কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১৮

ফকির ইলিয়াস




এগুলো কাঁটা নয়


(১)

মৃত পাহাড়ের দাগের ভেতর শুয়ে আছে যে মমি,
তার কোনও প্রাণ ছিল না।
কিংবা ক্রমশ বরফ হতে হতে নিস্তেজ হচ্ছে যে সমুদ্র
সে'ও এর আগে বিতরণ করে'নি কোনো মেঘের কিস্তি।
তবু বাষ্প উড়েছে।গ্রহগামী চিল,
 
পান করেছে সেই বাষ্পরেণু।

গোলাপকে বিধ্বস্ত করে যে সূর্য একাকী ফিরেছে ঘরে-
অথবা আগুনের বুকের দু'পাশে ফোটে আছে যে বেদনা,
এগুলোকে কাঁটা বলা যায় না। বরং বলা যায় আনন্দ,
বেঁচে থাকার যোগধ্যান।কারণ বাঁচার জন্য যেসব
রসায়ন প্রয়োজন হয়-; বেদনা তারই অংশ।


(২)

আয়নাগুলোকে ভেঙে ফেলা যায়। কিন্তু এই আয়নায়
একদা নিবন্ধিত হয়েছিল যে ছায়া, তাকে ভাগ করা
যায় না। মুছে ফেলা যায় না স্মৃতিকেও। ভোলা যায় না,
বাদল-বিধৌত দিনে যেভাবে উল্টে গিয়েছিল ডিঙি,
বসন্তকে একা ফেলে পরবাসী হয়েছিল যে ফাল্গুন।
.
মানব জীবনের তিন চতুর্থাংশ কাটে কাঁটাময়
ঘোরের ভেতর। কিছু কাঁটা সংকলিত হয়।
কিছু কাঁটার প্রকৃত কোনো সাকিন থাকে না।


(৩)

মানুষ নিজের জন্যেই লিখে রাখে সকল ধাতুদর্শনের
গান। কোনও আত্মজীবনীই সত্য নয়, কোনও
ইতিহাসই নয় পরিশুদ্ধ!
একথা জানার পর বৃক্ষই নিজেকে, মানুষের চেয়ে
উত্তম ভাবে। গায়ে কাঁটা দেয়া রাতগুলোকেই
ভাবে উজ্জ্বল সময়।

মানুষের জীবনে উজ্জ্বল দিন থাকে বড়জোর
দু'তিনটে। যদি তা চারটে' পেরিয়ে যায়-
সেই মানুষকে নিয়েই চন্দ্রকাহিনী লেখে
নক্ষত্রের প্রেমিকারা।


রোমিং অথবা রূপরহস্য

কিছুই লুকানো নেই আজ
আনন্দ, বিষাদ, কাব্যকলা কিংবা কামজ নদীর আওয়াজ
স্রোতের উষ্ণতা ঘিরে
যে জীবন লিখে গান, স্বপ্ন আর ঋতুর শরীরে
তার মন জুড়ে থাকে আষাঢ়ের নমস্য আগামী
সেকথা বৃষ্টি জানে - জানে ঝড়, কালের সুনামি।

আকাশে খোঁজার দাম - যাকে তোমরা রোমিং চার্জ বলো
মানুষ খুঁজেছে আগেও - মাটিদাগ, জলবিন্দুগুলো
এখন রহস্য হয়ে যে তারা মাথার উপরে
তোমাদের থাকে, পিতামহ তার বুক চিরে
রুয়েছেন প্রেমবৃক্ষ, পাতার সংসার
বলেছেন, কাছে থাকো প্রিয়তমা, ভালোবাসো আর
পড় ইতিহাস-
প্রকৃতি যেভাবে করে দ্যুতির প্রকাশ।

মানুষের সত্তা জানে, কত আলো বুকের পাঁজরে
কীভাবে আঁকড়ে থাকে সমকালে মায়াচক্র ঘরে।


আলনার আলোগুলো

ঘরটি ঝেড়ে মুছে সাফ করা হয়েছে। ধুয়ে পরিষ্কার
করা হয়েছে সেই লালফুলে ঘেরা বড় কম্বল। এটি গায়ে
দিয়ে শীত পোহাতেন আমার মা। এই আলনায় সযত্নে
মেলে দিতেন তাঁর পরার কাপড়, স্মৃতি এবং রোদসম্ভার।

জানালার ফাঁক স্পর্শ করে সূর্য এসে চুপিসারে দেখা দিত
এই আলনায় প্রতিটি ভোরে। তিনি রোদের ঝিলিকে প্রতিদিন
দেখতেন আমার পরবাসী মুখ। ঠিক যোহরের নামাজের শেষে
সেরে নিতেন দীর্ঘ মোনাজাত। আর ভাবতেন,
 
এখন ওখানে রাত! এখন ঘুমুচ্ছে আমার পুত্র, পুত্রবধূ আর
দুই নাতনি। ওরা আরাম করুক!

জগতে শান্তির পক্ষে একজন ত্যাগী ইবাদতকারী ছিলেন
আমার মা। কোনও দু'খী মানুষ দেখলেই হাত বাড়িয়ে
দিতেন আর বলতেন, মানুষের জন্যেই তো এই জীবন।

এই ঘরটি যেমন ছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। শূন্য এই খাট।
তাঁর বাক্স-শোকেস সবই আছে ঠিকঠাক!

এগুলো শাদা কাপড় দিয়ে ঝাড়ছে কেউ। আমি পাশে
দাঁড়িয়ে আছি। দেখছি। বলতে পারছি না কিছুই।
কোথায় মা! কোথায় তিনি!
আলনার আলোগুলো প্রতিদিনের মতোই তাদের প্রখর
রশ্মি ফেলছে আমার মুখাবয়বে।
 
তুলি, আমার ঘর্মরেখাগুলো মুছে দিচ্ছেন তাঁর আঁচল দিয়ে।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন