কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১৮

পারমিতা চক্রবর্ত্তী




লিটিল ম্যাগাজিনের একাল সেকাল




(২)

লিটিল ম্যাগাজিন মানেই সতত স্বাধীন৷ অর্থাৎ স্বাধীন ভাবে চলাকোন পোষণ বা তোষণ না করে সার্থক ভাবে এগিয়ে চলা লিটিল শব্দটির ব্যাখা করলে  সর্বোতভাবে পিছিয়ে পড়তে হবেলিটিল ম্যাগাজিনের কাজটাই বৃহৎ তবে অনেকেই আমরা লিটিল ম্যাগাজিন কাকে বলে এটাই জানি না যদিও সেভাবে এর ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা হয় না শিল্পসাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে চলমান ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারা ও মতামত ব্যক্ত করার মুদ্রিত মাধ্যমকে বলা যেতে পারে  লিটল ম্যাগাজিন। এ ম্যাগাজিন অনেকটাই অনিয়মিত এবং অবাণিজ্যিক। সুতরাং বাণিজ্যিক ধারার বিপরীতে কাজ করাটাই এর মূল লক্ষ্য।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু। ইংরেজি সমালোচনা সাহিত্যের ইতিহাস মতে লিটল ম্যাগাজিনের অভিযাত্রা শুরু হয় Ralph Waldo Emerson Margaret Fuller সম্পাদিত The Dial (Boston, 1840-1844)-এর মাধ্যমে। ইমার্সনের নতুন দর্শন Transendentalism-এ যারা সমর্থক তাঁরাই শুধু Dial ম্যাগাজিনে লিখতেন। লিটল ম্যাগাজিনের আরেক প্রভাবশালী পত্রিকা ছিল ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত Savoyভিক্টোরীয়ান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার উদারপন্থী ও সাম্যবাদী  লেখকদের প্রধান বাহন ছিল এটি। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশ শতকের গোড়ার দিকে সবচেয়ে নামী লিটল ম্যাগাজিন ছিল Poetry: A Magazine of Verse (Chicago 1912)পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন হেরিয়েট মনরো ও এজরা পাউন্ড

লিটিল ম্যাগাজিন আন্দোলন মূলত শুরু হয় ১৯৫০এর দশক ও ১৯৬oএর দশক থেকেবিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় লিটিল ম্যাগাজিনে এই আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ্য  করা যায়পরবর্তীতে পাশ্চাত্যের আদলে বঙ্গদেশে প্রথম লিটল ম্যাগাজিন প্রবর্তন করেন প্রমথ চৌধুরী। তাঁর সম্পাদিত সবুজপত্র (১৯১৪)-কে আধুনিক লিটল  ম্যাগাজিনের আদিরূপ বলে গণ্য করা হয়। বিংশ শতাব্দির প্রথম ভাগে বাংলা ভাষায় অন্যতম প্রধান সাময়িক পত্রিকা ছিল ‘সবুজপত্র’প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় এটি প্রকাশিত হতো। এর প্রথম প্রকাশ বাংলা ১৩২১ সালে (ইংরেজী: ১৯১৪ খ্রি.)সবুজপত্রে কখনো কোনো বিজ্ঞাপন এবং ছবি প্রকাশিত হয় নি। প্রমথ চৌধুরী সাময়িকীটিকে বাণিজ্যিকভাবে আকর্ষণীয় রূপ প্রদানের  জন্যে কোনো চেষ্টা করেননি বরং তিনি এর মান এবং আদর্শ ধরে  রাখার প্রতি অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। তাই সবুজপত্র সাধারণ পাঠক ও লেখকদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারেনি। প্রথম পর্যায়ে এটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দ(১৯২২ সাল)পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে সবুজপত্রের প্রকাশনা শুরু হয় ১৩৩২ বঙ্গাব্দ থেকে। সাময়িকীটি শেষ পর্যন্ত ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে (১৯২৭ সালে) বন্ধ হয়ে যায়

অবশ্য অনেকে মনে করেন যে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’  (১৮৭২) বাংলা ভাষায় প্রথম লিটল ম্যাগাজিনবাংলাসাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনায় বহু পত্রপত্রিকা বাণিজ্যিকভাবেই প্রকাশিত হয়েছে।  যেমন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১), অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদিত ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ (১৮৪৩), প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদার সম্পাদিত ‘মাসিক পত্রিকা’ (১৮৫৪),  দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘ভারতী’ (১৮৭৭), সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘সাধনা’ (১৮৯১), রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ (১৯০১), জলধর সেন ও অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত  ‘ভারতবর্ষ’ (১৯১৩) প্রভৃতি পত্রিকা। এসব পত্রিকা ছিল প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শের  বাহক, যদিও পাশাপাশি অভিনবত্বেরও ছাপ ছিল এগুলিতে। তবে সনাতন চিন্তাধারার প্রাধান্য ছিল এগুলিতে।

যথার্থ অর্থে বাংলায় লিটল ম্যাগাজিনের আবির্ভাব ঘটে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত  সবুজপত্র(১৯১৪) পত্রিকার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে কল্লোল(১৯২৩), শনিবারের চিঠি(১৯২৪), কালিকলম(১৯২৭), প্রগতি(১৯২৭), পূর্বাশা (১৯৩২) পত্রিকা লিটল ম্যাগাজিন প্রবাহকে আরও দৃঢ় করে। এইসব পত্রিকার লেখকগণের উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করা। এ লক্ষ্যে তাঁরা ইউরোপীয় আদর্শে বাস্তবজীবন, মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রসঙ্গকে তাঁদের রচনার প্রধান উপাত্ত  করেন লিটল ম্যাগাজিন-এ উন্মেষকালে রবীন্দ্রনাথের অনেক কালজয়ী রচনা প্রকাশিত হলেও লিটল ম্যাগাজিনের প্রভাবই বেশি লক্ষ করা যায়, বিশেষত বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা (১৯৩৫) পত্রিকার মাধ্যমে।
সুবিমল মিশ্র বারো সালে উল্টো দূরবীনকে দেওয়া ইন্টার্ভিউতে বলেছিলেন লিটল ম্যাগাজিন ঘাঁটতে ঘাঁটতে এমন লেখা হঠাৎ হঠাৎ করে পেয়ে যাই বইকি! চমকে ওঠার মতো লেখা। ঘাবড়ে দেবার মতো। মূলত তরুণদের। […] যা কিছু পেয়েছি, চমকে দেবার মতো, লিটল ম্যাগাজিনেই। বিগম্যাগে, তথাকথিত সাহিত্য-সংস্কৃতির মাতব্বর পাক্ষিক কাগজে তো…”

লিটিল ম্যাগাজিনের যাত্রাটাই শুরু হয়েছিল তরুণ লেখক/কবিদের নিয়ে। যেমন সবুজপত্র। সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং সম্পাদকের নিজের লেখা সন্নিবেশিত হয়। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, বরদাচরণ গুপ্ত, সুনীতিকুমার চট্রোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর রায় সবুজপত্রে লিখতেন। কান্তিচন্দ্র ঘোষ, অমিয় চক্রবর্তী এবং সুরেশ চক্রবর্তী কবিতা লিখতেন।
(ক্রমশ)  




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন