কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৯

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৬৫ 

    
সম্প্রতি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের একটি প্রতিবেদন রীতিমতো নাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে। ‘ঢাকা টুডে’ প্রচারিত গত ১৭ই ফেব্রুয়ারী ২০১৯এর এই প্রতিবেদনের হেডিং ছিল “ভারতের প্রথম ‘ধর্মহীন নাগরিকে’র স্বীকৃতি পেলেন স্নেহা”প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ভারতের তামিলনাড়ুর তিরুপাত্তুরের বাসিন্দা  স্নেহা পার্থিবরাজের কাছে ৫ই ফেব্রুয়ারী ২০১৯ দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বিশেষ দিনটিতেই তিনি তাঁর স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেখতে পেলেন। কেননা তিনি স্বপ্ন দেখতেন এমন একটি মানব সমাজের, যেখানে জাতি-ধর্মের কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে নিতান্ত কম বয়স থেকেই সমাজে প্রচলিত তথাকথিত জাতি ও ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর বিশ্বাস ও আস্থা ছিল মানবধর্মেএবং তিনি এই শিক্ষা পেয়েছিলেন তাঁর পরিবারের লোকজনদের কাছ  থেকেই। আর এই শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিতেই স্নেহা ২০১০ সালে নিজেকে ‘জাতি-ধর্মহীন’ ঘোষণা করার জন্য আবেদন করেছিলেন সরকারের কাছে। কিন্তু সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন সরকারী কর্মকর্তারা। কিন্তু পেশায় আইনজীবী স্নেহাকে হতোদ্যম করার ক্ষমতা কারও ছিল না। তাঁর যুক্তি ছিল, তথাকথিত জাতি-ধর্মে বিশ্বাসীরা যদি সরকার থেকে শংসাপত্র পেয়ে থাকেন, তাহলে যাঁরা তথাকথিত জাতি-ধর্মে অবিশ্বাসী, তাঁরা কেন শংসাপত্র পাবেন না! শুধুমাত্র মানবধর্মে বিশ্বাসী স্নেহা ২০১৭ সালে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে আবার আবেদন করেন সরকারের কাছে। যেহেতু স্নেহা ইতিপূর্বে সামাজিক শ্রেণীভিত্তিক কোনো সরকারী সুযোগ-সুবিধে কখনই ভোগ করেননি, তাই এবার সরকারী প্রশাসন তাঁর আবেদন গ্রহণ করতে বাধ্য হন। এবং অবশেষে দীর্ঘ ন’বছরের আইনি লড়াইয়ের পর গত ৫ই ফেব্রুয়ারী ২০১৯ তারিখে তিরুপাত্তুরের তহশিলদার টি এস সাথিয়ামূর্তি স্নেহার হাতে তুলে দেন সরকারী নথি। স্নেহা কোনো জাতি ও ধর্মের অন্তর্গত নন, নথিতে তা উল্লেখ করা হয়েছে।

তিরুপাত্তুরের সাব-কালেক্টর বি প্রিয়াঙ্কা পঙ্কজাম জানিয়েছেন, ‘আমরা তার স্কুল কলেজের সমস্ত নথি খতিয়ে দেখেছি। সেইসব নথিতে জাতি এবং ধর্ম এই দুটি কলাম সব জায়গায় ফাঁকা ছিল। তাই আমরা তার দাবিকে স্বীকৃতি দিয়েছি’ 

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, স্নেহা তাঁর এই লড়াইয়ে পাশে পেয়েছেন তাঁর স্বামী কে-পার্থিবরাজাকে। কে-পার্থিবরাজা নিজে সাহিত্যিক। তাঁরা তাঁদের এই  লড়াই পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দেবার জন্য তাঁদের তিন ছেলেমেয়ের স্কুলের ফর্মেও জাতি ও ধর্মের কলাম ফাঁকাই রেখে দিয়েছেন।

পরিশেষে, আরও একটি কথা উল্লেখ করা হয়তো বাহুল্য বলে মনে হবে না।  প্রকাশিত এই ৬৫তম সংখ্যার হাত ধরেই ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিন ছ’বছর পূর্ণ করে সাত বছরে প্রবেশ করল। এবং তা সম্ভব হয়েছে আপনাদের সবার সহযোগিতা ও শুভ কামনার জন্যই। আপনারা আমাদের কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন। 


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :   
        
08789040217 / 09835544675 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India

<<<< কথনবিশ্ব >>>>


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়




নদী থেকে বিদ্যার ত্রিদেবীর অন্যতমা, পরে একেশ্বরী: সরস্বতী



                                                                            
তিন তিনখানা, তিন কিসিমের সরস্বতী পুজো হয়ে গেলো, জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি জুড়ে। ৯-১০ ফেব্রুয়ারি দেবী সরস্বতী তো আছেনই; ৩০-১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা আমার কাছে বিদ্যাদেবীর প্রতীকই মনে হয়; আর ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষাদিবস তো বাংলাদেশ ছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গে ছাড়াও ভারতে এক সেকিউলার সরস্বতী পুজো ‘কালিমাটি’র এই সংখ্যাটা তার  পরেরটাই। কিন্তু ৯-১০ ফেব্রুয়ারি ক’জনের পুজো হলো? ছোটবেলায় গ্রামে দেখতাম উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ভাবে নিজের পুজোকে নাম দিতেন। সবাই সরস্বতী না ব’লে কেউ কেউ ‘ভারতীর আরতিতে’ ইত্যাদি দিয়ে ব্যানার সাজাতেন। কাউকে কিন্তু দেবী ইলাপূজার কথা বলতে শুনিনি। তিন বিদ্যাদেবী এক হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা দুঃখের। 

গ্রিক পুরাণে বিদ্যার বা জ্ঞানের দেবীর সংখ্যা নয়। এঁদের অধিক্ষেত্র আর প্রতীক নির্দিষ্ট। ক্যালিওপ-এর মহাকাব্য/লিখনফলক; ক্লিওর ইতিহাস/গোটানো পাণ্ডুলিপি; ইউটার্পি-র গান ও শোকগাথা/aulos নামের বাঁশি; মেলপোমিনি-র বিয়োগান্ত কাব্য/মর্মন্তুদ মুখোশ; পলিহিম্নিয়া-র স্তব?ওড়না; টার্প্সিকোরে-র নাচ/বীণা; থালিয়া-র মিলনান্ত কাব্য/মজার মুখোশ; আরইউরানিয়া-র জ্যোতির্বিদ্যা/খ-গোলক, দিক-নির্ণয় যন্ত্র।

 আর্যদের জ্ঞান, বিদ্যারও এক দেবী ছিলেন না। উপরে উল্লিখিত সরস্বতী, ইলা, ভারতী ছাড়াও অন্য নামও বেদে পুরাণে পাই। প্রথমে সরস্বতী ছিলেন সরস্বতী নদীর বৈদিক দেবী, যে নদী হিমালয় থেকে নির্গত হয়ে পশ্চিমবাহিনী হয়ে সমুদ্রে পড়তো। তাঁর তীরে মুনি ঋষিরা অর্চনা, বেদাভ্যাস, যজ্ঞ ইত্যাদি করায় তার জল ও তীর পবিত্র ছিল। তারপর নাকি দেবতা বরুণ তাঁর স্ত্রীকে চুরি করে কোথায় রেখেছে তা না করায় ক্রুদ্ধ মহর্ষি উতথ্যর অভিশাপে সরস্বতীর জল মরুভূমিতে গিয়েই নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। সম্ভবতঃ মরুভূমিপ্রসারে সরস্বতীর জল শুকিয়ে যাওয়ার পর থেকেই সরস্বতী নদীর আর্চনিক পবিত্রতা তাঁকে বাক, বিদ্যা, সাংস্কৃতিক কলাবিদ্যা ও বিজ্ঞানের দেবী করে তোলে। জনগণের কাছে সংস্কৃত ভাষাকে নিয়ে আনার গৌরব তাঁকেই দেওয়া হয়। কিন্তু শ্রীঅরবিন্দ তাঁর Secret of the Veda গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, সরস্বতীর নাম কেবল অন্যান্য নদীর সঙ্গে  নয়, অন্যান্য দেবীর সঙ্গেও, বিশেষ ক’রে ইলা ও ভারতীর সঙ্গে জড়িয়ে যায়, যাঁরা মনস্তাত্বিক প্রতীকই ছিলেন। সরস্বতীর পাশে তাঁদের পূজাও হতো। পরবর্তী পুরাণিক অর্চনাপদ্ধতিতে সরস্বতী একাই হয়ে যান বাক্, বিদ্যা ও কাব্যের দেবী, ভারতী হয়ে দাঁড়ায় তারই এক নাম। কিন্তু বেদে ভারতী কেবল সরস্বতীর থেকে আলাদা দেবীই নন, তার আর এক নাম মাহী। ঋগ্বেদের পঞ্চম খণ্ডের পঞ্চম সূক্তে লেখা হয়েছে—
इळासरस्वतीमहीतिस्रोदेवीरमयोभुवः |
बर्हिःसीदन्त्वअस्रिधः ||



অর্থাৎ ‘ইলা, সরস্বতী, মহী, তিন দেবী যাঁরা সুখের জন্ম দেন, যাঁরা হোঁচট খান না’, অথবা ‘আঘাত করতে আসেন না’, ‘তাঁরা যেন এই যজ্ঞীয় আসনে তাঁদের স্থান নেন’ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১১০ নং শ্লোকে এই ভাবটিই আরো বিশদ করা হয়েছে —
नो यज्ञं भारती तूयमेत्विळा मनुष्वदिहचेतयन्ती |
तिस्रो देवीर्बर्हिरेदं सयोनं सरस्वतीस्वपसः सदन्तु ||

‘ভারতী যেন আমাদের এই যজ্ঞে দ্রুত আসেন, এবং ইলা এখানে আমাদের চেতনা (অথবা জ্ঞান। বোধসমূহ)-কে মনুষ্যবৎ জাগ্রত ক’রে, এবং সরস্বতী, তিন দেবী বসুন এই সুখভরা আসনে, নিজেদের কাজ সুসম্পন্ন করতে করতে। কিম্বা মধুছান্দস-এর অষ্টম সূক্তে ভারতীকে মহী নামে উল্লেখ ক’রে বলা হচ্ছে যে — ইন্দ্রের জন্যে মহী কিরণে ভরভরন্ত, নিজের প্রাচুর্যে উপচে পড়ছেন, সুখী সত্য (সুনৃত) হিসেবে নিজের প্রকৃতিতে তিনি যজ্ঞদাতার জন্য এক পক্ব শাখার মতো উদার। যজ্ঞে সরস্বতীর সঙ্গী মহী জ্ঞানের প্রতীক, কারণ বেদে আলোক ও জ্ঞান সমার্থক।   

एवाहयस्यसून्र्ताविरप्शीगोमतीमही |
पक्वाशाखानदाशुषे ||

শ্রীঅরবিন্দ বলছেন সরস্বতী যেখানে শব্দ, মহী সেখানে সুনৃত, অর্থাৎ সুখপূর্ণ সত্য। ইলাও সত্যের শব্দ, এক পরবর্তী বিভ্রান্তিতে তাঁর নাম বাক্-এর ধারণার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়। সরস্বতী যেমন চেতনাকে যথার্থ চিন্তায়, অথবা মনের যথার্থ অবস্থায় জাগ্রত করেন, ‘চেতয়ন্তী সুমতীণাম্’, ইলাও তেমনই করেন। তিনি ‘সুবীরা’ বা উদ্দীপনায় ভরপুর, জ্ঞানদায়িনী। তিনিও সূর্যের সঙ্গে যুক্ত, যখন অগ্নি, ইচ্ছা সূর্যের, সত্য আলোকের প্রভুর রশ্মিতে প্রজ্বলিত হয়, ইলার সঙ্গে এক মন হয়ে উঠে, ‘जुषस्वाग्नइळयासजोषायतमानोरश्मिभिःसूर्यस्य |’ তিনি সূর্যরশ্মিদের অর্থাৎ সূর্যের গোপালদের মা, তাঁর নামের অর্থ যিনি সন্ধান করেন ও পান, আর ঋতম্ ও ঋষির মতো এটি একই ভাবনা-অনুষঙ্গ ধারণ করে। ইলা তার ফলে দ্রষ্টার সেই দিব্যদৃষ্টি যা সত্যকে লাভ করে।



শ্রীঅরবিন্দ Secret of the Veda গ্রন্থে বলছেন সরস্বতী যদি শ্রাব্য-সত্য শ্রুতির প্রতীক হন, যা আমাদের দেয় অনুপ্রেরিত শব্দ, ইলা প্রতিনিধিত্ব করেন দৃষ্টির, সত্যদৃষ্টিরশ্রুতি এবং দৃষ্টি যদি কবি, ঋষি ও সত্যদ্রষ্টার দুই শক্তি হয় তবে সরস্বতী ও ইলার ঘনিষ্ঠ যোগের কথা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। এর সঙ্গে যদি মহী বা ভারতী সূর্যের ‘বৃহজ্জ্যোতির’ বা ‘ঋতম্ জ্যোতির’ মতোই সত্য-চেতনার বৃহতত্বের প্রতীক, যা মানুষের সীমিত মানসে অবতীর্ণ বা উদিত হয়ে আর দুই ভগিনী জ্ঞান-কর্তৃত্বকে আবাহন করে আনে। তিনের মধ্যে এই সূক্ষ্ম কিন্তু জীবন্ত পার্থক্য পরে বেদজ্ঞানের পতনের কালে অষ্পষ্ট হয়ে যায় আর ভারতী বা মহী, ইলা আর সরস্বতী মিলে মিশে এক হয়ে যান।

আদিবৈদিক যুগ থেকে উত্তরবৈদিক যুগ অবধি নদী থেকে জ্ঞানের ত্রিদেবীর অন্যতমা হয়ে শেষে একেশ্বরী হওয়ার পথে দেবী সরস্বতীর জন্মবৃত্তান্ত এবং পতিবৃত্তান্ত সমানে পাল্টেছে। পতিবৃত্তান্তর কথায় আদিবৈদিক যুগে সরস্বতী অগ্নির সঙ্গে যোজিত ছিলেন, ইলা ও ভারতীর সঙ্গে অগ্নির জিহ্বার তিন শিখা। আদিতম বৈদিক যুগের সূক্তগুলির বহুধা ঐতিহ্যে সরস্বতী এরপর প্রথমে ইন্দ্রের, পরে দেববেদ্য অশ্বিনীকুমার ভ্রাতৃদ্বয়ের স্ত্রী বা সঙ্গিনী। তার কারণ সরস্বতীর পবিত্রকারী জলের কারণে তার তীরে যজ্ঞে ব্রাহ্মণদের পশুবলি বিধেয় ছিল। আন্তঃউপজাতি লড়াইয়ের সময় তাঁর জল ব্রহ্মহত্যার পাতক থেকেও মুক্তি দিতো। ভেড়া আর ভেড়ী ছিল তাঁর প্রিয়তম অর্ঘ্য, নিরামিষ খিচুড়ি নয়। যজুর্বেদের সময় থেকে সরস্বতী বাক বা পবিত্র শব্দের সঙ্গে একার্থক হয়ে ওঠেন। ব্রাহ্মণগুলির সময়ে ব্রহ্মার পূজা যখন তুঙ্গে, সরস্বতী হয়ে গেলেন ব্রহ্মার স্ত্রী। কিন্তু পরে বৌদ্ধ এবং জৈনরা যখন ব্রহ্মাকে তাঁদের বেদ-বিরোধী, দেব-বিরোধী বার্তার প্রধানা উদ্দিষ্টা করলেন, তখনও সরস্বতী এই ‘heterodox and heteroprax’ ঐতিহ্যগুলির মধ্যেও টিকে থাকলেন তো বটেই, নিজের সম্মানের আসনও ধরে রাখলেন।
পুরাণগুলিতে সরস্বতীকে করে দেওয়া হলো ব্রহ্মার কন্যা, তাঁর মুখমণ্ডল থেকে সৃষ্ট। কিন্তু সরস্বতীর জন্মের পরে তাঁর রূপ থেকে চোখ সরাতে না পেরে, কামাতুর ব্রহ্মা তাঁকে অবলোকন করতে, চারদিকে চারমুখ তৈরি ক’রে ফেললেন। কিন্তু এর ফলে তিনি অপদস্থ হওয়ায় সরস্বতীকে বিষ্ণুর স্ত্রী করা হলো। ব্রহ্মার অবশ্য অজাচার অভ্যস্ত। মানসকন্যা সন্ধ্যার সঙ্গেও তিনি অশোভন ব্যবহার করায় শিবের হাতে একটি মস্তক হারান। বিষ্ণুর স্ত্রী হবার এই সময়েই সরস্বতীর গায়ে ওঠে বীণা, পাণ্ডুলিপি, রুদ্রাক্ষ জপমালা, পায়ের নিচে হংস। তবে পরবর্তী কিছু পুরাণ মতো, তিন সপত্নী গঙ্গা, লক্ষ্মী, ও সরস্বতীর বিবাদ অসহ্য হয়ে ওঠায় বিষ্ণু সরস্বতীকে ব্রহ্মার হাতে তুলে দেন, আর গঙ্গাকে শিবের হাতে।

ব্রহ্মার সঙ্গে সরস্বতীর বিবাহও সুখের হয়নিকোনো যজ্ঞে অধিষ্ঠিতা থাকাকালে ব্রহ্মা তাঁকে ডাক পাঠালে সরস্বতী তাঁকে অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু প্রতীক্ষা করতে অরাজী ব্রহ্মা তাঁর জন্য এক দ্বিতীয়া স্ত্রী, গায়ত্রীকে গ্রহণ করায় সরস্বতী তাঁকে শাপ দেন যে বছরে একবার ছাড়া তাঁর পূজা হবে না। কিন্তু গায়ত্রীও একার্থে বিদ্যার দেবী হয়ে ওঠেন। ব্রহ্মার স্ত্রী গায়ত্রী চতুর্বেদের মাতা হওয়া ছাড়াও, একাধারে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও তিন বেদ। গীতকারীদের ত্রাণ করেন।

তবে বেদ যে বেঁচে আছে তা সরস্বতীর জন্যেই। মহাভারত অনুযায়ী শ্রুতিনির্ভর বেদ যখন ক্ষীণবীর্য ব্রাহ্মণদের দুর্বল স্মৃতির কারণে মৃতপ্রায়, তখন সরস্বতীর পুত্র সারস্বতই তাদের জীবন্ত রাখেন। বৌদ্ধযুগে প্রজ্ঞাপারমিতার মিথও শুষে নিয়ে সরস্বতী উচ্চতম জ্ঞানের প্রতীক হয়ে উঠলেন।



পুজোর দিনে অতি পরাক্রান্ত এই মিথের কথা ভাবতে ভাবতে ভাবছিলাম এই মিশ্র, স্ববিরোধী উপাদানের ইন্ডিক ঐতিহ্যের গর্বিত উত্তরাধিকারী আমি। সরলীকরণে কে আমায় মজায়! সম্বিত পেয়ে দেখি পাতের ডিম-পাঁউরুটি তেমনি  পড়ে আছে। থাক, আজ নিরামিষাশ

গ্রন্থসূত্র

1.   Sri Aurobindo, Secret of the Veda, Volume 15: The Complete Works of Sri Aurobindo (Pondicherry: Lotus Press, 2018), pp. 94-97.
2. George M. Williams, Handbook of Hindu Mythology (Oxford;  New York : Oxford University Press, 2008), p. 257;  সুধীরচন্দ্র সরকার, পৌরাণিক অভিধান (কলকাতা: এম. সি. সরকার, ১৩৯৬/১৯৮৯), পৃঃ ৫৩৬, ৫৪১-৪২।
3. Charles Russell Coulter, Patricia Turner (eds.) Encyclopedia of Ancient Deities (Oxon, New York: Routledge, 2012), pp. 413-14.
4. সরকার, পৌরাণিক অভিধান, পৃঃ ১৪৭-৪৮।
5. Williams, Handbook, p. 259; Coulter & Turner, Encyclopedia, 414.






শিবাংশু দে




হরীতকী ফলের মতন



(৫)

কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ পড়ে আছে-
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট 'রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি- সব; লম্বিত গভীর হয়ে গেলে
না দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ করে দিতে পারে; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায়; যেন
অমল আয়ত্বাধীন অবশেষে করে দিতে পারে
অধরা জ্যোৎস্নাকে; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে 'রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অনন্তের সার পেতে পারি।
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো।

অঘ্রাণ যাই যাই, পৌষের প্রথম শিরশির ভোর আমাদের শহরে। বেলা হলেই রোদ 
ভাসিয়ে দেয়। এখানে গ্রীষ্মঋতু যেন অনন্তভবানী, ভাঁড়ার ফুরোয়না তার সারা বছর। তবে একদেড় মাস যখন তার বিক্রমে ভাঁটা পড়ে তখন  সারা শহরের ফুর্তি আর বাঁধ মানেনা। ভোরের প্রথম আলো, তার ওম, ঘরে ঘরে উঁকি দিয়ে  বলে, তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রনে...

এমনই এক দশ সকালে অফিসে নানা জনতায় ঘেরায়িত হয়ে আছি, দশ দশে একশো রকম ফরমাইশ তাদের। তার মধ্যেই ম্যানেজার সাহেবের খাস আর্দালি এসে বলে, স্যার, বড়ো সাহেব ডাকছেন,
বলো একটু পরে যাচ্ছি,
আপনার ফোন এসেছে...
এই সময়...!!

তখন তো জনে জনে ফোন থাকতো না। সারা অফিসে এক আধটা ফোন। তাতেই  সবার কাজ চলে।

ম্যানেজার সাহেবের চেম্বারে ঢুকে বলি,
ফোন এসেছে?

তোর কাছে শুধু মেয়েদের ফোন কেন আসে বল তো?

স্বপনদা, মানে আমাদের ম্যানেজার সাহেব, লাহেরিয়াসরাইয়ের লোক। স্বভাবে পাক্কা মৈথিল। সুদর্শন, সাড়ে ছফুট দীর্ঘ ফ্রেম। বিহার রাজ্য ফুটবল টিমের স্টপার ছিলেন একদিন। সারা পৃথিবীটাই খেলার মাঠ তাঁর কাছে। সবার কাছেই ফেয়ার প্লে আশা করেন। কিন্তু আমাদের চাকরিতে এতো আঁকাবাঁকা, তাই মাঝে মাঝেই মন খারাপ। নিজের বাবা ছাড়া বোধ হয় পৃথিবীতে সবার সঙ্গেই তুইতোকারির সম্পর্ক। অবশ্য বৌদি খুব রাশভারি মহিলা, তাঁকে তুমি করেই কথা বলেন। আমরা আড়ালে বলতাম রামকেষ্ট ঠাকুরের অংশ আছে স্বপনদার মধ্যে। ভবতারিণীর সঙ্গেও 
তুইতোকারি।

কোনও জবাব না দিয়ে রিসিভারটা তুলে নিই,
এতো দেরি করো কেন...?
হুঁ...
হুঁ মানে?
হুঁ...
সামনে কেউ আছে নাকি?
হুঁ...
আজ বিকেলে একটু আসতে পারবে?
হুঁ...
কখন আসবে?
হুঁ...
ছটা, সাড়ে ছটা...?
হুঁ...
কোথায়?
হুঁ...
ওফ, নিকুচি করেছে...
হুঁ...
আমি মোদি পার্কের গেটে থাকবো...
হুঁ...

ফোনটা রাখতেই স্বপনদার প্রশ্ন,
কে রে? বৌমা নাকি?
কার বৌ?
তোরই হবে...
জানিনা, যাই অনেক কাজ পড়ে আছে
শোন শোন, এখনই হুঁ হুঁ' স্টক শেষ করে দিসনা, সারা জীবন রয়েছে তার জন্য। আর কোনও কথা তো বাঁচবে না শেষ পর্যন্ত...



সোয়া ছটা নাগাদ কীনান স্টেডিয়ামের দেওয়াল পেরিয়ে মোদি পার্কের দিকে। সন্ধের ঝুঁঝকো আঁধার নেমে গেছে এর মধ্যেই। ফুচকাওয়ালা, ক্যান্ডিফ্লস, বেলুনওয়ালা সবাই খুব ব্যস্ত সমস্ত। ঘরফেরত কারখানার খাটিয়ে লোকেরা বৌ বাচ্চার হাত ধরে বিশাল ফোয়ারাগুলিকে ঘিরে বসে চনাচটপটি খাচ্ছে।

বাইকটা সাইড করে লাগাতেই ছায়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো পর্ণা।

প্রথম বোধ হয় সময়ে এলে...
বোলো ভাই, কুছ খাস ইত্তিলা হ্যাঁয় ক্যা?
না... হ্যাঁ... মানে  বইটা
কোন বইটা?
ফিরে এসো...
আরে বাপরে... কবিতা শোনাতে তুমি এভাবে ডাকলে আমায়। ভাবলাম না জানি কী হলো শেষে...
না, সত্যি, আমি বোধ হয় একটু ওভার রিয়্যাক্ট করছি...
না, না, বলো বলো, কো  হসিনা জব শয়ের পড়তি হ্যাঁয় তো, অউর ভি হসিন হো জাতি হ্যাঁয়...
কী চাষাড়ে রিয়্যাক্শন...
সে যাই বলো, ধন্য আমি ধন্য হে, চাষি তোমার জন্য যে ...
চলো বসি...

বলো ...
ইয়ে , মানে এই 'কবিতা বুঝিনি আমি' কবিতাটা নিয়ে তোমার থেকে কিছু শুনবো 
ভাবলাম...
দ্যাখো, তোমাকে তো বলেছি আগেই, কবিতা ঠিক বোঝার জিনিস নয়। কবিতার 
শব্দগুলোর একটা স্কিম থাকে। আমাদের দৈনন্দিন যে  বোঝাবুঝির জগৎ, তা পেরিয়ে যাবার পর যে নিজের সঙ্গে বেঁচে থাকা, তার ঠিক কোনও ব্যাকরণ হয়না।  দাদু বলেছেন না নিজের অন্তরালের মানুষটিই সব চেয়ে দুর্বোধ্য। যেমন পাথরের আড়ালে জল, মানুষটিও জলের মতন। আমরা নিজের চারধারে নানা দরকারি  অদরকারি পাথরের বোঝা জমিয়ে তুলি। রক্তমাংসের  অসহায়তা,ভুলভাল বোধকেঘিরে নিরাপত্তার এই পাথুরে ছলনা, এই নিয়েই ভাবি ভালো আছি, সুখে আছি। 
অধিকাংশ মানুষই তো স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজে, আনন্দ খোঁজেনা। আনন্দ খোঁজার বড়ো বালাই। সংবেদনশীলতা অর্জন করতে হয়, অনেক ছোটো ছোট স্বাচ্ছন্দ্যকে জীবন থেকে বাদ দিতে হয়। এই যে দুর্গম অর্জনের পথ, সেখানকার পাথরের বাধাগুলো আমরা কবিতার কাছে গিয়ে সুগম করতে পারি। কবিতা যেন সেই সব জিলেটিন  স্টিক, যাকে ক্রমশ বিস্ফোরিত করে জীবনের অনন্ত পাথর পর্বতের ভিতর আমরা সুড়ঙ্গ কেটে এগিয়ে যাই।  পাথরের ওপারে কী আছে? কী পাবো সেখানে?

'...এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ পড়ে আছে-
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট 'রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি- সব;'

আমাকে যে আলো দেয় সে মহাজাগতিক অন্তহীন নক্ষত্রমালা হতে পারে বা হতে 
পারে ক্ষণস্থায়ী ফুরিয়ে যাওয়া জোনাকি। কিন্তু উভয়েরই যৎসামান্য কোমলআলোক আমার কাছে কবিতার মতো শূশ্রূষা বয়ে আনে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের,  অনন্তের স্বাদ, মৃদু লবণের মতো জীবনের প্রশান্তিকে আমার কাছে ফিরিয়েদেয়।  দ্যাখো, একটা কথা সব সময় মনে রাখবে, কবিতা মানে আদালতের কাগজ বা  সংবিধানের পাতা নয়। ডোন্ট বী টু সিরিয়াস... টেক ইট ইজি...




জীবন মানে তো একটা পথ চলা। যেকোন পথে যেতে প্রথমদিন শুধু পথটাকেই
 দেখি, তাকে মাপি। পরের দিন চোখ তুলে দেখি আশপাশ, কতো গাছ, কতো হাট, কতো খালবিল। তার পরের দিন গাছের পাতা কেমন সবুজ, কী রঙের ফুল, কোন 
পাখির বাসা, বিলে পদ্ম ফুটেছে না শালুক, মানুষগুলি বাইরে থেকে কেমন? তারপরকোনোদিন পেরিয়ে যাই  মানুষগুলির অন্দরমহল, হেঁসেলঘর। প্রথমদিন পথের  দুপাশে যেমন সব কিছু অচেনা, অজানা, অবুঝ লেগেছিলো, সেই অস্বস্তিটা যে কোথায় চলে যায়, কে জানে। কবিতাও তো জীবনের সঙ্গে সমান্তরাল চলে, তার  প্রথম অবুঝপনা কখন যে অতীত হয়ে যায়, তার কোনও হিসেব থাকেনা। তখন নিশ্চিন্তে বলে উঠি, 'কবিতা বুঝিনি আমি', যেহেতু তখন আমি জেনে গেছি, বুঝি নাই বুঝি, কবিতাকে তো আমি পেয়ে গেছি। ঠিক তোমার মতন...

যাহ...

নাহে, সকল ছন্দের মধ্যে তুমিই গায়ত্রী.....

এইরে, মনে পড়ে গেলো। তুমি বলেছিলে গায়ত্রীকে নিয়ে আমায় কিছু বলবে...

দ্যাখো, আমিও যে খুব কিছু জানি তা নয়, তবে যা জানি একদিন বলবো নিশ্চয়...

আজই বলো...

নাহ... আজ তোমাকে দেখতে এতো সুন্দর লাগছে না, এক্ষুনি তোমায় হারাতে চাই না...

আমায় হারাবে? কেন? কী হয়েছে?

কী আর হবে? গায়ত্রীরা হারিয়ে যেতেই আসে, হারিয়ে দিয়েই যায়...

শুধু আজেবাজে কথা। আমি তোমাকে হারাতে দেবই না...

বেঁধে রেখো পর্ণা, দুহাত দিয়ে বেঁধে রেখো...

'তুমি যেন ফিরে এসে পুনরায় কুণ্ঠিত শিশুকে
করাঘাত করে করে ঘুম পাড়াবার সাধ করে
আড়ালে যেও না; আমি এতদিনে চিনেছি কেবল
অপার ক্ষমতাময়ী হাত দুটি, ক্ষিপ্র  হাত দুটি-
ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা একা ব্যর্থ বারিপাত।
কবিতা সমাপ্ত হতে দেবে নাকি? সার্থক চক্রের
আশায় পংক্তি ভেবে ভেবে নিদ্রা চলে গেছে।
কেবলি কবোষ্ণ চিন্তা, রস এসে চাপ দিতে থাকে;
তারা যেন কুসুমের অভ্যন্তরে মধু- ঈর্ষিত
স্থান চায়, মালিকায় গাঁথা হতে ঘ্রাণ দিতে চায়।
কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারি, ক্রমে-ক্রমাগত
ছন্দিত ঘর্ষণে, দ্যাখ,উত্তেজনা শীর্ষলাভ করে,
আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে শান্তি নামে।
আড়ালে যেও না যেন, ঘুম পাড়াবার সাধ করে।'

(ক্রমশঃ)