কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১৮

দেবযানী বসু




মধুশীলা


ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছেন মণিকান্ত রায়চৌধুরী। পা হাঁটুর নিচে থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিল সেই কুড়ি বছরের যৌবনে। ওভারহেড ব্রিজ ব‍্যবহার না করার ফল। এবং বংশগত জিনের প্রভাবে সামান্য টিউবলাইটও ছিলেন। তার মামাতো ভাই বোনেরাও এরকম। পূর্ণিমার আলোর একটু এধার ওধার। নানা শারীরিক  অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও বিশেষ কোটায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। হাতদুটো সক্ষম থাকায় তবলা শিখেছেন। গান করতে পারেন। বেশ সংস্কৃতিমনস্ক। পাত্র হিসেবে একেবারেই ফ‍্যালনা ছিলেন না। বাড়ি গাড়ি আত্মীয়স্বজনে গমগম করছে জীবন। বিয়ে হল খুঁতযুক্ত মহিলার সঙ্গে। তারও এক পা ছোট। হাত পা একটু বাঁকা। কিন্তু ফর্সা স্বাস্থ্যবতী শিক্ষিতা। প্রাইভেটে স্নাতক। বনেদী ঘর। চকমেলানো বাড়ি। মনের মিল একেবারে রাজজোটক হল তাদের। সম্প্রতি আলিপুরে ফ্ল‍্যাট কিনে উঠে এসেছেন। মেয়ের আমেরিকায় বিয়ে দিয়েছেন। 

সারাদিন টিভির সামনে সময় কাটে। হাঁপানির টান। মাথা বেশ বিগড়েছে। পাশের ফ্ল্যাটের মধুশীলা সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তার স্ত্রীর। মনিকার। মধুশীলা রেডিওতে অনিয়মিত গাইতেন। এখন বহুদিন চর্চা নেই। তবু মনিকা আর মণিকান্ত তাকে গান করতে বলেন। মধুশীলা পান খেয়ে দাঁতের বারোটা বাজিয়েছেন। বিজনেস ম‍্যাগনেট স্বামী পুত্র সামলাতে দিন যায়। আর বাড়িতে সৌন্দর্যবর্ধনকারিনীদের ডেকে রূপচর্চা করেন। এটা মনিকার ঘরে বসে হয়। 
সময়ে অসময়ে মধুশীলা দেখেছে অসুস্থ মণিকান্ত বিছানায় শুয়ে ঘ‍্যা ঘ‍্যা করে গলা দিয়ে একটা আওয়াজ করছেন আর লুঙ্গির উপর দিয়ে জোরে জোরে হাত নাড়াচ্ছেন। বাড়ির ঝি চাকর ও মনিকা এ ব‍্যাপারে উদাসীন। মধুশীলা বিব্রত বোধ করে।

মধুশীলা মনিকার উৎসাহে আবার হারমোনিয়াম খুলে বসে আজকাল। প্রধানত পুরনো বাংলা গান করতে ভালো লাগে তার। কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে জাতীয় গান। একদিন সুযোগ আসে বিকেলে মনিকার ঘরে গান করার। মধুশীলার  কিশোর নাতি হারমোনিয়াম বয়ে দেয়। টিভির সামনে চেয়ারে মণিকান্ত বসেছেন। সোফায় অন্যান্য সবাই। কার্পেটের উপর কেউ কেউ। মাথা দোলানো দক্ষিণী পুতুলটিও মজা নিচ্ছে। একটু ভাঙা  আর কাঁপা কণ্ঠস্বর মধুশীলার। তবে সুরজ্ঞান ভালো। তবলা দুটো ঢাকা পড়ে আছে মণিকান্তর ব‍্যবহৃত পুরনো অয়েলক্লথ দিয়ে। তৃতীয় নং গান চলছে। গোঠে রাখাল বলে দে রে কোথায় বৃন্দাবন। গান শুনতে শুনতে মণিকান্ত হাত দোলাচ্ছেন। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। মুখ দিয়ে লালা। মধুশীলা মাঝে মাঝে চোখ বুঁজে গাইছেন। আচমকা চেয়ার ছেড়ে মণিকান্ত ধেয়ে এলেন মধুশীলার দিকে। তাকে জড়িয়ে ধরে আধো জড়ানো গলায় বলতে লাগলেন, তোমার মতো বৌ চেয়েছিলাম! তোমার মতো রাজরানী! আরো কত কি... সবার কণ্ঠস্বরই সেদিন অতিরিক্ত সুরেলা হয়ে গিয়েছিল।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন