কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৯

জয়া জাদবানী




প্রতিবেশী সাহিত্য


জয়া জাদবানী’র গল্প     

(অনুবাদ : মিতা দাশ)   


                   

লেখক পরিচিতি :

জয়া জাদবানীর  জন্ম ১লা মে ১৯৫৯জন্মস্থান কোতমা, জেলা শাহডোল, মধ্যপ্রদেশতিনি হিন্দী ভাষা সাহিত্য ও মনোবিজ্ঞানে স্নাতকত্তোর। হিন্দী ও সিন্ধি ভাষায় সমান সাবলীল জয়া জাদবানী একইসঙ্গে দুটি ভাষায় সৃজন করেছেন কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, ভ্রমণসাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্য। সাহিত্যচর্চার জন্য তিনি অর্জন করেছেন কথাক্রম সম্মান, কুসুমাঞ্জলি সম্মান এবং মুক্তিবোধ সম্মান।


আমিই হব বারবার  


আমি, সেই সমুদ্রে প্রথমবার ডুব  দিলাম, সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গগুলি আমায়  হাত তুলে তুলে বারবার নিজের কাছে ডাক ছিল ওদের সম্মোহন, ভয়ংকর! আমি চারিদিক চোখ তুলে তাকালাম, কোথাও এমন কিছুই ছিলো না, যারা আমার পা দুটি শিকলে জড়িয়ে আমায় আটকে রাখে... দূর বহুদূর দু’চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম শুধু রোদেপোড়া পাষাণ যার ফাঁক-ফোঁকরের নিচু জায়গাগুলিতে জল জমে জমে শাওলা হয়ে গেছেমাটিতে যতদূর চোখ যায় শুধু মেঠো রঙ, এর পাথরগুলিতে জলের স্রোতের বেগে কোথাও কোথাও গর্ত তৈরী হয়ে গেছে,  আর সেই গর্তে এখনো ঘোলাটে জল জমে রয়েছে। আমি রোমাঞ্চ খোঁজার লোভেই চারিদিক তাকিয়ে দেখলনভাবলাম এই ধুসর পাথরগুলি যদি একসঙ্গে ফেটে যায়? গোটা সমুদ্রের জল যদি এই পাথরগুলি শুষে নেয়? আমরা কোনও দিন পাথরের তৃষ্ণার কথা ভাবিনি... আমরা কোনও দিন বালিদের পিপাসার কথাও ভাবিনি... কখনো জলের পিপাসারও চিন্তা করিনি... আর আমরা সমুদ্রের তৃষ্ণার কথাও ভাবিনি, সমুদ্র হাতদুটো ছড়িয়ে নদীদের নিজের কাছে ডাকেআমাদের সীমারেখা দেখিয়ে বলে দেয়া হয় এটা ভারতের সীমারেখা, অন্য জায়গায় যে সব দাগ দেয়া ওটা ভারতের নয়, অন্য কোন দেশের সীমারেখা। এটা এই দেশের, ওটা ওই দেশের মানচিত্র, ওটা ওই দেশের সীমারেখা। সীমারেখার কাছে কিন্তু ভয় আছে, কিন্তু আমি কি করে বলি যে আমার মনটা সীমারেখাকে ছুঁয়ে দেখতে চায়! আমি কিন্তু মানা বা বাঁধন, নিয়ম ভাঙতে বিশ্বাসী। তাই আমি পণ করেছি যে, সীমারেখাকে ছোঁবোই। সীমারেখার কাছে যদি নাই বা যেতে পারি তাহলে এই সীমারেখা কেন? জানি না কেন, যে বস্তুটিকে ধরা ছোঁওয়া বারণ, আমার কিন্তু ওই বস্তুটিকে আরও বেশি করে ছুঁতে ইচ্ছে করে। মানুষের লালসার দরজা কোথায় গিয়ে খোলে আর কোথায় গিয়ে বন্ধ হয়, আমি আজও সঠিক বুঝে উঠতে পারিনি

তাই আমি সেই সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে নিজের দেহকে হাল্কা করে ভাসিয়ে দিলাম, তরঙ্গগুলি নিজের আক্রমক রূপেই ছিলওরা আমায় চারিদিক থেকে জাপটে ধরল, আর নিজেদের সঙ্গে আমায় নিয়ে চলল, অতল গভীরে, যেখানে সমুদ্রের সব জীবজন্তুগুলি আমার দেহে নিজেদের নাম, গন্ধ ও আঁচড়ের দাগ ফেলার জন্য ভয়াভহ রূপ নিয়ে এগিয়ে আসছে। বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব অরুচি, যার কাঁটাতারগুলি দিয়ে নিজেকে নিজে ক্ষত বিক্ষত করে নিয়ে ছিলাম আর তারপর এখন আমি নিজের রক্ত নিজের জীভ দিয়ে নিজেই লেহন করতে করতে আগামী আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। আমিও কিন্তু সেই জন্তুগুলিকে রেহাই দিলাম না, নিজের শরীরের সম্পূর্ণ জোর দিয়ে ওদের দেয়া আঁচড় হতে রক্ত ঝরাতে লাগলাম আমি আমার শরীরের সব অঙ্গই কাজে লাগাতে শুরু  করলাম, যে অঙ্গগুলি জানি না কত বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়েছিলআমি লামার্ক এবং ডারর্ভিন-এর বিকাশের কথাও ভাবিনি, আমি কিন্তু এক্কেবারেই ওই রকম কিছুই হতে দেব না । আমার শরীরের লোমগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল এই সীমানা থেকে ওই সীমানা অব্দি

সমুদ্রের সমস্ত জল এখন লাল। আমার ভাবনা চিন্তার কণাগুলি গভীর জলে মিলেমিশে যেতে লাগলোনিঃশব্দে আমি নিজের বুকে একটি গান লিখলাম, তারপর সবাইকে আহ্বান জানালাম। ওরা যারা আমায় ক্ষত বিক্ষত করেছিল, আর সেই ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাওয়ার চরম আনন্দকে উপভোগ করেছিলাম অতি আনন্দেই

এখন এসো, আমার সঙ্গে গাও সেই হিংসক গান, যে গানটি গাওয়ার পর যেকোন মানুষ কিছু করতে প্রস্তুত। দেখ আমার  ভেতরের হিংস্র জন্তুটা চীৎকার করে কাঁদছে ওকে সান্তনা দিও না, ও এই ধরনের ভাষা বোঝে নাওকে চাবুক দিয়ে  কষে মারো, ওকে আরও হিংস্র করে দাও। যতক্ষণ ওর ভেতর একটুও রক্তের কণা বাকি থাকবে, ওরা চুপ করে থাকবে না। কিন্তু ওকে মরতেও দিয়ো নাওরই জখমে পা রেখে মানুষ আজ সোজা দাঁড়িয়ে আছে।

এইসব ছাড়া তো কোন মানুষের কল্পনাও করা যায় না। আমি ওটাকে সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে লালন করেছি। সারাক্ষণ ওকে আশ্রয় দিয়েছি এবং ওর কাছে আশ্রয়ও চেয়েছিআজ আমি ওকে বেশ ভালো করে দেখতে চাই। ওর ধারালো নখে রক্ত লেগে আছে  আর ঠোঁটে আটকে আছে মাংসের কণাও নিজের লম্বা জিভ দিয়ে নিজের গায়ে মাখানো রক্ত চাটছে রক্তের গন্ধটা ওর বেশ ভাল লাগে কখনো কখনো  কোনো এক  বিশেষ গন্ধের খোঁজ ওকে বহুকাল ধরে তাড়া করে বেড়ায়। যদি ওর খোঁজ কখনো পূর্ণ হয়, তবে  ওকে ফুসলে-ফাসলে আদিম যুগের রীতিতে কাটাছেঁড়া করে যে, নিজের গন্ধ বাতাসে ছড়ানোর জন্য ওর ভেতর কিছুই থাকে নানিঃশেষ হয়ে যায় পুরোপুরিআমি ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। যদি চোখ না ফেরাই তাহলে সে জোর করে বেশ ভয়ংকর ভাবে নিজের কাছে টানবেওর চোখদুটো যেন যাদুকরের চোখ। সমানেই জ্বলজ্বল করছেযদি এক বার ওর ফাঁদে পড়েছ, তাহলে আর রেহাই নেইতার মোহজাল আমাদের ঘিরে ধরবে। আমি তা দেখেছি। কিছুদিনের ক্লান্তির সুখ আর সন্তুষ্টি। আবার কোনো নতুন গন্ধের খোঁজ...

আমার গান এখন শেষের পর্যায়আমি এখন সমুদ্রের অতল গভীরে, ওরা আমায় ঠেলে ফেলে দিয়েছে, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা, আমায় নিঃশ্বাস নয় আস্ফালন চাই। আমায় আমার জখমগুলি নিজের দেহ থেকে আলাদা মনে হয়েছেসমুদ্রের তীব্র তরঙ্গে ওরা এদিক-ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমি ওদের ধরার চেষ্টাতে মত্ত, কিন্তু ওরা আমার হাত থেকে ফসকে ছিটকে দূরে ছড়িয়ে পড়ছিলআমি দেখলাম ওরা সাগরের তটের বালিতে ছড়িয়ে রইলো। ছোট-বড় জখমগুলি পুরনো শামুখ ও শঙ্খের মতো সাগরের কিনারার বালিতে বয়সের তীব্র রোদে ঝলসাচ্ছেসন্ধ্যে নেমে এলে রোদ পড়ে যাবে আর এরাও কালো হয়ে যাবেহঠাত আবার কোনো বিকেলে আমি সাগরের কিনারায় একলা বসে ওদের ছাল ছাড়াব নিজের নখের আঁচড়ে, আর ওদের উপর জমা দুঃখগুলোকে পরিষ্কার করব।

জলের স্রোতগুলি আমায় রীতিমতো বেশ জোরে জোরে পাথরে আছাড়  মারছিল। আমার হাতে যখনই কোনো শামুক আসতো, আমি জোর করে ওর মুখ খুলে দিতাম আমি সেই একাকী শামুকের খোঁজে ছিলাম যার ভেতর সত্যিকারের মুক্ত রয়েছেআমার শরীর কেন জানিনা কত রকমের সমুদ্রের জীবেরা ঠোক্কর দিচ্ছিল ও আমায় চেটেও দিচ্ছিল। ‘আমি কিন্তু তোমাদেরই মত একজন...  আমি ওদের বললাম’.... ওরা ভ্রুক্ষেপও করল না। পাথরগুলো আহত হয়ে ক্ষত বিক্ষত হতে লাগলোপাথরের বালি আমার ধাক্কায় ছড়িয়ে যাচ্ছিলগুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছিলবহু বছর ধরে নিজেকে ওরা সংযত করে রেখেছিল, আজ সংযমের বাঁধ ভেঙে চূরমার করে একটি আকৃতি তৈরী হয়েছে সেই পাথরের বালি চালনি দিয়ে চেলে চেলে, আমার দেহের আঘাত খেয়ে খেয়েগআর এখন আমার দেহ বলতে আর কিছুই নেই, না রূপ  না রং না স্বাদ না গন্ধ, শুধু ইচ্ছার ও লালসার একটি মাত্র শুকনো কাঠি

জল আমার দেহের সঙ্গে খেলা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো, তরঙ্গরা আমায় ছেড়ে দিল। বলল... ‘তুমি একা নও’, তারপর ওরা অন্য কারো তল্লাসে এগিয়ে গেলকোনো ব্যাপারই না, শুধু আমিই তোমাকে খুঁজছিলাম তাই নয় তুমিও আমায় খুঁজছিলে তাই না? এখন আমাদের দুজনারই অন্য আর একজনের জন্য খোঁজএখন আমরা বুঝতে পারছি যে, নিজের নিজের জখম যদি নিজেরই জিভ দিয়ে চাটা হয়, এর ভেতর মারাত্মক ব্যাপারটা কী! মজা তো তখন, যখন অন্য কেউ আমাদের জখমগুলোকে চেটে দেয় এবং আমরা পা দুটি আরামে ছড়িয়ে  সারাটা দুপুর রোদের আলতো তাপে রোদ পোহাই, আর শুয়ে শুয়ে দেখি নিজের  নিজের বিষের প্রভাব কতটা!

আমি জল থেকে নিজের মাথা তুললাম আর চাঁদের কিরণগুলোকে গিলতে লাগলাম এবং ডাকলাম, এসো এসো, আমার ভেতর একাকার হয়ে যাও। আমি  সৃষ্টির একরূপ রহস্যের সন্ধান পেয়ে গেছি, বুঝে নিয়েছি। আমি য, তুমিও তাই যা তুমি, আমিও তাই হতে পারিআমায় রূপ দাও, রহস্য দাও, গন্ধ দাও। আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে নামো... আমি দেখলাম, আমার ভেতর শুধু চাঁদের কিরণই নয়, তারারাও ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে টুকরো টুকরো হয়ে... তারপর দেখলাম আমার গোটা দেহটা তারায় তারায় খচিত হয়ে উঠলোএকটা সুন্দর ঝলমল করা দেহ আমি আহ্লাদে ভরে উঠলাম...

‘দেখো আমায় দেখো...’ আমি দশদিককে ইঙ্গিত করে বললাম... আছে কেউ আমার মতো? শুধু আমিই হতে পেরেছি, শুধু আমাকেই হতে হবে। আমাকেই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে হবে, আবার আমাকেই সৃষ্ট হতে হবেসৃষ্টির শেষেও সৃষ্টির অভ্যুদ্বয় আমিই হব... বারবার...

আমি আমার মানচিত্রের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমি আমার সীমারেখাকে দূর থেকেই দেখলাম দেখলাম, কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা ও চারিদিক অন্ধকার কিছু তারা মিটমিট করে জলছে। যার টুকরোগুলি ওর উপর ঝরে পড়ছে আর নিঃসীম অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছেএমন আলোর জন্য আমরা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অপেক্ষা করে বসে রয়েছিআর যখন ওই টুকরোগুলি ঝরে পড়ছে, আমরা সবাই ক্ষুধার্ত শিয়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছি আর খামচে খামচে মাংসের কণাগুলি বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছি 

আমি বেরিয়ে এসে সেই পাথরটাকে দেখলাম, যাকে আমার দেহ তৈরী করেছিল তারপর আমি নিজের দেহকে দেখলাম, সেটা তারা দিয়ে খচিত, ঝলমল করছেআমি একটা তারা তুললাম আর সেই আকৃতির মাথায় সেঁটে দিলাম...‘এখন তুমি খুবই সুন্দর, আমারই প্রতিরূপ’আমি ওকে একটা চুমু খেলাম


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন