলেন সেই শব্দটি দিয়েযার উল্লেখ আমি ইতোমধ্যে করেছি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রকাশভঙ্গির মধ্যে একটা ম্যাজেস্টিক মাত্রা থাকা দরকাররাজকীয় গরিমা সেটা না থাকলে পরিবেশনটি বৃথা এখন তাই হচ্ছে হাটের ধূলাপ্রাণে সয় না একেবারে




যে ব্যাপারটা বহুদিন আগেই জেনেছি যে কবির কাঙালও যখন বলেআমায় ভিখারি করেছোআরো কী তোমার চাই? এই ভিখারি তো আসলে কপিলাবাস্তুর রাজকুমারের মতো আমাদের ঐতিহ্যে প্রথম মানুষযিনি ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যেও রাজকীয় সম্ভ্রমের সঞ্চার করেছিলেন যিনি তাঁর ভুবন শূন্য করে ফেলেন আরেক কাঙালের আশ মেটাতে এভাবে সর্বহারারও এক রাজসিক পরিচয় গড়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের সেই রাজসিক উত্তরাধিকার সন্ধ্যাকাশে ঊর্দ্ধকর হয়ে দাঁড়ালে থরে থরে ঝরে পড়া আপন প্রাণের ধন তাকে তো ম্যাজেস্টিক হতেই হবে

একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন করিকার গান এই মুহূর্তে ভালো লাগে? তিনি নাম করেন অদিতি মহসিনের এই শিল্পী আমারও খুব প্রিয় বলিমান্না দে যদি রবীন্দ্রসঙ্গীত  নিয়মিতভাবে রেকর্ড করতেনতবে একটা অন্যরকম গায়কীর প্রচলন হতে পারতো কারণ তিনি ভারতবর্ষের সামগ্রিক সঙ্গীতবৃত্তের সঙ্গে গভীরভাবে ওতোপ্রোত ছিলেন গানের ভিতর দিয়ে 'সীমাহীন' শ্রোতাসমাজের কাছে পৌঁছোনোর জাদু তাঁর জানা ছিলো তাঁর সূত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত বৃহত্তর শ্রোতৃমন্ডলীর কাছে সহজে আদৃত হতো নাআমি তাঁর 'স্টার' আবেদনের প্রসঙ্গে যেতে চাই না তা তো আশাজির মধ্যেও ছিলো মান্নাদা ছিলেন একজন আদ্যন্ত বাঙালি 'রবীন্দ্রনাথে' পরিভাষা কীসে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা ছিলো তাঁর তার সঙ্গে ছিলো আপোসহীন পেশাদারি উৎকর্ষ শুনেছিবাড়িতে সর্বক্ষণ রবীন্দ্রসঙ্গীতই গাইতেনগুনগুন করে মোহনদা জানানমান্নাদার সঙ্গে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাঁর ভদ্রতাবোধশালীনতা ছিলো প্রশ্নের ঊর্দ্ধে, অনুকরণীয়

ভাবিশান্তিনিকেতনী অনুশাসনের বেড়াজাল এইভাবে একজন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি গায়ককে রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রোতাদের কাছে অলভ্য করে রেখে দিলো

মোহনদার কাছে জানতে চাইএতো দীর্ঘদিন শান্তিনিকেতন বাসের পর তাঁর মাতৃভাষার সঙ্গে যোগাযোগটি এখন কী রকম রয়েছে? তিনি জানানএকসময় তিনি নিয়মিত পঞ্জাবিতে কবিতা লিখেছেন এখন হয়তো তার স্রোত একটু স্তিমিতকিন্তু তা রয়েছে পুরোমাত্রায় পঞ্জাবিভাষাসাহিত্যচর্চা তিনি নিয়মিত করে থাকেন শরীরের অসহযোগশোকসন্তাপের আগুন উপেক্ষা করে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ যেভাবে একটি পূর্ণতাময় যাপন আমাদের সামনে রেখে যানআমরা শুধু তার সাক্ষী থাকতে পারি

সন্ধে কখন রাত হয়ে গেছেবোঝা যায়নি প্রণাম করে বেরিয়ে আসি সবাই
-----------------------

হয়তো কোনও মানেই নেই। তবু পুরুষানুক্রমে একটা ফ্যান্টাসি জড়িয়ে আছে এই লালমাটি আর হরিৎ চরাচরের সঙ্গে। হয়তো অলীক এই মিছুটান। হয়তো বুকের মধ্যে চাষ করা একপো প্রেমের ধান। অক্ষয়বটের দিকে হেঁটে যাওয়া। তার কি কোনও নাম হয়? বিশেষণ? প্রায় চারদশক আগে একেবারেই অন্য একটা লোক  ছিলুম। অবশ্য তাও বলা যায় না ঠিক। বুঝি না ছিলুম কি না আদৌ ছাতিমতলার মতো অনশ্বর! যেভাবে সেই কোনকালে পর্ণার ট্রেন প্ল্যাটফর্ম  ছাড়িয়ে সিগন্যালের অন্যপারে চলে গিয়েছিল। সময়ও থেমে গিয়েছিল কোনও এক অদৃশ্য ফুলস্টপে। সেখানেই শেষ হওয়া গল্প পাহাড়ফেরৎ প্রতিধ্বনির মতো ফিরে আসে। সেভাবেই আবার শেষ হয় এই অন্যমন সংলাপের সিলসিলা, ফিরে আসবে বলেই...
"....বহুদিন আগে তোমার জন্য একটা গ্র্যাফিটি লিখেছিলুম এখানে, তোমায় আলাদা করে দেখানো হয়নি।
- মানে,
- এক্ষুনি দেখতে পাবে...

লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা চত্বর। এখানে যারা আসে, সবাই একবার দাঁড়ায়, মনে মনে পড়ে যায়, 'তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি'
- এর মানে...
- আসলে তোমাকে ভেবেই লিখেছিলুম ঐ লেখাটা, দেবেন ঠাকুর জানতে পেরে 'তুমি' কেটে 'তিনি' করে দিয়েছিলেন। আজ আমি আবার তোমাকে এটা ডেডিকেট করলুম।

- তুমি... তুমি না... একটা...

- বস করো ম্যাডাম, চলিয়ে জায়া যায় ...

বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার দাঁড়িয়েই ছিলো প্ল্যাটফর্মে। মেলা ফেরা অনেক লোকই এই গাড়িতে ফিরবে। একটা জায়গা দেখে ব্যাগটা রাখলুম।
একেবারে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীরবতা ভাঙার জন্য বললাম, দুদিন কোথা থেকে কেটে গেলো বোঝা গেলোনা ...
- বুঝতে চাইলে তো বুঝবে ...
- বেশ তো, তুমি কোনও দিন বুঝিয়ে দেবে তার জন্য অপেক্ষা করবো...  
- তুমি আমার সঙ্গে চলো...
- কোথায়?
- যতদূর এই ট্রেনটা যাবে
- বেশ যাবো...
- যাবে?
- নিশ্চয় যাবো
ঠিক যেমন করে সিনেমায় সবুজ পতাকা দোলে, গার্ড হুইসল দেয়, ট্রেন নড়তে থাকে, জানালায় বসা নায়িকার ধরা হাত থেকে নায়কের হাত ছেড়ে যায়, নায়ক ট্রেনের সঙ্গে দৌড়োতে থাকে... প্রায় সবই হলো... শুধু নায়ক দৌড়োলো না, অস্ফুটে বললো, চিঠি দিও...
নায়িকা শুনতে পেলো কি না ঠিক বোঝা গেলো না...

('নির্জন খড়ের মাঠে'র থেকে)

(শেষ)