কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৯

শিবাংশু দে




হরীতকী ফলের মতন



(৫)

কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ পড়ে আছে-
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট 'রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি- সব; লম্বিত গভীর হয়ে গেলে
না দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ করে দিতে পারে; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায়; যেন
অমল আয়ত্বাধীন অবশেষে করে দিতে পারে
অধরা জ্যোৎস্নাকে; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে 'রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অনন্তের সার পেতে পারি।
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো।

অঘ্রাণ যাই যাই, পৌষের প্রথম শিরশির ভোর আমাদের শহরে। বেলা হলেই রোদ 
ভাসিয়ে দেয়। এখানে গ্রীষ্মঋতু যেন অনন্তভবানী, ভাঁড়ার ফুরোয়না তার সারা বছর। তবে একদেড় মাস যখন তার বিক্রমে ভাঁটা পড়ে তখন  সারা শহরের ফুর্তি আর বাঁধ মানেনা। ভোরের প্রথম আলো, তার ওম, ঘরে ঘরে উঁকি দিয়ে  বলে, তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রনে...

এমনই এক দশ সকালে অফিসে নানা জনতায় ঘেরায়িত হয়ে আছি, দশ দশে একশো রকম ফরমাইশ তাদের। তার মধ্যেই ম্যানেজার সাহেবের খাস আর্দালি এসে বলে, স্যার, বড়ো সাহেব ডাকছেন,
বলো একটু পরে যাচ্ছি,
আপনার ফোন এসেছে...
এই সময়...!!

তখন তো জনে জনে ফোন থাকতো না। সারা অফিসে এক আধটা ফোন। তাতেই  সবার কাজ চলে।

ম্যানেজার সাহেবের চেম্বারে ঢুকে বলি,
ফোন এসেছে?

তোর কাছে শুধু মেয়েদের ফোন কেন আসে বল তো?

স্বপনদা, মানে আমাদের ম্যানেজার সাহেব, লাহেরিয়াসরাইয়ের লোক। স্বভাবে পাক্কা মৈথিল। সুদর্শন, সাড়ে ছফুট দীর্ঘ ফ্রেম। বিহার রাজ্য ফুটবল টিমের স্টপার ছিলেন একদিন। সারা পৃথিবীটাই খেলার মাঠ তাঁর কাছে। সবার কাছেই ফেয়ার প্লে আশা করেন। কিন্তু আমাদের চাকরিতে এতো আঁকাবাঁকা, তাই মাঝে মাঝেই মন খারাপ। নিজের বাবা ছাড়া বোধ হয় পৃথিবীতে সবার সঙ্গেই তুইতোকারির সম্পর্ক। অবশ্য বৌদি খুব রাশভারি মহিলা, তাঁকে তুমি করেই কথা বলেন। আমরা আড়ালে বলতাম রামকেষ্ট ঠাকুরের অংশ আছে স্বপনদার মধ্যে। ভবতারিণীর সঙ্গেও 
তুইতোকারি।

কোনও জবাব না দিয়ে রিসিভারটা তুলে নিই,
এতো দেরি করো কেন...?
হুঁ...
হুঁ মানে?
হুঁ...
সামনে কেউ আছে নাকি?
হুঁ...
আজ বিকেলে একটু আসতে পারবে?
হুঁ...
কখন আসবে?
হুঁ...
ছটা, সাড়ে ছটা...?
হুঁ...
কোথায়?
হুঁ...
ওফ, নিকুচি করেছে...
হুঁ...
আমি মোদি পার্কের গেটে থাকবো...
হুঁ...

ফোনটা রাখতেই স্বপনদার প্রশ্ন,
কে রে? বৌমা নাকি?
কার বৌ?
তোরই হবে...
জানিনা, যাই অনেক কাজ পড়ে আছে
শোন শোন, এখনই হুঁ হুঁ' স্টক শেষ করে দিসনা, সারা জীবন রয়েছে তার জন্য। আর কোনও কথা তো বাঁচবে না শেষ পর্যন্ত...



সোয়া ছটা নাগাদ কীনান স্টেডিয়ামের দেওয়াল পেরিয়ে মোদি পার্কের দিকে। সন্ধের ঝুঁঝকো আঁধার নেমে গেছে এর মধ্যেই। ফুচকাওয়ালা, ক্যান্ডিফ্লস, বেলুনওয়ালা সবাই খুব ব্যস্ত সমস্ত। ঘরফেরত কারখানার খাটিয়ে লোকেরা বৌ বাচ্চার হাত ধরে বিশাল ফোয়ারাগুলিকে ঘিরে বসে চনাচটপটি খাচ্ছে।

বাইকটা সাইড করে লাগাতেই ছায়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো পর্ণা।

প্রথম বোধ হয় সময়ে এলে...
বোলো ভাই, কুছ খাস ইত্তিলা হ্যাঁয় ক্যা?
না... হ্যাঁ... মানে  বইটা
কোন বইটা?
ফিরে এসো...
আরে বাপরে... কবিতা শোনাতে তুমি এভাবে ডাকলে আমায়। ভাবলাম না জানি কী হলো শেষে...
না, সত্যি, আমি বোধ হয় একটু ওভার রিয়্যাক্ট করছি...
না, না, বলো বলো, কো  হসিনা জব শয়ের পড়তি হ্যাঁয় তো, অউর ভি হসিন হো জাতি হ্যাঁয়...
কী চাষাড়ে রিয়্যাক্শন...
সে যাই বলো, ধন্য আমি ধন্য হে, চাষি তোমার জন্য যে ...
চলো বসি...

বলো ...
ইয়ে , মানে এই 'কবিতা বুঝিনি আমি' কবিতাটা নিয়ে তোমার থেকে কিছু শুনবো 
ভাবলাম...
দ্যাখো, তোমাকে তো বলেছি আগেই, কবিতা ঠিক বোঝার জিনিস নয়। কবিতার 
শব্দগুলোর একটা স্কিম থাকে। আমাদের দৈনন্দিন যে  বোঝাবুঝির জগৎ, তা পেরিয়ে যাবার পর যে নিজের সঙ্গে বেঁচে থাকা, তার ঠিক কোনও ব্যাকরণ হয়না।  দাদু বলেছেন না নিজের অন্তরালের মানুষটিই সব চেয়ে দুর্বোধ্য। যেমন পাথরের আড়ালে জল, মানুষটিও জলের মতন। আমরা নিজের চারধারে নানা দরকারি  অদরকারি পাথরের বোঝা জমিয়ে তুলি। রক্তমাংসের  অসহায়তা,ভুলভাল বোধকেঘিরে নিরাপত্তার এই পাথুরে ছলনা, এই নিয়েই ভাবি ভালো আছি, সুখে আছি। 
অধিকাংশ মানুষই তো স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজে, আনন্দ খোঁজেনা। আনন্দ খোঁজার বড়ো বালাই। সংবেদনশীলতা অর্জন করতে হয়, অনেক ছোটো ছোট স্বাচ্ছন্দ্যকে জীবন থেকে বাদ দিতে হয়। এই যে দুর্গম অর্জনের পথ, সেখানকার পাথরের বাধাগুলো আমরা কবিতার কাছে গিয়ে সুগম করতে পারি। কবিতা যেন সেই সব জিলেটিন  স্টিক, যাকে ক্রমশ বিস্ফোরিত করে জীবনের অনন্ত পাথর পর্বতের ভিতর আমরা সুড়ঙ্গ কেটে এগিয়ে যাই।  পাথরের ওপারে কী আছে? কী পাবো সেখানে?

'...এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ পড়ে আছে-
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট 'রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি- সব;'

আমাকে যে আলো দেয় সে মহাজাগতিক অন্তহীন নক্ষত্রমালা হতে পারে বা হতে 
পারে ক্ষণস্থায়ী ফুরিয়ে যাওয়া জোনাকি। কিন্তু উভয়েরই যৎসামান্য কোমলআলোক আমার কাছে কবিতার মতো শূশ্রূষা বয়ে আনে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের,  অনন্তের স্বাদ, মৃদু লবণের মতো জীবনের প্রশান্তিকে আমার কাছে ফিরিয়েদেয়।  দ্যাখো, একটা কথা সব সময় মনে রাখবে, কবিতা মানে আদালতের কাগজ বা  সংবিধানের পাতা নয়। ডোন্ট বী টু সিরিয়াস... টেক ইট ইজি...




জীবন মানে তো একটা পথ চলা। যেকোন পথে যেতে প্রথমদিন শুধু পথটাকেই
 দেখি, তাকে মাপি। পরের দিন চোখ তুলে দেখি আশপাশ, কতো গাছ, কতো হাট, কতো খালবিল। তার পরের দিন গাছের পাতা কেমন সবুজ, কী রঙের ফুল, কোন 
পাখির বাসা, বিলে পদ্ম ফুটেছে না শালুক, মানুষগুলি বাইরে থেকে কেমন? তারপরকোনোদিন পেরিয়ে যাই  মানুষগুলির অন্দরমহল, হেঁসেলঘর। প্রথমদিন পথের  দুপাশে যেমন সব কিছু অচেনা, অজানা, অবুঝ লেগেছিলো, সেই অস্বস্তিটা যে কোথায় চলে যায়, কে জানে। কবিতাও তো জীবনের সঙ্গে সমান্তরাল চলে, তার  প্রথম অবুঝপনা কখন যে অতীত হয়ে যায়, তার কোনও হিসেব থাকেনা। তখন নিশ্চিন্তে বলে উঠি, 'কবিতা বুঝিনি আমি', যেহেতু তখন আমি জেনে গেছি, বুঝি নাই বুঝি, কবিতাকে তো আমি পেয়ে গেছি। ঠিক তোমার মতন...

যাহ...

নাহে, সকল ছন্দের মধ্যে তুমিই গায়ত্রী.....

এইরে, মনে পড়ে গেলো। তুমি বলেছিলে গায়ত্রীকে নিয়ে আমায় কিছু বলবে...

দ্যাখো, আমিও যে খুব কিছু জানি তা নয়, তবে যা জানি একদিন বলবো নিশ্চয়...

আজই বলো...

নাহ... আজ তোমাকে দেখতে এতো সুন্দর লাগছে না, এক্ষুনি তোমায় হারাতে চাই না...

আমায় হারাবে? কেন? কী হয়েছে?

কী আর হবে? গায়ত্রীরা হারিয়ে যেতেই আসে, হারিয়ে দিয়েই যায়...

শুধু আজেবাজে কথা। আমি তোমাকে হারাতে দেবই না...

বেঁধে রেখো পর্ণা, দুহাত দিয়ে বেঁধে রেখো...

'তুমি যেন ফিরে এসে পুনরায় কুণ্ঠিত শিশুকে
করাঘাত করে করে ঘুম পাড়াবার সাধ করে
আড়ালে যেও না; আমি এতদিনে চিনেছি কেবল
অপার ক্ষমতাময়ী হাত দুটি, ক্ষিপ্র  হাত দুটি-
ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা একা ব্যর্থ বারিপাত।
কবিতা সমাপ্ত হতে দেবে নাকি? সার্থক চক্রের
আশায় পংক্তি ভেবে ভেবে নিদ্রা চলে গেছে।
কেবলি কবোষ্ণ চিন্তা, রস এসে চাপ দিতে থাকে;
তারা যেন কুসুমের অভ্যন্তরে মধু- ঈর্ষিত
স্থান চায়, মালিকায় গাঁথা হতে ঘ্রাণ দিতে চায়।
কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারি, ক্রমে-ক্রমাগত
ছন্দিত ঘর্ষণে, দ্যাখ,উত্তেজনা শীর্ষলাভ করে,
আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে শান্তি নামে।
আড়ালে যেও না যেন, ঘুম পাড়াবার সাধ করে।'

(ক্রমশঃ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন